সাতাশি বছর বয়সে আফ্রিকার বিশিষ্ট লেখক এবং নয়া-উপনিবেশবিরোধী চিন্তাবিদ নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো ২৮ মে পরলোকগমন করেছেন। পরিণত বয়সের এই মৃত্যুতে আক্ষেপের কিছু নেই। বরং সন্তুষ্টির কারণ রয়েছে যে একজন মানুষ হিসেবে তিনি পরিপূর্ণ একটি জীবন যাপন করে গেছেন। তিনি মূলত একজন লেখক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হলেও কিন্তু নানা কর্মকাণ্ডে জীবনকে পরিপূর্ণ করে তুলেছিলেন। 
নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো প্রসঙ্গে প্রথম কথা সম্ভবত এই যে তাঁকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়নি। এ সূত্রে ২০১০ সালের ৭ অক্টোবর বৃহস্পতিবারের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। তাঁর বাসার সামনে কয়েক ডজন সাংবাদিক ক্যামেরা নিয়ে হাজির হয়েছেন। তারা জেনে গেছেন ওই বছর সাহিত্যের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা যাদের খুব বেশি, নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো তাদের মধ্য অগ্রগণ্য। সুইডেনের নোবেল একাডেমির‌ স্থায়ী সচিব পিটার এঙ্গলুন্ড বিকাল পৌনে ৫টায় সংবাদ সম্মেলনে সংক্ষিপ্তভাবে জানালেন যে মারিয়ো বার্গাস ইয়োসাকে নোবেল পুরস্কার প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।‌ খবরটি শুনে নগুগি ঘর থেকে দরজা খুলে বের হয়ে এসে সাংবাদিকদের সান্ত্বনা দিতে দিতে বললেন, দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই। নোবেল কমিটির মূল্যায়ন খারাপ না। বার্গাস ইয়োসা একজন ভালো লেখক; নোবেল পাওয়ার যোগ্য। অনেক অনেক বছর সাহিত্যের নোবেল পুরস্কার প্রদানের জন্য নগুগির নাম সুপারিশ করা হয়েছে। লং লিস্ট করা হয়েছে। শর্ট লিস্ট করা হয়েছে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে নোবেল কমিটি সব সময় তাঁর পরিবর্তে অন্য কাউকে বেছে নিয়েছে। ‌ লাতিন আমেরিকার সাহিত্য বিষয়ে উৎসাহ জাগ্রত হওয়ার আগেই আফ্রিকার সাহিত্য সম্পর্কে আমাদের উৎসাহ উস্কে দিয়েছিল চিনুয়া আচেবে ও নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গোর উপন্যাস। তাদের সাহিত্য আমাদের নয়া-ঔপনিবেশিকতার আবির্ভাব সম্পর্কে ধীরে ধীরে সচেতন করে তুলেছিল। 
আফ্রিকা থেকে অনেকে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন– যাদের মধ্যে রয়েছেন আলবেয়ার কাম্যু, নাডিন গর্ডিমার ও আবদুলরাজাক গুরনাহ। কেনিয়ার মানুষ নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গোর অনন্য হয়ে উঠেছিলেন তাঁর কথাসাহিত্য, প্রবন্ধ ও বক্তৃতার মধ্য দিয়ে। ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৬৩ সালে কেনিয়া স্বাধীনতা অর্জন করে। কিন্তু এই স্বাধীনতা প্রকৃতই স্বাধীনতা কিনা তা বারংবার তার কথাসাহিত্যের মধ্য দিয়ে পরীক্ষা করেছেন নগুগি। যাদের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল, তাদের সঙ্গে রাষ্ট্র বিশ্বাসঘাতকতা করে– এই চিত্রটি তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর কথাসাহিত্য এমন এক ঘরানার যাকে বলা হয় ‘ফিকশনাল হিস্ট্রি’। কোনো কোনো উপন্যাসে রাষ্ট্র ও সরকারের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আমরা মূর্তিমান দেখতে পাই। 
ঔপনিবেশিক শাসন থেকে আফ্রিকার মুক্তির যে বয়ান গড়ে তোলা হয়েছে তা নগুগির উপন্যাস প্রবন্ধ এবং বক্তৃতার মধ্য দিয়ে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ‌ কেনিয়ার ঔপনিবেশিক ইতিহাস থেকে শুরু করে স্বাধীনতা পরবর্তীকালের বিবিধ রূপ রাজনৈতিক দুর্নীতি ছিল তাঁর প্রিয় বিষয়।  এমনকি ভাষাগত স্বাধীনতার পক্ষেও আন্দোলনের সূত্রপাত করেছেন। নিজের জন্মগত নাম জেমস নগুগি বদলে করেছেন। নতুন নাম নিয়েছেন নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো। ইংরেজিতে লেখা বন্ধ করে মাতৃভাষায় (গিকুয়ু ভাষায়) লিখতে শুরু করেছেন। তাঁর জনপ্রিয় বইগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘দ্য উইজার্ড অব দ্য ক্রো’, ‘পেটালস অব ব্লাড’ ও ‘ডিকলোনাইজিং দ্য মাইন্ড’। এ বইগুলিতে তিনি মাতৃভাষায় লেখা ও ভাষার স্বাধীনতা ওপর সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। সরকারের কোপানলে পড়ে বহু বছর তাঁকে নির্বাসনে কাটাতে হয়েছে। ১৯৭০-এর দশকে এক বছর কারাবন্দি ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার হন।
তিনি ম্যান বুকার পুরস্কারের জন্য সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান পেয়েছিলেন এবং পার্ক কিয়ং-নি সাহিত্য পুরস্কার জিতেছিলেন। উল্লেখযোগ্য, তাঁর ‘দ্য আপরাইট রেভল্যুশন’ গল্পটি ১০০-এরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তাঁর উপন্যাসগুলো কেনিয়া তথা আফ্রিকার সীমাহীন সামাজিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের বিশ্বস্ত প্রতিরূপ। 
তাঁর শারীরিক ও রাজনৈতিক আক্রমণের শিকার হয়েছেন কিন্তু কখনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা থেকে পিছিয়ে আসেননি। তাঁর কথা– “প্রতিরোধই জীবিত থাকার সেরা উপায়।” তাঁর সাহিত্যিক অবদান আফ্রিকান ভাষার পুনরুত্থান, ন্যায়বিচার এবং রাজনৈতিক সাহস নিয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
তাঁর প্রথমদিকের উপন্যাস ‘উইপ নট, চাইল্ড’ ও ‘দ্য রিভার বিটুইন’ জেমস নগুগি নামে প্রকাশিত হয়েছিল। তবে ১৯৬৭-তে প্রকাশিত  ‘আ গ্রেন অব হুইট’-এ (একদানা গম) উপস্থাপিত ইতিহাস এবং কল্পকাহিনির মধ্যে সম্পর্ক নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করেছেন। একসময় রাজনৈতিক সক্রিয়তাকে জীবনের অভিলক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন।  সাহিত্য তাঁর জন্য কেবল সামাজিক বাস্তবতা প্রত্যাখ্যান করার মাধ্যম ছিল তা নয়, বরং তিনি সাহিত্যকে দেখেছেন ঐতিহাসিক সামাজিক শক্তি এবং চাপ দ্বারা নির্ধারিত একটি সৃজনশীল প্রক্রিয়া হিসেবে। যারা কেনিয়ার ইতিহাস রচনা করবেন তাদের জন্য নগুগির সাহিত্য একটি অন্যতম উপাদান। তাকে “রাজনৈতিক আন্দোলনের আলোচক, ভবিষ্যদ্বাণীকারী এবং দ্রষ্টা” হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। 
সাহিত্যের রাজনৈতিক ভূমিকা সম্পর্কে নগুগির মতো অকপট লেখক আর কাউকে দেখা যায় না। ১৯৭৫ সালে নগুগি একটি সাক্ষাৎকারে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, সাহিত্যকে অবশ্যই আমাদের সমাজের সমস্ত শক্তি এবং দুর্বলতাগুলো স্বাধীনভাবে এবং সঠিকভাবে প্রতিফলিত করতে সক্ষম হতে হবে। তিনি বলতেন:  এমন কোনো লেখক নেই যিনি অরাজনৈতিক। মূল কথা হলো: একজন লেখক তাঁর রচনায় কার রাজনীতিকে সমর্থন করেন? –তাঁর ব্যাপক সাহিত্যকর্মে স্বীয় সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি তাঁর অটল বিশ্বাস প্রতিফলিত হয়ে আছে। 
নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গোর প্রয়াণে পৃথিবী এমন একজন লেখককে হারাল যিনি নিরাপসভাবে রাষ্ট্র ও মানুষের মধ্যে অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব ও বৈরিতার ব্যাপারে আমাদের অক্লান্তভাবে সচেতন করে গেছেন। তাঁর প্রতি জ্ঞাপন করছি অতল শ্রদ্ধা। v

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: গল প ন ব ল প রস ক র প ঔপন ব শ ক র উপন য স স ব ধ নত র জন ত ক আম দ র কর ছ ন র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

আমার স্ত্রী খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করছেন না: জেডি ভ্যান্স

মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স তাঁর স্ত্রী উষা ভ্যান্স ক্যাথলিক গির্জার মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে কোনো একদিন খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করবেন বলে যে মন্তব্য করেছিলেন, তা নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। নিজের এ মন্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে বিশাল এক পোস্ট দিয়েছেন তিনি।

জেডি ভ্যান্স বলেন, তাঁর যে মন্তব্য নিয়ে কথা হচ্ছে, সেটি মূল বক্তব্য থেকে কেটে নেওয়া একটি অংশ। কোন প্রসঙ্গে তিনি ওই মন্তব্য করেছেন, সেটা দেখানো হয়নি।

গত বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের মিসিসিপি অঙ্গরাজ্যে তরুণদের সংগঠন ‘টার্নিং পয়েন্ট ইউএসএ’র একটি অনুষ্ঠানে এক তরুণীর প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে ভ্যান্স তাঁর স্ত্রী উষা একদিন খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন। ভারতীয় বংশোদ্ভূত উষা হিন্দু সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠেছেন।

স্ত্রী একদিন খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করবেন, এমন আশাবাদ ব্যক্ত করা ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, ভ্যান্সের এ মন্তব্য কি তাঁর স্ত্রীকে ধর্ম পরিবর্তনের জন্য চাপ দেওয়ার ইঙ্গিত।

স্ত্রী একদিন খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করবেন, এমন আশাবাদ ব্যক্ত করা ভিডিও ভাইরাল হওয়া পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, ভ্যান্সের এ মন্তব্য কি তাঁর স্ত্রীকে ধর্ম পরিবর্তনের জন্য চাপ দেওয়ার ইঙ্গিত।

জবাব দিতে এক্স পোস্টে ভ্যান্স বলেন, একটি পাবলিক ইভেন্টে তাঁকে তাঁর আন্তধর্মীয় বিয়ে নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। তিনি ওই প্রশ্ন এড়িয়ে যেত চাননি, উত্তর দিয়েছেন।

মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট লিখেছেন, ‘প্রথমেই বলি, প্রশ্নটি আসে আমার বাঁ পাশে থাকা একজনের কাছ থেকে, আমার আন্তধর্মীয় বিয়ে নিয়ে। আমি একজন পাবলিক ফিগার, লোকজন আমার ব্যাপারে জানতে আগ্রহী এবং আমি প্রশ্নটি এড়িয়ে যেতে চাচ্ছিলাম না।’

এ বছর জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিষেক অনুষ্ঠানে জেডি ভ্যান্স ও তাঁর স্ত্রী উষা ভ্যান্স

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ঢাবি থেকে ড. জাকির নায়েককে ডক্টরেট দেওয়ার দাবি শিক্ষার্থীদের
  • বগুড়ায় বাড়িতে হাতবোমা তৈরির সময় বিস্ফোরণ, আহত একজন গ্রেপ্তার
  • ‘সাংস্কৃতিক জাগরণেই মুক্তি’
  • যদি ঠিক পথে থাকো, সময় তোমার পক্ষে কাজ করবে: এফ আর খান
  • বিবাহবিচ্ছেদ ও খোরপোষ নিয়ে ক্ষুদ্ধ মাহি
  • ফতুল্লায় দুই ট্রাকের মাঝে পড়ে যুবকের মৃত্যু
  • ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুই পক্ষের সংঘর্ষে ২০ মামলার আসামি নিহত, গুলিবিদ্ধ ৩
  • নামতে গেলেই চালক বাস টান দিচ্ছিলেন, পরে লাফিয়ে নামেন
  • তানজানিয়ার বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফের বিজয়ী সামিয়া
  • আমার স্ত্রী খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করছেন না: জেডি ভ্যান্স