পরিণত বয়সে ফ্রেডরিখ নিৎশে, ১৮৮০-এর দশকের জার্মানিতে স্মরণ-সর্বস্ব ইতিহাস রচনাকে অসুস্থতা হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। সেই ভাবনাকে আড়ে-দিঘে টেনে আরেক ধাপ এগিয়ে রণজিৎ গুহ একে ‘নিষ্প্রাণ জ্ঞান’ বলেন৷ দুঃখজনক হলেও, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসচর্চা চিরকাল একরৈখিকভাবেই হয়েছে। সেখান থেকে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য বা চিন্তা পাওয়া দুঃসাধ্য।
রাষ্ট্রের সঙ্গে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে যাঁরা জড়িত, তাঁদের আত্মজীবনী, স্মৃতিকথা নিঃসন্দেহে মূল্যবান। কিন্তু এই ঘরানাটিও ‘আমিত্ব নামক অশ্লীলতার মহাসমুদ্রে’ অবগাহন করে নির্মিত। কাজেই এই বাড়াবাড়ি রকমের ‘আমি’ লেখককে প্রশান্তি দিলেও পাঠককে ত্যক্তবিরক্ত-ক্ষুব্ধ করতে পারে। তবে ডায়েরি অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য।
তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি পড়া আমাদের জন্য যেকোনো বিচারেই লাভজনক। রবীন্দ্রনাথ ‘সাহিত্যের সত্য’র দ্বিতীয় প্রবন্ধে ‘পাওয়া’, ‘হওয়া’, আর ‘হয়ে ওঠা’ সংক্রান্ত যে আলাপ করেছেন, তাজউদ্দীনের জীবনের সঙ্গে এর বিস্ময়কর সাদৃশ্য রয়েছে। যে বর্তমান সতত, অস্থির, তাকে ডায়েরির পাতায় বদ্ধ করে পাঠক-গবেষকদের বিচিত্র ভাবনা-চিন্তা-গবেষণার নিঃশঙ্ক খোরাক জুগিয়েছেন তিনি।
তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৪৬ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত প্রতিদিন ইংরেজিতে ডায়েরি লিখতেন। এই লেখাগুলো কবি বেলাল চৌধুরীর অনুবাদে প্রকাশিত হয়েছে ধারাবাহিকভাবে। এর আগে ১৯৪৯ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় নিয়ে প্রথম খণ্ড এবং ১৯৪৯ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৫০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় নিয়ে দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে। এবার প্রকাশিত হলো তৃতীয় খণ্ড, যেখানে ১৯৫১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত একটি পূর্ণ বছরের ডায়েরি অন্তর্ভুক্ত আছে। এই খণ্ডটিও আগের মতোই তাজউদ্দীনের রাজনৈতিক জীবন, চিন্তা ও ব্যক্তিগত উপলব্ধির গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে বিবেচিত। একটি ব্যক্তিগত অনুভূতির উল্লেখ তাজউদ্দীনের এই ডায়েরির নিরপেক্ষতার প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা যায়। ৮ মে উনি ‘বি.
তাজউদ্দীন আহমদ মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ম্যাট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় তাঁর সাফল্য ছিল ব্যতিক্রমী ও ঈর্ষণীয়। তবে রাজনীতিতে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ার কারণে তাঁর ছাত্রজীবনে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ব্যস্ততা তাঁর নিয়মিত ক্লাসে যাওয়া ও পড়াশোনায় প্রভাব ফেলে। লিয়াকত আলী খানের মৃত্যুর পর আয়োজিত স্মরণসভায় তিনি প্রধান উদ্যোক্তার ভূমিকা পালন করেন। তবু তিনি পড়াশোনা একেবারে ছেড়ে দেননি। রাজনীতির চাপের মধ্যেও তিনি অর্থনীতির পাশাপাশি সাহিত্য ও বিজ্ঞান পড়ায়ও আগ্রহ ধরে রেখেছিলেন। কখনো শরৎচন্দ্রের চরিত্রহীন, কখনো যৌনবিজ্ঞান বিষয়ে বই পড়ে সময় কাটান। তা ছাড়া নিয়মিত পত্রপত্রিকা পড়তেন। পড়ার নেশা তাঁকে নিয়মিত নিয়ে যেত ঢাকার বিভিন্ন লাইব্রেরিতে। ৬ মার্চ ডায়েরিতে লেখেন, ‘আমার জন্য বই খুঁজতে সদরঘাট গেলাম। কিন্তু বই পেলাম না।’ এই সূত্রে পরিষ্কার, তাজউদ্দীনের জ্ঞানপিপাসা কখনো ম্লান হয়নি; রাজনীতি তাঁকে যতই ব্যস্ত করুক না কেন, বইয়ের প্রতি তাঁর ভালোবাসা অটুট ছিল।
তাজউদ্দীন আহমদের ১৯৫১ সালের ডায়েরি তাঁর জীবনের এক জটিল সময়ের প্রতিচ্ছবি। তিনি তখন মামলা-মোকদ্দমার জটিলতায় জড়িয়ে পড়েছেন, আবাসিক হলে থেকেও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করতে পারেননি। জীবনের নানা চাপের মাঝেও তিনি নিয়মিত নজর রাখছেন পাঠ্য বিষয়, ধান ও লবণের বাজারদর, এমনকি আবহাওয়ার গতিবিধির ওপরও। তাঁর ডায়েরি মূলত ব্যক্তিগত, কিন্তু তাতে সময়ের রাজনৈতিক, সামাজিক ও আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহেরও প্রতিফলন ঘটে। আন্তর্জাতিক ঘটনাগুলো অনেক সময় পাদটীকায় স্থান পেলেও, তাৎপর্যপূর্ণভাবে উপস্থিত। সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হলো সমাজের নানা স্তরের মানুষের সঙ্গে তাঁর মেলামেশা এবং সেই সব মানুষের চরিত্র বিশ্লেষণ, যা তিনি দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন। মাত্র ২৫ বছর বয়সী যুবকের এই পর্যবেক্ষণশক্তি, বিচারবুদ্ধি ও লেখনী পাঠককে মুগ্ধ করবে। ডায়েরির মাধ্যমে বোঝা যায়, কীভাবে তাজউদ্দীন ধীরে ধীরে একজন পরিণত রাষ্ট্রনায়কে রূপ নিচ্ছেন। নেতৃত্ব শুধু পদে বসালেই হয় না, যোগ্যতা থাকতে হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যদি তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী না হতেন, তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাস ভিন্ন রকম হতে পারত। দৃঢ়তা, প্রজ্ঞা আর ত্যাগের যে বিরল উদাহরণ তিনি স্থাপন করেছেন, তা তাঁকে অনন্য করে তুলেছে।
তাজউদ্দীন আহমদ একসময় বদরুদ্দীন উমরকে বলেছিলেন, তাঁর ডায়েরিগুলোর বিশেষ গুরুত্ব নেই। তবে উমর এই মূল্যায়নের সঙ্গে একমত নন। তাঁর মতে, তাজউদ্দীনের ডায়েরি ছাড়া সে সময়কার রাজনৈতিক আন্দোলনের সঠিক ইতিহাস রচনা করা কঠিন হতো। ডায়েরিতে তাজউদ্দীন যেসব ব্যক্তি, স্থান ও ঘটনার উল্লেখ করেছেন, সেগুলো প্রথম দেখায় তেমন গুরুত্বপূর্ণ না লাগলেও প্রকৃতপক্ষে সেগুলো ওই সময়ের রাজনৈতিক পরিবেশ, দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও সংগঠনের অন্তর্গত চিত্র তুলে ধরতে অমূল্য দলিল। বর্তমান গ্রন্থটি ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত মূল্যবান উৎস হিসেবে বিবেচিত হবে নিঃসন্দেহে।
তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি: ১৯৫১
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন
প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল
মূল্য: ৫৫০ টাকা; পৃষ্ঠা: ২৫৬
প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ২০২৪
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ত জউদ দ ন আহমদ ত জউদ দ ন র র র জন ত ক প রক শ ত
এছাড়াও পড়ুন:
বাবা-মেয়ের কাছ থেকে টাকা ছিনতাই, গ্রেপ্তার ২
মৌলভীবাজারের বড়লেখায় বাবা ও মেয়ের কাছ থেকে নগদ টাকা ও মোবাইল ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় দুইজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। শুক্রবার (১ আগস্ট) রাতে সিলেটের শাহপরাণ থানা এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
শনিবার (২ আগস্ট) দুপুরে মৌলভীবাজার পুলিশ সুপার কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নোবেল চাকমা এ তথ্য জানান।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- কুলাউড়ার সেলিম আহমদ ওরফে অনিক (৩৭) ও সিলেটের শাহপরাণ এলাকার সাকিব আহমদ (২৫)।
আরো পড়ুন:
জুলাই হত্যাকাণ্ডের মামলায় চট্টগ্রামে প্রথম অভিযোগপত্র দাখিল
হত্যাচেষ্টা মামলায় রসিকের সাবেক কাউন্সিলর গ্রেপ্তার
পুলিশ জানায়, বড়লেখার শিমুলিয়া এলাকার আব্দুল আহাদ গত ৩০ জুলাই দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে পূবালী ব্যাংকের বড়লেখা শাখা থেকে দুই লাখ টাকা উত্তোলন করেন। তার মেয়ে সুহাদা আক্তারের ব্যাগে নগদ ১৬ হাজার টাকা ছিল। টাকা নিয়ে মোটরসাইকেলযোগে বাড়ি ফেরার পথে শিমুলিয়া এলাকায় চারজন সন্ত্রাসী দুইটি মোটরসাইকেলে এসে তাদের পথরোধ করে।
তারা ধারালো অস্ত্র দেখিয়ে আব্দুল আহাদের মেয়ের ভ্যানেটি ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। ছিনতাইকৃত ব্যাগে নগদ ২ লাখ ১৬ হাজার টাকা, একটি মোবাইল ফোন, দুই ভরি রুপার চেইন এবং জাতীয় পরিচয়পত্র ছিল। এ ঘটনায় বড়লেখা থানায় বাদী আব্দুল আহাদ অভিযোগ দেন। এরপর মামলা রুজু হয় (মামলা নম্বর-১৭, ধারা ৩৪১/৩৯২ দণ্ডবিধি)।
তথ্যপ্রযুক্তি ও গোয়েন্দা নজরদারির সহায়তায় সন্ত্রাসীদের শনাক্ত করা হয়। ১ আগস্ট রাতে সিলেট শহরের শাহপরাণ থানাধীন কাজিরবাজার এলাকা থেকে দুইজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে ৯৯ হাজার ৫০০ টাকা, ভিকটিমের মোবাইল, ধারালো একটি দা, একটি মোটরসাইকেল ও কালো হেলমেট, টি-শার্ট ও গেঞ্জি জব্দ করা হয়।
মৌলভীবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) নোবেল চাকমা বলেন, “গ্রেপ্তারকৃতরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। মামলার বাদীও তাদের শনাক্ত করেছেন। তারা জবানবন্দিতে পলাতক আরো কয়েকজন সহযোগীর নাম প্রকাশ করেছে। তাদের ধরতে অভিযান চলছে।”
ঢাকা/আজিজ/মাসুদ