মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি নাগরিকদের জঙ্গিবাদী তৎপরতায় যুক্ত হওয়ার অভিযোগটি গুরুতর বলেই অন্তর্বর্তী সরকারের দুই উপদেষ্টা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন মালয়েশিয়ায় উগ্রবাদী মতাদর্শ ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগে আটক বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন। এরপর আইন ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ নজরুল শুক্রবার রাতে জানিয়েছেন, তিনজন ইতিমধ্যে দেশে ফিরেছেন এবং তঁাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশিদের জঙ্গিবাদে জড়ানোর ঘটনাকে বিব্রতকর বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
শুক্রবার কুয়ালালামপুরে সংবাদ সম্মেলনে মালয়েশিয়ার পুলিশপ্রধান খালিদ ইসমাইল জঙ্গি-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ৩৬ জন বাংলাদেশি নাগরিককে আটক করার কথা জানান। তাঁর বরাতে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে শ্রমিকদের মধ্যে ইসলামিক স্টেট (আইএস) জঙ্গিগোষ্ঠীর মতাদর্শ প্রচার এবং তহবিল সংগ্রহ করে, বাংলাদেশি শ্রমিকদের এমন একটি চক্র ভেঙে দিয়েছে মালয়েশীয় কর্তৃপক্ষ। চক্রটি অন্যান্য বাংলাদেশি শ্রমিককে নিশানা করে সদস্য সংগ্রহ করত এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অনলাইন মেসেজিং প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে উগ্র ও চরমপন্থী মতাদর্শ ছড়িয়ে দিত বলেও তিনি অভিযোগ করেছেন।
মালয়েশীয় পুলিশপ্রধানের বক্তব্য সন্দেহমুক্ত নয়। সেখানে অবস্থিত বাংলাদেশি শ্রমিকদের কেউ কেউ তাঁদের ভাষ্য অনুযায়ী জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত থাকতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশে আইএসের সাংগঠনিক ভিত্তি থাকার দাবি সঠিক নয়। তারপরও বাংলাদেশ মালয়েশিয়ার অভিযোগকে উড়িয়ে না দিয়ে দেশে ফেরত আসা ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদের উদ্যোগ নিয়েছে। এর সঙ্গে দেশের ভেতরে কেউ থাকলে সেটাও বেরিয়ে আসবে। এর সঙ্গে কেবল বাংলাদেশের ভাবমূর্তির বিষয় জড়িত নয়, লাখ লাখ শ্রমিকের জীবিকার প্রশ্নও আছে। গেল শতকের শেষ দশক ও চলতি শতকের প্রথম দশকে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের অনেক দেশে জঙ্গিবাদী তৎপরতা বেড়ে যায়, যার প্রভাব পড়ে বাংলাদেশেও।
জঙ্গিবাদ বিশ্বব্যাপী প্রবণতা। এ থেকে খুব কম দেশই মুক্ত থাকতে পেরেছে। এখানে দুই ধরনের অতিশয়োক্তি আছে। এক পক্ষ মনে করে বাংলাদেশে ব্যাপক মাত্রায় জঙ্গিবাদী তৎপরতা ছিল। আরেক পক্ষের দাবি, জঙ্গিবাদ বলে বাংলাদেশে কিছু নেই। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার সহজ পথ ছিল যেকোনো তৎপরতা ও ব্যক্তিকে ‘জঙ্গি’ তকমা লাগিয়ে দেওয়া। জঙ্গি ইস্যু কাজে লাগিয়ে তারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর দমন–পীড়ন চালিয়েছে। আবার অন্যদিকে ঢাকার পুলিশ কমিশনার শেখ মো.
মালয়েশিয়ায় ৩৬ বাংলাদেশির বিরুদ্ধে জঙ্গি তৎপরতার যে অভিযোগ উঠেছে, তাকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। মালয়েশিয়ার অভিযোগ কতটা সত্য, তা যথাযথ তদন্ত করে বের করতে হবে। দেশের কোনো পক্ষ এর সঙ্গে যুক্ত আছে কি না, তা খুঁজে বের করতে হবে। মনে রাখতে হবে, মালয়েশিয়া বাংলাদেশের অন্যতম শ্রমবাজার। সেখানে শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে এই ঘটনা নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। ফলে বাংলাদেশকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে এর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও উদ্যোগ নিতে হবে। আবার নিরীহ কেউ যাতে হয়রানির শিকার না হন, সে বিষয়েও সরকারকে সর্বোচ্চ সজাগ থাকতে হবে।
দুই উপদেষ্টার সঙ্গে আমরাও আশাবাদী হতে চাই যে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের জঙ্গি তৎপরতার অভিযোগ নিয়ে যে সমস্যা তৈরি হয়েছে, দেশটির সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তার নিরসন হবে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: উপদ ষ ট
এছাড়াও পড়ুন:
‘আইএস তহবিলে অর্থ পাঠাত’ গ্রেপ্তার বাংলাদেশিরা: মালয়েশিয়ার আইজিপি
জঙ্গিবাদে জড়িত থাকার অভিযোগে মালয়েশিয়ায় গ্রেপ্তার বাংলাদেশিরা সিরিয়া ও বাংলাদেশে ‘ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সেলগুলোকে অর্থ পাঠাত’ বলে জানিয়েছেন দেশটির পুলিশ প্রধান (আইজিপি) মোহাম্মদ খালিদ ইসমাইল।
আজ শুক্রবার সদর দপ্তর বুকিত আমানে এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের মহাপরিদর্শক বলেন, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে পরিচালিত ধারাবাহিক অভিযানে ওই ৩৬ বাংলাদেশিকে আটক করা হয়। তারা মূলত কারখানা, নির্মাণ ও সেবা খাতে কর্মরত ছিলেন।
রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মুসলিম অধ্যুষিত মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে ২০১৬ সালে আইএসের এক হামলার পর থেকে শত শত সন্দেহভাজন জঙ্গিকে আটক করেছে দেশটির পুলিশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আঞ্চলিক অভিযান জোরদার হওয়ার পর এ ধরনের গ্রেপ্তারের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এসেছে।
শিল্প, খামার ও নির্মাণ খাতে শ্রমিক ঘাটতি পূরণে মালয়েশিয়া ব্যাপকভাবে বিদেশি শ্রমিকের ওপর নির্ভরশীল। প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি শ্রমিক দেশটিতে পাড়ি জমান।
গোয়েন্দা তথ্যের বরাতে পুলিশ প্রধান খালিদ ইসমাইল বলেছেন, বাংলাদেশিদের ওই চক্রটি অন্য বাংলাদেশি শ্রমিকদের মধ্যে থেকে সদস্য বাড়াচ্ছিলেন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মেসেজিং অ্যাপের মাধ্যমে ‘উগ্রবাদী মতাদর্শ’ ছড়াচ্ছিল।
তিনি আরও বলেন, এই চক্র আন্তর্জাতিক মানি ট্রান্সফার সার্ভিস ও ই-ওয়ালেট ব্যবহার করে সিরিয়া ও বাংলাদেশে ‘আইএসের জন্য’ অর্থ পাঠাত। মালয়েশিয়া পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের কাউন্টার টেরোরিজম ডিভিশন অর্থ সংগ্রহের প্রমাণ পেয়েছে। তিনি বলেন, ‘তারা ঠিক কত অর্থ সংগ্রহ করেছে, তা এখনও তদন্তাধীন। আমাদের ধারণা, সদস্য ফি এবং চাঁদা থেকেই এই অর্থ এসেছে।’
পুলিশের বরাত দিয়ে মালয়েশিয়ার সংবাদমাধ্যম স্টার লিখেছে, ‘গেরাকান মিলিটান র্যাডিকাল বাংলাদেশ’ বা ‘জিএমআরবি’ নামে পরিচিত এই চক্র হোয়াটসঅ্যাপ ও টেলিগ্রামের মতো অ্যাপে সদস্য সংগ্রহ এবং উগ্র মতবাদের প্রচার করে আসছিল।
খালিদ ইসমাইল বলেন, আমাদের ধারণা, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে তাদের সদস্য সংখ্যা ১০০ থেকে ১৫০ জনের মত। প্রাথমিক তদন্তে দেখা গেছে, প্রত্যেক সদস্যকে বছরে ৫০০ রিংগিত ফি দিতে হয়। তবে অনুদানের পরিমাণ নির্ভর করছে সদস্যদের ওপর।
আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক আইএস সেলগুলোর সঙ্গে এই চক্রের কোনো সংযোগ আছে কি না—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এখনও তদন্ত চলছে।
মালয়েশিয়ার পুলিশ প্রধান বলেন, আমরা অন্যান্য দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং ইন্টারপোলের সঙ্গে সমন্বয় করে এই জঙ্গি নেটওয়ার্ক উন্মোচনে কাজ করছি।
আটকদের মধ্যে পাঁচ জনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে জাড়িত থাকার অভিযোগে মামলা করা হয়েছে। ১৫ জনকে দেশে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। আর ১৬ জন এখনো পুলিশের হেফাজতে রয়েছেন এবং তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে বলে জানিয়েছেন আইজিপি খালিদ ইসমাইল।
তিনি বলেন, তবে যাদের সংশ্লিষ্টতা কম, তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে। আর যাদের সম্পৃক্ততা বেশি, তাদের বিরুদ্ধে মালয়েশিয়ার প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাইফুদ্দিন নাসিউশন ইসমাইলের বরাত দিয়ে ৩৬ বাংলাদেশিকে জঙ্গি সন্দেহে আটকের খবর প্রথম সংবাদমাধ্যমে এসেছিল গত ২৭ জুন।
তিনি বলেছিলেন, আটক বাংলাদেশিদের ওই দলটি আইএসের মতাদর্শ মালয়েশিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল এবং নিজেদের ভেতরে সদস্য নিয়োগের সেল গঠন করেছিল। এই সেলগুলো উগ্র মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য অর্থ সংগ্রহ এবং নিজের দেশের বৈধ সরকারকে উৎখাতের পরিকল্পনায় কাজ করছিল।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বৃহস্পতিবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘তাদের সন্ত্রাসবাদী সন্দেহে আটক করেছে, আমরা বিস্তারিত জানতে চেয়েছি তাদের কাছে। আশা করছি, দুই-চারদিনের মধ্যে জানতে পারব যে বাস্তবে তাদের বিষয়টা কী।
আটকদের বিষয়ে বাংলাদেশের করণীয় কী, এমন প্রশ্নে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আমাদের করণীয় হচ্ছে যে দেখা, এ ধরনের বিশেষ অপকর্মের সঙ্গে জড়িত কি-না; যদি জড়িত হয়, তাদের ব্যাপারে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা; এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে, সেটার চেষ্টা করা।