পোশাকশিল্পে এখনই রূপান্তরের সময়
Published: 2nd, August 2025 GMT
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। এই সিদ্ধান্ত সরবরাহ ব্যবস্থায় নতুন ভারসাম্য তৈরি করেছে। কারণ, এখন বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম (২০ শতাংশ) ও ভারত (২৫ শতাংশ)—তিন দেশই প্রায় সমান বা কাছাকাছি শুল্ক দেবে।
এই সিদ্ধান্ত স্বল্পমেয়াদে চাপ তৈরি করলেও দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ তৈরি করতে পারে। সে জন্য বাংলাদেশকে মানসম্পন্ন, টেকসই ও দ্রুত সরবরাহ করতে সক্ষম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। এই সুযোগ সীমিত সময়ের জন্য। এখনই আমাদের পোশাকশিল্পকে উৎপাদন, পণ্য বৈচিত্র্য, দ্রুত সরবরাহের পথে এগোতে হবে। তাহলে এই সুযোগ আমরা নিতে পারব।
এই সুযোগ নিতে হলে বাংলাদেশকে বেশ কিছু বিষয়ে জোর দিতে হবে।
এক.
দুই. চীন ও ভিয়েতনামের মতো পোশাকপণ্যে বৈচিত্র্য বাড়াতে হবে। আমাদের প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রে শুধু দ্রুত সরবরাহ করছে না, তাদের পোশাকের বৈচিত্র্য অনেক বেশি। একই অবস্থা চীনেরও। অন্যদিকে বাংলাদেশ এখনো সুতার কাপড়ের ওপর নির্ভরশীল। পোশাকের বৈচিত্র্য বাড়াতে হলে উৎপাদন খাতে লেজার কাটিং, সিমলেস বন্ডিংয়ের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতিতে বিনিয়োগ করতে হবে। এখনই বড় বিনিয়োগ সম্ভব না হলে ছোট দল গড়ে তুলতে হবে, যারা বিদ্যমান যন্ত্র দিয়েই সিনথেটিক বা কৃত্রিম পোশাক তৈরি করতে পারবে। শুধু বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের দিকে না ঝুঁকে, মধ্যম সারির ব্র্যান্ডগুলোর কাছে বৈচিত্র্যময় পোশাক নিয়ে যেতে হবে।
তিন. সিনথেটিক কাপড়ের দেশীয় উৎসে জোর দেওয়া দরকার। আমাদের প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম অনেক সময় সহজে ক্রয়াদেশ পায়। তারা নিজেরা যেমন কৃত্রিম কাপড়ের পোশাকের উৎস গড়ে তুলেছে, তেমনি ভৌগোলিক নৈকট্যের কারণে চীন থেকে কম সময়ে ও খরচে এই কাপড় আমদানি করতে পারে।
বাংলাদেশ এখনো কৃত্রিম কাপড়ের জন্য চীন, কোরিয়া ও তাইওয়ানের ওপর নির্ভরশীল। এসব দেশ থেকে কাপড় আমদানিতে ১৫ থেকে ২৫ দিন সময় লাগে। এতে সময় ও খরচ বাড়ে। সে জন্য দেশীয় বস্ত্রকলগুলো যেন কৃত্রিম তন্তু দিয়ে কাপড় তৈরি ও রং করার জন্য বিনিয়োগে উৎসাহিত হয়, তা নিশ্চিত করা দরকার। যাদের সক্ষমতা কম, তারা তুলার সুতা দিয়ে তৈরি পণ্যে সামান্য কৃত্রিম উপাদান যুক্ত করে নতুন নকশার পোশাক তৈরি করতে পারে।
চার. শুধু কমপ্লায়েন্স নয়, স্বচ্ছতাও নিশ্চিত করতে হবে। এখন শুধু কর্মসহায়ক পরিবেশ, অর্থাৎ কমপ্লায়েন্সের শর্ত পূরণ করলেই হচ্ছে না। বৈশ্বিক, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা এখন পরিবেশবান্ধব উৎপাদন, বিদ্যুৎ-পানির সাশ্রয়, রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা ও শ্রমিকদের অবস্থা, অর্থাৎ টেকসই উৎপাদনব্যবস্থা দেখতে চায়। ক্রেতাদের নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষও এসব বিষয়ে সোচ্চার।
এ ক্ষেত্রে করণীয় হলো, প্রতি কেজি কাপড় তৈরিতে কত লিটার পানি লাগে, প্রতি পিস পোশাকে কত ইউনিট বিদ্যুৎ লাগে, কতজন শ্রমিক দীর্ঘমেয়াদে কাজ ধরে রাখে—এসব তথ্য নিয়মিত সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা দরকার। এসব তথ্য সহজ ও আকর্ষণীয় প্রতিবেদনের মতো করে সাজিয়ে রাখা দরকার, যেন সহজেই বিদেশি ক্রেতাদের দেখানো যায়। অনেক ক্রেতা হয়তো নিজে থেকে এসব জানতে চান না, কিন্তু দেখলে তাঁরা এর প্রশংসা করবেন এবং আস্থাও পাবেন। পোশাকশিল্পে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে হলে এসব বিষয় এখন অপরিহার্য।
পাঁচ. অর্থায়নের সুযোগ কাজে লাগানো দরকার। অনেক কারখানা বড় পরিসরে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। অর্থায়ন, কাঁচামালের দাম ও ক্রয়াদেশের অনিশ্চয়তা তাদের আটকে রাখছে। অথচ এখনই সঠিক জায়গায় বিনিয়োগের সময়। বাংলাদেশ ব্যাংকের রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের মতো অর্থায়নের স্কিমগুলো সম্পর্কে জানা দরকার। নতুন ক্রেতাদের কাছ থেকে কিছু অগ্রিম নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। আবার অন্য কারখানার সঙ্গে ক্রয়াদেশ ভাগাভাগি করে নেওয়া যায়। এতে একবারে বড় ক্রয়াদেশ নেওয়া সম্ভব হয়। সঠিক বিনিয়োগ করলে নতুন বাজার ধরা সম্ভব।
সময় এখন এগিয়ে যাওয়ারডোনাল্ড ট্রাম্পের পাল্টা ২০ শতাংশ শুল্ক প্রথমে বাড়তি চাপ মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এটি সম্ভাবনার নতুন দরজাও খুলে দিয়েছে। দীর্ঘ সময় বাংলাদেশ যেভাবে সস্তা শ্রম আর শুল্ক সুবিধার ওপর নির্ভর করে এসেছিল, সেই যুগ শেষ।
এখন আমাদের লড়তে হবে গুণগতমান, বৈচিত্র্য, উদ্ভাবন, স্বচ্ছতা ও গতিশীলতার ওপর ভিত্তি করে। বৈশ্বিক ক্রেতারা এখনো বাংলাদেশকে পছন্দ করে। তাদের পছন্দের জায়গা ধরে রাখতে হলে আমাদেরও পরিবর্তিত হতে হবে। পিছিয়ে পড়ার সময় নেই। এখন এগিয়ে যাওয়ার সময়।
সাইয়েদ তানজিম মোজাহের: পরিচালক, ইন্ডিপেন্ডেন্ট অ্যাপারেলস
চট্টগ্রামভিত্তিক দ্বিতীয় প্রজন্মের তৈরি পোশাক উদ্যোক্তা
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: দ র ত সরবর হ জন য ব র জন য আম দ র দরক র র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
৭৭ মেট্রিক টন চাল তুলে নিয়েছেন ডিলার, উপকারভোগীরা জানেন ‘বরাদ্দ হয়নি’
মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলায় গত জুলাই মাসে ট্রেডিং করপোরেশন বাংলাদেশের (টিসিবি) উপকারভোগীদের জন্য ৭৭ দশমিক ৮ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ করা হয়েছিল। প্রক্রিয়া অনুযায়ী উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে এ চাল খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির (ওএমএস) একজন ডিলার (পরিবেশক) তুলেও নেন। তবে ওই মাসে টিসিবির অন্য পণ্য পেলেও চাল পাননি বলে অভিযোগ করেছেন উপকারভোগীরা।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, মহম্মদপুরের ৮ ইউনিয়নে টিসিবির উপকারভোগী কার্ডধারী আছেন ১৫ হাজার ৫৬৭ জন। এসব উপকারভোগী নিজেদের কার্ড দেখিয়ে প্রতি মাসে একবার ইউনিয়নের টিসিবির নিয়োগ করা ডিলারের কাছ থেকে বাজারের চেয়ে কম মূল্যে তেল, চিনি, ডাল ও চাল কিনতে পারেন। গত জুলাইয়ে ডিলারদের কাছ থেকে তেল, চিনি ও ডালের একটি প্যাকেজ কিনতে পেরেছেন তাঁরা। ওই মাসে চালের বরাদ্দ আসেনি বলে জানানো হয় কার্ডধারীদের।
মহম্মদপুর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে পাওয়া নথিতে দেখা গেছে, গত ৩০ জুলাই উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. মজনুর রহমান স্বাক্ষরিত দুইটি বিলি আদেশে (ডিও) উপজেলার হোসেনিয়া কান্তা ঋতু নামে একজন ওএমএস ডিলারের অনুকূলে ৭৭ দশমিক ৮৩৫ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। ওই দিনই মহম্মদপুর ও বিনোদপুর খাদ্যগুদাম থেকে এ চাল তুলেও নেওয়া হয়।
সেখানে ৩০ টাকা কেজিতে চাল পাওয়া যায়। বাজার থেকে ওই চাল কিনতে কেজিতে প্রায় ৫০ টাকা লাগে। জুলাই মাসে চাল না পাওয়ায় কিছুটা কষ্টই হইছে।শরিফা, টিসিবির কার্ডধারী, রাজাপুর ইউনিয়নটিসিবি ও উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন টিসিবি উপকারভোগীদের চাল ছাড়া অন্য পণ্য সরাসরি তাঁদের নিয়োগ করা ডিলারদের কাছে সরবরাহ করে। চালের বরাদ্দ দেওয়া হয় খাদ্য বিভাগ থেকে। এ অনুযায়ী উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে প্রথমে খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে নিয়োগ করা ওএমএস বা খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ডিলারদের অনুকূলে ২৬ টাকা কেজি দরে চাল বরাদ্দ দেয়। সেই চাল ওই ডিলারদের কাছ থেকে ২৮ টাকা কেজি দরে নেন টিসিবির ডিলাররা। এরপর তাঁরা ৩০ টাকা কেজি দরে ওই চাল উপকারভোগীদের কাছে বিক্রি করেন।
উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের পারুল নামে টিসিবির এক উপকারভোগী ১ সেপ্টেম্বর জানান, আগস্ট মাসে চাল, ডাল, তেল ও চিনির প্যাকেজ পেলেও জুলাই মাসে তাঁদের চাল ছাড়া অন্য তিন ধরনের পণ্যের প্যাকেজ দেওয়া হয়েছিল। জুলাই মাসে তাঁদের জানানো হয় চাল বরাদ্দ হয়নি।
বিষয়টি জানতে উপজেলার ৮ ইউনিয়নে টিসিবির নিয়োগ করা ৮ জন ডিলারের সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। তাঁদের মধ্যে মহম্মদপুর সদর, নহাটা, পলাশবাড়ীয়া, বালিদিয়া, রাজাপুর ও বাবুখালী ইউনিয়নের ডিলার জানিয়েছেন, জুলাই মাসে তাঁদেরকে চাল দেওয়া হয়নি। নহাটা ও রাজাপুর ইউনিয়নের ডিলার মিলন ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মিলন ঘোষ ৪ সেপ্টেম্বর বলেন, ‘জুলাই মাসে আমাদের বলা হইছিল চাল বরাদ্দ নেই। এ কারণে চাল ছাড়া অন্য পণ্যগুলো বিক্রি করেছি। তবে অ্যাপে দেখাইছিল চাল। কিন্তু আমরা পাইনি।’
হোসনিয়া কান্তা উপজেলার বিনোদপুর এলাকার ওএমএস ডিলার। গত ২৫ জুলাই লটারির মাধ্যমে তিনিসহ তিনজন উপজেলায় ওএমএস ডিলার হিসেবে নিয়োগ পানঅবশ্য বিনোদপুর ও দীঘা ইউনিয়নের দুই ডিলার দাবি করেছেন তাঁরা অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে চালও কার্ডধারীদের কাছে বিক্রি করেছেন। তবে দুই ইউনিয়নের অন্তত ১০ জন উপকারভোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তাঁরা কেউই চাল পাননি। এর মধ্যে বিনোদপুর বাজারের একজন ফল ব্যাবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘জুলাই মাসে ডিলার জানাইছিল চাল ফুরায় গেছে।’
হোসনিয়া কান্তা উপজেলার বিনোদপুর এলাকার ওএমএস ডিলার। গত ২৫ জুলাই লটারির মাধ্যমে তিনিসহ তিনজন উপজেলায় ওএমএস ডিলার হিসেবে নিয়োগ পান বলে খাদ্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে। এ বিষয়ে জানতে হোসেনিয়া কান্তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও পাওয়া যায়নি। উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে সরবরাহ করা তাঁর মুঠোফোনে সোমবার যোগাযোগ করা হলে একজন ধরে জানান, ওই নম্বর হোসেনিয়া কান্তা ঋতু নামে কেউ ব্যবহার করেন না।
জানতে চাইলে টিসিবির ঝিনাইদহ ক্যাম্প অফিসের উপপরিচালক আকরাম হোসেন সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘টিসিবির চাল খাদ্য বিভাগ থেকে সরবরাহ করা হয়। আর বিতরণ কার্যক্রম তদারকির জন্য প্রতিটি উপজেলায় নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি কমিটি রয়েছে। যেখানে প্রতি ইউনিয়নে একজন ট্যাগ অফিসার আছেন, যিনি এগুলো তদারকি করেন।’
জেলার কয়েকজন চাল ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২৬ টাকা কেজি দরে কেনা এসব চাল বাজারে প্রায় ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। উপকারভোগীদের কাছে তা ৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করার কথা। এ হিসাবে উপকারভোগীদের ফাঁকি দিয়ে এ চাল বাজারে বিক্রি করতে পারলে কেজিতে ২২ থেকে ২৪ টাকা লাভ হয়।
চাল না পাওয়ার বিষয়ে কেউ কোনো অভিযোগ করেননি বলে জানিয়েছেন মহম্মদপুরের ইউএনও শাহীনুর আক্তার। সোমবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘চাল দেওয়া হয়নি এখন পর্যন্ত এমন অভিযোগ কেউ দেয়নি। খাদ্য অফিস থেকে আমি যত দূর জানতে পেরেছি তাতে সবকিছু দেওয়া হয়ে গেছে। বরাদ্দ থাকলে তা আটকে রাখার সুযোগ নেই। তারপরও কোনো অভিযোগ থাকলে খতিয়ে দেখব।’
হঠাৎ এক মাসে চাল না পাওয়ায় বিপাকে পড়েন উপকারভোগীরা। রাজাপুর ইউনিয়নের শরিফা নামের টিসিবি কার্ডধারী এক নারী বলেন, ‘সেখানে ৩০ টাকা কেজিতে চাল পাওয়া যায়। বাজার থেকে ওই চাল কিনতে কেজিতে প্রায় ৫০ টাকা লাগে। জুলাই মাসে চাল না পাওয়ায় কিছুটা কষ্টই হইছে।’