২০০৮ সালের মালেগাঁও বিস্ফোরণ: আসামিরা খালাস পেলেও মামলার নথি গায়েবের রহস্য কাটেনি
Published: 3rd, August 2025 GMT
ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের মালেগাঁওয়ে ২০০৮ সালের বিস্ফোরণ মামলার প্রমাণ হিসেবে প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দি–সংবলিত ১৩টি নথি ২০১৬ সালে আদালত থেকে গায়েব হয়ে যায়। গত বৃহস্পতিবার মামলার রায় হওয়ার আগপর্যন্ত সেগুলোর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। রায়ে সাত আসামিকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে।
রায়ের দিন মুম্বাইয়ের বিশেষ আদালত বলেছেন, (অভিযোগের ব্যাপারে) আসামিদের বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল, কিন্তু আইনি প্রমাণের অভাবে তাঁদের দোষী সাব্যস্ত করা যায়নি।
গায়েব হয়ে যাওয়া নথিগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য ছিল। এগুলো ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারা অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে রেকর্ড করা হয়েছিল। মহারাষ্ট্রের সন্ত্রাস দমন স্কোয়াড (এটিএস) জানিয়েছিল, এসব জবানবন্দি–সংবলিত নথিতে আসামিদের ষড়যন্ত্রমূলক বৈঠকে উপস্থিত থাকার কথা উল্লেখ ছিল।
বিজেপির সাবেক সংসদ সদস্য প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর, লেফটেন্যান্ট কর্নেল প্রসাদ পুরোহিতসহ অন্যদের খালাস দেওয়ার সময় আদালত বলেন, ষড়যন্ত্রমূলক কোনো বৈঠক হওয়ার বিষয়টি প্রমাণ করা যায়নি। কারণ, অধিকাংশ সাক্ষী নিজেদের আগের বক্তব্য থেকে সরে এসেছিলেন। সাক্ষীদের কয়েকজন এটাও বলেছেন যে ভয় দেখিয়ে বা জোর করে এটিএস তাঁদের থেকে বক্তব্য আদায় করেছিল।
ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ) ২০১১ সালে এটিএসের কাছ থেকে তদন্তের দায়িত্ব নেওয়ার পর কিছু প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য নতুন করে রেকর্ড করে। এ কারণে গায়েব হয়ে যাওয়া জবানবন্দি–সংবলিত নথি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। কারণ, আগের নথিগুলো থাকলে দুই জবানবন্দির মধ্যে মিল-অমিল যাচাই করে দেখা যেত।
সরকার পক্ষ থেকে এ কারণে হারিয়ে যাওয়া নথিগুলোর ফটোকপি ব্যবহারের অনুমতি চাওয়া হয়েছিল। বিচারিক আদালত এতে অনুমতিও দিয়েছিলেন। কিন্তু অভিযুক্ত ব্যক্তিরা বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে মুম্বাই হাইকোর্টে আবেদন করেন। হাইকোর্ট সেই অনুমতি স্থগিত করেন। কারণ, ফটোকপিগুলো যে আসল নথিরই অনুলিপি, তা প্রমাণ করা যায়নি। আদালত তখন বলেছিলেন, এনআইএ চাইলে প্রমাণ সংগ্রহ করে ফটোকপিগুলো নথি হিসেবে ব্যবহার করার জন্য নতুন করে আবেদন করতে পারবে।
বৃহস্পতিবার মুম্বাইয়ের বিশেষ আদালতের বিচারক এ কে লাহোটি বলেন, সরকার পক্ষ নতুন কোনো আবেদন করেনি। তারা প্রত্যক্ষদর্শীদের জেরা করেই বিচারকাজ চালিয়ে গেছে। সাক্ষীদের শুধু এতটুকুই জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারা অনুযায়ী তাঁরা ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে কোনো জবানবন্দি দিয়েছিলেন কি না?
বিচারক আরও বলেন, প্রত্যক্ষদর্শীরা আগে জবানবন্দি দিয়ে থাকলেও তা গ্রহণযোগ্য হবে না। কারণ, তাঁদের জবানবন্দির কপি আদালতে উপস্থিত করা হয়নি। এ ছাড়া সেই জবানবন্দিগুলো যাচাইয়ের সুযোগ দেওয়া হয়নি।
সরকার পক্ষ বলছে, তারা অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জবানবন্দির কপি দিয়েছিল। কিন্তু তাঁরা তা না নিয়ে বলেছেন আগের আইনজীবীরা বদলে গেছেন, নতুনদের কাছে কপি নেই। এনআইএ বলছে, এভাবে কপি না নেওয়াটা আসলে অজুহাত এবং আদালতে এ আচরণ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা উচিত।
আদালত বলেছেন, যেসব ম্যাজিস্ট্রেট প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানবন্দি রেকর্ড করেছিলেন, সরকার পক্ষ তাঁদেরও আদালতে হাজির করেননি। এ অবস্থায় শুধু ফটোকপির ভিত্তি করে জবানবন্দিগুলো গ্রহণযোগ্য নয়।
গায়েব হয়ে যাওয়া জবানবন্দিগুলোর মধ্যে দুই প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা ম্যাজিস্ট্রেটদের বলেছিলেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক হামলা ও হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা নিয়ে বৈঠক করেছিলেন। তাঁরা আলাদা সংবিধান ও পতাকা নিয়েও কথা বলেছিলেন। জবানবন্দির নথি গায়েব হয়ে যাওয়ার পর তাঁরা আগের বক্তব্য থেকে সরে আসেন। তাঁরাসহ মোট ৩৯ প্রত্যক্ষদর্শী আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছেন।
‘সিমির জড়িত থাকার প্রমাণ মেলেনি’
২০০৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর মালেগাঁওয়ের ভিকু চক এলাকায় বিস্ফোরণে ৬ জন নিহত ও প্রায় ১০০ জন আহত হন। আসামিরা আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থন করে দাবি করেছিলেন, বিস্ফোরণের জায়গার কাছেই নিষিদ্ধ সংগঠন স্টুডেন্টস ইসলামিক মুভমেন্ট অব ইন্ডিয়ার (সিমি) একটি কার্যালয় ছিল। বিস্ফোরণের সঙ্গে সিমির সদস্যরা জড়িত ছিলেন।
বিশেষ আদালত বলেছেন, ‘…ঘটনায় সিমির কোনো কর্মী জড়িত ছিলেন বা ঘটনাস্থলে তাঁদের দেখা গেছে, এমন কোনো প্রমাণ মামলার নথিতে নেই।’ আদালত এ–ও বলেছেন, এটিএসের তদন্ত কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, ঘটনার সময় সিমির কার্যালয়টি চালু ছিল কি না, তা তিনি কখনোই খতিয়ে দেখেননি।
আদালত বলেন, একজন প্রত্যক্ষদর্শী বিস্ফোরণের স্থানে একটি মেয়েকে দেখেছেন বলে জানিয়েছিলেন। আদালত মন্তব্য করেন, তদন্ত কোন দিকে এগোবে, তা ঠিক করা তদন্ত কর্মকর্তার এখতিয়ার হলেও তদন্তের সময় যদি নির্দিষ্ট কোনো তথ্য তাঁর নজরে আসে, তবে সে দিকগুলোও বিবেচনায় এনে তদন্ত করা জরুরি।
উল্লেখ্য, বিজেপির সাবেক সংসদ সদস্য সাধ্বী প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর ছাড়াও সাত অভিযুক্তের মধ্যে ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল প্রসাদ পুরোহিত, অবসরপ্রাপ্ত মেজর রমেশ উপাধ্যায়, সুধাকর চতুর্বেদী, অজয় রহিরকর, সুধাকর দাস দ্বিবেদী ওরফে শঙ্করাচার্য ও সমীর কুলকার্নি।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গ য় ব হয় তদন ত ক বল ছ ন কর ছ ল
এছাড়াও পড়ুন:
সরকারির পাশাপাশি বেসরকারি প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরাও বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে: হাইকোর্ট
শুধু সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ দিতে পারবে বলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের নেওয়া সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। এক রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি রেজাউল করিমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ সোমবার এ রায় দেন।
একই সঙ্গে ২০০৮ সালের প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা নীতিমালার আলোকে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়ে পরীক্ষার আয়োজন করতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ২০২৫ সালের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বৃত্তি পরীক্ষা আগামী ২১ থেকে ২৪ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা।
আইনজীবীদের তথ্যমতে, শুধু সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে বলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর গত ১৭ জুলাই এক স্মারকে জানায়। এই সিদ্ধান্তের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে কেরানীগঞ্জ পাবলিক ল্যাবরেটরি স্কুলের পরিচালক মো. ফারুক হোসেন, শিক্ষক ও অভিভাবক প্রতিনিধিসহ ৪২ জন চলতি বছর রিটটি করেন। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত ২ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট রুল দিয়ে ওই স্মারকের কার্যক্রম অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য স্থগিত করেন। শুধু সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনুমতিসংক্রান্ত ১৭ জুলাইয়ের ওই স্মারক (ম্যামো) কেন আইনগত কর্তৃত্ব–বহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, রুলে তা জানতে চাওয়া হয়। সেই সঙ্গে ২০০৮ সালের প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা নীতিমালার আলোকে বৃত্তি পরীক্ষার আয়োজন করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা–ও জানতে চাওয়া হয়। চূড়ান্ত শুনানি শেষে আজ রুল অ্যাবসলিউট (যথাযথ) ঘোষণা করে রায় দেওয়া হয়।
আদালতে রিট আবেদনকারীদের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী নিয়াজ মোর্শেদ। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পক্ষে আইনজীবী মুনতাসির উদ্দিন আহমেদ শুনানিতে ছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সৈয়দ ইজাজ কবির।
পরে আইনজীবী নিয়াজ মোর্শেদ প্রথম আলোকে বলেন, শুধু সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ দিতে পারবে বলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের গত ১৭ জুলাইয়ে স্মারক অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। ২০০৮ সালের প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা নীতিমালা অনুসারে সব বেসরকারি অর্থাৎ বেসরকারি নিম্নমাধ্যমিক, রেজিস্ট্রার্ড কিন্ডারগার্টেন, কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং রেজিস্টার্ড/অস্থায়ী রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত/স্থাপনা ও প্রাথমিক অনুমতিপ্রাপ্ত চালু বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে। এ জন্য ১৫ দিনের মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। হাইকোর্টের রায়ের ফলে শুধু সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাই নয়, এসব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ২১ থেকে ২৪ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিতব্য প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে।
প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা ১৯৮১ সালে প্রবর্তন করা হয় বলে জানান প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের আইনজীবী মুনতাসির উদ্দিন আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ২০০৫ সালে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পায়। ২০০৮ সাল পর্যন্ত এটি চলে। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত নতুন নীতিমালার আলোকে পিএসসি পরীক্ষা হয়। এতে যারা ভালো করত, তাদের বৃত্তি দেওয়া হতো। তবে করোনার সময় ২০২০ ও ২০২১ সালে তা বন্ধ ছিল। ২০২২ সালে আবার বৃত্তি পরীক্ষা শুরু হয়, তবে তা প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার নীতিমালার (সংশোধিত–২০১৬) আলোকে। বিভিন্ন কারণে ২০২৩ ও ২০২৪ সালে এটি বন্ধ ছিল। পরিস্থিতি বিবেচনায় ২০২৫ সালে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল শুধু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নেবে। বেসরকারি শিক্ষার্থীরাও প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে—এমন নির্দেশনা দিয়ে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। তারা যাতে পরীক্ষা দিতে পারে সে জন্য ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করা হবে।