ঐকমত্য হয়েছে বেশ কিছু মৌলিক সংস্কারে
Published: 3rd, August 2025 GMT
ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর কয়েক মাস ধরে যে আলোচনা হয়েছে এবং তার ভিত্তিতে ঐকমত্যে পৌঁছানো গেছে, তা একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এর আগে এতগুলো রাজনৈতিক দলের একত্রে বসে মতবিনিময় বা যুক্তিতর্ক উত্থাপন করার নজির নেই। এবার দলগুলো ধৈর্য ধরে একটা ইতিবাচক পরিবেশে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ দেখিয়ে যে আলোচনা করেছে, তা বিরল।
প্রথম দিকে আলোচনায় কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে সফল আলোচনাই হয়েছে। এটা অনেকটা ‘মিনি পার্লামেন্টের’ মতো কাজ করেছে, যা একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমার মতে, এটি দেশের গণতান্ত্রিক উন্নয়নের পথও প্রশস্ত করবে।
আমাদের লক্ষ্য ছিল কতগুলো মৌলিক সংস্কারের দিকে নজর দেওয়া। এর মধ্যে অন্যতম ছিল কতগুলো সাংবিধানিক ও গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে নিয়োগপ্রক্রিয়া। এত দিন দলীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে নির্বাহী বিভাগ এসব নিয়োগ দিয়ে এসেছে। যার ফলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করেছে। যেটি আমাদের ভোটাধিকার হরণ করেছে এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
এবার আমাদের লক্ষ্য ছিল নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্ম কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, ন্যায়পাল ও দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ যাতে নিরপেক্ষ হয় এবং দুর্নীতি দমন কমিশনকে যাতে একটা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা যায়। এর মাধ্যমে নিরপেক্ষ, নির্দলীয় ব্যক্তিরা যাতে নিয়োগ পান, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়ায়।
আরেকটি বিষয় ছিল প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার লাগাম টানা। প্রয়াত অর্থনীতিবিদ ড.
আরেকটা মৌলিক সংস্কার হচ্ছে সংবিধান সংশোধন। কথায় কথায় যাতে সংবিধান কাটাছেঁড়া করতে না পারে, সেই ব্যবস্থার ওপর জোর দিয়েছি। আমরা সবাই জানি যে পঞ্চদশ সংশোধনী শেখ হাসিনাকে দানবে পরিণত হতে সহায়তা করেছে। মানুষের ভোটাধিকার হরণ হয়েছে। সংসদের উচ্চকক্ষ স্থাপনের মাধ্যমে নিম্নকক্ষে একতরফাভাবে জনমত উপেক্ষা করে, অন্যান্য দলের মতের প্রতি কোনো রূপ শ্রদ্ধা প্রদর্শন না করে আর সংবিধান সংশোধন করা যাবে না। সংসদের উচ্চকক্ষ পিআর (সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতিতে হবে। যার মাধ্যমে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে।
আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে রায় দিয়েছেন। পঞ্চদশ সংশোধনীকে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করেছেন। কিন্তু কীভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়োগ হবে, এটাও একটা মৌলিক সংস্কারের বিষয়। যাতে যোগ্য ব্যক্তিরা ওই পদে অধিষ্ঠিত হয়ে আবারও আগের মতো ভোটের অধিকার ধ্বংস করতে না পারে। সে ব্যাপারে আমরা ঐকমত্যে পৌঁছেছি।
জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ, উপজেলা পর্যায়ে স্থানীয় নিম্ন আদালতের সম্প্রসারণ, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ, অর্থ বিল আর অনাস্থা প্রস্তাবে গোপন ভোট দেওয়াসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক সংস্কার হয়েছে।
তবে কিছু ক্ষেত্রে কিছুটা অপূর্ণতা রয়ে গেছে। যেমন নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ব্যাপারে যতটুকু অর্জন করতে চেয়েছিলাম, ততটুকু পারিনি। তবু আমরা মনে করি, একটা গুরুত্বপূর্ণ যাত্রা শুরু হলো।
প্রবাদ আছে, ‘পুডিং কতটা সুস্বাদু বা ভালো হয়েছে, তা জানতে হলে খেয়ে দেখতে হবে।’ সংস্কারের সার্থকতা নির্ভর করবে বাস্তবায়নের ওপর। আমার বিশ্বাস, রাজনৈতিক দলগুলো প্রজ্ঞা এবং সাহসিকতার পরিচয় দেবে। ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের রক্তের সঙ্গে আমরা যেন বিশ্বাসঘাতকতা না করি।
বদিউল আলম মজুমদার, সদস্য, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত ক ঐকমত য আম দ র ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
এই অগ্রগতি ধরে রাখতে হবে
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় দফা আলোচনা শেষে মৌলিক সংস্কারের ১৯টি বিষয়ে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত এসেছে। এর মধ্যে ৭টি বিষয়ে সব দল একমত হয়েছে আর ১২টি বিষয়ে বিভিন্ন দলের ভিন্নমত ও মন্তব্যসহ সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি বড় অগ্রগতি, যা আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে দীর্ঘ হতাশার মাঝে কিছুটা হলেও আশাবাদের জায়গা তৈরি করে।
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান যে বৃহৎ জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে, তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হলো বাংলাদেশের নাগরিকেরা আর পুরোনো ব্যবস্থায় ফিরতে চান না। অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা যাতে কোনোভাবে ফিরতে না পারে, তার জন্য রাষ্ট্র, সরকার ও শাসনকাঠামোয় মৌলিক সংস্কার প্রত্যাশা করেছেন তাঁরা।
জন-আকাঙ্ক্ষার কথা বিবেচনায় নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার প্রথম পর্যায়ে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, প্রশাসন ও পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন করে। এরপর আরও পাঁচটি কমিশন গঠন করা হয়। এসব কমিশন তাদের প্রতিবেদন দেওয়ার পর প্রধান ছয়টি কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। প্রথম দফায় ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত ৩২টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে ৪৪টি এবং ২ জুন থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত ৩০টি দলের সঙ্গে ২৩টি বৈঠক করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। অতীতে এত সময় ধরে এতগুলো রাজনৈতিক দল মিলে এমন রাজনৈতিক ঐক্যপ্রচেষ্টা আর কখনোই হয়নি।
প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দুই দফা আলোচনার পর যেসব বিষয়ে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা নিয়ে ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ চূড়ান্ত করার কাজ চলছে। তবে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি ও এর আইনি ভিত্তি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে। আমরা মনে করি, এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য থাকাটা স্বাভাবিক। আর সেই মতপার্থক্য নিরসনের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য পথ হলো আলাপ-আলোচনা ও সংলাপ। ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনার ধারাবাহিকতায় রাজনৈতিক দলগুলো খুব শিগগির এ ব্যাপারে একটা যৌক্তিক সমাধানে পৌঁছাতে পারবে বলে আমরা আশা করি।
গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হাসিনা সরকারের আমলে পরপর তিনটি জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়নি। ফলে দেশের সিংহভাগ নাগরিকই দীর্ঘদিন ধরে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত আছেন। এ অবস্থায় দেশের নাগরিক ও রাজনৈতিক দলগুলোর সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা হলো একটি গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন, যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ আবার গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করবে। ইতিমধ্যে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমা ঘোষণা করেছেন। আমরা মনে করি, তাঁর ঘোষিত সময়সীমা, অর্থাৎ আগামী ফেব্রুয়ারি-এপ্রিলের মধ্যেই দেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে।
একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকারের। নির্বাচন কমিশন সে ব্যাপারে তাদের প্রস্তুতিও নিচ্ছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোরও ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে অগ্রগতি দেখাতে পেরেছে, তা ধরে রাখার দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর। এ ক্ষেত্রে দলগুলো তাদের প্রতিশ্রুতি কতটা বাস্তবায়ন করছে, তার ওপর দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের অনেকটাই নির্ভর করে। এই প্রচেষ্টা একটা অগ্রগতির জায়গায় নিয়ে আসার জন্য ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজসহ কমিশনের অন্য সদস্যরা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। তাঁদের সবাইকে আমরা সাধুবাদ জানাই।
এটা ঠিক যে একটি ভালো নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে বড় একটা বাধা দেশের বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। ৫ আগস্টের পর পুলিশের মনোবল ও শৃঙ্খলা অনেকটাই ভেঙে পড়েছিল। সেখান থেকে অনেকটা উত্তরণ হলেও এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারেনি পুলিশ। এ ক্ষেত্রে নির্বাচনের পরিবেশ সুষ্ঠু রাখতে ও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরাতে সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য বাহিনীরও অধিক সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।