বিশ্বব্যাপী বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ঐতিহাসিকভাবে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। বর্তমানে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ১২৩.২ মিলিয়নেরও বেশি (ইউএনএইচসিআর, গ্লোবাল ট্রেন্ডস: ফোর্সড ডিসপ্লেসমেন্ট ইন ২০২৩)। এই সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। শরণার্থী, যারা যুদ্ধ, নিপীড়ন বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে পালিয়ে আসে, তাদের সমস্যা সমাধানে বিশ্বব্যাপী সরকার ও সংস্থাগুলো আলোচনা ও বিতর্কে জড়িত, কিন্তু সমাধান সুদূরপরাহত।

কোরআন শরণার্থীদের বিষয়ে প্রধানত সামাজিক ন্যায়বিচারের উপর জোর দিয়েছে। বলা হয়েছে: ‘যদি কোনো মুশরিক তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে, তাকে আশ্রয় দাও যাতে সে আল্লাহর কথা শুনতে পায়, তারপর তাকে তার নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দাও।’ (সুরা তাওবা, আয়াত: ৬)

এই আয়াতটি নির্দেশ করে যে শরণার্থীদের দুর্বলতা, ভয় এবং বাস্তুচ্যুতির সমস্যা সমাধানে জাতি বা ধর্মের প্রতি বিবেচনা না করে ইসলামী আচরণ প্রয়োগ করতে হবে।

শরণার্থী নবীগণ

কোরআনে বর্ণিত হয়েছে যে নবী ইবরাহিম (আ.

) ও তাঁর পরিবারকে হিজরত করতে হয়েছিল এবং আল্লাহ তাঁদের সাহায্য করেছিলেন (সুরা আম্বিয়া, আয়াত: ৭১)। নবী মুসা (আ.) মিশরীয়দের নিপীড়ন থেকে পালিয়ে মাদায়েনে আশ্রয় নেন, যেখানে তিনি আশ্রয়, কর্মসংস্থান ও অন্যান্য সুবিধা পান (সুরা কাসাস, আয়াত: ২০-২৮)।

মহানবী (সা.) নিজেও শরণার্থী ছিলেন। মক্কার নির্যাতন থেকে রক্ষার জন্য প্রথমে তিনি কিছু অনুসারীকে আবিসিনিয়ায় হিজরতের নির্দেশ দেন। তারপর নিজে মদিনায় হিজরত করেন। এই হিজরত ইসলামের ইতিহাসে এতটাই তাৎপর্যপূর্ণ যে এটি হিজরি ক্যালেন্ডারের সূচনা হিসেবে গণ্য হয়।

আরও পড়ুনহিজরতকারীদের ফেরত আনার জন্য কোরাইশরা আবিসিনিয়ায় লোক পাঠাল: ১১৬ এপ্রিল ২০২৩মদিনায় শরণার্থীদের প্রতি নবী (সা.)-এর আচরণ

মদিনায় পৌঁছে নবীজি (সা.) মক্কার মুহাজিরদের (শরণার্থীদের) দারিদ্র্য ও কষ্টের প্রতি গভীরভাবে সচেতন ছিলেন। তারা সবকিছু ফেলে অসহনীয় পরিস্থিতি থেকে পালিয়ে এসেছিলেন এবং নতুন শহরে আয়, জমি বা সম্পত্তি ছাড়া ছিলেন। একটি প্রাচীন আরবি প্রবাদে বলা হয়েছে, ‘অপরিচিত ব্যক্তি চোখ থাকলেও অন্ধ।’

নবীজি (সা.) মদিনার আনসার (স্থানীয় বাসিন্দা) এবং মুহাজিরদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের ঘোষণা দেন। তিনি প্রত্যেক মুহাজিরের জন্য একজন আনসারকে ভাই বা বোন হিসেবে নির্ধারণ করেন। এই ভ্রাতৃত্বের মাধ্যমে তিনি শরণার্থীদের জন্য দুটি প্রধান সমস্যা—আশ্রয় এবং খাদ্য—সমাধান করেন। আনসাররা তাদের ঘর, খাবার এবং জীবিকা মুহাজিরদের সঙ্গে ভাগ করে নেন। এটি শরণার্থীদের নতুন জীবন শুরু করতে সাহায্য করে এবং তাদের একাকীত্ব দূর করতে ভূমিকা রাখে।

নবীজি (সা.)-এর এই পদক্ষেপ ছিল শরণার্থীদের জন্য একটি সোনালী নীতি। আশ্চর্যজনকভাবে, ১৯৫১ সালের জাতিসংঘের শরণার্থী কনভেনশন এই নীতির উপর ভিত্তি করে গড়েিই উঠেছিল, যা শরণার্থীদের শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং ব্যবসা শুরুর অধিকার নিশ্চিত করে।

শরণার্থীদের প্রতি আচরণ

আজকের বিশ্বে শরণার্থী সমস্যা একটি বৈশ্বিক সংকট। যদিও অনেক পশ্চিমা দেশ শরণার্থীদের প্রবেশ সীমিত করতে চায়, তুরস্ক এবং কানাডার মতো দেশগুলো তাদের সমাজে শরণার্থীদের একীভূত করার উপর জোর দেয়। তুরস্কের গাজিয়ান্তেপ শহর প্রায় ৬০০,০০০ সিরিয়ান শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। তারা সেখানে কাজের অনুমতি, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষার সুযোগ পায় এবং সরকার তাদের নাগরিকত্বের পথ তৈরি করছে (হাউ টু ট্রিট রিফিউজিস উইথ ডিগনিটি: আ লেসন ফ্রম টার্কি, নিউ ইয়র্ক টাইমস, ২০১৮)।

কানাডাও ২০১৫ সালে হাজার হাজার সিরিয়ান পরিবারকে আশ্রয় দিয়ে শিরোনামে এসেছিল। সাধারণ মানুষ তাদের জন্য সময় ও অর্থ দান করে নতুন জীবন শুরুতে সাহায্য করেছিল, যা জাতিসংঘের শরণার্থী কনভেনশনের প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করে।

আরও পড়ুনসুরা কাহাফের ৪ কাহিনিতে সফলতার ৪ শিক্ষা২০ জুলাই ২০২৫নবীজি (সা.)-এর শিক্ষা

নবীজি (সা.)-এর শিক্ষা আজও প্রাসঙ্গিক। কোরআন ও সুন্নাহ দয়া ও করুণার উপর জোর দেয়। তিনি বলেছেন: ‘যে কাউকে কষ্টে থাকতে দেখে তাকে সময় দেয় বা তার বোঝা হালকা করে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তাকে তাঁর ছায়ায় আশ্রয় দেবেন, যেদিন তাঁর ছায়া ছাড়া কোনো ছায়া থাকবে না।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ১৩০৩)

তিনি আরও বলেছেন: ‘যে নেতা দরিদ্র বা প্রয়োজনে থাকা কারো জন্য দরজা বন্ধ করে, আল্লাহ তার দারিদ্র্যের সময় আসমানের দরজা বন্ধ করে দেবেন।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২৪১৬)

এই শিক্ষাগুলো শরণার্থীদের প্রতি দায়িত্বশীল ও মানবিক আচরণের গুরুত্ব তুলে ধরে।

নবীজি (সা.)-এর শরণার্থীদের প্রতি আচরণ—তাদের আশ্রয়, খাদ্য ও ভ্রাতৃত্ব প্রদান—আজকের বিশ্বের জন্য একটি আদর্শ। কোরআন ও সুন্নাহ শরণার্থীদের দুর্বলতা ও চাহিদার প্রতি সংবেদনশীল হতে শেখায়। তুরস্ক ও কানাডার মতো দেশ এই নীতি অনুসরণ করে শরণার্থীদের মানবিকভাবে গ্রহণ করছে। নবীজি (সা.)-এর শিক্ষা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে শরণার্থীদের সাহায্য করা কেবল মানবিক দায়িত্ব নয়, বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথ।

আরও পড়ুনপরিবেশ নিয়ে নবীজি(সা.) এর ১০ শিক্ষা১৯ এপ্রিল ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স হ য য কর এর শ ক ষ দ র জন য আল ল হ হ জরত র উপর ক রআন সমস য

এছাড়াও পড়ুন:

পুরোপুরি বিলুপ্তির পর উগান্ডায় আবার ফিরল গন্ডার

উগান্ডার মধ্যাঞ্চলে প্রায় ২৭ বর্গমাইল (৭০ বর্গকিলোমিটার) এলাকায় বিস্তৃত জিওয়া র‍্যাঞ্চ নামে খামারে রয়েছে প্রচুর সবুজ ঘাস, জলাভূমি, বনাঞ্চল। সেই খামারে সাত হাজার গরু ঘুরে বেড়াত। এখন আর সেখানে গরু নেই। এর জায়গায় ঘাস খায় গন্ডার। উগান্ডায় এখন কেবল এখানেই রয়েছে গন্ডার। নিজেদের প্রাকৃতিক আবাসে বসবাস করছে এসব বন্য প্রাণী।

আফ্রিকার দেশ উগান্ডায় ৪০ বছর আগে গন্ডার একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। তবে একজন খামারির হাত ধরে আবার দেশটিতে ফিরে এসেছে বন্য এ প্রাণী। সেখানকার বেসরকারি খামার জিওয়া র‍্যাঞ্চে এখন গন্ডার আছে প্রায় অর্ধশত। কীভাবে গন্ডারদের সেই দেশে ফিরিয়ে আনা হলো, বলা যাক সেই গল্প।

একসময় ধূসর ও সাদা গন্ডারের আবাসস্থল ছিল উগান্ডা। ১৯৮০-এর দশকে শিকার, চোরাচালান ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় দেশটি থেকে গন্ডার সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যায়। একসময় সেখানে প্রায় ৭০০টি গন্ডার থাকলেও সে সংখ্যা শূন্যে নেমে আসে।

এর এক দশক পর জিওয়া র‍্যাঞ্চের মালিক ক্যাপ্টেন জোসেফ চার্লস রয়ের কাছে গন্ডার ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব দেয় ‘রাইনো ফান্ড উগান্ডা’। জোসেফ এ প্রস্তাবে সম্মত হন এবং ২০০৫-০৬ সালে কেনিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা থেকে ছয়টি গন্ডার নিয়ে আসেন। খামারটিতে বংশবৃদ্ধির মাধ্যমে সেই গন্ডারের সংখ্যা এখন দাঁড়িয়েছে ৪৮–এ।

৪৮টি গন্ডারের মধ্যে জিওয়া র‍্যাঞ্চে গত তিন মাসে জন্মেছে পাঁচটি শাবক। খামারের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ও সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা এই সাফল্যের মূল কারণ বলে ধরা হয়। সেখানে কর্তব্যরত রেঞ্জাররা প্রতিটি ‘গন্ডার পরিবারকে’ সার্বক্ষণিক নজরে রাখেন। গন্ডারগুলো যাতে চোরাচালানের শিকার না হয়, সে জন্য রয়েছে নিশ্ছিদ্র সীমানা পাহারার ব্যবস্থা।

জিওয়া র‍্যাঞ্চে যেসব ব্যক্তি রেঞ্জার হিসেবে কাজ করেন, তাঁদের একজন শরিফ নসুবাগা। তিনি খামারটিতে ১০ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করছেন।

শরিফ নসুবাগা বলেন, প্রতি ঘণ্টায় তাঁরা গন্ডারদের কার্যকলাপ এবং তাদের আচরণ, যেমন খাওয়া, মলমূত্র ত্যাগ, বিশ্রাম নেওয়া রেকর্ড করেন। তিনি বলেন, এই কাজ করতে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে গন্ডারদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। কোন গন্ডারের আচরণ কেমন, কোনটি শান্ত আর কোনটি আক্রমণাত্মক, তা তাঁরা জেনে গেছেন।

জিওয়া র‍্যাঞ্চে গন্ডারের বাইরে চিতাবাঘ, জিরাফ, জেব্রাসহ ৩০০টির বেশি প্রজাতির পাখি দেখা যায়। পর্যটকেরা এখানে এসে বন্য প্রাণীগুলো দেখতে পারেন। পর্যটকদের থেকে পাওয়া অর্থ প্রাণীগুলোর সংরক্ষণে ব্যয় হয়।

জিওয়া কর্তৃপক্ষ জানায়, র‍্যাঞ্চের মূল লক্ষ্য হলো পর্যাপ্ত গন্ডার প্রজনন করে তাদের উগান্ডার জাতীয় উদ্যানগুলোতে স্থানান্তর করা। এ খামারে ৮০টি পর্যন্ত গন্ডার রাখা যেতে পারে। গন্ডারের প্রজাতিতে বৈচিত্র্য আনতে আফ্রিকার অন্যান্য দেশ থেকে শিগগিরই আরও আটটি গন্ডার আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জিওয়া কর্তৃপক্ষ।

সার্বিক বিষয়ে উগান্ডায় গরিলা সংরক্ষণে বিপ্লব ঘটানো প্রাণিচিকিৎসক গ্ল্যাডিস কালেমা-জিকুসোকা বলেন, জাতীয় উদ্যানগুলোতে গন্ডার স্থানান্তর একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে এ জন্য পর্যাপ্ত বিনিয়োগ ও পর্যাপ্ত রেঞ্জার অপরিহার্য।

জিকুসোকা বলেন, ইদি আমিনের শাসনামলে উগান্ডা থেকে গন্ডার সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। সেই গন্ডার ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে প্রমাণিত হচ্ছে, উগান্ডা আবার স্থিতিশীল হয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • এআই এজেন্ট উন্মুক্ত করল অ্যাডোবি
  • নতুন প্রজাতির তৃণভোজী ডাইনোসরের জীবাশ্ম আবিষ্কার
  • চাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের প্যানেল ঘোষণা
  • আগামী সরকারের মন্ত্রীদের জন্য গাড়ি কেনার অতি আগ্রহের কারণ কী, প্রশ্ন টিআইবির
  • মুসলিম পরিবারে শিশুর নিরাপত্তা
  • পুরোপুরি বিলুপ্তির পর উগান্ডায় আবার ফিরল গন্ডার