Prothomalo:
2025-10-07@09:50:41 GMT

এখানে বসা নিষেধ

Published: 7th, October 2025 GMT

নির্বিকার একাডেমির তত দিন পর্যন্ত বেশ ভালোই চলছিল, যত দিন না এই অলক্ষুণে লোকটা কোনো সার্টিফিকেট ছাড়াই হাজির হয়েছিল। সার্টিফিকেট তো দূরের কথা, লোকটা একেবারেই বকলম—কোনো নিয়মকানুন না জেনেই সে বড় হয়েছে। তার নাকি কোনো নামই নেই। এসেই কী একটা যে ঝামেলা পাকিয়ে দিল ব্যাটা!

লোকটার মধ্যে এক অদ্ভুত নীরবতা ছিল। সে কথা বলত না, তর্ক তো মোটেই করত না, এমনকি পুরো পৃথিবী নিয়ে এমন একটা উদাসীন ভঙ্গি করে শিরীষগাছটার ছায়ায় বসে থাকত যে কারও মনে হতে পারত এই লোকটাকে আমলে আনার কোনো কারণ নেই। কিন্তু তারপরও কারও কারও নজরে পড়ল সে। তারা দেখল একাডেমির পাঠ্যক্রমের বাইরে এমন একটা ভাষা আছে তার চোখে, যা সেখানকার কেউই পড়তে পারছে না।

এটা পৃথিবীর এমন একটা দেশের গল্প, যেখানে প্রতিষ্ঠানে যা শেখানো হয় তাকেই চূড়ান্ত সত্য বলে বিবেচনা করা হয়। এ দেশে মানুষ জন্মায় কেবল শেখার জন্যই। মৃত্যুর আগেই সে তার প্রয়োজনীয় সবকিছু শিখে ফেলে আর জীবদ্দশায় তা অক্ষরে অক্ষরে কাজে লাগায়। বাস্তব জীবনে কাজে দেয়—এমন ধরনের শিক্ষাই এখানে সিলেবাসভুক্ত। আর যার হাতে পাঠের এই গুরুভার, তার নামই নির্বিকার একাডেমি।

এটা কেবল একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই নয়, একধরনের প্রকল্পও, যার মূল উদ্দেশ্য হলো এমন সব প্রজন্ম তৈরি করা, যারা বিনয়ী হবে আর জোটবদ্ধ থাকবে। একাডেমিক ভবনগুলোর মতোই শক্তিশালী এর সিলেবাস—একেবারে প্রাসঙ্গিক আর মূলানুগ। এখানে শেখানো হয় কীভাবে ভাবতে হয় না, কীভাবে প্রশ্নাতীতভাবে বিশ্বাস করতে হয় এবং কীভাবে সন্দেহ আর কৌতূহলের দরজায় চিরস্থায়ীভাবে পেরেক ঠুকে দেওয়া যায়। শিক্ষকেরা এমনভাবে শিক্ষার্থীদের মগজধোলাই করেন যে তারা সিলেবাসের বাইরে যাওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারে না। এই প্রতিষ্ঠানে চর্চার মুখ্য বিষয় হচ্ছে ‘চিন্তাশূন্য অনুসরণ’। ক্লাসে শেখানো হয় ‘তর্ক মানেই ত্রুটি’, ‘উৎসাহ হচ্ছে বিচ্যুতি’, ‘সন্দেহ একটা নৈতিক ব্যাধি’, ‘নিজস্বতা একধরনের অলীক কল্পনা’, ‘ভিন্নতা একধরনের বিলাসিতা’ আর ‘কর্তৃত্বই চূড়ান্ত সত্য’।

পাঠ্যপুস্তকে স্পষ্টভাবে নির্দেশ থাকে—‘চেনা পথের বাইরে যেয়ো না, হারিয়ে যাবে।’ শিক্ষার্থীরা কয়েক বছরেই শিখে যায়—বিকল্প ভাবনা মানেই অনিয়ম, অনিয়মে জন্মায় অস্থিরতা আর অস্থিরতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তারা এ–ও শিখে যায়, সবচেয়ে নিরাপদ অবস্থান হলো শ্রোতা হয়ে থাকা আর প্রশ্নহীনভাবে মাথা ঝাঁকানো।

প্রশিক্ষণের সূচনা হয় নিষ্পাপ শিশুদের নিয়ে। শুরুতেই তাদের শেখানো হয় ‘আমি’—নিজেকে চেনার ভাষা। সেই ‘আমি’কে তারা চিনতে শেখে একটা কাঠামোর ভেতর দিয়ে। তারপর আসে দ্বিতীয় ধাপ—‘আমরা’। এই ‘আমরা’ কোনো বন্ধনকে নয়, বরং একটা সম্মিলিত সত্তাকে নির্দেশ করে। শিশুরা শিখে নেয় কীভাবে ‘আমি’ থেকে ‘আমরা’তে নিজেকে বিলীন করে দিতে হয়। ধীরে ধীরে ‘আমি’ হয়ে ওঠে এক অপরাধের নাম, একধরনের বিপথগামিতা।

পাঠ্যপুস্তকে স্পষ্টভাবে নির্দেশ থাকে—‘চেনা পথের বাইরে যেয়ো না, হারিয়ে যাবে।’ শিক্ষার্থীরা প্রথম কয়েক বছরেই শিখে যায়—বিকল্প ভাবনা মানেই অনিয়ম, অনিয়মে জন্মায় অস্থিরতা আর অস্থিরতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ধীরে ধীরে তারা এ–ও শিখে যায়, সবচেয়ে নিরাপদ অবস্থান হলো শ্রোতা হয়ে থাকা আর প্রশ্নহীনভাবে মাথা ঝাঁকানো।

এই একাডেমির সর্বোচ্চ স্বীকৃতির নাম ‘পূর্ণ নির্বিকারতা’। একটা স্বর্ণপদক, সাথে একটা সনদ আর ঠান্ডা একটা মগজ, যা আদ্যোপান্ত অনুভূতিহীন। এই মগজ কখনো কাঁদে না, হাসে না, বিস্মিত হয় না, ভালোবাসে না। ‘পূর্ণ নির্বিকারতা’ হলো সেই একাডেমির শিক্ষার্থীদের আরাধ্য এমন এক শিখর, যেখানে পৌঁছালে আর কোনো প্রশ্ন থাকে না। আধুনিক বিশ্বের যোগ্য মডেল নাগরিকে রূপান্তরিত হলেই এই পুরস্কারের জন্য মনোনীত হওয়া যায় আর বিজয়ের মুকুট ছিনিয়ে আনতে হয় কঠোর প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে। এই পুরস্কার কেবল সফলতার নয়, বরং সবচেয়ে দক্ষ শাসনব্যবস্থার শ্রেষ্ঠ হাতিয়াররূপেও স্বীকৃত।

নিশ্ছিদ্র নিয়মে বাঁধা এমন এক বিশুদ্ধতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় যখন আচমকাই এমন একটা অপদার্থের আগমন ঘটে, তখন তা স্বভাবতই পুরো কাঠামোর ভারসাম্যকে বিপন্ন করে তোলে। সে কারণে একাডেমির অধ্যক্ষ বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন। এই অনধিকার প্রবেশ শিক্ষার্থীদের আচরণে স্খলন ঘটাতে পারে, সে আশঙ্কায় তিনি দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হলেন। নির্দেশ এল—প্রত্যেকেই যেন লোকটিকে উপেক্ষা করে, কেউ যেন তার সঙ্গে কোনো কথাবার্তা বা ভাবের আদান–প্রদান না করে। তার বিরুদ্ধে জারি হলো একরকম নিঃশব্দ সামাজিক বয়কট। তবে কেবল ব্যাপারটাকে উপেক্ষাতেই সীমাবদ্ধ রাখা হলো না, তাকে পর্যবেক্ষণেও রাখা হলো—তার চালচলন, কথাবার্তা, কার কাছে সে ঘোরাফেরা করছে, কী লক্ষ্য তার—এসব নিয়ে নীরব নজরদারি চলতে থাকল। কিন্তু দিন কয়েকেই হাঁপিয়ে উঠল সবাই। লোকটা কোনো কথা তো বলেই না, কারও কাছে তো যায়ই না, কেবল একাডেমিক ভবন–১-এর ডান পাশ দিয়ে বয়ে চলা শান্ত নদীটার ধারের শিরীষগাছটার ছায়ায় ততোধিক শান্ত হয়ে বসে থাকে।

তবু কেমন অনিয়ন্ত্রিত লাগে। তার এই নিয়মবহির্ভূত উপস্থিতিতে বিরক্তি বাড়তে থাকে। শেষমেশ অধ্যক্ষ নিজেই ঘোষণা করলেন, এই ব্যক্তি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পরিসরে এক ‘পাঠ্যবহির্ভূত প্রক্ষেপ’। ফলে একটা বিশেষ অধ্যাদেশও জারি হলো, ‘যে ব্যক্তি শেখেনি তাকে জিজ্ঞেস কোরো না। কারণ, তার নিরুত্তরতা একটি বিক্ষোভ। আর বিক্ষোভ শিক্ষাব্যবস্থায় অবৈধ।’

তাকে তো কেউ নিয়োগই দেয়নি! সে কারণে কেউ কেউ তাকে প্রত্যাখ্যানও করতে পারেনি। তাই তারা শিরীষগাছের তলায় যাওয়া শুরু করল। সে কিছু বলত না, তবু তারা শুনত, তারা শুনত তার চুপ করে থাকার মধ্যকার এক বিশেষ অনুরণন, এমন এক অশ্রুতপূর্ব সংগীত, যা স্তব্ধতার দেয়াল ধসিয়ে তাদের শেখাত নতুন এক ভাষা।

তবু কিছু ছাত্র গোপনে তার কাছে যেত। সে কোনো শিক্ষক ছিল না, ছিল না পদাধিকারী কেউ; ক্ষমতাবান হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না যে নম্বরের প্রত্যাশায় শিক্ষার্থীরা যাবে তার কাছে। তাকে তো কেউ নিয়োগই দেয়নি! সে কারণে কেউ কেউ তাকে প্রত্যাখ্যানও করতে পারেনি। তাই তারা শিরীষগাছের তলায় যাওয়া শুরু করল। সে কিছু বলত না, তবু তারা শুনত, তারা শুনত তার চুপ করে থাকার মধ্যকার এক বিশেষ অনুরণন, এমন এক অশ্রুতপূর্ব সংগীত, যা স্তব্ধতার দেয়াল ধসিয়ে তাদের শেখাত নতুন এক ভাষা। সে কিছু শেখাত না, তবু তারা শিখত—‘না শেখা’র সম্ভাবনাকে। এই শিক্ষার্থীরা জানত, তারা কোনো উত্তরের খোঁজে নয়, বরং প্রশ্নের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে নেমেছে। তারা ধীরে ধীরে বুঝে ফেলেছিল, শেখার আরেক নাম ভুলে যাওয়া—ভুলে যাওয়া সেই ‘চোখ বুজে মেনে চলা’র নিয়মাবলি। কোনো শিক্ষা কিংবা নির্দেশনা না দিয়েই, এমনকি একটা বাক্যও না বলে লোকটা তাদের কাছে হয়ে উঠেছিল এক জীবন্ত আয়না, যেখানে তারা আবার ‘আমরা’ থেকে ‘আমি’ হয়ে উঠছিল। তার চুপ করে থাকাটা হয়ে উঠেছিল অজস্র না-বলা কথার জটলা আর তার উপস্থিতি হয়ে উঠেছিল ভিন্ন ধারার আরেক সিলেবাসের উন্মোচন।

বিষয়টা জানাজানি হয়ে গেল একসময়। ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল খবর—কিছু ছাত্র নিয়ম ভেঙে সেই নিষ্কর্মা মানুষটার কাছে যাচ্ছে। সে কিছু শেখাচ্ছে না, অথচ শিক্ষার্থীরা শিখে নিচ্ছে। কথা না বললেও অনেক কিছু নাকি শোনা যায় তার কাছ থেকে।

এ দেখি মহাবিপদ!

নড়েচড়ে বসল পুরো প্রতিষ্ঠান। ঘটনাটির নাম দেওয়া হলো ‘নীরব যোগাযোগ’। এ জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করা হলো। দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর কমিটি রিপোর্ট পেশ করল, ‘এই নীরব যোগাযোগ প্রতিষ্ঠানের জন্য হুমকিস্বরূপ।’

শিক্ষার্থীদের পথে ফেরাতে ‘ভ্রান্ত অভিভাষণ তত্ত্ব’ নামে নতুন কোর্স চালু হলো। নীরবতা, চোখের ভাষা ইত্যাদির প্রতিকার কীভাবে করা যায় তার পদ্ধতি শেখানোই ছিল এ কোর্সের উদ্দেশ্য। শিক্ষার্থীদের শেখানো হলো—চোখে চোখ রাখা বিপজ্জনক, নীরবতা সন্দেহজনক আর অনুভব মানেই অবাধ্যতা। জানালাবিহীন ঘরে চলতে থাকল প্রশিক্ষণ। প্রতিষ্ঠান ভাবল, সবকিছু আবার নিয়ন্ত্রণে চলে আসছে। কিন্তু তত দিনে সমস্যার শিকড় অনেক গভীরে পৌঁছে গেছে। সেই অশিক্ষিত মানুষটার নিঃশব্দ উপস্থিতি শিক্ষার্থীদের সুসংহত মগজে একটা সূক্ষ্ম ছিদ্র তৈরি করে ফেলেছে এর মধ্যেই। আর ঠিক সেই ছিদ্রপথ দিয়েই প্রবেশ করেছে ভাবনার বীজ, যদিও তা ভুল ভাবনা। কী ভাবতে হবে তা তারা শিখছিল না, বরং শিখছিল কীভাবে ভাবা যায়—ভুলভাল ভাবনা হলেও। আর এই ভুলভাল ভাবার অধিকারই ছিল একাডেমির চোখে সবচেয়ে বিপজ্জনক। কারণ, ভুল ভাবনা মানে প্রশ্ন আর অনিশ্চয়তা, যা একবার জন্মালে ইহজগতে আর দমন করা যায় না। এই একটুখানি ফাঁকই প্রতিষ্ঠানের শতাব্দীপ্রাচীন কাঠামোকে কাঁপিয়ে তোলার জন্য যথেষ্ট হয়ে উঠছিল।

পরিস্থিতি ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে জরুরি ভিত্তিতে একটি সভা ডাকা হলো। একাডেমি তার শীতল আর ধাতব নীরবতা ভেঙে হঠাৎ এক অশরীরী আলোড়নের মুখোমুখি হলো যেন। সভাকক্ষে একধরনের চাপা উত্তেজনা, উদ্বেগ আর অজানা শঙ্কা নিয়ে নীতিনির্ধারকেরা বসে আছেন। মেজাজ হারিয়ে, সংযম ভেঙে অধ্যক্ষ স্পষ্ট আর কঠিন সুরে বললেন, ‘আমাদের এখনই কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শিক্ষার মান ও বিশুদ্ধতার ঐতিহ্য যদি আমরা রক্ষা না করতে পারি, তবে আমাদের ওপর চেপে বসবে “মূর্খের অজ্ঞতা”। এই একাডেমি হয়ে উঠবে চিন্তার শৃঙ্খলার বদলে বিকারগ্রস্তের উন্মাদনার ক্ষেত্র।’

শিক্ষার্থীদের পথে ফেরাতে ‘ভ্রান্ত অভিভাষণ তত্ত্ব’ নামে নতুন কোর্স চালু হলো। নীরবতা, চোখের ভাষা ইত্যাদির প্রতিকার কীভাবে করা যায় তার পদ্ধতি শেখানোই ছিল এ কোর্সের উদ্দেশ্য। শিক্ষার্থীদের শেখানো হলো—চোখে চোখ রাখা বিপজ্জনক, নীরবতা সন্দেহজনক আর অনুভব মানেই অবাধ্যতা।

এই ঘোষণার পর প্রশাসনিক মহল থেকে পরবর্তী দিকনির্দেশনা এল—লোকটিকে আর সহ্য করা যাবে না, তাকে সরিয়ে ফেলতেই হবে। তবে শুধু শারীরিকভাবে অপসারণ নয়—তার অস্তিত্ব, স্মৃতি, এমনকি তার নামটুকুও মুছে ফেলতে হবে একাডেমির সামগ্রিক তথ্যব্যবস্থা থেকে। তাকে দেখানো হলো এক আত্মবিধ্বংসী ব্যক্তিত্ব হিসেবে, যে নিজের পাশাপাশি পরিবেশকেও ধ্বংস করে দেয়। সেই যুক্তিতে তার উপস্থিতি ধরা হলো এমন একটা ভাইরাসের মতো, যা একাডেমির কাঠামোতে ঢুকে পড়ে তার নীতিনৈতিকতাকে ধ্বংস করছে প্রতিনিয়ত। তার নাম, পরিচয়, রেজিস্ট্রেশন নম্বর—যেগুলো পরবর্তীকালে শিক্ষার্থীদের দ্বারা তৈরি হয়েছিল—সবকিছু নিখুঁতভাবে মুছে ফেলা হলো সব ডেটাবেজ থেকে, যেন সে কখনোই ছিল না। তার উপস্থিতিকে এক ‘মায়াজাল’ হিসেবে ঘোষণা করা হলো। যেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা, কর্মচারী অর্থাৎ গোটা একাডেমি মিলে এক জাদুর ফাঁদে আটকা পড়ে গিয়েছিল—যে জাদু কেটে এখন তারা মুক্ত।

কিন্তু বিলয়ের পরেও লোকটার উপস্থিতি বিলীন হলো না—কোথায় যেন রেশ রয়ে গেল তার! তার শূন্যতা, তার নীরবতা, তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণার কারণ—এ সবই ধীরে ধীরে পাঠের বাইরের পাঠ হয়ে উঠতে লাগল। বহু ছাত্র এখন ক্লাসে প্রশ্ন করে, ‘এই যে “কেউ ছিল না”, সে তো আমাদের চিন্তা করার ইচ্ছেটুকু দিয়েছিল, তাই না?’

শিক্ষকেরা চুপ থাকেন। কারণ, সিলেবাসে এর কোনো উত্তর নেই। একাডেমি পড়ল মহাবিপদে। ছাত্রদের ভেতরে যে ক্ষীণ চিন্তার রেখা অঙ্কিত হচ্ছিল, তাকে আর হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। কেননা সেটা দিন দিন কেমন যেন ছোঁয়াচে হয়ে উঠছিল। একই রকম প্রশ্ন করছিল পাশের শিক্ষার্থীও, বলছিল, ‘চিন্তা কেন করা যাবে না?’ সেই নীরব মানুষটার সেই নিঃশব্দ আর ভুল শিক্ষা শিক্ষার্থীদের স্বাধীনভাবে চিন্তা করার উৎসাহ জোগাচ্ছিল ধীরে ধীরে।

ব্যাপারটাকে ভয়ংকর হুমকি হিসেবে দেখল একাডেমি, তারপর মরিয়া হয়ে গ্রহণ করল সেই সিদ্ধান্ত, যা একেবারে দেয়ালে পিঠ ঠেকে না গেলে কর্তৃপক্ষ নেয় না। তারা প্রয়োগ করল তাদের সর্বশেষ অস্ত্র—আবেগ-নিরাময় ডোজ। এটা ছিল শৃঙ্খলা ফেরাতে একাডেমির চূড়ান্ত পদক্ষেপ। এটা একধরনের ইনজেকশন, যা মস্তিষ্কের প্রতিক্রিয়ার কেন্দ্রগুলোকে চিরতরে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। এর প্রভাবে হারিয়ে যায় উত্তেজনা, উদ্বেগ, বিস্ময়, প্রেম, ভয়, কিংবা কৌতূহলের মতো মৌলিক অনুভূতিগুলো।

দেওয়া হলো ডোজ। যাক, শান্তি! কর্তৃপক্ষ হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। একাডেমি যেন দীর্ঘ এক দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠল। শৃঙ্খলা ফিরে এল সব জায়গায়। ক্লাসরুমগুলো নিঃশব্দ, করিডরে সীমিত চলাফেরা, লাইব্রেরিতে শুধুই সিলেবাসভিত্তিক বই এবং শিক্ষার্থীদের চোখে নেই আর কোনো অনাহূত দীপ্তি। এখন আর কেউ এমন প্রশ্ন করে না, যার উত্তর সিলেবাসে নেই।

তবু চলতে–ফিরতে হঠাৎ হঠাৎ দেখা যায়, শিরীষগাছটার ছায়ায় কেউ একজন এখনো বসে থাকে—অদৃশ্য আর নিস্তব্ধ। নতুন ছাত্রদের কাছে সে ব্যক্তি এক রহস্যময় সত্তা, যার নাম কেউ জানে না, যার মুখ কেউ চেনে না। তারা শুধু শুনেছে, গাছটির ছায়ায় বসা নিষেধ এবং নিষেধ অমান্য করার শাস্তি সম্পর্কে তাদের সতর্ক করা হয়েছে।

কিন্তু এখনো কিছু ঝিম-মারা দুপুরে, ক্লাস ফাঁকি দিয়ে একজন-দুজন যায় শিরীষগাছটার তলায়; যদিও তারাও জানে যে এখানে বসা নিষেধ।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র উপস থ ত একধরন র এমন একট এক ড ম র ল এক ড ম ব যবস থ এমন এক সন দ হ র জন য ক র এক সবচ য় ন রবত

এছাড়াও পড়ুন:

ভারত কীভাবে চীনা ‘ড্রাগন’ ও মার্কিন ‘ইগল’কে  সামলাবে

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রতিক তিয়ানজিন সফর ছিল সাত বছর পর তাঁর প্রথম চীন সফর/। তিনি সেখানে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) সম্মেলনে অংশ নেন। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে মোদির উপস্থিতি একধরনের বহুরৈখিক সংহতির ছবি তুলে ধরে। এই ছবি দেখে মনে হতে পারে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনকে অস্বস্তিতে ফেলতে পরিকল্পিতভাবে সব সাজানো হয়েছিল।

কিন্তু এই রাজনৈতিক প্রদর্শনীর আড়ালে লুকিয়ে আছে আরও জটিল বাস্তবতা। আর সেই বাস্তবতাকে ভারতের অত্যন্ত সতর্কতা ও সুস্পষ্ট কৌশলের সঙ্গে মোকাবিলা করা জরুরি।

আসলে মোদির এই সফর ছিল একধরনের কূটনৈতিক পুনর্মিলনের ইঙ্গিতবাহী বার্তা। প্রায় এক ঘণ্টার সৌহার্দ্যপূর্ণ বৈঠকে মোদি ও সি দুই দেশের মধ্যে সরাসরি বিমান যোগাযোগ পুনরায় চালু করতে এবং হিন্দুধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী দেবতা শিবের তীর্থস্থান কৈলাস–মানস সরোবরে যাত্রা আবারও চালু করতে একমত হন।

দুই নেতা হাত মেলালেন। ছবি তুললেন। মনে হলো, ভারত-চীন সম্পর্ক নতুন এক শান্তিপূর্ণ অধ্যায়ে প্রবেশ করছে।

তবে আশাবাদী হওয়ার মতো কারণ খুব বেশি নেই। ১৯৫০-এর দশক থেকেই ভারত বারবার চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেছে। কিন্তু প্রতিবারই শেষ হয়েছে হতাশা কিংবা প্রতারণায়।

১৯৬২ সালের যুদ্ধ (যখন চীনা বাহিনী হিমালয় সীমান্তে একযোগে আক্রমণ চালায়) দুই দেশের প্রাথমিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে সম্পূর্ণভাবে ভেঙে দেয়।

পরে ১৯৮০-এর দশকের শেষ দিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর উদ্যোগে সম্পর্ক কিছুটা স্থিতিশীল হয়। কিন্তু গত এক দশকে ভারত-চীন সম্পর্ক আবারও উত্তেজনায় ভরে উঠেছে। ২০১৩ সালের দেপসাং, ২০১৪ সালের চুমার, ২০১৭ সালের দোকলাম এবং ২০২০ সালের গালওয়ানের সংঘর্ষ—সবই দেখিয়েছে, সীমান্তে শান্তি এখনো অধরাই। এসব সংঘর্ষে দুই দেশের সেনারা নিহতও হয়েছেন।

আজও হিমালয়ের বরাবর যে সীমান্তরেখা ‘লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল’ (এলএসি) নামে পরিচিত, তা নিয়ে বিরোধ রয়ে গেছে। চীন সীমান্ত অঞ্চলে দ্রুতগতিতে অবকাঠামো নির্মাণ চালিয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে চীনের পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক—বিশেষ করে ‘চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর’ প্রকল্প, সামরিক সহায়তা ও কূটনৈতিক সমর্থন—ভারতের কৌশলগত দুর্বলতাকে আরও প্রকট করে তুলছে।
সবচেয়ে যত্নসহকারে সাজানো সৌহার্দ্যের পরিবেশও যে বাস্তবতাকে আড়াল করতে পারবে না, তা হলো ভারত-চীন সম্পর্কের জটিল সমস্যাগুলো এখনো গভীর ও কঠিন। এই সমস্যাগুলোর সমাধান সহজ নয়।

চীনের সঙ্গে উত্তেজনা এড়ানোর মানে যেন মিথ্যা বন্ধুত্বের ভ্রমে জড়িয়ে পড়া না হয়। আবার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে আলোচনা করার অর্থ যেন না হয় এমন কোনো বিরোধ সৃষ্টি করা, যা পারস্পরিক সহযোগিতার কাঠামোগত ক্ষেত্রগুলোয় বিঘ্ন ঘটায়।

ভারত-চীন সম্পর্কের আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো অর্থনৈতিক বৈষম্য। চীনের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যঘাটতি বর্তমানে প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। এতে স্পষ্ট হয়, চীনা পণ্যের ওপর ভারত ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম ও ওষুধ উৎপাদনে ব্যবহৃত রাসায়নিক উপাদান থেকে শুরু করে বিরল খনিজ পদার্থ—সবক্ষেত্রেই ভারত চীনের ওপর আমদানিনির্ভর।

অন্যদিকে ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি ও সেবা প্রদানকারীরা চীনা বাজারে প্রবেশ করতে হিমশিম খাচ্ছে; অথচ চীনা কোম্পানিগুলো ভারতের সরবরাহব্যবস্থায় আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে। অর্থনৈতিক ভারসাম্য আনার জন্য ভারত বারবার চীনের প্রতি যে আহ্বান জানিয়েছে, তা এখন পর্যন্ত খুব একটা ফল দেয়নি।

কোনো সম্মেলনই ভারত-চীন সম্পর্কের কাঠামোগত সমস্যাগুলো ঢেকে রাখতে পারে না। এসসিও সম্মেলনে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং যখন বললেন ‘ড্রাগন ও হাতি একসঙ্গে হাঁটুক’, তখন মোদি সীমান্তে শান্তি ও ন্যায্য বাণিজ্য সম্পর্কের ওপর আবারও জোর দিলেন। পাশাপাশি তিনি ভারতের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) বিরোধিতা দৃঢ়ভাবে পুনর্ব্যক্ত করলেন।

এ প্রকল্পের সবচেয়ে বড় অংশ হলো এমন একটি মহাসড়ক, যা পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে গেছে, আর সেই ভূখণ্ড ভারত নিজস্ব বলে দাবি করে। একই সঙ্গে মোদি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধেও ভারতের অটল অবস্থানের কথা তুলে ধরেন।

দ্বিপক্ষীয় এসব মতবিরোধ ছাড়াও আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কেও দুই দেশের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। চীন এখন বিশ্বব্যবস্থার বিকল্প কাঠামো গড়ে তুলতে চায়। এসসিও সম্মেলনে সি চিন পিং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অর্থনীতি ও অবকাঠামো খাতে এমন কিছু উদ্যোগের কথা বলেন, যা পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরতা কমাবে। বর্তমানে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া রাশিয়ার জন্য এটি একধরনের ভূরাজনৈতিক লাইফলাইন। কিন্তু ভারতের দৃষ্টিতে এসসিও কেবল আঞ্চলিক সহযোগিতার একটি মঞ্চ, যেখানে ভারত তার কৌশলগত স্বাধীনতা প্রদর্শন করে।

নরেন্দ্র মোদি ও সি চিন পিং

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ভারত কীভাবে চীনা ‘ড্রাগন’ ও মার্কিন ‘ইগল’কে  সামলাবে