‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে’ বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই ছোট নদী নামে পরিচিত নাগর নদে চাক জাল ও পলো দিয়ে শুরু হয়েছে মাছ ধরার উৎসব। প্রতিবছরের মতো এবারও সিংড়ার ১৫-১৬ গ্রামের মানুষের অংশগ্রহণে খরসতি, সারদানগর ও নওগাঁর আত্রাই সীমান্তে মঙ্গলবার এ আয়োজন করা হয়। মাছ ধরা শেষে আনন্দ করতে করতেই বড়দের সঙ্গে মাছ নিয়ে বাড়ি ফেরে শিশুরাও।
কালের বিবর্তনে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী এ উৎসব আগের মতো জাঁকজমক না হলেও গান ও হৈ-হুল্লোড় কোনো কমতি ছিল না। উৎসব দেখতে ভিড়ে করেন উৎসুক জনতা।
মাছ ধরা উৎসবের দলনেতা কাদিরগাছা গ্রামের শাহাদত হোসেন বলেন, সবাই মিলে মাছ ধরতে নেমেছি। কেউ মাছ পেলে তার বাড়িতে
খবর পৌঁছে যাচ্ছে। রবি-বোরো মৌসুমে কৃষকের ধান রোপণ শেষে এই নদে মাছ ধরার উৎসব শুরু হয়। প্রায় মাসব্যাপী এলাকায় এ উৎসব চলে। এ বছর প্রশাসনের তৎপরতায় নদী-নালা, খাল-বিল উন্মুক্ত থাকায় মৎস্য শিকারিদের মুখে হাসি ফুটেছে।
তাজপুর গ্রামের সুনিল কুমার শীল বলেন, পাঁচটি বোয়াল মাছ পেয়েছি। আশা করছি, আরও মাছ ধরতে পারবো। শীতের মধ্যে পানিতে নামা কষ্ট, কিন্তু এখন কোনো কষ্ট মনে হচ্ছে না।
জয়নগর উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র নয়ন বলে, বিদ্যালয় ছুটি থাকায় এলাকার মানুষের সঙ্গে দলবেঁধে মাছ ধরার উৎসবে এসেছি।
মাছ আমাকে ফাঁকি দিতে পারিনি। দুইটা বোয়াল ধরা দিয়েছে চাকে।
চলনবিল জীববৈচিত্র্য রক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম বলেন, প্রশাসনের তৎপরতায় চলনবিলের নদ-নদী ও খাল-বিল উন্মুক্ত থাকায় দেশীয় প্রজাতির মাছ ও বিলের জীববৈচিত্র্য রক্ষিত হচ্ছে। সাধারণ মানুষ দেশীয় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতে পারছেন।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
ফসলের ক্ষেতে আশার আলো
বৈশাখ মাস, চারদিকে উৎসবের আমেজ। সেই উৎসবের ঢেউ লেগেছে শহর-বন্দর, গ্রাম-গঞ্জে। নতুন ধান ঘরে তোলার ধুম লেগেছে হাওর অঞ্চলে; বিশেষ করে সুনামগঞ্জ, ময়মনসিংহসহ কয়েকটি এলাকায়। হাওরের পুবালি বাতাসে এখন পাকা ধানের ম-ম গন্ধ। বৈশাখ এলেই সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলে চিরচেনা এ রূপ চোখে পড়ে। ঠা-ঠা রোদ মাথায় নিয়ে ক্ষেতে ধান কাটেন কৃষক। অন্যদিকে চলে মাড়াই। কিষানিরা মনের আনন্দে মাড়াই করা ধান শুকান। বিকেলের শান্ত রোদে শুকনো ধান মাথায় নিয়ে ঘরে ফেরেন।
ধান কাটা উৎসবে শুধু কিষান-কিষানি নন, সব বয়সী মানুষই যোগ দেন। হাওরে এটি এক অনন্য উৎসব। চলে বৈশাখজুড়ে। এ উৎসবের কাছে কাঠফাটা রোদ, ঝড়-বৃষ্টি যেন তুচ্ছ। ধানের সবুজ শীষের রং যখন লালচে হতে শুরু করে, তখন কৃষকের মনের রং বদলায়। চোখ-মুখ খুশিতে ভরে ওঠে। লোকমুখে প্রচলিত– বছরের প্রথম দিনে ঘরে ফসল তুললে সারাবছর অভাব থাকে না। তাই তো হাওরে চলছে পাকা ধান কাটার উৎসব। তবে চলতি মৌসুমে বৃষ্টিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় ধান তলিয়ে যায়। যাতে অনেক কৃষক নিঃস্ব হয়ে পড়েন।
আনন্দ-বেদনার এ বৈশাখে প্রকৃতি নতুন বিন্যাসে সাজে। বসন্তে প্রকৃতিতে যে রং লাগে, তা পূর্ণতা পায় বৈশাখে। অসীম আকাশে নানা বর্ণের মেঘের আনাগোনা আমাদের মনে সঞ্চারিত করে সঞ্জীবনী মন্ত্র। চোখে প্রশান্তি এনে দেয় সর্ববিস্তৃত প্রকৃতি। এ সময় চারদিকে আগুন ছড়ানো কৃষ্ণচূড়া, পলাশ, জারুল, বাগানবিলাসসহ প্রকৃতিতে রঙের ছড়াছড়ি। দেখা মেলে আম, কাঁঠাল, লিচু, জামরুলসহ মধুমাসের বিভিন্ন ফলের। কৃষিনির্ভর গ্রামবাংলা মেতে ওঠে উৎসব আমেজে। বৈচিত্র্যময় সমারোহে বসে বৈশাখী মেলা। এতে লোকগান, পুতুলনাচ, বায়োস্কোপ, নাগরদোলা, সার্কাস ইত্যাদি আকর্ষণ করে সবাইকে।
ঋতুবৈচিত্র্যের এ দেশে রুদ্রমূর্তির বৈশাখে প্রকৃতিতে থাকে ভিন্ন চেহারা। কালবৈশাখী আসে তীব্রবেগে। উড়িয়ে নিয়ে যায় অভাগীর জীর্ণ কুটির। উপকূলে বিপদ হয়ে আসে সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস। গ্রীষ্মের তাপদাহে তটস্থ হয় মানুষ। এ সময় আবহমান গ্রামবাংলার ছোট নদী, খালবিল, ডোবা শুকিয়ে যায়। কৃষকরা পড়েন বিপাকে। আবার এ সময়ে প্রকৃতি সাজে নতুন করে। তীব্র গরমে হাঁসফাঁস করা মানুষ একটু স্বস্তি পেতে আশ্রয় নেয় সবুজ প্রকৃতির শীতল ছায়ায়। একদিকে বৈশাখ খরতাপ ছড়ায়, অন্যদিকে প্রকৃতির প্রশান্তির শীতল ছোঁয়া দেয় পরম আনন্দ। বৈশাখ আসে নতুন করে সব গড়তে। শীর্ণ-জীর্ণতায় সবুজ সতেজ করে তুলতে। ‘নূতনের কেতন উড়ে’ কালবৈশাখীতে। একরাশ স্বপ্ন বুকে নিয়ে শুরু হয় নবজীবনের হিসাবনিকাশ। স্বপ্নমুখর বৈশাখের রং তাই একটু বেশিই উজ্জ্বল। প্রকৃতি সজীব সতেজ আর মানুষেরা প্রাণচঞ্চল।
সুহৃদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়