মন্ত্রীদের সরকারি গাড়ির যথেচ্ছ ব্যবহারের বদনাম বেশ পুরোনো। ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে সরকারি গাড়ি নিয়ে মন্ত্রীদের ‘বাহাদুরি’ সে সময় কুড়িয়েছিল তিরস্কার। সবকিছু আমূল বদলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা এখন একই পথের পথিক। সরকারি গাড়ি ব্যবহারে তারাও নিয়ম-নীতির ধার ধারছেন না। বিধি অনুযায়ী, উপদেষ্টাদের একটি করে সরকারি গাড়ি পাওয়ার কথা। ক্ষমতার অপব্যবহার করে কোনো কোনো উপদেষ্টা নিজের ও দপ্তরের নামে তিন থেকে চারটি সরকারি গাড়ি দখলে রেখেছেন। সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টা পরিবারের সদস্যরা সেই গাড়িতে সওয়ার হচ্ছেন। শুধু তাই নয়, উপদেষ্টার একান্ত সচিব (পিএস), সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস), জনসংযোগ কর্মকর্তারাও (পিআরও) কোনো কোনো ক্ষেত্রে গাড়ি হাঁকাচ্ছেন।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, জনগণের স্বার্থে অন্তর্বর্তী সরকার নিয়মের চর্চা প্রতিষ্ঠা করবে– এটিই সবার প্রত্যাশা। উপদেষ্টারা যেভাবে গাড়ি দেদার ব্যবহার করছেন, তা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

সমকালের অনুসন্ধান বলছে, অন্তর্বর্তী সরকারের ২২ উপদেষ্টার মধ্যে আটজন ছাড়া বাকি সবাই একাধিক সরকারি গাড়ি ব্যবহার করছেন। একমাত্র বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন সরকারি কোনো গাড়িতেই চড়েন না। সরকারি কাজে তিনি ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করেন। দায়িত্ব নেওয়ার পরই সরকারি যানবাহন অধিদপ্তর (পরিবহন পুল) থেকে একটি করে টয়োটা হাইব্রিড ক্যামরি গাড়ি বরাদ্দ পান সব উপদেষ্টা। দৈনিক ১৮ লিটার জ্বালানি তেলের সমপরিমাণ টাকাও পাচ্ছেন তারা। তবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কয়েকজন উপদেষ্টার পরিবারের সদস্য ব্যবহার করছেন বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থার প্রকল্পের দামি গাড়ি। এ জন্য বিভিন্ন দপ্তর থেকে জোগান দেওয়া হয়েছে একাধিক চালকও। এসব বাড়তি গাড়ির পেছনে চালক, জ্বালানি ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বাবদ গাড়িপ্রতি সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে প্রতি মাসে গচ্চা যাচ্ছে প্রায় লাখ টাকা।

১৯৭৩ সালের ‘দি মিনিস্টারস, মিনিস্টারস অব স্টেট অ্যান্ড ডেপুটি মিনিস্টারস (রেমিউনারেশন অ্যান্ড প্রিভিলেজেস)’ অ্যাক্টে স্পষ্ট বলা আছে, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীরা (বর্তমান উপদেষ্টারা মন্ত্রী মর্যাদার) সার্বক্ষণিক ব্যবহারের জন্য সরকারি একটি কার (গাড়ি) পাবেন। যার রক্ষণাবেক্ষণ খরচ জোগাবে সরকার। পরে সংশোধিত আইনে বলা হয়, জরুরি দাপ্তরিক কাজের জন্য কিংবা ঢাকার বাইরে নির্ধারিত কোনো সফরে গেলে অতিরিক্ত একটি জিপগাড়ি ব্যবহার করতে পারবেন। এসব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দপ্তর কিংবা সংস্থাকে জিপগাড়ি সরবরাহ করতে হবে। অথচ উপদেষ্টারা একাধিক গাড়ি কবজায় নিয়ে ইচ্ছামতো জ্বালানিতে অপ্রয়োজনে বা ব্যক্তিগত কাজে ঘুরছেন। এ সুযোগে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের গাড়িচালকরাও জ্বালানি কেনার পরিমাণ বেশি দেখিয়ে বাড়তি টাকা পকেটে পুরছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ ব্যাপারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক এবং দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড.

ইফতেখারুজ্জামান সমকালকে বলেন, রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় এবং নিয়মের ব্যত্যয় যাতে না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা এই সরকারের জন্য জরুরি। অন্তর্বর্তী সরকার এমন কিছু নজির স্থাপন করবে, যেটি পরে যে কোনো রাজনৈতিক সরকারের জন্য দৃষ্টান্ত হবে। আর যদি সেটি না করে একই ধারা অব্যাহত রাখে, তাহলে সেটি ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুঃখজনক হবে। এটি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। জনগণের স্বার্থে নিয়মের চর্চা প্রতিষ্ঠা করবে– এটাই অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সবার প্রত্যাশা। এ জন্য গাড়িসহ অন্য যে কোনো সুযোগ-সুবিধা ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিয়ম অনুযায়ী যেটি প্রাপ্য, এর বাইরে যেন অপব্যবহার না হয়, সেটি নিশ্চিত করা এই সরকারের দায়িত্ব।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার সমকালকে বলেন, অতীতের সংস্কৃতির মতো যদি এটা হয়ে থাকে, তাহলে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। জনগণের প্রত্যাশা, তারা অতীত সংস্কৃতি বর্জন করে কৃচ্ছ্রসাধন করবেন। কেউ ভুল করলে সেটি থেকে সরে আসবেন।   

কার কত গাড়ি
সরকারি গাড়ি ব্যবহারের দিক থেকে এগিয়ে আছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম। প্রভাব খাটিয়ে এই উপদেষ্টা দুটি সরকারি গাড়ি ব্যবহার করছেন। এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প থেকে নিয়েছেন একটি (ঢাকা মেট্রো-গ-১৪৫২৩৩), অন্যটি সরকারি পরিবহন পুল (ঢাকা মেটো-ভ-১১১৮৩৯) থেকে নেওয়া। পরিবহন পুলের গাড়িটি বেশির ভাগ সময় উপদেষ্টার পরিবারের কাজে ব্যবহার হয়। ওই গাড়ির চালক আলমগীর বলেন, উপদেষ্টা স্যারের চালক তিনজন। দু’জন স্যারের ডিউটি করি। আর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের চালক টিটু সবসময় স্যারের বাসায় ডিউটি করেন।

ফারুক-ই-আজমের দপ্তরের নামে বরাদ্দ নেওয়া হয়েছে আরও দুটি গাড়ি। সেগুলো তাঁর পিএস ও পিআরও ব্যবহার করছেন। এই মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালী পিএস লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) আবদুল গাফফারের ব্যবহারের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে একটি পাজেরো স্পোর্ট জিপ (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৮৫৫৫৮) আনা হয়েছে। মন্ত্রীর তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা এনায়েত হোসেনের জন্যও মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে নেওয়া হয়েছে একটি গাড়ি (ঢাকা মেট্রো গ-১৬৩২০৯)। পিএস ও পিআরওর চালকের বেতন থেকে শুরু করে যাবতীয় খরচ বহন করা হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে।
এ ব্যাপারে উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বলেন, ‘আমি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জিপটাই বেশি ব্যবহার করি। জ্বালানি খরচও মন্ত্রণালয় দেয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে দেওয়া পরিবহন পুলের গাড়িটা বাসায় থাকে।  দুজন চালক আছে।’ নিয়ম অনুযায়ী মন্ত্রণালয়ের গাড়ি এভাবে ব্যবহার করা যায় কিনা– এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি ওইভাবে দেখিনি। মন্ত্রণালয়ের সচিব দিয়েছেন, তাই ব্যবহার করছি।’  মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের গাড়ি পিএস-পিআরও ব্যবহারের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আগে থেকে যেভাবে ব্যবহার হয়ে আসছিল, সেভাবেই ব্যবহার হচ্ছে।’
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ একাই ব্যবহার করছেন তিনটি গাড়ি। এর মধ্যে পাজেরো স্পোর্ট বড় জিপ (ঢাকা মেট্রো ঘ- ১৪৭৪০৪), প্যারাডো (ঢাকা মেট্রো ঘ- ১৮৪৭৫৭) এবং পরিবহন পুল থেকে নেওয়া টয়োটা ক্যামরি। এসব গাড়ি উপদেষ্টা ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা মিলেমিশে ব্যবহার করছেন। অর্থ উপদেষ্টার পিএস ব্যবহার করেন জনতা ব্যাংকের একটি জিপ (ঢাকা মেট্রো গ-১৫৭২৮৭), সঙ্গে চালকও ফ্রি। 

যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের গাড়ি (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩৫৯১৫) ও পরিবহন পুলের ক্যামরি ব্যবহার করতেন। তাঁর পিএস ব্যবহার করতেন চালকসহ যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের গাড়ি। স্থানীয় সরকার বিভাগের দায়িত্ব পাওয়ার পর উপদেষ্টা সজীব (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩৯১০০) ও তাঁর পিএস (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৮৫৩২৮), এপিএস (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৮৫৩২৬) ব্যবহার করছেন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের গাড়ি ও চালক। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টার এপিএস মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘এপিএসদের গাড়ি ব্যবহার বৈধও না, অবৈধও না। কারণ, পদবি অনুযায়ী গাড়ি ব্যবহার করা যায় না। তবে যখন উপদেষ্টার জরুরি কাজ করতে হয়, তখন এই গাড়ি ব্যবহার করি। আবার উপদেষ্টার সঙ্গে থাকলে তাঁর গাড়িতেই উঠি।’
উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা ব্যবহার করছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্পের গাড়ি (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৮২২৮০) ও পরিবহন পুলের একটি টয়োটা ক্যামরি গাড়ি। তাঁর পিএস ব্যবহার করছেন আরেকটি গাড়ি (ঢাকা মেট্রো ঘ-২১৯২০৯)। এ ছাড়া খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার ব্যবহার করছেন খাদ্য অধিদপ্তরের প্রকল্পের গাড়ি (ঢাকা মেট্রো ঘ-১২৯৯২১) ও পরিবহন পুলের ক্যামরি। আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘আমি একজন উপদেষ্টা, মানে মন্ত্রী। আমি খাদ্য অধিদপ্তরের একটা জিপ ব্যবহার করছি, আর পরিবহন পুলের গাড়িটা বাসায় থাকছে।’ এতে নিয়মের ব্যত্যয় হচ্ছে কিনা– এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘকাল থেকে এটা হয়ে আসছে। সচিবরাও দুইটা করে গাড়ি ব্যবহার করছেন।’   

উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ ব্যবহার করছেন সমাজসেবা অধিদপ্তরের গাড়ি (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৫৯৪৯৬) এবং ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন চড়ছেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গাড়িতে (ঢাকা মেট্রো ঘ-২১০৪১১)। তাদের দু’জনের পুলের গাড়ি ব্যবহার করছেন পরিবারের সদস্যরা। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার ব্যবহার করছেন নম্বরহীন একটি জিপ গাড়ি। বাড়তি গাড়ির জন্য চালকের বেতন থেকে শুরু করে তেল খরচ সবই বহন করছেন উপদেষ্টা ও তাদের দপ্তরের কর্মকর্তারা।   
এদিকে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম শুধু পুলের একটি  গাড়ি বরাদ্দ নিলেও চালক পেয়েছেন দু’জন। তারা হলেন হাবিবুর রহমান ও সুকান্ত কুমার উজ্জ্বল। চালক হাবিবুর বলেন, ‘আমরা দুইজনই স্বাস্থ্য উপদেষ্টার ডিউটি করি।’ 
সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরের পরিবহন কমিশনার আবুল হাছানাত হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘আমরা ২২ উপদেষ্টাকেই একটি গাড়ি ও একজন চালক বরাদ্দ দিয়েছি। শুধু বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন পুলের গাড়ি নেননি।’ স্বাস্থ্য উপদেষ্টাকে দু’জন চালক দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পরিবহন পুলে চালক সংকট আছে। উপদেষ্টাদের একাধিক চালক দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’

উপদেষ্টাদের বাড়তি গাড়ি দেন সচিবরা 
আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীর নামে বরাদ্দ ছিল তিন থেকে চারটি গাড়ি। তবে ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ওইসব গাড়ি বিভিন্ন দপ্তরে জমা হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা দায়িত্ব নেওয়ার পর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবরা উপদেষ্টাদের সেসব গাড়ি নেওয়ার ব্যাপারে উৎসাহ জোগান। সচিবদের এমন প্রস্তাবে রাজি হয়ে অনেক উপদেষ্টা এখন বাড়তি গাড়ি ব্যবহার করছেন।
এ ব্যাপারে শিল্প মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব জাকিয়া সুলতানা বলেন, প্রকল্পের গাড়ি উপদেষ্টাদের দেওয়ার ব্যাপারে কাজ করেছে প্রশাসন শাখা। আগের মন্ত্রীরা প্রকল্পের এসব গাড়ি ব্যবহার করতেন, সেই নিয়মে বর্তমান উপদেষ্টাদের  তা দেওয়া হয়েছে।


 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: পর ব র র সদস য ব যবহ র করছ ন কল য ণ ট র স ট ব যবহ র করত উপদ ষ ট দ র ন উপদ ষ ট ব যবহ র র র ব যবহ র য উপদ ষ ট র উপদ ষ ট উপদ ষ ট র প রকল প র র প রকল প ক মন ত র মন ত র র র র জন য সরক র র র পর ব র প এস সব গ ড় এক ধ ক প আরও র একট

এছাড়াও পড়ুন:

আঠারো শতকের সুফি কবি ও সংগীতজ্ঞ সৈয়দ খাজা মীর দর্দ

আবদালি মারাঠিদের উৎপাত ও অত্যাচারে অন্য কবিরা যখন একে একে দিল্লি ছেড়ে লক্ষ্ণৌ চলে গিয়েছিলেন, তখনো প্রিয় শহর দিল্লি ছাড়েননি সৈয়দ খাজা মীর দর্দ (১৭২০-১৭৮৪ খ্রি.), বরং আমৃত্যু সেখানেই থেকে গিয়েছিলেন। লক্ষ্ণৌয়ে অবস্থানকারী কবিদের কাব্যবৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তাঁর কবিতার যে পার্থক্য ছিল, শুধু সে কারণেই তিনি সেই জায়গায় যাননি তা নয়, তাঁর আত্মমর্যাদাবোধ ছিল প্রখর, কারও তারিফ করে কখনো কসিদা লিখেছেন বলে শোনা যায়নি, সর্বোপরি তাঁর জীবনদর্শনও ছিল সমকালিক অন্য কবিদের থেকে আলাদা। মধ্যযুগের যে সময়টায় মীর দর্দের জন্ম, সেই সময় উর্দু সাহিত্যে ‘মীর-সওদার যুগ’ বলে পরিচিত—এই দুই কবি পারস্য কবি খাজা শামসুদ্দিন হাফিজ সিরাজি ও শেখ মোসলেহ উদ্দিন সাদির পথ অনুসরণ করে ফারসি কবিতার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ধারাকে উর্দু কবিতার ধারায় যুক্ত করেন এবং সফল হন। মির্জা রফী সওদার চেয়েও সাত বছরের অগ্রজ মীর দর্দ এই সবকিছুই নিবিড়ভাবে লক্ষ করেছেন, পারস্য ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ ভান্ডার থেকে অনেক কিছু গ্রহণও করেছেন, তবু আমাদের ধারণা, পারিবারিক বংশধারার প্রভাবেই তাঁর জীবনদর্শন ও কাব্যচিন্তা শুরু থেকেই ভিন্ন ছিল।

মধ্যযুগের যে সময়টায় মীর দর্দের জন্ম, সেই সময় উর্দু সাহিত্যে ‘মীর-সওদার যুগ’ বলে পরিচিত—এই দুই কবি পারস্য কবি খাজা শামসুদ্দিন হাফিজ সিরাজি ও শেখ মোসলেহ উদ্দিন সাদির পথ অনুসরণ করে ফারসি কবিতার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ধারাকে উর্দু কবিতার ধারায় যুক্ত করেন এবং সফল হন।

মাহমুদ আলী খান জামী তাঁর ‘দর্দ কে সো শের’ (প্রকাশকাল: ১৯৫৫ খ্রি., দিল্লি) গ্রন্থে লিখেছেন, খাজা মীর দর্দের দাদা বাদশাহ আলমগীরের শাসনামলে বুখারা থেকে এ দেশে এসেছিলেন, আর বাবা খাজা মাহমুদ নাসির আন্দালিব ছিলেন ‘শায়েরে উর্দু’ এবং ব্যক্তিগত জীবনে একজন সুফি। ভিন্ন মতে, তাঁর বাবার নাম (মাহমুদ নাসির নয়) মুহাম্মদ, আর তিনি উর্দু ভাষার কবি ছিলেন না, ছিলেন ফারসি ভাষার কবি। এঁরা ছিলেন নকশবন্দী ঘরানার পথিকৃৎ খাজা বাহাউদ্দিনের বংশধর ও অনুসারী। সুফি পরম্পরার মধ্যে বেড়ে উঠেছিলেন বলেই মাত্র বাইশ বছর—ভিন্ন মতে, সাতাশ বছর বয়সে জাগতিক মোহ ত্যাগ করে সুফি শুদ্ধাচারী হয়ে ওঠেন দর্দ এবং সুফি তত্ত্বসংক্রান্ত একাধিক বই লেখেন। ফলে তিনি যখন শের ও গজল লেখেন, তখন সেগুলোতে স্বভাবগত কারণেই সুফি মরমি কবিতার সহজগভীর ভাবের ছায়া পড়েছে। নিচে দর্দ কে সো শের বই থেকে—অন্যত্র গজলরূপে গণ্য এবং গীত—প্রথম ৩টি শের পড়লে এ কথার সত্যতা মিলতে পারে :

তোহমতে চন্দ অপনে জিম্মে ধর চলে
জিস লিয়ে আয়ে থে হম সো কর চলে
জিন্দেগি হ্যয় য়া কোই তোফান হ্যয়
হম তো ইস জিনে কে হাথোঁ মে মর চলে
শমা কে মানিন্দ হম ইস বজম মে
চশম নম আয়ে থে দামন তর চলে

অর্থাৎ :

কত অপবাদ বয়ে নিয়ে আমি চলছি
অথচ যে কারণে এসেছি তা–ই করে গেছি
এ কোনো জীবন, নাকি তুফান
তার হাতেই তো আমি মারা যাব
এই সভার প্রদীপ ছিলাম আমি
এখন আমার চোখের জলে আঁচল ভিজে যায়

[অনুবাদ: লেখক]

অল্প বয়স থেকে যিনি এমন ভাবনায় তাড়িত, তাঁর গজলে এই প্রভাব পড়াটাই স্বাভাবিক। সুফি কবি ও সাধক হিসেবে স্বীকৃত হলেও গজলকার হিসেবে যেরকম গণ্য হননি খাজা মঈন উদ্দিন চিশতি, ঠিক একই কারণেই গজলকার হিসেবে কেউ কেউ তাঁর নাম সমকালের মীর তকী মীর ও মির্জা রফী সওদার কাতারে রাখতে কুণ্ঠিত। অবশ্য এ ক্ষেত্রে খোদ মীর তকী মীরের একটি মন্তব্য আছে, যা অনেকেই উদ্ধৃত করেন, তা হলো: তিনি নাকি আড়াইজন কবিকে সবিশেষ গুরুত্ব দিতেন, যার মধ্যে একজন তিনি নিজে, অন্যজন মির্জা রফী সওদা আর অর্ধজন হলেন খাজা মীর দর্দ।

তাঁর এমন সহজগভীর ভাষার জন্য বোধ হয় বেশ কিছু অনুসারী তৈরি হয়েছিল, যাঁরা নিয়মিত তাঁর মাহফিলে আসতেন। শুধু ভাবশিষ্যরাই নন, সংগীতশাস্ত্রে পারদর্শী খাজা মীর দর্দ মর্যাদার ক্ষেত্রে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন যে তাঁর পাক্ষিক আসরে অনুরাগী হিসেবে কখনো কখনো বাদশাহ শাহ আলমও আসতেন।

শের ও গজলের ক্ষেত্রে মীর তকি মীর শেষমেশ যে উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন সেই জায়গা থেকে বিচার করে তাঁর এই কথাটিকে সদর্থে ধরে নিলে কবিতায় খাজা মীর দর্দের অবদানকে বিশেষভাবে মূল্যায়ন না করে উপায় নেই। আসলে পারস্য কবিতার ঐতিহ্য ধারণ করে উর্দু গজলে যখন পরবর্তীকালের জনপ্রিয় বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নারীর সঙ্গে আলাপের আবহ তৈরি হচ্ছে, খাজা দর্দ তখন একই উৎস থেকে গ্রহণ করেছিলেন সুফি ঐতিহ্য। সমালোচকদের মতে, তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ‘দিওয়ান-এ উর্দু’, কিন্তু তাঁর ‘শমা-এ মহফিল’, ‘আহ-এ দর্দ’, ‘দর্দ-এ দিল’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের প্রাঞ্জল ভাষা ও সুফিহৃদয়ের ভাব সেই সময় ও পরবর্তীকালের কবিদেরকেও প্রভাবিত করেছে। তাঁর একটি অনবদ্য শের হলো: ‘তমান্না তেরি হ্যাঁয় অগর হ্যাঁয় তমান্না/ তেরি আরজু হ্যায় অগর আরজু হ্যায়’ অর্থাৎ, আকাঙ্ক্ষা যদি থাকে, তা তোমারই আকাঙ্ক্ষা/ আশা তোমার জন্য, আদৌ আশা বলে যদি কিছু থাকে’। প্রেমের এমন একনিষ্ঠ নিবেদন খাজা দর্দের শেরেই পাওয়া সম্ভব। নিচে পড়ে নিতে পারি তাঁর আরও একটি জনপ্রিয় শের:

হাজারোঁ খওয়াহিশেঁ অ্যায়সি কে হর খওয়াহিশ পে দম নিকলে
বহুত নিকলে ম্যারে আরমান ল্যাকিন পির ভি কম নিকলে

অর্থাৎ :

এমন হাজার বাসনা আমার, যার প্রতিটি বাসনার জন্য প্রাণ ওষ্ঠাগত
কিছু আকাঙ্ক্ষা পূরণ হলো বটে; কিন্তু তা খুবই সামান্য

তাঁর এমন সহজগভীর ভাষার জন্য বোধ হয় বেশ কিছু অনুসারী তৈরি হয়েছিল, যাঁরা নিয়মিত তাঁর মাহফিলে আসতেন। শুধু ভাবশিষ্যরাই নন, সংগীতশাস্ত্রে পারদর্শী খাজা মীর দর্দ মর্যাদার ক্ষেত্রে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন যে তাঁর পাক্ষিক আসরে অনুরাগী হিসেবে কখনো কখনো বাদশাহ শাহ আলমও আসতেন।

আরও পড়ুনএকাদশ শতকের সুফি কবি হাকিম সানায়ি গজনভি২৮ আগস্ট ২০২৫

মীর দর্দের এমন উচ্চাসনে পৌঁছার অন্য একটি কারণ হলো, তাঁর জন্মের বহু আগে থেকেই গান শোনা ও তার চর্চা বিষয়ে যে তর্ক-বিতর্ক চলে আসছিল, সে বিষয়ে তাঁর সবিস্তার আলোচনা এবং গানবিষয়ক গান লেখার উদাহরণ। আমাদের অজানা নয়, গান বিষয়ে কওয়ালির প্রতিষ্ঠাতা আমির খসরুর একাধিক বাণী আছে, যেমন: ‘গান হলো আত্মার খোরাক’, ‘দরবেশের কাছে গান হলো ঐশ্বরিক জ্যোতির সমতুল’ ইত্যাদি, আর দর্দ লিখেছেন: ‘অগর ঘিনা নফস কো বড়্কায়ে তো হারাম, অগর দিল কো ইলাহ কি তরফ নরম করে তো হালাল’ অর্থাৎ গান যদি মনকে প্রবৃত্তিতাড়িত হতে উসকে দেয় তাহলে হারাম, আর স্রষ্টামুখী করলে হালাল’। এ বিষয়ে দর্দের যে শের রয়েছে, সেটি আরও সুন্দর :

সামা’ আহলে দিল কো হ্যা সোদমন্দ দর্দ
কে ইস সে নরম হোতা হ্যা পাত্থর কা দিল ভি

অর্থাৎ :

হৃদয়বান মানুষের জন্য গান উপকারী, হে দর্দ
কারণ পাথরের মতো হৃদয়ও তাতে গলে যায়।

উল্লেখ্য যে, গান বিষয়ে আলোচনা করবার সময় এ অঞ্চলের গবেষক ও সুফি-বাউল-ফকিরেরা ইমাম গাজ্জালি, মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি ও আমির খসরুর বইয়ের তথ্যের উল্লেখ করেন, কিন্তু প্রকাশ ও প্রচারের অভাবে কোথাও সৈয়দ খাজা মীর দর্দের কথা পাওয়া যায় না। জাভেদ হুসেন দর্দের কয়েকটি গজল অনুবাদ করতে গিয়ে তার ভূমিকায় লিখেছেন: ‘দর্দ ছিলেন একজন বড় সংগীতজ্ঞ। সুফি সাধনায় সংগীতের ভূমিকা নিয়ে হুরমতে ঘিনা নামে পুস্তিকা লিখেছেন। উর্দু গজলের গীতিময়তা আজ দেখা যায় তাতে দর্দের ভূমিকা ব্যাপক ও গভীর।’ এই পুস্তিকাটি দুর্লভ, ভবিষ্যতে এটি অনূদিত হলে শায়ের ও গজলকার মীর দর্দের পাশাপাশি সংগীতচিন্তক হিসেবে তাঁর পরিচয়টাও আমরা জানতে পারব।

অন্য আলো–য় লিখতে পারেন আপনিও। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধসহ আপনার সৃজনশীল, মননশীল যেকোনো ধরনের লেখা পাঠিয়ে দিন। পাঠাতে পারেন প্রকাশিত লেখার ব্যাপারে মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়া।
ই–মেইল: [email protected]

সম্পর্কিত নিবন্ধ