মানুষ কি প্রেমে পড়ার পর কবি হয় নাকি কবি হওয়ার পর প্রেমে পড়ে? ব্যাপারটা হয়তো এ রকম, খ্যাতিমান লেখক হওয়ার আগের প্রেমের খবর রাখে না কেউ, নামজাদা লেখক হলেই প্রেম হয়ে ওঠে আলোচনার খোরাক। প্রেম কবি-লেখকের জন্য যেমন হয়ে উঠতে পারে অনুপ্রেরণার উৎস, তেমনই ডেকে আনতে পারে বিপর্যয়। আমাদের সর্বক্ষেত্রে অপরিহার্য রবীন্দ্রনাথের বড় কোনো উল্লেখযোগ্য প্রেমকাহিনি নেই, তারপরও পৃথিবীর সব কবির হয়ে প্রেমের শাশ্বত রূপের কথা লিখেছেন তিনি: ‘আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি/ যুগল প্রেমের স্রোতে/ অনাদিকালের হৃদয়-উৎস হতে।/.
রবীন্দ্রনাথের জীবনে প্রেম কি একেবারেই আসেনি? কাদম্বরী দেবী, আনা তড়খড় কিংবা বিদেশিনী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্ভাব্য সম্পর্কের কথা কেবল আভাসে-ইঙ্গিতেই বলা হয় প্রমাণহীনভাবে। আনা তড়খড়ের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দুই মাসের সান্নিধ্যের সময় তাঁদের মধ্যে প্রকৃত প্রেমের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল কি না, সেটি তথ্যপ্রমাণসহ বলা না গেলেও রবিজীবনীকারদের ইঙ্গিতটা সেদিকেই। পূরবী কাব্যগ্রন্থের ‘ক্ষণিকা’ কবিতার ‘গোধূলিবেলার পান্থ জনশূন্য প্রান্তরে’, ‘তার ভীরু দীপশিখা’ নিয়ে দিগন্তের অজানা পারে চলে যাওয়া ‘ক্ষণিকা’ই যে আনা, সেটিও গবেষকদের ধারণা। একই গ্রন্থের ‘বিদেশি ফুল’ কবিতাটি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে নিয়ে লেখা হলেও হতে পারে। তবে যে পূরবী কাব্যগ্রন্থে আনা তড়খড় ও ওকাম্পোকে নিয়ে লেখা বলে অনুমিত কবিতা গ্রন্থিত হয়েছে, গ্রন্থটিও উৎসর্গ করা হয়েছে জনৈকা ‘বিজয়া’কে, যে নামে ওকাম্পোকে ডাকতেন রবীন্দ্রনাথ। কিংবা কাদম্বরী দেবীকে নিয়ে লিপিকার ‘কৃতঘ্ন শোক’ অথবা কড়ি ও কোমল-এর ‘কোথায়’ কবিতা দুটিকে আমরা কীভাবে নেব?
রবীন্দ্রনাথ-ওকাম্পো প্রসঙ্গে এসে যায় সমিল আরেকটি ঘটনা। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের বহু প্রেম ও প্রেমিকার মধ্যে সবচেয়ে অসম বয়সী অনুমিত সম্পর্কটি ছিল আদ্রিয়ানা ইভানচিচের সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ ও ওকাম্পোর মধ্যে বয়সের পার্থক্য ছিল উনত্রিশ বছর, আর হেমিংওয়ের সঙ্গে আদ্রিয়ানার একত্রিশ। হেমিংওয়ের মধ্যে আদ্রিয়ানার জন্য যে পরিমাণ আকুলতা দেখা যায়, রবীন্দ্রনাথের তপস্বীর মতো আচরণে সে রকম কিছুই ছিল না, বরং বিষয়টি ছিল ঠিক বিপরীত, ওকাম্পোরই বরং অমোঘ আকর্ষণ ছিল ভারতীয় এই কবির প্রতি। ওকাম্পোকে লেখা চিঠির নিচে যে ভালোবাসার কথা লিখতেন রবীন্দ্রনাথ, তার মধ্যেও বোধ করি ছিল না কোনো অনৌচিত্যবোধ।
হেমিংওয়ের জীবনে যতবার প্রেম এসেছে, তার তুলনা বিরল। প্রেমকাতুরে এই লেখক নিজেকে জড়িয়েছেন একের পর এক নারীর সঙ্গে। তাঁদের মধ্যে চারজনের সঙ্গে স্থাপিত হয়েছিল বৈবাহিক সম্পর্ক। মূলত কৈশোরোত্তীর্ণ বয়স থেকেই নানান বয়সী মেয়েদের সঙ্গে ছিল তাঁর প্রেমের সম্পর্ক। বিবাহিত জীবনেও আটপৌরে হয়ে যাওয়া দাম্পত্য সম্পর্কের ফাটল গলে আবির্ভূত হয়েছেন প্রেমাস্পদা নারীরা। ১৮ বছর বয়সে প্রেমকাতুরে হেমিংওয়ের জীবনে প্রথম প্রেমিকার আগমন ঘটে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আহত হওয়ার পর ইতালির যে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, সেখানকার এক নার্স অ্যাগনেস কুরোওস্কির প্রেমে পড়েন হেমিংওয়ে। স্বল্পস্থায়ী সেই প্রেমের করুণ সমাপ্তির আগে ও পরে তাঁর জীবনে একে একে আসেন মার্জোরি বাম্প, কেট স্মিথ, গ্রেস কুইনল্যান, আইরিন গোল্ডস্টেইন, পলিন স্নো, ফ্রান্সেস কোটস ও ক্যাথরিন লংওয়েল নামের নারীরা। তারপর আবারও তিনি প্রেমে পড়েন তাঁর চেয়ে আট বছরের বড় হ্যাডলি রিচার্ডসনের। প্রেম থেকে দাম্পত্যে গড়ানো এই সম্পর্কের পাঁচ বছরের মাথায় হেমিংওয়ের জীবনে প্রেমিকা ও পরে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে আসেন ভোগ ফ্যাশন ম্যাগাজিনের সাংবাদিক পলিন ফেইফার। পলিন ও হেমিংওয়ের দ্বিতীয় পুত্রসন্তানের জন্মের পর দুজনের মধ্যে শারীরিক দূরত্ব বৃদ্ধি পেলে বাইশ বছরের তরুণী সোনালি চুল আর ডাগর নীলাক্ষির দীর্ঘাঙ্গী জেন ম্যাসনের মধ্যে হেমিংওয়ে খুঁজে পান তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারঙ্গম আর এক রমণীকে, তবে এই সম্পর্ক বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়নি। এবার তাঁর নতুন প্রেমিকা হয়ে আসেন সাংবাদিক মার্থা গেলহর্ন। তাঁদের দাম্পত্য সম্পর্কের স্থায়িত্ব ছিল পাঁচ বছর। প্রেমিকা মেরি ওয়েলশ এসেছিলেন তাঁর চতুর্থ ও সর্বশেষ স্ত্রী হয়ে। হেমিংওয়ে ও মেরির জীবনের কিউবা পর্বে লিওপোল্ডিনা রড্রিগেজ নামের এক নারীর সঙ্গে হেমিংওয়ের বিশেষ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এঁরা ছাড়া হেমিংওয়ের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কের কানাঘুষা ছিল পেইন্টার জেরাল্ড মারফির স্ত্রী সারাহ, ব্যারন ফন ব্লিক্সেনের স্ত্রী ব্যারনেস ইভা ব্লিক্সেন, জার্মান অভিনেত্রী মার্লিন দিয়েত্রিচকে নিয়ে। প্রায় অর্ধেক বয়সী আদ্রিয়ানা ইভানচিচও এ সময়ের মানসী। হেমিংওয়ের জীবনে আসা নারীদের দীর্ঘ তালিকার তুলনায় এত নারীর প্রেমে রমণীয় ছিল না অন্য লেখকদের জীবন।
তবে হেমিংওয়ের ৬২ বছরের জীবনে যে কজন নারী এসেছিলেন, সে হিসাবে মায়াকোভস্কির ৩৬ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে আসা কমপক্ষে পাঁচজন প্রেমিকাকেও নেহাত কম বলা যায় না। ২০ বছর বয়সে তাঁর জীবনে প্রথম আসা এলসা ত্রিয়োলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা–পরবর্তী জীবনে ঢাকা পড়ে যায় এলসার বড় বোন লিলিয়া ব্রিকের প্রেমে। এমনকি মায়াকোভস্কির সঙ্গে লিলিয়ার শারীরিক সম্পর্কের কথা জানার পরও সব মেনে নিয়েছিলেন লিলিয়ার স্বামী রুশ লেখক ওসিপ ব্রিক। বাকি জীবন এই দম্পতির সঙ্গে যুক্ত থেকেও একের পর এক নারীর প্রেমে পড়েছেন মায়াকোভস্কি। তাঁর সঙ্গে বহুভাষী অনুবাদক ও ফ্যাশন মডেল এলি জোনসের পরিচয় ঘটে ১৯২৫ সালে নিউইয়র্কে। দেড় বছরের সেই ভালোবাসার ফসল হিসেবে মায়াকোভস্কি রেখে গেছেন এক কন্যাসন্তান, প্যাট্রিসিয়া টমসন, রাশিয়ায় যিনি পরিচিত ইয়েলেনা ভ্লাদিমিরনোভা মায়াকোভস্কায়া নামে। বাবা–মায়ের সম্পর্ক নিয়ে একটা বইও লিখেছেন প্যাট্রিসিয়া।
তাতিয়ানা ইয়াকোভলেভার সঙ্গে মায়াকোভস্কির পরিচয় হয় ১৯২৮ সালে প্যরিসে এবং প্রথম দেখায়ই প্রেম। মায়াকোভস্কির প্যারিসবাসের মাসাধিককালের অধিকাংশ সময় কেটেছে তাতিয়ানার সান্নিধ্যে। মায়াকোভস্কির কবিতায় তাতিয়ানার উপস্থিতি টের পাওয়ার পর লিলিয়া বুঝতে পারেন সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বীর পাল্লায় পড়েছেন তিনি। অবশ্য তত দিনে লিলিয়ার সঙ্গে কবির প্রেমে ফিকে হয়ে এসেছে শরীর, রয়ে গেছে কেবল বন্ধুত্বের সম্পর্ক। একসময় রাশিয়ায় ফিরতে আসতে হয় মায়াকোভস্কিকে। তাতিয়ানাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার বহু চেষ্টা করলেও রাজি হননি এই নারী। দেশে ফেরার আগে প্যারিসের এক ফুলের দোকানে বেশ কিছু টাকা অগ্রিম দিয়ে গিয়েছিলেন মায়াকোভস্কি, যাতে প্রতি রোববার তাতিয়ানার কাছে তাঁর নামে একটা করে ফুলের তোড়া পাঠানো হয়। এমনকি মায়াকোভস্কির মৃত্যুর পরও তাতিয়ানার কাছে সাপ্তাহিক ফুল পাঠানো অব্যাহত ছিল বহুদিন।
মায়াকোভস্কির শেষ প্রেম ১৯২৯ সালে বিখ্যাত অভিনেত্রী ভেরোনিকা পোলোনোস্কায়ার সঙ্গে। পরের বছরই নিজ বাড়িতে আত্মহত্যা করেন কবি। ধারণা করা হয়, স্বামীকে ছেড়ে আসতে ভেরোনিকার অস্বীকারই মায়াকোভস্কিকে প্ররোচিত করেছিল আত্মহননে।
গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের বয়স যখন চৌদ্দ, তখনই তাঁর ভালো লেগে গিয়েছিল নীল নদের সাপের মতো গোপন সৌন্দর্যে ভরপুর নয় বছরের কিশোরী মার্সেদেস বার্চাকে। সেই ভালো লাগা থেকে প্রণয়ের একপর্যায়ে ১৮ বছরের মার্কেস ১৩ বছরের মার্সেদেসকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এই প্রণয় শেষাবধি পরিণয়ে পরিণত হয়। মার্সেদেসের সঙ্গে প্রেমপর্বের আগে আরেকজন প্রেমিকা ছিলেন মার্কেসের। আত্মজীবনীতে মার্তিনা ফনসেকা নামের এক বিবাহিতা নারীর কথা অকপটে লিখেছেন মার্কেস। মার্কেসের তখন কৈশোরোত্তীর্ণ বয়স। নাবিক স্বামীর অবর্তমানে এই নারী তাঁকে দিয়েছিলেন অসম বয়সের প্রেম ও শরীরের দীক্ষা। কিশোর প্রেমিকের পড়াশোনার দেখভালও করতেন মার্তিনা, ফলে পরীক্ষায় খুব ভালো ফল করেছিলেন মার্কেস। অবশেষে একসময় মার্তিনাই ছেড়ে গিয়েছিলেন তাঁকে। সেই ধাক্কা সইতে বেশ কষ্ট হয়েছিল কিশোর প্রেমিকটির। মার্কেসের মৃত্যুর পর উদ্ঘাটিত হয়, সুসানা কাতো নামে মার্কেসের এক গোপন প্রেমিকা ছিলেন। ইন্দিরা কাতো নামে তাঁদের বিবাহবহির্ভূত এক কন্যাও আছে। উল্লেখ্য, সুসানা ছিলেন মার্কেসের চেয়ে ৩৩ বছরের ছোট।
ইংরেজ কবি পি বি শেলির ঘটনাটা আরও জটিল। উনিশ বছর বয়সে ষোলো বছরের হ্যারিয়েট ওয়েস্টব্রুককে নিয়ে স্কটল্যান্ডে পালিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তিন বছরের মাথায় হ্যারিয়েট যখন সন্তানসম্ভবা, তখন আবারও শেলি ইউরোপে পালিয়ে যান মেরি ওলস্টোনক্রাফটকে নিয়ে। কিছুদিন পর এক ছেলের মা হন হ্যারিয়েট। কিন্তু স্বামীর এই বিশ্বাসঘাতকতা সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেন তিনি। এবার মেরিকে বিয়ে করার পথে আর বাধা থাকে না। হ্যারিয়েটের মৃত্যুর তিন সপ্তাহের মধ্যেই শেলি বিয়ে করেন মেরিকে। তবে এই দুর্দমনীয় প্রেমের মাধুরী উপভোগ করতে পারেননি শেলি। মেরির ঘরে তাঁর চার সন্তানের মধ্যে তিনজনই অকালে মারা যায়। শেলি নিজেও নৌকাডুবিতে মারা যান ত্রিশ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই।
সিমন দ বুভোয়ার মেধায় আকৃষ্ট হয়ে জ্যঁ পল সার্ত্রে প্রেমে পড়েছিলেন তাঁর। তবে তাঁদের মধ্যকার সম্পর্কটা ছিল ভিন্নতর, ছাঁদনাতলায় না গেলেও পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধনহীন জীবনে একধরনের আত্মিক বিবাহবন্ধনে কাটিয়েছিলেন তাঁরা।
প্রেমের শাশ্বত রূপ কবিদের রচনায় থাকলেও তাঁদের জীবনেই কখনো নেমে আসে অপূর্ণতার গুরুভার যন্ত্রণা। তা না হলে সিলভিয়া প্লাথের মাত্র একত্রিশ বছরের জীবন এভাবে তছনছ হয়ে যায় না। কবি টেড হিউজের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর দুর্নিবার প্রেমের পূর্ণতা পাওয়ার আগেই কয়েক মাসের মাথায় ঘর বাঁধেন এই কবি দম্পতি। ছয় বছর পর টেড-সিলভিয়াদের বাড়ি ভাড়া নেন জার্মান কবি আসিয়া ওয়েভিল এবং তৃতীয় স্বামী ডেভিড ওয়েভিল। আসিয়াকে দেখে প্রেমে পড়ে যান টেড। তাঁর কবিতা ‘ড্রিমার্স’-এ খোলাখুলিভাবে এই জার্মান সুন্দরীর কথা লিখেছেন, ‘আমার ভেতরের স্বপ্নবাজটি প্রেমে পড়ে যায় তার।’ সিলভিয়া তখন দুই সন্তানের মা। ঘর বাঁধতে তাঁদের যেমন দেরি হয়নি, ভাঙতেও সময় লাগেনি। বছর না ঘুরতেই রান্নাঘরের গ্যাস খুলে দিয়ে আত্মহত্যা করেন সিলভিয়া প্লাথ। আসিয়াকে বিয়ে না করলেও তাঁর গর্ভে এক কন্যাসন্তান ছিল টেডের। সিলভিয়ার আত্মহননের ছয় বছর পর আসিয়াও হিউজের কন্যাসন্তানটিকে নিয়ে একই কায়দায় গ্যাস দিয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলেন।
পাশ্চাত্য বিশ্বের লেখকদের জীবনের প্রেম অনেক উদ্দাম ও বৈপ্লবিক হলেও আমাদের অপেক্ষাকৃত রক্ষণশীল সমাজে এ রকম দৃষ্টান্ত বিরল নয়। মাইকেল মধুসূদনের প্রথম প্রেম ছিল রেবেকা ম্যাকটিভিস নামে এক ইংরেজ যুবতীর সঙ্গে। সাত বছরের দাম্পত্য জীবন কাটিয়ে তাঁদের বিচ্ছেদ ঘটে, তারপর বিয়ে করেছিলেন এমিলিয়া আঁরিয়েতা নামের এক ফরাসি রমণীকে।
কবি নজরুলের জীবনের প্রথম নারী ছিলেন নার্গিস। কিন্তু একটি রাতও কাটানোর আগে শেষ হয় তাঁদের দাম্পত্য জীবন। তারপরের প্রেম ফজিলাতুন্নেসা। রানু সোম, কানন দেবী—এঁদের সঙ্গে সত্যিকার প্রেমের সম্পর্ক বিষয়ে কোনো তথ্যপ্রমাণ নেই। শেষাবধি পরিণয়ে রূপ পেয়েছিল প্রমীলা সেনগুপ্তার সঙ্গে নজরুলের প্রণয়।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মার্গারিট এবং জীবনের পরবর্তী পর্বে স্বাতীর কথা বাংলাভাষী পাঠকদের অনেকেরই জানা। হুমায়ূন আহমেদে আর গুলতেকিন এবং তারপর শাওনের সঙ্গে প্রেম ও বিয়ের কথা জানেন না, এমন মানুষ বাংলাদেশে খুব কমই আছে। উড়নচণ্ডী কবি আবুল হাসান আর সুরাইয়া খানমের পবিত্র প্রেম ছিল কবির প্রতি কবির মুগ্ধতার বহিঃপ্রকাশ। আর অপূর্ণ প্রেমের নায়িকা হেলেনকে ভালোবেসেই একটা পুরো জীবন নিঃসঙ্গ কাটিয়ে গেছেন কবি হেলাল হাফিজ।
কবি-লেখকদের জীবনে অপূর্ণ প্রেম বা বিরহের যন্ত্রণাই কি তাঁদের সৃষ্টির প্রসববেদনা হয়ে ওঠে? এ রকম ধারণার কোনো ভিত্তি আদৌ আছে কি না, সেটি গবেষণাসাপেক্ষ। তবে যে রবীন্দ্রনাথ ‘যুগল প্রেমের স্রোতে নিখিলের সুখ’ দেখতে পান, তিনিই আবার লেখেন, ‘এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না, শুধু সুখ চলে যায়।’
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র এক ন র দ র জ বন বছর র ম জ বন র হয় ছ ল ত হয় ছ ত রপর হওয় র র বয়স শ বছর প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
শিক্ষা আন্দোলনের চেতনা বনাম রাষ্ট্রের নীরবতা
পূর্ববঙ্গের ভাষা আন্দোলনের ওপর দাঁড়িয়ে ইতিহাস আমাদের প্রভূত জাতীয়তাবাদী শক্তি দিয়েছে। ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পুরোনো ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদের’ নতুন মোড়ক জন্ম দিয়েছিলেন পূর্ববঙ্গের মানুষ, যা তাঁরা ১৯০৫-১৯১১ সাল পর্যন্ত গ্রহণ করেননি; কিন্তু ১৯৪৮ সালের পর সেই জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে গ্রাহ্য করা জরুরি ছিল।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ হয়ে উঠল পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক ও সাম্প্রদায়িক ‘ডমিনেন্ট হেজিমনি’র বিপরীতে নিপীড়িত জাতিসত্তার কণ্ঠস্বর। এই প্রভাব বাংলাদেশকে জাতিরাষ্ট্র হিসেবে জন্ম দিলেও ভাষা আন্দোলন আমাদের পাঠ্যপুস্তকীয় ইতিহাসে শুধু ‘বায়ান্ন’ ও ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’তে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। এটা রাষ্ট্রই সুচারুভাবে গড়ে তুলেছে। কেননা, এতে তার তথাকথিত উদারবাদী রাজনীতির এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা সহজ হয় এবং ক্ষতিগ্রস্ত করা যায় প্রতিরোধের রাজনীতিকে।
রাষ্ট্রের এই রাজনীতির সবচেয়ে বড় বলি হয়েছে ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলন, মুখ্যত বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারিকে যে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়েছে এ রাষ্ট্রে, শিক্ষা আন্দোলন প্রসঙ্গে তার সিকিভাগ বিদ্যায়তনিক মনোযোগও দেওয়া হয়নি। অথচ ভিন্ন আলাপ তুললে ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন মূলত ভাষা আন্দোলনের যে প্রতিরোধ, সেটিরই একটি পরিবর্ধিত রূপ এবং প্রাথমিক পূর্ণতার জন্মদাতা।
আমাদের পাঠ্যপুস্তকে এই গৌরবগাথার বয়ান পাবেন মাত্র এক অনুচ্ছেদ। এই দ্বিচারিতার পেছনেও অন্য এক রাজনীতি আছে। সত্য এই যে ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান হয়ে বাংলাদেশ অর্জন পর্যন্ত; কিন্তু নতুন দেশে শিক্ষাব্যবস্থা যতটা সর্বজনীন ও বি–উপনিবেশিত করা উচিত ছিল, সেদিকে রাষ্ট্র ও সরকারগুলোর যথাযথ আগ্রহ আজও নেই।
কেন হয়েছিল শিক্ষা আন্দোলনব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার পথ ধরেছিল পাকিস্তানের সামরিক আমলাতন্ত্র ও অভিজাততন্ত্রী শাসকগোষ্ঠী। ঔপনিবেশিক মনোজগৎ নিয়েই ১৯৫৯ সালের ৫ জানুয়ারি গঠিত হয়েছিল পাকিস্তানের শিক্ষা বিভাগের সচিব এস এম শরীফের নেতৃত্বাধীন শিক্ষা কমিশন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভাবাদর্শে শিক্ষাকে গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষায় শরীফ শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদন জমা দেয়। মাত্র আট মাসে প্রস্তুত সেই প্রতিবেদন প্রত্যাঘাতের ভয়ে প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালে। প্রকাশিত হওয়ার পরপরই পূর্ববঙ্গ আবার ফুঁসে ওঠে। ভেঙে ফেলে আইয়ুব শাহির রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকা সময়ের কঠিন-কঠোর মার্শাল ল। কেন? এর গুরুত্বটা অনুধাবন করা প্রয়োজন।
প্রতিবেদনের সুপারিশে শরীফ কমিশন প্রথমত বলেছিল, উর্দু হবে পাকিস্তানের শিক্ষার ভাষা, ইংরেজি হবে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে বাধ্যতামূলক আর বাংলা বর্ণমালার বদলে চালু হবে রোমান হরফ (রোমান হরফে ইউরোপীয় বহু দেশ তাদের ভাষাকে লিখিতভাবে প্রকাশ করে)।
দ্বিতীয়ত, শিক্ষাকে পণ্য ঘোষণা দিয়ে রাষ্ট্র শিক্ষার দায়িত্ব নেবে না বলে কমিশন সুপারিশ করে। অর্থাৎ যাঁর টাকা আছে, শিক্ষার অধিকার তাঁরই, এটাই ছিল এই সুপারিশের মূলকথা।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক (ফ্রি) না করার পরিপূর্ণ পাঁয়তারা ছিল এই সুপারিশে। পাকিস্তান হওয়ার পর থেকেই পূর্ববঙ্গে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা কমে যাচ্ছিল। কমিশনের সুপারিশ তাতে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে উঠল। গ্রাম-অধ্যুষিত পূর্ববঙ্গে বরাবরই কৃষক ও শ্রমিকেরা ছিল সংখ্যাগুরু। ভাষা ও অর্থের মারণাস্ত্র প্রয়োগ করলে এই বিশাল মেহনতি শ্রমজীবী শ্রেণির সন্তানেরা শিক্ষিত হবে কীভাবে?
এই যে দুটি বিপদ, এগুলো নতুন নয়, পুরোনোই। ১৮৩৫ সালে দেওয়া ম্যাকওলে নীতিরই নতুন সংস্করণ। প্রথমে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি চাপিয়ে দেওয়া; তারপর ইংরেজি না জানলে চাকরি না পাওয়ার আতঙ্ক ঢোকানো ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক নীতি। ঠিক একই খড়্গ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আবারও নেমে এল ১৯৬২ সালে।
শিক্ষার্থীরা এই শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরোধিতা ও মাতৃভাষায় শিক্ষার দাবিতে রাজপথে নামলেন। লম্বা সে লড়াইয়ের ইতিহাস। সে ইতিহাস গৌরবেরও, চাঞ্চল্যেরও। লম্বা সময় ধরে লড়াই করার পর ১৭ সেপ্টেম্বর হরতাল ডাকা হলো, যার মূল কুশীলব ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের মোহাম্মদ ফরহাদ ও ছাত্রলীগের সিরাজুল আলম খান।
সেই হরতালের মিছিলে গুলি চলল। শহীদ হলেন মোস্তফা, বাবুল ও ওয়াজিউল্লাহ। টঙ্গীতে সুন্দর আলী। সেই থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘শিক্ষা দিবস’। কিন্তু সেটি নামে, মর্মে-কর্মে অতলান্ত বিস্মৃতির ছাপ।
ভাষার প্রশ্নটি শিক্ষা ও কর্মসংস্থানেরও প্রশ্নশিক্ষার প্রশ্নটি যে ভাষার সঙ্গে যুক্ত ছিল, তা শরীফ কমিশনের সুপারিশ থেকেই স্পষ্ট। কিন্তু একে শুধু ১৯৫২ বা ১৯৬২ সালের ঘটনাবলি দিয়ে মোটেও বোঝা যাবে না। যেতে হবে ইতিহাস ও রাজনীতির আরও গভীরে।
১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আট বছরের সংগ্রাম তাতে আপাত সফল হয়; কিন্তু এই সাফল্যের চেয়েও বড় অর্জন আছে।
ভাষার প্রশ্নটিকে পূর্ববঙ্গের উদয়োন্মুখ (অ্যাসপায়েরিং) শিক্ষিত মধ্যবিত্ত (শিক্ষার্থী ও বুদ্ধিজীবীরা) যে আর্থসামাজিক বয়ান দিয়ে মোকাবিলা করেছিলেন, তার তুল্য বিচার হতে পারে ১৮৫৭ সালের প্রথম ভারতীয় স্বাধীনতাযুদ্ধে সিপাহি বিদ্রোহের সঙ্গে। সেই প্রতিরোধকে ঔপনিবেশিক বিদ্যায়তনিক ভাষায় ক্ষুদ্রার্থে ‘সিপাহি বিদ্রোহ’ বলা হলেও আদতে তা ভারতবর্ষের ঔপনিবেশিক উৎপাদন সম্পর্ক তথা সার্বিকভাবে উৎপাদন পদ্ধতিকে নাকচ করে পুরো ভারতবর্ষে প্রতিরোধের আগুন জ্বালিয়েছিল।
ভাষা আন্দোলনের মধ্যেও এই বৈশিষ্ট্য প্রকট। ভাষার সঙ্গে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সম্পর্ককে সামনে আনা হয়েছিল। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে ভারতের মুসলিম-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোকে স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ হিসেবে গড়ে তোলার যে আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত হয়েছিল, তা মুসলিম লীগ ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহই প্রথম নাকচ করে প্রতারণা করেন। সেই স্বায়ত্তশাসনের আকাঙ্ক্ষা থেকেই পাকিস্তান আমলে পূর্ববঙ্গের জমিনে সব আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে।
ভাষা হিসেবে বাংলাকে নাকচ করে দেওয়ার সঙ্গে এই স্বায়ত্তশাসনের আকাঙ্ক্ষাকে ভূলুণ্ঠিত করার সম্পর্ক আছে। পূর্ববঙ্গ স্বায়ত্তশাসন পেলে বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করেই তার গঠন তৈরি হতো। কিন্তু পাকিস্তানের ক্ষমতাকাঠামো তার ওপর চাপিয়ে দিতে চাইল উর্দু, যা পূর্ববঙ্গের আমজনতার কাছে ‘ভিনদেশি’ ভাষাই ছিল মুখ্যত। এমতাবস্থায় শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের প্রশ্নটি স্বাভাবিকভাবেই সামনে এসে গেছে।
শিক্ষার মাধ্যম (মিডিয়াম অব ইনস্ট্রাকশন) ও চাকরির পরীক্ষার ভাষা উর্দু হলে বাঙালি সেই ভার বহন করতে পারত না। মনে রাখতে হবে, পাকিস্তানিরা উর্দুকে শুধু একক রাষ্ট্র ভাষাই বানাতে চায়নি, পঞ্চাশের দশকে বাংলা লিখতে বলেছিল ফার্সি-আরবি প্রভাবিত নাস্তালিক হরফে, যে হরফে পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষাগুলো লিখিত।
নৌবাহিনীর পরীক্ষা উর্দুতে নেওয়ার প্রতিবাদ এ জন্যই হয়েছিল। নদীমাতৃক পূর্ববঙ্গকে পশ্চিমা উর্দুভাষী রেজিমেন্ট দ্বারা চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলার এই প্রবণতা খেয়াল করার মতো। মনে রাখতে হবে, এই প্রবণতা পঞ্চাশের দশকের শুরুর প্রবণতা, একাত্তরের গণহত্যা যার চূড়ান্ত পরিণতি। ভাষাকেন্দ্রিক লড়াই তাই শুধু ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় সীমিত ছিল না। এর সঙ্গে একটি প্রতারিত জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিকভাবে বিকাশের সম্পর্ক জড়িত। জড়িত শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইও।
আর অন্তরে ছিল এমন একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীকে গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা, যারা ১৮৫৭ সালের মতোই প্রথাগত উৎপাদন–সম্পর্ক ও উৎপাদনপদ্ধতিকে সমূলে উৎপাটন করে আপামর জনগোষ্ঠীর কথা ঊর্ধ্বে তুলে ধরবে। যুক্ত হয়েছিল ভূমিব্যবস্থা বদলে ফেলতে চাওয়া বিখ্যাত তেভাগা আন্দোলনের লড়াইয়ের স্পিরিট, যার প্রভাবে ১৯৫০ সালের জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হয়।
১৯৫০ সালে রাজশাহীর জেলে সংঘটিত হয় কুখ্যাত ‘খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড’, যেখানে রাজবন্দী বামপন্থী নেতা-কর্মীদের মধ্যে ৭ জন নিহত হন, আহত হন ৩০ জনের বেশি। ১৯৫৪ সালে আদমজী ও কর্ণফুলী কারখানায় বাঙালি শ্রমিকদের ওপর অবাঙালি মালিকগোষ্ঠীর লেলিয়ে দেওয়া দানবীয় হত্যাকাণ্ডে নিহত হন ৯০ জন, আহত হন ২৫০ জনের বেশি শ্রমিক। ভাষা আন্দোলন এসব নির্মমতার বিরুদ্ধেও প্রতিরোধের অপর নাম।
সবিশেষে এই আন্দোলন এমন কিছু আর্থসামাজিক বিষয় সামনে এনেছিল, যা শিক্ষিত মধ্যবিত্তের নেতৃত্বে পূর্ববঙ্গের মেহনতি মানুষের দুর্দশা লাঘবের বড় মঞ্চ হয়ে উঠেছিল, স্বপ্ন দেখিয়েছিল উৎপাদন-সম্পর্ক বদলের। এ কারণেই এটি একটি আন্দোলন মাত্র ছিল না, ছিল অভিজাত ক্ষমতাকাঠামোর বিরুদ্ধে একেকটি নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর ‘অনন্য অভ্যুত্থান’।
শরীফ শিক্ষা কমিশন বাতিল হয় শিক্ষার্থীদের আত্মবলিদানের শক্তিতেই। মনে রাখতে হবে, রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল; লড়াইটা তাই মূল ভাষা আন্দোলনের চেয়েও কঠিন ছিল; কিন্তু এই ইতিহাস লিপিবদ্ধ করতে হলে রাষ্ট্রের খোলনলচে বদলে ফেলার প্রচেষ্টা থাকা প্রয়োজন ছিল। নতুন রাষ্ট্র অভিজাত শ্রেণির বিপক্ষে যেতে চায়নি। তাই ভাষা আন্দোলনের পরম্পরা হিসেবে শিক্ষা আন্দোলনের যে চেতনা তৈরি হয়েছিল, তা লোপাট হয়ে গেছে।ভাষা ও ‘শিক্ষার মাধ্যম’ অঙ্গাঙ্গি ছিলনতুন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে, এ প্রসঙ্গ মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা ভারত ভাগ হওয়ার আগপর্যন্ত বারবার এড়িয়ে গেছেন। পূর্ববঙ্গের নেতারাও সেটি অনুভব করেননি। ১৯৪৬ সালে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম প্রাদেশিক পরিষদে শিক্ষার অধিকার প্রসঙ্গে যে ইশতেহার তুলে ধরেন, তাতে ভাষার প্রসঙ্গটি স্থান পায়নি। ছাত্র-যুবা ও বুদ্ধিজীবীরা কিন্তু ঠিকই আলাপটা তুলেছিলেন। তবে সেটি শুধু রাষ্ট্রভাষার প্রসঙ্গে নয়, এর সঙ্গে তাঁরা শিক্ষার মাধ্যম নিয়েও কথা বলেছেন।
১৯৪৭ সালের জুলাইয়ে গণ আজাদী লীগ, ১৯৪৭ সালের ৬-৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত সম্মেলনে গণতান্ত্রিক যুবলীগ, ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা—বাংলা না উর্দু শীর্ষক পুস্তিকায় তমদ্দুন মজলিস বাংলাকে পূর্ববঙ্গের দাপ্তরিক ভাষা করার পাশাপাশি মাতৃভাষা বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করার দাবি তোলেন। গণতান্ত্রিক যুবলীগ তো অবৈতনিক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষারও দাবি জানায়।
মোদ্দাকথা, শুধু রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেই ভাষার অধিকার বাস্তবায়িত হয় না। এর কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত হয় মূলত শিক্ষায়, সরকারি দপ্তরে ও চাকরির পরীক্ষায়; কিন্তু ১৯৫৬ সালে সাংবিধানিক স্বীকৃতির তথাকথিত ভণিতা ছাড়া বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি পাকিস্তানিদের মনোভাব কখনোই বদলায়নি। সেই মনোভাবেরই প্রতিফলন শরীফ শিক্ষা কমিশন। এ জন্যই শিক্ষা আন্দোলন নিয়ে আমাদের বয়ান ও দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো জরুরি।
শিক্ষা ও আজকের বাংলাদেশশরীফ শিক্ষা কমিশন বাতিল হয় শিক্ষার্থীদের আত্মবলিদানের শক্তিতেই। মনে রাখতে হবে, রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল; লড়াইটা তাই মূল ভাষা আন্দোলনের চেয়েও কঠিন ছিল; কিন্তু এই ইতিহাস লিপিবদ্ধ করতে হলে রাষ্ট্রের খোলনলচে বদলে ফেলার প্রচেষ্টা থাকা প্রয়োজন ছিল। নতুন রাষ্ট্র অভিজাত শ্রেণির বিপক্ষে যেতে চায়নি। তাই ভাষা আন্দোলনের পরম্পরা হিসেবে শিক্ষা আন্দোলনের যে চেতনা তৈরি হয়েছিল, তা লোপাট হয়ে গেছে।
যে কারণে রাষ্ট্রীয় শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে বারবার শিক্ষার্থীদের নামতে হয়েছে। এরশাদের আমলে মজিদ খান শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করে ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি শিক্ষার্থীরা জীবন দিয়েছেন, যে দিনটি স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস নামে স্বীকৃত হলেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের করতে হয়েছে ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সময়ে হয়েছে বর্ধিত ফি–বিরোধী আন্দোলন, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে আন্দোলন।
বিস্ময়কর বটে, বর্তমান শিক্ষার্থীদের অনেকেই হয়তো জানেনই না শিক্ষা দিবস কী ও কেন! ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ বা ১৬ ডিসেম্বর সম্পর্কে জানেন; কারণ, পাঠ্যপুস্তকে এগুলো স্বাভাবিক মহিমায় প্রকাশিত হয়েছে। ১৭ সেপ্টেম্বর নিয়ে সেটি করতে গেলে রাষ্ট্রকে সরাসরি শিক্ষা সংকোচন নীতি ও শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের বিপক্ষে দাঁড়াতে হবে; কিন্তু রাষ্ট্র সেটি করবে না।
সেটি করলে রাষ্ট্রের তথাকথিত উদার অর্থনীতি ও ব্যক্তিমালিকানায় শিক্ষাকে সোপর্দ করার সব নকশা শিক্ষার্থী সমাজের কাছে উন্মোচিত হয়ে যাবে।
শিক্ষার্থীরা তখন প্রশ্ন করবেন, ‘এ রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে শিক্ষাক্ষেত্রে আমি বৈষম্যের শিকার কেন হচ্ছি? কেন রাষ্ট্র দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষক হলেও, দেশের টাকা বিদেশে পাচার করতে দিলেও যেকোনো স্তরে আমার শিক্ষার ভার বহন করবে না?’
এসব প্রশ্নের উত্তর পুঁজিতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোয় চলতে চাওয়া রাষ্ট্রের কাছে নেই। শিক্ষা দিবসের দুর্দমনীয় চেতনা তাই শুধু কাগজের কালিতেই লেখা আছে; মর্মে নেই, কর্মে তো নেই-ই।
ড. সৌমিত জয়দ্বীপ, সহকারী অধ্যাপক, স্কুল অব জেনারেল এডুকেশন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
মতামত লেখকের নিজস্ব