প্রায় ৩ হাজার বছর আগে থেকেই বাংলায় পাটের চাষ শুরু হয়েছিল। তখন গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলে পাট চাষ হত। উষ্ণ ও আদ্র আবহাওয়ায় এবং গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের দোআঁশ মাটিতে ভালো ফলন হয় এই আঁশ জাতীয় উদ্ভিদের। আর সে অনুযায়ী পূর্ববাংলা ও পশ্চিমবঙ্গেই পৃথিবীর সিংহভাগ পাট উৎপাদিত হয়ে থাকে। এছাড়াও চীন, ব্রাজিল ও থাইল্যান্ডসহ বেশকিছু অঞ্চলে পাটের চাষ হয়।   
চৈত্র-বৈশাখ মাসে পাট বোনা শুরু হয়। বীজ থেকে চারা আসতে সময় লাগে ৩-৫ দিন। শাক খাওয়ার উপযোগী হয় ১৫-১৬ দিনে। পাট গাছ পরিণত হতে সময় লাগে সাড়ে ৩ মাস থেকে ৪ মাস। কাটা পাট পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয় ২২-২৫ দিন। পঁচানোর পর আঁশ পাটকাঠি থেকে আলাদা করে রোদে শুকাতে হয়। পাটের রঙ সাদাটে বা হালকা লালচে হলে ভালো দাম পাওয়া যায়। প্রতি বিঘা জমিতে ৫-৭ মণ পাটের উৎপাদন হয়।
পাটকে বাগানের এক প্রকার উদ্ভিদ বলে গণ্য করা হত। যার পাতা সবজি এবং ঔষুধ রূপে ব্যবহৃত হতো। যদিও এখনো হয়। পাট পাতা বা শাক খুব সুস্বাদু খাবার। আর এর ঔষধি গুণ তো রয়েছেই। তবে বর্তমানে পাটের চাষ করা হয় মূলত এর তন্তুর জন্য।
পাট এক প্রকার দ্বিবীজপত্রী আঁশযুক্ত গাছ। এর ছাল বা বাকল থেকেই আসে সোনালি আঁশ এবং ভেতরের শক্ত অংশটি কাঠি। প্রাচীন কালে এই কাঠিকে বলা হতো নালিতা। কোন কোন অঞ্চলে একে নল, নলখাগড়া টাঙ্গি বা টাঙ্গা বলা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে পাটকাঠি রূপার কাঠিতে পরিণত হয়েছে।
উষ্ণ আবহাওয়া এবং মৌসুমী বৃষ্টিপাতের প্রভাবে বাংলাদেশে পাটের ফলন সব থেকে বেশি হয়। এমনকি এই আবহাওয়ার কারণেই বাংলাদেশে পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত জাতের পাট উৎপন্ন হয়। মূলত বছরে একবার পাট চাষ হয়।
পাললিক বেলে দোআঁশ, এঁটেল দোআঁশ, নদীর অববাহিকার মাটিতে পাট ভালো জন্মে, যার পিএইচ পরিসীমা ৪.                
      
				
পাট চাষের জন্য অনুকূল পরিবেশ হলো ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রা। ৭০-৯০ শতাংশ আপেক্ষিক আর্দ্রতা এবং বপনের সময় পাটের জন্য বার্ষিক ১৬০-২০০ সেমি বৃষ্টিপাত প্রয়োজন। খুব উঁচু নয় আবার নিচু নয়, অর্থাৎ বৃষ্টির পানি যেখানে খুব বেশি সময় স্থায়ী হয় না এমন জমিতে পাট চাষ করা ভালো।
বাংলাদেশে ময়মনসিংহ, রংপুর, ফরিদপুর, যশোর, কুষ্টিয়া অঞ্চলে পাটের চাষ ভালো হয়। এছাড়াও বাংলাদেশের অন্যান্য জেলায়ও পাট চাষ করা হয়।
পাটের ইংরেজি শব্দ ‘জুট’ (Jute)। কিন্তু জুট শব্দটি কোন ভাষা থেকে এসেছে তা সুনির্দিষ্ট ভাবে জানা যায়নি। তবে অনেকের মতে উরিয়্যা শব্দ ‘ঝুট’ বা সংস্কৃত শব্দ জট থেকে ইংরেজি জুট শব্দের উৎপত্তি।
বাংলাদেশে বিভিন্ন জাত মিলিয়ে শ’খানেক জাতের পাট পাওয়া যায়। আগেকার সময়ে পাটের আলাদা কোন শ্রেণি বিভাগ ছিল না, কিন্তু বিভিন্ন নামে ডাকা হত। তন্মধ্যে ধলসুন্দর, বাউ, বিদ্যাসুন্দর, কেউত্রা, পাইধা, কাজলা, কাটাইওবা উল্লেখযোগ্য। তবে বাণিজ্যের উদ্দ্যেশে দুই প্রকারের পাট বেশি ব্যবহৃত হয়। সেগুলো হলো- সাদা পাট বা তিতা পাট, যা বৈজ্ঞানিক নাম করকোরাস ক্যাপসালারিস এবং তোষা পাট বা মিঠা পাট, যার বৈজ্ঞানিক নাম করকোরাস ওলিটোরিয়াস। এছাড়া মেস্তা নামের পাটও জনপ্রিয়, যার বৈজ্ঞানিক নাম হিবিসকাস ক্যানাবিনাস।
তবে যেসব দেশে পাটের চাষ হয় না, সেখানে পাটের বিকল্প হিসেবে কেনাফ নামের এক প্রকার উদ্ভিদের আঁশ ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশেও কিছু এলাকার মাটিতে এই কেনাফ চাষ করা হয়। পাটের মানের ভিত্তিতে কেনাফকে নিম্ন মানের পাট ধরা হয়। বাংলাদেশে একটা সময় সবথেকে বেশি চাষ হতো সাদা পাট যদিও বর্তমানে তোষা পাট বেশি চাষ করা হয়।
সাদা পাটের আদি আবাস বা উৎপত্তি স্থল হলো চীন, তোষা পাটের আদি নিবাস মিসর, মেস্তার আদি নিবাস হলো ভারত এবং কেনাফ এর উৎপত্তি স্থল চীন ও থাইল্যান্ড। বিভিন্ন ধরনের পাটের উৎপত্তি বা আদি নিবাস যে দেশই হোক না কেন বাংলাদেশের থেকে ভালো ভালো মানের পাট আর কোন দেশে উৎপাদন হয় না। এ বছরও বাংলাদেশ ভালো মানের পাট উৎপাদনে বিশ্বে প্রথম স্থানে রয়েছে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার বা অঞ্চলের আবহাওয়া, মাটি, পানি একেক রকম। যার জন্য পাটের আঁশের গুণাগুণ ভিন্ন হয়। বাংলাদেশের আবহাওয়ার এই ভিন্নতার জন্য পাটের আঁশের মানের তারতম্যের ভিত্তিতে পাটকে অঞ্চলভিত্তিক পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
এর মধ্যে বৃহত্তর ঢাকা, ময়মনসিংহ, জামালপুর, কুমিল্লা, টাঙ্গাইল জেলায় উৎপাদিত পাট কে জাত পাট বলা হয়। এ অঞ্চলে উৎপাদিত সাদা ও তোষা পাটের আঁশ খুবই শক্ত। জাত পাট অন্য সকল পাটের থেকে উজ্জ্বল হয়ে থাকে এবং এ অঞ্চলের পাটের তৈলাক্ততা বেশি।
বৃহত্তর ফরিদপুর জেলায় উৎপাদিত পাট মূলত হার্ড ডিস্ট্রিক্ট পাটের অন্তর্গত। হার্ড ডিস্ট্রিক্ট পাট জাত পাটের মতো একই শক্তি সম্পন্ন। তবে জাত পাটের তুলনায় কিছুটা কম সুক্ষ্ম। হার্ড ডিস্ট্রিক্ট অঞ্চলে তোষা পাট বেশি হয়। পাটের উজ্জ্বলতা ও তৈলাক্ততা অধিক হয়। এ অঞ্চলের তোষা পাটের রং উজ্জ্বল কাঁচা সোনা বর্ণের।
বৃহত্তর পাবনা জেলায় উৎপাদিত পাটকে ডিস্ট্রিক্ট পাট বলা হয়। তবে ব্রহ্মপুত্র নদের পশ্চিম পাড় অঞ্চলে উৎপাদিত পাট ডিস্ট্রিক্ট পাটের অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও নোয়াখালী, সিলেট, পার্বত্য অঞ্চলে উৎপাদিত পাটকে ডিস্ট্রিক্ট পাট হিসেবেই ধরা হয়। এ অঞ্চলের পাটের আঁশ কিছুটা মোটা হয়। উজ্জ্বলতা এবং তৈলাক্ততাও কিছুটা কম। তবে পাটের আঁশের শক্তি জাত পাটের মতোই। এ জাতের সাদা পাটের রঙ সাদাটে এবং তোষা পাটের রঙ বাদামী বা ফ্যাকাশে লাল হয়।
এছাড়া বৃহত্তর কুষ্টিয়া, যশোর, বরিশাল, খুলনা অঞ্চলে উৎপাদিত পাটকে বলা হয় সফট ডিস্ট্রিক্ট পাট। পাটের আঁশ অপেক্ষাকৃত মোটা, তবে নরম। পাটের আঁশের উজ্জ্বলতা ও তৈলাক্ততা তুলনামূলকভাবে কম। বৃহত্তর রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া অঞ্চলের পাটগুলো নর্দান পাটের অন্তর্গত। তবে একই এলাকার কিছু স্থানে ভিন্নধর্মী কিছু পাট উৎপাদন হয়। এ জাতের পাটও অপেক্ষাকৃত মোটা। উজ্জলতা ও তৈলাক্ততাও কম।
পাট বাংলাদেশের বহুমুখী পণ্য তৈরির প্রধান কাঁচামাল। প্যাকেজিং শিল্পে ব্যবহার্য অন্যতম এবং গুরুত্বপূর্ণ আঁশ হলো পাট। বাংলাদেশের ১৯টি পণ্যের প্যাকেজিং মোড়কের জন্য পাটের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তবে পাট এখন প্যাকেজিংয়ে সীমাবদ্ধ নেই। পাট থেকে নতুন নতুন ফেব্রিক্স তৈরি হচ্ছে এবং তা পরিধানের যোগ্যও।
পাট থেকে নতুন নতুন পণ্য তৈরির গবেষণা চলছে বহু আগে থেকেই। এরই ধারাবাহিকতায় পাট থেকে তৈরি হয়েছে রেসিং কার, শক্তিশালী এন্টিবায়োটিক, বায়োপলি, ঢেউটিন এবং জুটেক্স নামক এক প্রকার ফেব্রিক্স, যা বাঁধ নির্মাণে ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও গবেষণার ফলে নিত্য নতুন পণ্য পাচ্ছি আমরা।
২০২৩–২০২৪ অর্থবছরে বিজেএমএ ও বিজেএসএ এর তথ্য মতে (জুলাই/২০২৩- ফেব্রুয়ারি/২০২৪) বাংলাদেশে মোট উৎপাদিত পাটজাত পণ্যের পরিমাণ ৩.৪৪ লাখ মেট্রিক টন। মোট রপ্তানির পরিমাণ ১.০৩ লাখ মেট্রিক টন। মোট রপ্তানি আয় ৯৬.২৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশী টাকায় যার পরিমাণ ১০৫৮.৯৮ কোটি টাকা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশে পাট উৎপাদন ১৮ শতাংশ কমে ৭৫ লাখ ৬৫ হাজার বেলে নেমেছে।
পাটশিল্পের গবেষণা, ইনোভেশন তথা সার্বিক উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ সরকারের পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়, জেডিপিসি, বিজেএমসি একনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাচ্ছে। প্রতি বছর ৬ মার্চ জাতীয় পাটদিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ সরকারের পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় ও জেডিপিসির যৌথ উদ্যোগে পাট পণ্য প্রদর্শনী ও মেলার আয়োজন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় এ বছরও জাতীয় পাট মেলার আয়োজন করা হয়েছে জেডিপিসি প্রাঙ্গণে। আগামী ১০ মার্চ পর্যন্ত চলবে এ মেলা।
বাংলার পাটের অতীত সুনাম যেমন রয়েছে, তেমনি পাট শিল্পের ভবিষ্যতও উজ্জ্বল। মাঝে কয়েক দশক পাটের উত্থান-পতন দেখেছে বিশ্ববাসী। তরুণ উদ্যোক্তারা নতুন নতুন ইনোভেশন, ফিউশনের মাধ্যমে পাটশিল্পে নতুনত্ব নিয়ে এসেছে, যা বিশ্ববাজারেও সমাদৃত হচ্ছে। সেদিন খুব বেশি দূরে নয়, বাংলাদেশ আবারও সোনালী আঁশের ও রুপার কাঠি খ্যাত পাট নিয়ে বিশ্বে মাথাউঁচু করে দাঁড়াবে।
বাংলাদেশে পাটশিল্পের সম্ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে সমস্যাও রয়েছে। সব সমস্যাকে ছাপিয়ে পাট শিল্পের সোনালী সুদিন ফিরে আসবে, জাতীয় পাট দিবসে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
(লেখক: উদ্যোক্তা, ওনার ও ডিজাইনার, জুট হ্যাভেন)
ঢাকা/মেহেদী
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর উৎপ দ ত প ট প ট উৎপ দ ত ল ক তত ব যবহ র উৎপত ত চ ষ কর র জন য র উৎপ
এছাড়াও পড়ুন:
সরকারি কর্মসম্পাদন পরিবীক্ষণ পদ্ধতি বাস্তবায়নে কমিটি
সরকারি কর্মসম্পাদন পরিবীক্ষণ পদ্ধতি (গভর্নেন্স পারফরমেন্স মনিটরিং সিস্টেম- জিপিএমএস)’ বাস্তবায়নে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদকে সভাপতি করে তিন সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি’ গঠন করেছে সরকার।
সম্প্রতি এই কমিটি গঠন করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।
কমিটিতে বাকি দুই সদস্য হলেন, পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ও খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার।
অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সরকারি কাজের জবাবদিহিতা, দক্ষতা ও জনকল্যাণ নিশ্চিতে প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজের মূল্যায়নের নতুন পদ্ধতি চালু হয়েছে। বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) পরিবর্তে নতুন সরকারি কর্মসম্পাদন পরিবীক্ষণ পদ্ধতি (জিপিএমএস) চালু করা হয়েছে। এই জিপিএমএস বাস্তবায়নে উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি’ গঠন করা হয়েছে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব বা প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব, অর্থ সচিব, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার), বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের সচিব, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগের সচিব কমিটিকে সহায়তা করবেন। তাছাড়া, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা দেবে।
এ কমিটি জিপিএমএস বাস্তবায়নের বিষয়ে সার্বিক দিক-নির্দেশনা দেবে। মন্ত্রণালয় বা বিভাগের জিপিএমএসে সেকশন ১-এর আওতায় প্রস্তুত করা পরিকল্পনা অনুমোদন দেবে এবং অর্থবছর শুরুর আগে মন্ত্রণালয় বা বিভাগের জিপিএমএস পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চূড়ান্ত করবে এ কমিটি।
এছাড়া, প্রতি অর্থবছর শেষে মন্ত্রণালয় বা বিভাগের জিপিএমএসের সার্বিক মূল্যায়ন পর্যালোচনা করে সুপারিশ দেবে। জিপিএমএস বিষয়ে সরকারের দেওয়া অন্য যেকোনো দায়িত্ব পালন করবে বলে প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়েছে।
ঢাকা/নঈমুদ্দীন/ইভা