‘বিনিময়’ ব্যর্থ, তবু ২৭৭ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে চেয়েছিল আইসিটি বিভাগ
Published: 17th, March 2025 GMT
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের এক মাস আগে পাঁচ বছরের জন্য আর্থিক লেনদেন প্ল্যাটফর্ম ‘বিনিময়’-এ বড় অঙ্কের বিনিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছিল তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ।
‘বিনিময়’-এর জন্য আইসিটি বিভাগের অধীন সংস্থা বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি) দিয়ে ২৭৭ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ের একটি প্রকল্প গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।
চালুর পর ‘বিনিময়’ জনপ্রিয়তা পায়নি। আইসিটি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ‘বিনিময়’ ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আওয়ামী ঘনিষ্ঠদের আর্থিক সুবিধা দিতেই এ প্রকল্পের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
তবে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর উদ্যোগটি বাতিল করে আইসিটি বিভাগ। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রস্তাবটি বাদ দেওয়া হয়েছে।’
আইসিটি বিভাগের উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন একাডেমি প্রতিষ্ঠাকরণ (আইডিয়া) প্রকল্পের আওতায় ৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ইন্টার-অপারেবল ডিজিটাল ট্রানজেকশন প্ল্যাটফর্ম (আইডিটিপি) ‘বিনিময়’ চালু হয় ২০২২ সালের নভেম্বরে। ব্যাংক ও মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের (এমএফএস) মধ্যে আর্থিক লেনদেনের জন্য প্ল্যাটফর্মটি করা হয়।
বিনিময় চালুর পর তা সুবিধা করতে পারেনি। বিনিময়ে লেনদেন তেমন না হওয়া সত্ত্বেও থেমে থাকেনি আইসিটি বিভাগ।
২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৯ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদে ২৭৭ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে ‘বিনিময় প্ল্যাটফর্ম উন্নত ও স্থিতিশীলকরণ’ নামের প্রকল্পের উদ্যোগ আইসিটি বিভাগের আগ্রহে গ্রহণ করা হয়েছিল।
প্রকল্প প্রস্তাবের উদ্দেশ্য-লক্ষ্যে বলা হয়েছিল, প্ল্যাটফর্মটি সমৃদ্ধ করা, কারিগরিভাবে আরও শক্তিশালী করা, পরিচালনায় সহায়তার পাশাপাশি সরকারি বিল, বেতন-ভাতা, কর-ভ্যাট সংগ্রহ, পেনশন, মেট্রোরেলের কার্ড রিচার্জের মতো সুযোগ তৈরি করা।
আইসিটি বিভাগ সূত্র বলছে, যে প্রকল্প থেকে ‘বিনিময়’ তৈরি করা হয়েছে, সেখানে বেশি অর্থ ব্যয়ের সুযোগ ছিল না। তাই এখান থাকে আরও লাভবান হতে বিসিসিকে দিয়ে আরেকটি প্রকল্পের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড.
সজীব ওয়াজেদ ছাড়াও এ প্ল্যাটফর্ম থেকে সুবিধা নিয়েছেন সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের ছেলে জারেফ হামিদ। বিনিময় প্ল্যাটফর্মটি ওরিয়ন ইনফরমেটিক্স, মাইক্রোসফট, ফিনটেক লিমিটেড ও সেইন ভেঞ্চারস যৌথভাবে তৈরি করে। এর মধ্যে ফিনটেক লিমিটেড নসরুল হামিদের স্ত্রী সীমা হামিদ ও ছেলে জারেফ হামিদের, যা ২০২২ সালে নাম পরিবর্তন করে হয় ভেলওয়্যার লিমিটেড। এর মালিকানায় আছে জারেফ হামিদ ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি প্রাইম হোল্ডিংস এলএলসি। বিনিময় পরিচালনার জন্য ভেলওয়্যারের সঙ্গে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে চুক্তি করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বিনিময় তৈরির আগেই বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় একই ধরনের সেবা চালুর সিদ্ধান্ত হয়েছিল। ২০২০ সালের ২৭ অক্টোবর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সেবাটি চালুর কথা ছিল। তখন এ নিয়ে প্রজ্ঞাপনও জারি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে শেষ পর্যন্ত সেবাটি আর চালু হয়নি। কারণ, এ কাজের সঙ্গে যুক্ত হয় আইসিটি বিভাগ। নেওয়া হয় নতুন সরকারি প্রকল্প।
সূত্র জানায়, এখন ‘বিনিময়’ রাখতে চাচ্ছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। ‘বিনিময়’-এর মতো সেবা থাকবে, তবে এ প্ল্যাটফর্ম (বিনিময়) ব্যবহার করা হবে না। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে এ ব্যাপারে এখনই কিছু বলছে না বাংলাদেশ ব্যাংক।
বিনিময়ের ব্যাপারে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকটির মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান প্রথম আলোকে বলেন, ভেলওয়্যারের সঙ্গে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ ঠিকমতো হচ্ছে না। তাদের কাছ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকও তাদের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছে না। তাদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। জবাব না পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সূত্র জানায়, এ চুক্তি রাখার ইচ্ছা নেই বাংলাদেশ ব্যাংকের। কারণ, সেবাটি প্রায় অকার্যকর হয়ে আছে। এ ছাড়া ভেলওয়্যারের সঙ্গে যে চুক্তিটি হয়, সেটার সবকিছু প্রস্তুত করে বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে দেওয়া হয়েছিল।
সরকার পতনের পরপরই ‘বিনিময়’ নিয়ে আইসিটি বিভাগের পক্ষ থেকে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ সাল থেকে ‘ক্যাশলেস সোসাইটি’ গড়ার উদ্দেশ্যে বিনিময় তৈরির আলোচনা শুরু হয়। ২০২৪ সালের ১০ আগস্ট পর্যন্ত বিনিময়ের গ্রাহকসংখ্যা ৩ লাখ ৭১ হাজার ৮০০ জন। ‘বিনিময়’-এ গড়ে প্রতিদিন ২৮–৩০ লাখ টাকা লেনদেন হয়। একই সময় পর্যন্ত বিনিময়ে ৮৯ কোটি ৮২ লাখ ২৮ হাজার ৩৫০ টাকার লেনদেন সম্পন্ন হয়েছে।
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক যদি বিনিময় বন্ধের মতো কোনো সিদ্ধান্তে যায়, তবে সেটাকে সাধুবাদ জানাতে হবে। দেশের আর্থিক খাতের লেনদেনের প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন ধরনের পেমেন্ট সিস্টেম থাকতে পারে। কিন্তু সর্বজনীন মাধ্যম (ইউনিভার্সাল পেমেন্ট গেটওয়ে এগ্রিগেটর) একটাই হতে পারে।
সেটা ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচ বাংলাদেশকেই (এনপিএসবি) হতে হবে। অবশ্যই সেটা বেসরকারি খাতের হাতে থাকতে পারে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের যে এনপিএসবি সেবা আছে, সেটাকে বরং এখন শক্তিশালী করতে হবে। এখানে ব্যাংক, আর্থিক সেবা খাত, মার্চেন্ট, মার্কেট ও এমএফএস যুক্ত রয়েছে। বিনিময়ের পেছনের যে গোষ্ঠী আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছিল, তারা দেখেছে, বাংলাদেশে এমএফএস খাত ভালো করছে। তাই সেটাকে তারা টার্গেট (নিশানা) করেছিল।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প ল য টফর ম প রকল প র ভ লওয় য র ল নদ ন আর থ ক হয় ছ ল র জন য মন ত র আইস ট সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
সুদ পরিশোধে ব্যয় বাড়ছে
সুদ পরিশোধে সরকারের ব্যয় বাড়ছে। এ ব্যয় বহন করতে রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে। বাজেটে সরকারের সুদ পরিশোধ সংক্রান্ত পূর্বাভাসে দেখা যাচ্ছে, আগামী বছরগুলোতে সুদ ব্যয় ক্রমাগত বৃদ্ধি পাবে।
পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের প্রায় ১৫ ভাগ অর্থই সুদ খাতে খরচ করতে হচ্ছে এখন। এ পরিস্থিতিতে আগামী তিন অর্থবছরে সুদ খাতেই ব্যয় করতে হবে চার লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। পাঁচ অর্থবছরের ব্যবধানে সুদ ব্যয় বাড়ছে ৩৩ শতাংশ। এর মধ্যে শতাংশের হিসাবে বৈদেশিক ঋণের সুদ ব্যয় সবচেয়ে বেশি বাড়বে।
অর্থ বিভাগের করা ‘মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতি-২০২৫-২০২৬ থেকে ২০২৭-২০২৮’ এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে সুদ খাতে ব্যয় হয়েছিল এক লাখ ১৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ খাতে সুদ ব্যয় ছিল ৯৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা এবং বিদেশি ঋণের সুদ ব্যয় গেছে ১৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা।
চলতি ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে (যা চলতি জুনের ৩০ তারিখে শেষ হয়ে যাবে) মূল বাজেটে সুদ খাতে ব্যয় বরাদ্দ ছিল এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বছর শেষে এই সীমায় সুদ ব্যয় ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। ফলে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে ব্যয় বাড়িয়ে ধরা হয়েছে এক লাখ ২১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এ হিসাবের মধ্যে ছিল অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ব্যয় ৯৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং বিদেশী ঋণের ২২ হাজার কোটি টাকা।
একইভাবে আগামী তিন অর্থবছরে সুদ খাতে ব্যয়েরও একটি প্রক্ষেপণ করেছে অর্থ বিভাগ। এই হিসেবে দেখা যায় আগামী ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরে সুদ খাতে ব্যয় হবে এক লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা (অভ্যন্তরীণ এক লাখ কোটি টাকা , বিদেশি ঋণের সুদ ব্যয় ২২ হাজার কোটি টাকা)। একইভাবে এর পরের অর্থবছর ২০২৬-২০২৭ অর্থবছরে একলাখ ৩৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা(অভ্যন্তরীণ এক লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা এবং বিদেশি ঋণের ২৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা) এবং ২০২৭-২০২৮ অর্থবছরে সুদ খাতে ব্যয়ের প্রক্ষেপণ করা হয়েছে ১ লাখ ৫২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
অর্থ বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, মোট সুদ ব্যয়ের সিংহভাগই অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধ। অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধ ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ৯৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৭-২০২৮ অর্থবছরে এক লাখ ২৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা গিয়ে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু মোট বাজেটের অনুপাতে অভ্যন্তরীণ সুদ পরিশোধের হার ২০২৩ -২০২৪ অর্থবছরে ১৬ দশমিক ২৯ শতাংশ থেকে কমে ২০২৭-২০২৮ অর্থবছরে ১২ দশমিক ৭৫ শতাংশে হ্রাস পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ মোট সুদ ব্যয়ের তুলনায় কম, তবে এটি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। ফলে এটি ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ১৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৭-২০২৮ অর্থবছরে ২৭ হাজার ১০০ কোটি টাকায় উন্নীত হতে পারে। মোট বাজেটের অনুপাতে বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ এ সময়কালে ২ দশমিক ৪৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২ দশমিক ৭৬ শতাংশে উন্নীত হতে পারে।
বিদেশি ঋণের সুদ ব্যয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে অর্থ বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধের কার্যকর ব্যবস্থাপনা শুধু আর্থিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্যই নয়, বরং এটি সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রক্ষা, টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা, আন্তর্জাতিক ঋণমান বজায় রাখা এবং ভবিষ্যতের উন্নয়ন সম্ভাবনা সুরক্ষিত রাখার জন্য অপরিহার্য।