ব্রাজিলের জালে চার গোল করে ‘সুখবর’ উদ্যাপন আর্জেন্টিনার
Published: 26th, March 2025 GMT
আর্জেন্টিনা ৪-১ ব্রাজিল
মনুমেন্তালে নামার আগেই সুখবর পেয়েছে আর্জেন্টিনা দল। ২০২৬ বিশ্বকাপে খেলা নিশ্চিত, যেটা কি না আবার নিজেদের বিশ্বকাপ বাছাইয়ের ইতিহাসে দ্রুততমও। এমন খবরে মনটা কার না ফুরফুরে হবে! চিরপ্রতিদ্বন্দ্বিদের সঙ্গে তাই বুঝি একটু নির্মম মজা করার সাধ হয়েছিল আর্জেন্টিনার।
কিক অফের পর প্রথম দুই মিনিটে ব্রাজিলের খেলোয়াড়েরা বল পাননি। তখনই বোঝা গিয়েছিল, কিছু একটা নিয়ে তাড়া আছে লিওনেল স্কালোনি অ্যান্ড গংয়ের। হাতে পাঁচ ম্যাচ রেখে বিশ্বকাপে খেলার টিকিট পাওয়া উদ্যাপনে বুঝি কেক কাটতে হবে! কিংবা মাঠেই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বিদের কেক বানিয়ে…। আরেকটু হলে সেটাই হতো! কারণ শুরুটা ছিল কেকে দ্রুত পোচ দেওয়ার মতোই! তারপর সময় শেষ হওয়ার আগে আরও একটি। এভাবে চারবার অর্থাৎ চারটি গোল। আর্জেন্টিনা জিতেছে ৪-১ গোলে।
চার মিনিটে (৩ মিনিট ৪৭ সেকেন্ড) হুলিয়ান আলভারেজের গোল। সেটা আবার বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ম্যাচে তৃতীয় দ্রুততম। তাতেও আর্জেন্টিনার তাড়াটা ঠিক পরিস্কার বোঝানো যাচ্ছে না। ব্রাজিল ‘মাকড়সা’র কামড় মানে ‘স্পাইডার’ আলভারেজের কাছে গোল হজম করতে সময় পেয়েছে মাত্র ৮ মিনিট। এনজো ফার্নান্দেজ দিয়েছেন দ্বিতীয় পোচ; ১২ মিনিটে। ব্রাজিল তখনও বলার মতো একটি আক্রমণও করতে পারেনি। পোস্টেও শট নেই। ওদিকে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বিদের বিপক্ষে রচিত হয়েছে নতুন ইতিহাস। এত দ্রুত কখনো দুই গোল হজম করেনি ব্রাজিল!
দুই গোল ব্যবধানে পিছিয়ে থাকা ব্রাজিলকে ম্যাচে ফিরিয়েছে আসলে আর্জেন্টিনাই। স্বাগতিকদের রক্ষণদেয়ালের অন্যতম ‘স্তম্ভ’ ক্রিস্টিয়ান রোমেরো ব্রাজিলের প্রতি একটু ‘প্রসন্ন’ হয়ে উঠেছিলেন কি না! ২৬ মিনিটে তাই বল পায়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, দূরে থাকা মাথিয়াস কুনিয়া বল কাড়তে ছুটে আসেন কি না তা দেখার জন্য বুঝি! কুনিয়া আসলেন ঠিকই, কিন্তু রোমেরো তাঁকে ড্রিবলিংয়ের চেষ্টা করেও পারলেন না। বল কেড়ে কুনিয়ার ডান পায়ের জোরাল শট সোজা আর্জেন্টিনার জালে। জাতীয় দলের হয়ে এ ফরোয়ার্ডের প্রথম গোল আর্জেন্টিনার পোস্টে ব্রাজিলের প্রথম শটও।
কিন্তু আর্জেন্টিনার তাড়া তখনও শেষ হয়নি। ৩৬ মিনিটে বক্সের বাঁ প্রান্ত থেকে বাঁ পায়ের জোরাল শটে গোলকিপার বেন্তোর পরীক্ষা নিয়ে চোখ রাঙানি দেন থিয়াগো আলমাদা। কে জানত, পরের মিনিটেই তৃতীয় পোচটি দেবেন অ্যালেক্সিস ম্যাক অ্যালিস্টার। ফার্নান্দেজের বাতাসে ভাসানো কম্পাসে মাপা পাস লিভারপুল মিডফিল্ডারের পায়ে এসে পড়েছে। ভলিতে প্রথমার্ধেই ব্রাজিলকে তিন গোল দেওয়ার কাজটুকু সেরেছেন পাকানো পায়ের কাজে। বিশ্বকাপ বাছাইয়ে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে দ্বিতীয়বারের মতো প্রথমার্ধে তিন গোল হজম করল ব্রাজিল। প্রথম ২০০৫ সালের জুনে আর্জেন্টিনার মাটিতেই।
প্রথমার্ধে ৬১ শতাংশ সময় বল দখলে রেখে ব্রাজিলের পোস্টে চারটি শট নিয়েছে আর্জেন্টিনা। তিনটি গোল এবং আরেকটি আলমাদার সেই শট। এই আলমাদার ডিফেন্স চেরা পাস থেকেই বল দারুণভাবে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে প্রথম গোলটি করেন আলভারেজ। ফার্নান্দেজের আলতো টোকায় করা গোলটি ৩৩ পাসের ফসল, ৩৫ তমটি ছিল নাহুয়েল মলিনার।
গোল পেতে মরিয়া ব্রাজিল তিনটি পরিবর্তন নিয়ে বিরতির পর মাঠে নেমেছে। রদ্রিগোর জায়গায় এনদ্রিক, জোয়েলিংতনের জায়গায় হোয়াও গোমেজ ও হলুদ কার্য দেখা মুরিল্লোর জায়গায় লিও ওর্তিজ। কিন্তু তাতে ব্রাজিলের খেলার ধার বাড়েনি। আক্রমণভাগ থেকে মিডফিল্ড ছিল বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। রক্ষণে একটু চাপেই ঠকঠক কাঁপুনি! ৫৬ মিনিটে আলমাদার শট পোস্টের ওপর দিয়ে চলে যায়, ৬১ মিনিটে বক্সের ভেতর থেকে হেডে নিশ্চিত গোল মিস করেন নিকোলাস তালিয়াফিকো।
রাফিনিয়া চেষ্টা করেছেন। ফ্রি কিক থেকে বল মানব দেয়ালে মেরেছেন। পোস্টেও মেরেছেন। কিন্তু ম্যাচের আগে যে প্রতিশ্রুতির আগুন তিনি জ্বেলেছিলেন তা নেভাতে তেমন একটা তাগিদ দেখা যায়নি। বিরতির পর দর্শকদের খালি মুখে ফেরত দিলে কেমন দেখায় তাই বুঝি আরেকটি গোল করেছে আর্জেন্টিনা। আলমাদার বদলি নামা জিউলিয়ানো সিমিওনে ৭১ মিনিটে সেই গোলদাতা। ব্রাজিলের রক্ষণ ভেঙেচুরে বাঁ দিক থেকে ঢুকে পড়া তালিয়াফিকোর ক্রস বেশ কঠিন কোণ থেকে নেওয়া শটে গোল করেন আর্জেন্টিনার সাবেক ডিফেন্ডার ডিয়েগো সিমিওনের এই ছেলে।
বিস্তারিত আসছে…।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আর জ ন ট ন র আলম দ র প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
জীবন বাঁচানোর যৌথ যাত্রা
প্রথমবার বন্ধুদের সঙ্গে স্বেচ্ছায় রক্তদানের লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন রাহিল। বয়স তখনও ১৮ হয়নি। সন্ধানীর স্বেচ্ছাসেবীরা তখন বলেছিলেন– ‘১৮ বছর পূর্ণ হলে এসো, জীবন বাঁচাতে রক্ত দিও।’ রাহিল সে কথার মান রেখেছেন। ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার পর নিয়মিত রক্ত দিয়ে চলেছেন, এখন পর্যন্ত ৩৯ বার! তিনি বলেন, ‘মানুষের উপকার করতে পারার আনন্দের সঙ্গে আর কিছু তুলনা হয় না। এই ভাবনা থেকেই রক্তদানের চিন্তা মাথায় আসে।’
১৪ জুন, বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। ২০০৪ সাল থেকে এ দিনটি উদযাপিত হয়ে আসছে, বিশ্বব্যাপী রক্তদাতাদের নিঃস্বার্থ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে– ‘দাও রক্ত, জাগাও আশা– জীবন বাঁচানোর যৌথ যাত্রা’। প্রতিপাদ্যটিই যেন বলে দেয়, একাই নয়– এই পথচলা একসঙ্গে, জীবনের পাশে দাঁড়ানোর যাত্রা।
বাংলাদেশেও স্বেচ্ছায় রক্ত দেওয়ার প্রবণতা আশাব্যঞ্জকভাবে বাড়ছে। পেশাদার ডোনারদের তুলনায় এখন স্বেচ্ছাসেবীর সংখ্যা বেশি। জীবন বাঁচানোর যৌথ যাত্রায় কাজ করে যাচ্ছেন দেশের বহু মানুষ। কেউ এককভাবে, কেউ সংগঠনের ব্যানারে কাজ করছেন এই মানবিক প্রয়াসে। তেমনই একটি সংগঠন ‘ব্লাডম্যান বাংলাদেশ’। নামটি শুনে সুপারহিরোর কথা মনে হতে পারে, তবে তারা বাস্তবের নায়ক। এটি একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, যারা রক্তদাতা ও গ্রহীতার মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি করে। এদের একটি কল সেন্টার রয়েছে– ০১৬২৭-২৬০৯৩৩; যার মাধ্যমে প্রতিদিন কেউ না কেউ ফিরে পান বেঁচে থাকার সুযোগ।
ব্লাডম্যানের প্রতিষ্ঠাতা শাহারিয়ার হাসান জিসান বলেন, ‘দেশে রক্তের যে চাহিদা, তা পুরোপুরি পূরণ হচ্ছে না। স্বেচ্ছায় রক্তদাতার সংখ্যা এখনও প্রয়োজনের তুলনায় কম। ফলে রক্তের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। আরও বেশি মানুষকে এই দায়িত্ব নিতে হবে।’
থ্যালাসেমিয়া রোগী মো. মারুফ বিল্লাহ ২০০৮ সাল থেকে রক্ত নিচ্ছেন। তাঁর অভিজ্ঞতা বেদনাবিধুর– ‘যখন আমার শরীরে রক্ত কমে যায়, তখন বিভিন্ন রকম অসুস্থতার মধ্যে পড়ে যাই। হাত-পা প্রচণ্ড ব্যথা করে। দাঁড়াতে অসুবিধা হয়, মাথা ঘোরে। কোনো কাজ না করা সত্ত্বেও হাঁপাতে থাকি। এ সমস্যা জটিল আকার ধারণ করে যখন রক্ত পাই না। একবার রক্ত না পেয়ে খুব কষ্টের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম আমি ও আমার পরিবার। অনেক খোঁজার পরও আমার গ্রুপের রক্ত পাচ্ছিলাম না। আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি। শেষমেশ এক আত্মীয় এসে রক্ষা করেছিলেন আমাকে। আরেকবার আমি প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়ি। তখনও প্রায় ১০ দিন পর একজন ডোনারের সন্ধান পেলাম। তাঁর হাসপাতালে আসার কথা ছিল। আমি পৌঁছাতে একটু দেরি করে ফেলেছিলাম। কারণ সেদিন কোনো যানবাহন খুঁজে পাচ্ছিলাম না। দেরি হওয়ার জন্য আমি ক্ষমা চাইলাম। তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন, তাচ্ছিল্য করেন। আমি অসহায় ছিলাম। তারপরেও রক্ত মেলেনি। ডোনারের সঙ্গে আমার রক্ত ম্যাচ করল না। ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয় সেসব মুহূর্ত।’
করোনাকালেও এ রকম অসংখ্য মানবিক গল্প জন্ম নিয়েছে। এমনই এক অভিজ্ঞতার কথা জানান রাতুল হাসান। তাঁর মায়ের জরুরি অস্ত্রোপচারে দরকার ছিল দুই ব্যাগ রক্ত। সংক্রমণের ভয়, লকডাউন– সবকিছুর মাঝে এগিয়ে এসেছিলেন দু’জন অচেনা রক্তদাতা। রাতুল বলেন, ‘ওই সাহায্যের কথা আমি কোনো দিন ভুলতে পারব না।’
একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নওশাদ। আদরের সন্তানের থ্যালাসেমিয়া থাকায় প্রায় প্রতি মাসেই এক বা একাধিকবার রক্তের প্রয়োজন হয়। নওশাদ বলেন, ‘প্রতি মাসে যাদের রক্তের প্রয়োজন শুধু তারা ও তাদের পরিবারই জানে কী কঠিন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় আমাদের। জীবন বাঁচাতে এগিয়ে আসা সব রক্তদাতার প্রতি আমাদের চিরকৃতজ্ঞতা।’
রক্তদানের আনন্দ শুধু গ্রহীতার বাঁচিয়ে তোলাতেই সীমাবদ্ধ নয়, দাতার নিজের মধ্যেও তা জন্ম দেয় অপার শান্তি। রক্তগ্রহীতা আর তাঁর পরিবার কৃতজ্ঞ থাকেন জীবন বাঁচানোর জন্য। অন্যদিকে দাতার জন্য এটি যে কী আনন্দের, তা ভাষায় বোঝানো সম্ভব নয়। আবার ধর্মীয় দৃষ্টিকোণেও রক্ত দেওয়া অত্যন্ত পুণ্য বা সওয়াবের কাজ। তেমনি শারীরিক দিক থেকেও এর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতে, নিয়মিত রক্ত দেওয়া শরীরকে রাখে সুস্থ ও সচল, নতুন রক্তকোষ গঠনে সাহায্য করে।
মানবিক ও ধর্মীয় সব দৃষ্টিকোণ থেকে রক্তদাতা অনাবিল শান্তি অনুভব করেন এবং সামাজিকভাবে বিশেষ মর্যাদা পান। বলা হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে দৃঢ় সম্পর্ক হলো রক্তের সম্পর্ক– গভীর, অচ্ছেদ্য বন্ধন। রক্তদানের মাধ্যমে গড়ে ওঠে মানবিকতার সম্পর্ক, গড়ে ওঠে সমাজে সংহতি ও সহমর্মিতার সেতু। রক্ত চেনে না জাতি, বর্ণ, গোত্র কিংবা ধর্ম– এ এক নীরব ভালোবাসার বার্তা। এই নিঃস্বার্থ সম্পর্কগুলোই সমাজকে করে তোলে আরও মানবিক, আরও সংবেদনশীল।
ভূপেন হাজারিকার অমর গানের পঙ্ক্তি মনে পড়ে– ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য।’ এই কথাগুলোর জীবন্ত উদাহরণ আজকের স্বেচ্ছাসেবী রক্তদাতারা। তাদের ভালোবাসা, তাদের নিঃস্বার্থতা আমাদের জীবনযাত্রাকে করে তোলে আরও আলোকিত। রক্তদানের মতো ছোট্ট এক কর্ম, কখনও হয়ে ওঠে কারও জীবনের সবচেয়ে বড় উপহার। v