একটি কাগজের নোট যেভাবে অস্ত্র হয়ে উঠল
Published: 2nd, April 2025 GMT
অর্থনীতি এবং রাজনীতির মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এই সম্পর্ক কখনো দৃশ্যমান, কখনো অদৃশ্য; কখনো শান্তিপূর্ণ, আবার কখনো রক্তক্ষয়ী সংঘাতের জন্ম দিয়েছে। তবে ইতিহাসের সবচেয়ে চতুর কৌশল বোধ হয় একটা কাগজের মুদ্রাকে বিশ্বব্যাপী ক্ষমতার প্রতীক বানানো। অথচ এই কাগজের টুকরার বিনিময়ে আপনি বাস্তব কিছু পাবেন তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।
ডলার হলো সেই মুদ্রা। ধীরে ধীরে সে গোটা পৃথিবীকে তার শিকলে জড়িয়েছে। এটি কীভাবে সম্ভব হলো? এর পেছনে রয়েছে এক দীর্ঘ পরিকল্পনা। এর শিকড় ছড়িয়ে আছে যুদ্ধ, তেল, ঋণ এবং কূটনৈতিক চালবাজির গভীরে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ডলারের রাজত্ব শুরুডলারের বিশ্বজয়ের শুরু হয় ১৯৪৪ সালে। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রায় শেষের দিকে। যুদ্ধে ইউরোপ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ব্রিটেন আর্থিক সংকটে জর্জরিত। জার্মানি ও জাপানের অর্থনীতি চূর্ণ–বিচূর্ণ। এমন অবস্থায় বিশ্ব অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার জন্য আমেরিকার নিউ হ্যাম্পশায়ারে ব্রেটন উডস সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে ভবিষ্যতে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক লেনদেনের ভিত্তি হবে মার্কিন ডলার। আর তা সোনার সঙ্গে যুক্ত থাকবে। অর্থাৎ, প্রতিটি ডলার একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সোনার সমতুল্য হবে। আর বিশ্বের অন্যান্য মুদ্রাগুলো তাদের মান নির্ধারণের জন্য ডলারের ওপর নির্ভর করবে।
এই ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে চলে যায়। কারণ, এখন বিশ্বের অন্যান্য দেশকে নিজেদের মুদ্রার মান ঠিক রাখতে হলে ডলারের রিজার্ভ রাখতে হবে। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও লেনদেনে ডলার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে।
নিক্সনের যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত এবং ডলারের মুক্তিএই ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের একটি সীমাবদ্ধতা ছিল। যেহেতু ডলার স্বর্ণের সঙ্গে যুক্ত, তাই যুক্তরাষ্ট্র চাইলে ইচ্ছেমতো ডলার ছাপাতে পারত না। কারণ, প্রতিটি ডলারের বিপরীতে সমপরিমাণ স্বর্ণ মজুত রাখতে হতো।
কিন্তু ১৯৬০-এর দশকে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্র তখন ভিয়েতনাম যুদ্ধে বিশাল অঙ্কের অর্থ ব্যয় করছে। পাশাপাশি দেশটির ভেতরেই সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্প ও উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে ব্যাপক অর্থ ব্যয় করা হচ্ছিল। এসব কারণে বাজারে প্রচুর ডলার ছড়িয়ে পড়েছিল; কিন্তু সেই অনুপাতে স্বর্ণের মজুত ছিল না।
এরই মধ্যে ফ্রান্সসহ কয়েকটি দেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে দাবি করে যে তারা তাদের হাতে থাকা ডলারের বিনিময়ে স্বর্ণ নিতে চায়। এটি ছিল ব্রেটন উডস চুক্তির নিয়ম অনুযায়ী তাদের বৈধ অধিকার। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পারল, যদি সবাই স্বর্ণ দাবি করতে থাকে, তাহলে তাদের ভান্ডারে থাকা স্বর্ণে টান পড়বে। তৈরি হবে অর্থনৈতিক সংকট।
এই পরিস্থিতিতে ১৯৭১ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এক চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি ঘোষণা করলেন, ‘এখন থেকে ডলার আর স্বর্ণের সঙ্গে যুক্ত থাকবে না।’ এর মানে দাঁড়াল, যুক্তরাষ্ট্র এখন থেকে ইচ্ছেমতো ডলার ছাপাতে পারবে, এবং এর কোনো নির্দিষ্ট মানদণ্ড থাকবে না। বিশ্ব অর্থনীতিতে এটি ছিল এক বিশাল ধাক্কা। এটি ইতিহাসে ‘নিক্সন শক’ নামে পরিচিত।
এই ঘোষণার মাধ্যমে ডলার এক সম্পূর্ণ নতুন রূপে আবির্ভূত হলো। সে এখন শুধু একটি কাগজের মুদ্রা নয়। বরং এক প্রকার বিশ্বাসের প্রতীক। মানুষ যত দিন বিশ্বাস করবে যে ডলার মূল্যবান, তত দিন এটি চলবে।
পেট্রোডলারের সৃষ্টি এবং তেলের রাজনীতিনিক্সন যখন ডলারকে সোনার মান থেকে মুক্ত করলেন, তখন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি নতুন চ্যালেঞ্জ দেখা দিল—বিশ্বের অন্যান্য দেশ কেন এখনো ডলার গ্রহণ করবে? কারণ, এখন এটি কেবল একটি কাগজ, যার পেছনে কোনো বাস্তব সম্পদ নেই।
এই সংকট সমাধানে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের দিকে নজর দিল। ১৯৭৩ সালে সৌদি আরবের সঙ্গে একটি গোপন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেখানে বলা হয়—সৌদি আরব তেল বিক্রির ক্ষেত্রে শুধু ডলার গ্রহণ করবে। এর পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবকে সামরিক সহায়তা ও নিরাপত্তা দেবে। পরবর্তী সময়ে অন্যান্য ওপেক (অর্গানাইজেশন ফর পেট্রোলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিজ) দেশগুলোও এই চুক্তির অনুসরণ করে।
ফলাফল হলো, বিশ্বের সব দেশকে তাদের প্রয়োজনীয় তেল কেনার জন্য ডলার সংগ্রহ করতে হলো। যারাই তেল কিনতে চাইল, তাদের ডলারের প্রয়োজন পড়ল। ফলে, দেশগুলো তাদের রিজার্ভে ডলার জমাতে বাধ্য হলো। এভাবেই ডলার স্বর্ণের পরিবর্তে ‘তেলের মানদণ্ডে’ পরিণত হলো। একে বলা হয় ‘পেট্রোডলার ব্যবস্থা’।
এই ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রকে আরও শক্তিশালী করল। কারণ, এখন তারা যত খুশি ডলার ছাপাতে পারে। বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোকে তা ব্যবহার করতে বাধ্যও করতে পারে।
আন্তর্জাতিক ঋণের ফাঁদ এবং ডলারের আধিপত্যডলার কেবল লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে বিশ্বকে শাসন করেনি, এটি একটি ভয়ংকর ঋণের ফাঁদও তৈরি করেছে।
বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ডলারে ঋণ দিতে শুরু করল। এই ঋণের সঙ্গে কঠোর শর্ত জুড়ে দেওয়া হতো, যেমন—সরকারি সম্পদ বেসরকারিকরণ, সামাজিক খাতের বাজেট কমানো, মার্কিন কোম্পানিগুলোকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া ইত্যাদি।
অনেক দেশ এই ঋণের জালে আটকে পড়ে। তারা ডলার ঋণ নিয়েছে, কিন্তু যখন তারা এটি পরিশোধ করতে পারছে না। ফলে তাদের অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়ছে। তখন যুক্তরাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সেই দেশগুলোর নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করে।
এভাবে ডলার শুধু একটি মুদ্রা নয়, বরং এটি অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠল।
যুক্তরাষ্ট্র এখনো কয়েকটি কৌশল অবলম্বন করছে ডলারের প্রভাব ধরে রাখতে—যেমন, নতুন বাণিজ্য চুক্তি করা; বিশ্বব্যাপী সামরিক উপস্থিতি আরও জোরদার করা ও চীনের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও বাণিজ্যযুদ্ধ চালিয়ে তাদের মুদ্রার উত্থান ঠেকানো।ডলারের আধিপত্যের চ্যালেঞ্জদীর্ঘ কয়েক দশক ধরে মার্কিন ডলার বৈশ্বিক বাণিজ্যের মূল মুদ্রা হিসেবে রাজত্ব করে আসছে। বিশ্বব্যাপী আমদানি-রপ্তানি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ, জ্বালানি লেনদেন—সবকিছুতেই ডলারের একচেটিয়া আধিপত্য ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একাধিক দেশ ও জোট ডলারের বিকল্প ব্যবস্থার দিকে এগোতে শুরু করেছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে শক্তিশালী পরিবর্তনের ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়ে উঠছে, যা ভবিষ্যতে ডলারের অব্যাহত আধিপত্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।
চীন ও ইউয়ানের উত্থান: ডলারের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বীবিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের উত্থান গত দুই দশকে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। ২০০০ সালের দিকে চীনের অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে ছোট ছিল। কিন্তু ২০২০-এর পর দেশটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়। চীন শুধু উৎপাদনশীলতার দিক থেকে নয়, বরং বৈশ্বিক বাণিজ্যে তাদের নিজস্ব মুদ্রা ইউয়ানের ব্যবহার বাড়িয়ে ডলারের আধিপত্যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে।
চীন এখন বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ নামে একটি বিশাল অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। সেখানে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের বহু দেশ যুক্ত হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় চীন বিভিন্ন দেশে ট্রেনলাইন, বন্দর, সড়ক এবং শিল্প–কারখানা নির্মাণ করছে। এর বিনিময়ে চীন ওই দেশগুলোর সঙ্গে ইউয়ানে লেনদেন করছে। ফলে এসব দেশেও ইউয়ানের ব্যবহার বাড়ছে এবং ডলারের বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে উঠছে।
এ ছাড়া চীন বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সঙ্গে মুদ্রা বিনিময় চুক্তি করেছে। এর ফলে দেশগুলো চাইলে ডলারের পরিবর্তে সরাসরি ইউয়ানে লেনদেন করতে পারে।
বিশ্বের বৃহত্তম জ্বালানি রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম রাশিয়া ও ইরান ইতিমধ্যেই চীনের সঙ্গে তেল ও গ্যাস লেনদেনে ডলারের পরিবর্তে ইউয়ান গ্রহণ করছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোও এখন চীনের সঙ্গে ইউয়ানে বাণিজ্য করার পরিকল্পনা করছে।
রাশিয়া ও পেট্রোডলারের পতনের সূচনারাশিয়া ডলারের আধিপত্য ভাঙতে সবচেয়ে আক্রমণাত্মক নীতি গ্রহণ করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এর ফলে রাশিয়ার ব্যাংকগুলোকে আন্তর্জাতিক অর্থ লেনদেনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম সুইফট সিস্টেম থেকে বাদ দেওয়া হয়। এর ফলে রাশিয়া ডলারভিত্তিক লেনদেন থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা শুরু করে।
রাশিয়া এখন তার প্রধান বাণিজ্য অংশীদারদের সঙ্গে রুবল ও ইউয়ানভিত্তিক লেনদেন চালু করেছে। ভারত ও চীনের সঙ্গে রাশিয়া তেলের দাম রুবল ও ইউয়ানে নিচ্ছে, যা ডলারের জন্য বড় একটি ধাক্কা। ফলে ‘পেট্রোডলার’ ব্যবস্থা, যেখানে এখন ধীরে ধীরে দুর্বল হতে শুরু করেছে।
ব্রিকস জোটের বিকল্প মুদ্রা পরিকল্পনাবিশ্ব অর্থনীতিতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে ব্রিকস (ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চায়না, সাউথ আফ্রিকা) জোটের শক্তিশালী হয়ে ওঠা। এই দেশগুলো একত্রিত হয়ে ডলারের বিকল্প একটি মুদ্রা তৈরির চেষ্টা করছে।
২০২৩ সালে ব্রিকস সম্মেলনে নতুন সদস্য হিসেবে সৌদি আরব, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর ও ইথিওপিয়া যোগ দেয়। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত বিশ্বের অন্যতম প্রধান তেল উৎপাদনকারী দেশ। তারা যদি ডলারের বদলে ব্রিকস মুদ্রা বা ইউয়ানে লেনদেন শুরু করে, তাহলে এটি ডলারের ওপর সরাসরি আঘাত হানবে।
ব্রিকস দেশগুলো নিজেদের মধ্যে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একটি বিকল্প আন্তর্জাতিক মুদ্রা বা ডিজিটাল মুদ্রা চালুর পরিকল্পনা করছে। যদি তারা এটি বাস্তবায়ন করতে পারে, তবে এটি ডলারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
মধ্যপ্রাচ্যে পরিবর্তন: সৌদি আরব কি ডলার ছেড়ে দেবে?২০২৩ সালে চীন ও সৌদি আরবের মধ্যে ইউয়ানে তেল বিক্রির আলোচনা শুরু হয়। সৌদি আরব যদি চূড়ান্তভাবে ইউয়ানে তেল বিক্রি শুরু করে, তাহলে এটি পেট্রোডলার ব্যবস্থার অবসান ঘটাতে পারে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত ইতিমধ্যেই চীনের সঙ্গে ইউয়ানে লেনদেন শুরু করেছে। এ ছাড়া ইরান ও রাশিয়া আগেই ডলারের বিকল্প খুঁজে নিয়েছে। ফলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর এই পরিবর্তন ডলারের ভবিষ্যৎ নিয়ে বড় প্রশ্ন তৈরি করেছে।
ডিজিটাল মুদ্রার উত্থান: ডলার কি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে?বিশ্বব্যাপী ক্রিপ্টোকারেন্সি ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিজিটাল মুদ্রা ব্যবস্থার উত্থান ডলারের জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
চীন ইতোমধ্যেই ‘ডিজিটাল ইউয়ান’ চালু করেছে, যা দেশটির অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক লেনদেনে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইউরোপ, রাশিয়া এবং ভারতের মতো দেশগুলোও তাদের নিজস্ব ডিজিটাল মুদ্রার উন্নয়ন করছে।
যদি এই ডিজিটাল মুদ্রাগুলো ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে, তাহলে বিশ্বব্যাপী ডলারের ব্যবহার কমতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র কি এই পরিবর্তন ঠেকাতে পারবে?ডলারের আধিপত্য হারানো যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিশাল অর্থনৈতিক ধাক্কা হতে পারে। কারণ, মার্কিন সরকার এত দিন ধরে বিশাল পরিমাণ ঋণ নিয়ে চলেছে, যার বেশির ভাগই ডলার ছাপিয়ে পরিশোধ করা হয়। যদি বিশ্ব ডলারের বিকল্প ব্যবহার শুরু করে, তাহলে মার্কিন ডলারের চাহিদা কমে যাবে এবং মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পাবে।
তবে যুক্তরাষ্ট্র এখনো বেশ কয়েকটি কৌশল অবলম্বন করছে ডলারের প্রভাব ধরে রাখতে—যেমন, নতুন বাণিজ্য চুক্তি করা; বিশ্বব্যাপী সামরিক উপস্থিতি আরও জোরদার করা ও চীনের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও বাণিজ্যযুদ্ধ চালিয়ে তাদের মুদ্রার উত্থান ঠেকানো।
তবে প্রশ্ন থেকেই যায়—এই কৌশলগুলো কত দিন কার্যকর থাকবে?
ডলার এখনো বিশ্বের প্রধান মুদ্রা। কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতিতে দ্রুত পরিবর্তন আসছে। চীন, রাশিয়া, ব্রিকস দেশগুলো এবং মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ ডলারের বিকল্প ব্যবস্থার দিকে এগোচ্ছে।
রাতারাতি হয়তো কিছু ঘটবে না। তবে একসময় ব্রিটিশ পাউন্ডও বিশ্বব্যাপী আধিপত্য বিস্তার করেছিল। এখন তার সেই দাপট আর নেই। ডলারের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটতে চলেছে? উত্তর সময়ই দেবে।
জাভেদ হুসেন প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব শ ব র অন য ন য ত ক ল নদ ন ব যবস থ র ল র র জন র র জন য স বর ণ র প রকল প ব যবহ র ও ইউয় ন সবচ য় র এখন ইউর প ন করছ
এছাড়াও পড়ুন:
খুলনায় এক মাসে ১৩ লাশ উদ্ধার, বাড়ছে উদ্বেগ
বাড়িতে ঝগড়া চলছিল বড় ভাই ও ভাবির। ছোট ভাই এসে ঝগড়া থামানোর চেষ্টা করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বড় ভাই ছোট ভাইয়ের মাথায় শাবল দিয়ে আঘাত করেন। মাটিতে লুটিয়ে পড়লে ধারালো বঁটি দিয়ে ছোট ভাইকে হত্যা করেন। পরে বড় ভাই শহিদুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তিনি এখন কারাগারে। ঘটনাটি ঘটেছে গত ৩০ মে, খুলনার কয়রা উপজেলার বাগালী ইউনিয়নের উলা গ্রামে।
এর আগে ২৭ মে কয়রার ইসলামপুর গ্রামের কয়রা নদীর চর থেকে শিকলে বাঁধা অবস্থায় আবদুল মজিদ (৬২) নামের এক বৃদ্ধের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ছাড়া ৮ জুন কয়রার কাছারিবাড়ি বাজার-সংলগ্ন পুকুর থেকে নমিতা (৪০) নামের এক নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়।
১০ জুন কয়রা সদরের গোবরা সড়কে এক ভ্যানচালকের সঙ্গে এক মোটরসাইকেলচালকের কথা-কাটাকাটিকে কেন্দ্র করে দুই গ্রামের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে আহত হন অন্তত ১৫ জন। ঘটনায় ১২ জনকে আসামি করে থানায় মামলাও হয়েছে। এ ছাড়া কথা-কাটাকাটির জেরে কয়রার পল্লীমঙ্গল গ্রামে গত তিন দিনে কয়েক দফা মারামারি, হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।
অসন্তোষ-দ্বন্দ্বের জেরে কয়রা উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকায় হত্যা–সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। ১০ মে থেকে ৯ জুন পর্যন্ত এক মাসে খুলনার ১০টি থানা এলাকায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনাসহ ১৩টি লাশ উদ্ধার হয়েছে। এ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে।
কয়রা কপোতাক্ষ মহাবিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষক বিদেশ রঞ্জন মৃধা বলেন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উপাদান কমে যাওয়ায় মানুষ অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। মূল্যবোধ ও ভারসাম্য নষ্ট হয়ে মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব ও ভালোবাসা কমে যাচ্ছে। এতে খুনখারাবি বাড়ছে। একসময় সমাজের একজনের ভালোতে সবাই আনন্দ পেতেন। নেতিবাচক দিকগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করতেন। এখন সেই ব্যবস্থা উঠেই গেছে বলা যায়। পাশাপাশি রাজনৈতিক আধিপত্যের লড়াইয়ে প্রভাববলয় সৃষ্টি করতেও সহিংসতার ঘটনা ঘটছে।
৩ জুন খুলনা শহরে দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে সবুজ হাওলাদার (৩০) নামের এক যুবকের মৃত্যু হয়। ৪ জুন খুলনা সদর থানার মতিয়াখালী খালের মধ্যে আটকে ছিল এক নারীর মরদেহ। পরে পুলিশ গিয়ে মরদেহ উদ্ধার করে। ওই নারীর পরিচয় না পেয়ে বেওয়ারিশ হিসেবে আঞ্জুমান মুফিদুলে দাফন করা হয়। গত ৯ জুন বিকেলে রূপসা উপজেলার আঠারোবেকী নদীতে পাওয়া যায় অজ্ঞাতনামা যুবকের মরদেহ। মরদেহের শ্বাসনালিতে গভীর ক্ষতচিহ্ন ছিল। রূপসা নৌ পুলিশের ওসি আবুল খায়ের বলেন, ধারণা করা হচ্ছে, এটি একটি হত্যাকাণ্ড।
এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে রহস্য উদ্ঘাটন ও অপরাধী শনাক্তে দীর্ঘসূত্রতার কারণেই অপরাধ বেড়ে চলেছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ মানবাধিকার ব্যুরোর কয়রা উপজেলা শাখার সভাপতি তরিকুল ইসলাম। তাঁর ভাষ্য, প্রতিটি ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত শেষে দোষীদের আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারলে অপরাধপ্রবণতা কমে আসবে। আইনি প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার কারণে অপরাধ বেড়ে চলেছে।
কয়রা উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুলী বিশ্বাস বলেন, সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনায় এলাকার মানুষের মধ্যে উৎকণ্ঠা বাড়ছে, এটা ঠিক। তবে প্রতিটি ঘটনায় পুলিশও তাৎক্ষণিকভাবে আইনি ব্যবস্থা নিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। যে বিষয়গুলো পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সামাজিক ভ্রাতৃত্ববোধের মধ্য দিয়ে সমাধান করা যায়, সেখানে খুনাখুনি, অস্থিরতা, মামলা-হামলার মধ্য দিয়ে একধরনের বিভীষিকাময় পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে; যা সবার জন্যই অকল্যাণকর ও ভয়ানক।