আশ্রয়ণ প্রকল্প লুটপাটে ইউএনও একাই একশ
Published: 4th, April 2025 GMT
বগুড়ার ধুনটের সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সঞ্জয় কুমার মোহন্তের বিরুদ্ধে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৭৮টি ঘর নির্মাণের টাকা আত্মসাৎ এবং ঘর বরাদ্দের সময় গৃহহীনের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। আশ্রয়ণ প্রকল্প থেকে তিনি অন্তত ২ কোটি টাকা লুটপাট করেছেন।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ধুনটে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ‘মুজিব শতবর্ষের উপহার’ হিসেবে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় চার ধাপে ৩৯৯টি ঘর নির্মাণের জন্য ৭ কোটি ৯৩ লাখ ৯১ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে ৩৯৯ ঘরের মধ্যে ২৬১টি বরাদ্দের সুবিধাভোগীর নামের তালিকা পাওয়া গেলেও বাদ বাকি ৭৮ ঘরের হদিস মেলেনি। ঘরের নামে অর্থ বরাদ্দ ও নির্মাণ খরচের হিসাব একটি নথিতে পাওয়া যায়। তবে কার নামে কোথায় এই ৭৮টি ঘর নির্মাণ ও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তা নেই। বরাদ্দের প্রমাণ লোপাটের জন্য ওই ঘরের নামে অর্থ বরাদ্দ ও বিতরণের কোনো তথ্য সংরক্ষণ করা হয়নি।
তখন জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে প্রকল্পের তদারকির দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) উজ্জ্বল কুমার ঘোষ। তিনিও এই প্রকল্পের দুর্নীতিতে সহায়তা করেছেন বলে অভিযোগ আছে।
জানা গেছে, আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়নে ইউএনও সভাপতি, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সদস্য সচিব, সহকারী কমিশনার (ভূমি), উপজেলা প্রকৌশলী (এলজিইডি) ও সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে সদস্য এবং উপজেলা চেয়ারম্যানকে উপদেষ্টা রেখে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণ করার কথা। তবে ইউএনও সঞ্জয় কুমার কাগজকলমে ঘর নির্মাণ কমিটি করলেও বাস্তবে কাউকে সঙ্গে রাখেননি। ঠিকাদার নিয়োগ ছাড়াই তিনি একাই ঘর নির্মাণকাজ করেন।
ইউএনওর চাঁদাবাজি
আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণে ইউএনও সঞ্জয় কুমারের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ করেন ধুনট উপজেলা ইটভাটার মালিকরা। মথুরাপুর এলাকার এসএসএস ইটভাটার মালিক শাহা আলী জানান, সঞ্জয় কুমার মোবাইলে ফোনে তাঁর কাছ থেকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণের জন্য ৬০ হাজার ইট চান। ইট দিতে না পারায় ইউএনও ক্ষুব্ধ হয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে ৫ লাখ টাকা জরিমানা করেছিলেন।
ধুনট ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি হায়দার আলী হিন্দোল জানান, ইউএনও ইটভাটা বন্ধ করার হুমকি দিয়ে প্রত্যেক ভাটা থেকে ৫০ থেকে ৬০ হাজার করে ইট নিয়েছেন। কিন্তু টাকা পরিশোধ করেননি। রামনগরের বালু ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম জানান, ইউএনও ১০০ ট্রাক বালু নিয়ে দাম পরিশোধ করেননি।
কমিটির সদস্যরা যা বলেছেন
সাবেক প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) আব্দুল আলীম বলেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণের সব কাজ ইউএনও একাই করেছেন। অনেকটা চাপের মুখে শুধু টাকা তোলার জন্য কাগজপত্র ও চেকে আমাকে সই দিতে হয়েছে। ঘর নির্মাণ কমিটির সদস্য ধুনট সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাসুদ রানা জানান, ঘর নির্মাণের টাকা বরাদ্দ ও ভূমিহীনদের মাঝে ঘর বরাদ্দ দেওয়ার বিষয়ে তাদের কিছুই জানানো হয়নি।
সাবেক ধুনট উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল হাই খোকন বলেন, ভূমি ও গৃহহীনের ঘর নির্মাণ ও বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে সাবেক এমপি হাবিবর রহমানের যোগসাজশে সঞ্জয় কুমার ৭৮টি ঘর নির্মাণ না করেই টাকা আত্মসাৎ করেছেন। আব্দুল হাই খোকন উপজেলা চেয়ারম্যান থাকার সময় ইউএনওর বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন। তবে কোনো প্রতিকার হয়নি।
বগুড়া দুদকের উপপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সঞ্চয় কুমারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে দেখব, কী অভিযোগ ছিল।
ঘর বরাদ্দে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে টাকা ভূমি ও গৃহহীনের জন্য ঘর বরাদ্দের নামে সঞ্জয় কুমারের বিরুদ্ধে লাখ লাখ টাকা ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। টাকার বিনিময়ে ঘর বরাদ্দ দেওয়ার কারণে প্রকৃত গৃহহীনের ভাগ্যে ঘরজেটেনি।
গোসাইবাড়ি বাজারের ব্রিজের পাশে বাস করা জোছনা খাতুন বলেন, চুনিয়াপাড়া এলাকায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি ঘরের জন্য সঞ্জয় কুমারের কাছে আকুতি-মিনতি করেও ঘর পাইনি। যারা ৪০ থেকে ৫০ হাজার করে টাকা দিয়েছে তারাই ঘর পেয়েছে। একই এলাকার স্বামীহারা দিপালী রানী বলেন, দুই মেয়েকে নিয়ে রাস্তার পাশে বাস করছি। একটি ঘরের জন্য ইউএনওর কাছে একাধিকবার গিয়েছি, কিন্তু টাকা দিতে না পারায় ঘর পাইনি।
এদিকে গোসাইবাড়ি কলেজ পাড়ায় আধাপাকা ঘর থাকার পরও আজাহার আলী মণ্ডলের স্ত্রী আনজুয়ার খাতুন চুনিয়াপাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর পেয়েছেন। আজাহার আলী মণ্ডলের জামাতা শামীম হোসেনের জমি ও ঘরবাড়ি থাকার পরও মেয়ে রাশেদা খাতুনও ঘর পেয়েছেন টাকার বিনিময়ে।
বাসের অযোগ্য উপহারের ঘর
নির্মাণকাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করে দায়সারাভাবে ঘর তৈরি করায় বছর না যেতেই প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের ঘরের প্লাস্টার খসে পড়েছে। দেয়ালে ধরেছে ফাটল, জানালা-দরজা ভেঙে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ধুনট সদরের কালেজপাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের সুবিধাভোগী সোবহান বলেন, চিমটি দিলেই ঘরের প্লাস্টার খসে পড়ে, বৃষ্টি হলে ঘরের ভেতর পানি ঢোকে।
ধুনট উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) ফরিদুল ইসলাম বলেন, ওই সময়ে আশ্রয়ণ প্রকল্প নিয়ে কী হয়েছে তা আমার জানা নেই। সে সময়কার ৭৮টি ঘরের জন্য টাকা বরাদ্দ ও বিতরণের কোনো তথ্য আমার দপ্তরে নেই।
ধুনটের বর্তমান ইউএনও খৃষ্টফার হিমেল রিছিল বলেন, আশ্রয়ণ প্রকল্প নিয়ে এ ধরনের দুর্নীতির ঘটনা ঘটলে তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও বর্তমানে টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) সঞ্চয় কুমার মোহন্তের সঙ্গে যোগাযোগ করে সমকাল। তিনি বলেন, ঘর নির্মাণ না করে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ মিথ্যা। আমি বরাদ্দ অনুযায়ী ঘর নির্মাণ করে ভূমি ও গৃহহীনের মাঝে দিয়েছি। জেলা প্রশাসক হোসনা আফরোজ বলেন, এ বিষয়ে অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ঘর ন র ম ণ র কর মকর ত বর দ দ র বর দ দ ও কর ছ ন র জন য উপজ ল ইটভ ট সদস য
এছাড়াও পড়ুন:
শেরপুরে বেশি দামে সার বিক্রি: ২ ব্যবসায়ীকে সোয়া লাখ টাকা জরিমানা
শেরপুরে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে সার বিক্রি করায় দুই সার ব্যবসায়ীকে প্রায় সোয়া লাখ টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) দুপুরে শেরপুর পৌর শহরের আখের মাহমুদ বাজারে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান পরিচালনা করা হয়। এ সময় এক বিএডিসি সার ডিলারকে ১ লাখ টাকা ও লাইসেন্সবিহীন সার বিক্রি করায় আরেক ব্যবসায়ীকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
আরো পড়ুন:
সোনারগাঁয়ে মহাসড়কে ১০০০ স্থাপনা উচ্ছেদ
ঝিনাইদহে ২৫০টি অবৈধ জাল জব্দ, বাঁধ উচ্ছেদ
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ ভুইয়া আদালত পরিচালনা করেন। তিনি জরিমানার তথ্য জানান।
ইউএনও আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ ভুইয়া বলেন, ‘‘সার বিক্রিতে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়ায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে দুই অসাধু ব্যাবসায়ীকে জরিমানা করা হয়েছে। কৃষকের উপর জুলুম মেনে নেওয়া হবে না।’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘আমাদের বিভিন্ন সোর্স এ সব অসাধু ব্যবসায়ীদের খোঁজখবর রাখছেন। যার বিরুদ্ধে প্রমাণ পাওয়া যাবে, তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।’’ জনস্বার্থে এ ধরনের অভিযান চলমান থাকবে বলেও জানান তিনি।
অভিযানকালে সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মুসলিমা খানম নীলু, উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেনসহ অন্যান্যরা উপস্থিত ছিলেন।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি রোপা আমন মৌসুমে কৃত্রিম সার সংকট দেখিয়ে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে কৃষকদের কাছে সার বিক্রি করছেন। বেশি দাম নেওয়ার অভিযোগ পেয়ে মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) দুপুরে শহরের আখের মাহমুদ বাজারে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। অভিযানকালে বেশি দামে সার বিক্রির প্রমাণ পেয়ে বিএডিসি সার ডিলার মেসার্স মীম এন্টারপ্রাইজকে ১ লাখ টাকা জরিমানা করেন। একইসঙ্গে লাইসেন্সবিহীন সার বিক্রয় করায় একই বাজারের কীটনাশক বিক্রেতা শিশির এন্টারপ্রাইজকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
শেরপুর সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মুসলিমা খানম নীলু বলেন, ‘‘আমন মৌসুসে সারের দাম ও চাহিদার ভারসাম্য রক্ষায় আমরা নিয়মিত অভিযান করছি। আমরা যেখানে অভিযোগ পাচ্ছি, সেখানে অভিযান পরিচালনা করছি। সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে সার বিক্রির সুযোগ নেই।’’
ঢাকা/তারিকুল/বকুল