যখন ভবিষ্যতের কোনো ইতিহাসবিদ আমাদের এই সময় নিয়ে লিখবেন, তখন তাঁর মনে হবে, এই সময়ে সব আন্তর্জাতিক আইন অর্থহীন হয়ে গিয়েছিল। মুছে গিয়েছিল ন্যায় আর মানবতার ধারণা। আর পশ্চিমা বিশ্ব যে গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের মুখোশ পরে থাকে, সেই মুখোশ ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়েছিল।

যখন জেগে থাকা প্রতিটি মুহূর্ত আমাদের সামনে এক ভয়াবহ গণহত্যার চিত্র তুলে ধরে, তখন আর কীই–বা বলা যায়? যখন শিশুদের থেঁতলানো মুখ, বিচ্ছিন্ন অঙ্গ, আহত মায়েদের কান্না আর চিহ্নহীন মৃতদেহগুলো আমাদের চোখের সামনে ঘুরতে থাকে.

... মানুষ আর তার মানবিক সত্তা যেন নিখোঁজ হয়ে গেছে।

যাদের হাতে রয়েছে ধ্বংসের সবচেয়ে আধুনিক অস্ত্র, সেই সব ক্ষমতাধর রাষ্ট্র নিঃসংকোচে, নির্লজ্জভাবে তা ব্যবহার করছে। শুধু তা–ই নয়, নিজেদের এই রক্তপিপাসাকে ন্যায়সংগত প্রমাণ করতে তারা তৈরি করছে বানানো তথ্য, বিকৃত ইতিহাস। 

ইসরায়েলের নেতানিয়াহু সরকার যেন অবাধ ছাড় পেয়েছে এই জাতিগত নির্মূল অভিযান চালানোর জন্য। ঘরবাড়ি ধ্বংস, খাদ্য ও চিকিৎসার সরবরাহ বন্ধ, পরিকল্পিত অনাহার ও মৃত্যুর ফাঁদ—সবই চলছে একেবারে নির্লজ্জভাবে। আর এই নৃশংসতার প্রধান পৃষ্ঠপোষক যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অন্যান্য পশ্চিমা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র।

যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র, যুদ্ধবিমান, গোলাবারুদ ও ‘স্মার্ট বোমা’ পাঠাচ্ছে। যুক্তরাজ্য থেকেও প্রতিদিন সাইপ্রাসে অবস্থিত একটি ঘাঁটি থেকে বিমান দিয়ে গাজায় নজরদারি চালানো হচ্ছে, যাতে ইসরায়েল তাদের লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করতে পারে। এসব খবর গণমাধ্যমেই এসেছে। কোনো সরকার তা অস্বীকারও করেননি। ইসরায়েলে পুরো ইউরোপ, বিশেষ করে জার্মানি ও ইতালি অস্ত্র রপ্তানি করে যাচ্ছে অব্যাহতভাবে।

বেশির ভাগ ইসরায়েল-সমর্থকের কাছে ফিলিস্তিন সমস্যা যেন হঠাৎ করেই ২০২৩ সালের অক্টোবরে হামাসের আক্রমণের মাধ্যমে শুরু হয়েছে। তাঁরা দেখতে চান না কিংবা স্বীকার করেন না যে এর সূচনা বহু আগেই—১৯৪৮ সালের ‘নাকবা’ বা ফিলিস্তিনিদের উৎখাত থেকে। সেই সঙ্গে এসেছে দখলদারত্ব। ৭৫ বছরের বেশি সময় ধরে চলে আসা ফিলিস্তিনিদের ভূমি, স্বাধীনতা, মর্যাদা ও সমতার অধিকারের নিরন্তর অস্বীকৃতি।

ইসরায়েল তার কার্যকলাপ গোপনে করে না। বরং তারা এমনভাবে কাজ করে, যেন বিশ্ব জানতে পারে তারা কতটা নির্লজ্জ ও দায়মুক্তভাবে কাজগুলো করে যেতে পারে। এর সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত—গাজায় ১৫ জন জরুরি সেবা ও উদ্ধারকর্মীর গণহত্যা, যাঁদের মরদেহ পাওয়া গেছে একটি অগভীর গণকবরে। 

ইসরায়েল তার কার্যকলাপ গোপনে করে না। বরং তারা এমনভাবে কাজ করে, যেন বিশ্ব জানতে পারে তারা কতটা নির্লজ্জ ও দায়মুক্তভাবে কাজগুলো করে যেতে পারে। এর সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত—গাজায় ১৫ জন জরুরি সেবা ও উদ্ধারকর্মীর গণহত্যা, যাঁদের মরদেহ পাওয়া গেছে একটি অগভীর গণকবরে। 

ইসরায়েলের দাবি ছিল, অ্যাম্বুলেন্সগুলো ‘সন্দেহজনক ও বিপজ্জনকভাবে’ চলছিল। তাই তাঁদের গুলি করা হয়। কিন্তু তারা ব্যাখ্যা দেয়নি যে কেন নিহত ব্যক্তিদের কারও কারও হাত পেছনে বাঁধা ছিল।

নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন মেডিকেলকর্মী জীবিত ছিলেন। তাঁকেও ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। তারপর সম্ভবত ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়, যেন তিনি বেঁচে ফিরে গিয়ে বিশ্বকে জানাতে পারেন, কী ভয়াবহ বর্বরতা চালানো হয়েছে। এটা কি কোনো বিকৃত, অসুস্থ মানসিকতার পরিকল্পনা?

এই দৃশ্যপট মনে করিয়ে দেয় ১৯৮০-৯০ দশকের দক্ষিণ আফ্রিকার আন্দোলনের কথা। তখন সারা বিশ্বে বর্ণবৈষম্যমূলক রাষ্ট্রটির বিরুদ্ধে বর্জনের ডাক উঠেছিল। 

কিন্তু তখনকার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করে ‘গঠনমূলক সম্পৃক্ততা’ নামক এক শব্দবন্ধ তুলে আনেন। তিনি দাবি করেছিলেন যে বাণিজ্য ও সম্পর্ক রাখলে সেই দেশের ওপর প্রভাব বিস্তার করা যায়।

আজ অনেক ইসলামি ও আরব রাষ্ট্রও হয়তো একই নীতি অনুসরণ করছে। এমনকি যখন গাজায় গণহত্যা আবার শুরু হলো, তখনো ইসরায়েলে নিযুক্ত সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রদূত তেল আবিবে এক জমকালো ইফতারের ছবি পোস্ট করেন, যেখানে লোকজন খাবারে ভরপুর টেবিল ঘিরে বসে ভোজে মত্ত। অথচ ঠিক সেই সময় গাজার দিকে মানবিক সহায়তা, খাদ্য বা ওষুধ কিছুই প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছিল না।

এটা কি আরব রাষ্ট্রগুলোর ‘গঠনমূলক সম্পৃক্ততা’? নাকি আত্মপ্রবঞ্চনা? এই দৃশ্যপটে প্রশ্ন উঠতেই পারে, পশ্চিমা গণতন্ত্র আর মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব কি নিজেদের বিবেককে কোনো হিমঘরে রেখে দিয়েছে? পুরো ফিলিস্তিন ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত সেই বিবেক কি আর জাগবে না?

আব্বাস নাসির ডন পত্রিকার সাবেক সম্পাদক

ডন থেকে নেওয়া ইংরেজির অনুবাদ

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইসর য় ল গণহত য

এছাড়াও পড়ুন:

একাত্তরের গণহত্যার জন্য জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে হবে: আলাল

বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেছেন, ‘‘বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি তোলা উচিত, চব্বিশ এবং আগের গণহত্যা, নির্যাতন-নিপীড়ন, ভোটাধিকার হরণ—এসবের জন্য যদি আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হতে পারে। তাহলে একাত্তরে গণহত্যা, ধর্ষণ, নারকীয় হত্যাযজ্ঞের জন্য জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করতে হবে। তাদের কার্যক্রমও নিষিদ্ধ করতে হবে। একই অপরাধে দুই রকমের বিচার হতে পারে না।’’

শনিবার (১ নভেম্বর) রাজধানী ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের আয়োজনে ‘স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষায় আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অপরিহার্য’ শীর্ষক মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

আরো পড়ুন:

দ্রুত নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করুন: দুলু

নৌকা ডুবেছে, শাপলা ভাসবে: এনসিপির তুষার

মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘‘যদি আওয়ামী লীগের মতো একই ধরনের অপরাধে জামায়াতের বিচার না হয়, তাহলে সেটা হবে ইতিহাসের প্রতি অবিচার।’’

তিনি বলেন, ‘‘আজকে জামায়াত তাদের পোশাক-চেহারা, আচরণ পাল্টে নতুন রূপে হাজির হয়েছে। তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে বৈঠক করছে। কিন্তু, মূল উদ্দেশ্য বিএনপিকে আক্রমণ করা। এই বহুরূপীদের চেহারা জনগণ চিনে ফেলেছে।’’

বিএনপির এই নেতা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে বিএনপিই একমাত্র শক্তি। অথচ এই শক্তিকে দুর্বল করার ষড়যন্ত্র চলছে। সরকার নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে নির্বাচনের নামে প্রক্রিয়া চালালেও জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা কেড়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

আলাল আরো বলেন, ‘‘বর্তমান সরকার মনে করেছে, দেশের সব অনাচারের মূলে সংবিধান। কিন্তু সমস্যার মূল সংবিধান নয়—ক্ষমতার অপব্যবহার ও জনগণের ভোটাধিকার হরণ। শেখ হাসিনার ১৬-১৭ বছরের শাসনে এই অন্যায়, নির্যাতন, দুর্নীতি ও অর্থ পাচারই হয়েছে সবচেয়ে বড় বাস্তবতা।’’

ঢাকা/রায়হান/রাজীব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • শাহরুখ খান: গণহত্যার সময় বিলিয়নিয়ার হওয়ার অর্থ কী
  • ৩০০ আসনে প্রার্থী বাছাই প্রায় চূড়ান্ত: তারেক রহমান
  • গণতন্ত্রের পথে সংকট দেখছেন তারেক
  • এমন তো হবার কথা ছিল না: তারেক রহমান
  • সুদানে গণহত্যার প্রতিবাদে জাবি ও জবিতে মানববন্ধন
  • জুলাইবিরোধী শক্তির শাস্তি দাবিতে ইবিতে বিক্ষোভ
  • সুদানে আরএসএফের গণহত্যায় আরব আমিরাত ইন্ধন দিচ্ছে কেন
  • একাত্তরের গণহত্যার জন্য জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে হবে: আলাল
  • সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠাই এখন জাতির দাবি
  • জনগণের বৃহত্তর ঐক্য ছাড়া এই ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থার পতন হবে না: সাকি