পশ্চিমা গণতন্ত্র ও মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বের বিবেক কি জাগবে না
Published: 8th, April 2025 GMT
যখন ভবিষ্যতের কোনো ইতিহাসবিদ আমাদের এই সময় নিয়ে লিখবেন, তখন তাঁর মনে হবে, এই সময়ে সব আন্তর্জাতিক আইন অর্থহীন হয়ে গিয়েছিল। মুছে গিয়েছিল ন্যায় আর মানবতার ধারণা। আর পশ্চিমা বিশ্ব যে গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের মুখোশ পরে থাকে, সেই মুখোশ ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়েছিল।
যখন জেগে থাকা প্রতিটি মুহূর্ত আমাদের সামনে এক ভয়াবহ গণহত্যার চিত্র তুলে ধরে, তখন আর কীই–বা বলা যায়? যখন শিশুদের থেঁতলানো মুখ, বিচ্ছিন্ন অঙ্গ, আহত মায়েদের কান্না আর চিহ্নহীন মৃতদেহগুলো আমাদের চোখের সামনে ঘুরতে থাকে.
যাদের হাতে রয়েছে ধ্বংসের সবচেয়ে আধুনিক অস্ত্র, সেই সব ক্ষমতাধর রাষ্ট্র নিঃসংকোচে, নির্লজ্জভাবে তা ব্যবহার করছে। শুধু তা–ই নয়, নিজেদের এই রক্তপিপাসাকে ন্যায়সংগত প্রমাণ করতে তারা তৈরি করছে বানানো তথ্য, বিকৃত ইতিহাস।
ইসরায়েলের নেতানিয়াহু সরকার যেন অবাধ ছাড় পেয়েছে এই জাতিগত নির্মূল অভিযান চালানোর জন্য। ঘরবাড়ি ধ্বংস, খাদ্য ও চিকিৎসার সরবরাহ বন্ধ, পরিকল্পিত অনাহার ও মৃত্যুর ফাঁদ—সবই চলছে একেবারে নির্লজ্জভাবে। আর এই নৃশংসতার প্রধান পৃষ্ঠপোষক যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অন্যান্য পশ্চিমা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র, যুদ্ধবিমান, গোলাবারুদ ও ‘স্মার্ট বোমা’ পাঠাচ্ছে। যুক্তরাজ্য থেকেও প্রতিদিন সাইপ্রাসে অবস্থিত একটি ঘাঁটি থেকে বিমান দিয়ে গাজায় নজরদারি চালানো হচ্ছে, যাতে ইসরায়েল তাদের লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করতে পারে। এসব খবর গণমাধ্যমেই এসেছে। কোনো সরকার তা অস্বীকারও করেননি। ইসরায়েলে পুরো ইউরোপ, বিশেষ করে জার্মানি ও ইতালি অস্ত্র রপ্তানি করে যাচ্ছে অব্যাহতভাবে।
বেশির ভাগ ইসরায়েল-সমর্থকের কাছে ফিলিস্তিন সমস্যা যেন হঠাৎ করেই ২০২৩ সালের অক্টোবরে হামাসের আক্রমণের মাধ্যমে শুরু হয়েছে। তাঁরা দেখতে চান না কিংবা স্বীকার করেন না যে এর সূচনা বহু আগেই—১৯৪৮ সালের ‘নাকবা’ বা ফিলিস্তিনিদের উৎখাত থেকে। সেই সঙ্গে এসেছে দখলদারত্ব। ৭৫ বছরের বেশি সময় ধরে চলে আসা ফিলিস্তিনিদের ভূমি, স্বাধীনতা, মর্যাদা ও সমতার অধিকারের নিরন্তর অস্বীকৃতি।
ইসরায়েল তার কার্যকলাপ গোপনে করে না। বরং তারা এমনভাবে কাজ করে, যেন বিশ্ব জানতে পারে তারা কতটা নির্লজ্জ ও দায়মুক্তভাবে কাজগুলো করে যেতে পারে। এর সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত—গাজায় ১৫ জন জরুরি সেবা ও উদ্ধারকর্মীর গণহত্যা, যাঁদের মরদেহ পাওয়া গেছে একটি অগভীর গণকবরে।ইসরায়েল তার কার্যকলাপ গোপনে করে না। বরং তারা এমনভাবে কাজ করে, যেন বিশ্ব জানতে পারে তারা কতটা নির্লজ্জ ও দায়মুক্তভাবে কাজগুলো করে যেতে পারে। এর সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত—গাজায় ১৫ জন জরুরি সেবা ও উদ্ধারকর্মীর গণহত্যা, যাঁদের মরদেহ পাওয়া গেছে একটি অগভীর গণকবরে।
ইসরায়েলের দাবি ছিল, অ্যাম্বুলেন্সগুলো ‘সন্দেহজনক ও বিপজ্জনকভাবে’ চলছিল। তাই তাঁদের গুলি করা হয়। কিন্তু তারা ব্যাখ্যা দেয়নি যে কেন নিহত ব্যক্তিদের কারও কারও হাত পেছনে বাঁধা ছিল।
নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন মেডিকেলকর্মী জীবিত ছিলেন। তাঁকেও ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। তারপর সম্ভবত ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়, যেন তিনি বেঁচে ফিরে গিয়ে বিশ্বকে জানাতে পারেন, কী ভয়াবহ বর্বরতা চালানো হয়েছে। এটা কি কোনো বিকৃত, অসুস্থ মানসিকতার পরিকল্পনা?
এই দৃশ্যপট মনে করিয়ে দেয় ১৯৮০-৯০ দশকের দক্ষিণ আফ্রিকার আন্দোলনের কথা। তখন সারা বিশ্বে বর্ণবৈষম্যমূলক রাষ্ট্রটির বিরুদ্ধে বর্জনের ডাক উঠেছিল।
কিন্তু তখনকার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করে ‘গঠনমূলক সম্পৃক্ততা’ নামক এক শব্দবন্ধ তুলে আনেন। তিনি দাবি করেছিলেন যে বাণিজ্য ও সম্পর্ক রাখলে সেই দেশের ওপর প্রভাব বিস্তার করা যায়।
আজ অনেক ইসলামি ও আরব রাষ্ট্রও হয়তো একই নীতি অনুসরণ করছে। এমনকি যখন গাজায় গণহত্যা আবার শুরু হলো, তখনো ইসরায়েলে নিযুক্ত সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রদূত তেল আবিবে এক জমকালো ইফতারের ছবি পোস্ট করেন, যেখানে লোকজন খাবারে ভরপুর টেবিল ঘিরে বসে ভোজে মত্ত। অথচ ঠিক সেই সময় গাজার দিকে মানবিক সহায়তা, খাদ্য বা ওষুধ কিছুই প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছিল না।
এটা কি আরব রাষ্ট্রগুলোর ‘গঠনমূলক সম্পৃক্ততা’? নাকি আত্মপ্রবঞ্চনা? এই দৃশ্যপটে প্রশ্ন উঠতেই পারে, পশ্চিমা গণতন্ত্র আর মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব কি নিজেদের বিবেককে কোনো হিমঘরে রেখে দিয়েছে? পুরো ফিলিস্তিন ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত সেই বিবেক কি আর জাগবে না?
● আব্বাস নাসির ডন পত্রিকার সাবেক সম্পাদক
ডন থেকে নেওয়া ইংরেজির অনুবাদ
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
লন্ডনে ড. ইউনূস-তারেক রহমানের বৈঠককে স্বাগত জানাল জেএসডি
লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের আলোচনা ও ঐকমত্যের সূচনাকে স্বাগত জানিয়েছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি)। দলটি বলেছে, আমরা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, জনগণ শুধু কথায় নয়, বাস্তবে সংস্কার ও বিচারের দৃশ্যমান অগ্রগতির পদক্ষেপ দেখতে চায়।
শুক্রবার জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন এক বিবৃতিতে এ কথা বলেন।
তারা বলেন, এই উচ্চপর্যায়ের সংলাপ দেশে রাজনৈতিক সমঝোতা ও জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে গণঅভ্যুত্থানের কাঙ্ক্ষিত অভিপ্রায় অনুযায়ী রাষ্ট্র সংস্কার, শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর এবং গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠার পথে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
বিবৃতিতে নেতারা বলেন, অধ্যাপক ইউনূস এবং তারেক রহমানের বৈঠক ও বিবৃতিতে আগামী বছরের পবিত্র রমজানের আগেই একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনার ওপর গুরুত্বারোপ এবং তার পূর্বশর্ত হিসেবে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার ও ফ্যাসিস্ট সরকারের বিচারের প্রক্রিয়ায় দৃশ্যমান অগ্রগতি অর্জনের ঘোষিত প্রত্যয়ে রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে।
বিবৃতিতে বলা হয়, গণমানুষের রক্তস্নাত গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম দাবি- গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য কাঠামোগত মৌলিক সংস্কার এবং গণহত্যাকারী ফ্যাসিবাদী শক্তির বিচারের ব্যবস্থা। এই বিষয় দুটির দৃশ্যমান অগ্রগতিই কেবল একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ভিত্তি রচনা করতে পারে।
রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি সমাজের শ্রমজীবী, কর্মজীবী ও পেশাজীবীদের মতামত, আকাঙ্ক্ষা ও অংশগ্রহণে রাষ্ট্রীয় রাজনীতির মৌলিক সংস্কারের লক্ষ্যে দ্রুত ‘জাতীয় সনদ’ প্রণয়নের আহ্বান জানায় জেএসডি।