সংবিধানে মূলনীতির প্রয়োজন আছে কি না, প্রশ্ন তুলেছে এনসিপি
Published: 19th, April 2025 GMT
দেশের সংবিধানে মূলনীতির প্রয়োজন আছে কি না, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনাকালে সেই প্রশ্ন তুলেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলটি সংস্কার কমিশনের সুপারিশ করা ‘বহুত্ববাদ’ নিয়ে আরও ব্যাখ্যা চেয়েছে। এ ছাড়া ১৯৭২–এর সংবিধানের মূলনীতি ও পরবর্তী সংশোধনীর মাধ্যমে যে ‘দলীয় মূলনীতি’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, সেগুলো বাতিলের দাবি জানিয়েছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দিনব্যাপী আলোচনা শেষে আজ শনিবার বিকেলে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের এ কথা বলেন। এর আগে সকাল সাড়ে ১০টায় জাতীয় সংসদের এলডি হলে আলোচনা শুরু হয়।
বিকেলে নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘সংবিধানের মূলনীতির বিষয়ে কমিশনের প্রস্তাব ছিল, মূলনীতিগুলো বাতিল করা। তাঁরা পাঁচ মূলনীতির প্রস্তাব দিয়েছেন। আমরা চার মূলনীতি বাতিলের প্রস্তাবকে সমর্থন করেছি এবং বহুত্ববাদের বিষয়টির আরও ব্যাখ্যা বা সংজ্ঞায়ন চেয়েছি। তাঁরা এ নিয়ে আরও আলোচনা ও ব্যাখ্যার কথা আমাদের জানিয়েছেন।’ তিনি বলেন, পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে দলীয় আদর্শকে সংবিধানে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে জন্য মূলনীতি কাঠামোর বাইরে সংবিধানকে ভাবা যায় কি না, কমিশনের কাছে সেই প্রশ্ন করা হয়েছে। কারণ, সংবিধানে গণপ্রজাতন্ত্রী এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কথা বলা থাকে। মৌলিক অধিকারগুলোর কথা বলা থাকে। সে ক্ষেত্রে আলাদা করে মূলনীতির প্রয়োজন আছে কি না, সেই প্রশ্নও রেখেছেন এনসিপির নেতারা। তাঁরা বাহাত্তরের মূলনীতি ও পরবর্তী সংশোধনীর মাধ্যমে যে দলীয় মূলনীতিগুলো প্রবেশ করানো হয়েছে, সেগুলো বাতিলের দাবি জানান।
নাহিদ বলেন, তাঁদের প্রস্তাবের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য, রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরে গিয়ে সাংবিধানিক নিয়োগ বাস্তবায়ন, শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরপ্রক্রিয়ায় প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম তৈরি, নারীর ক্ষমতায়ন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়গুলো স্থান পেয়েছে। তিনি বলেন, ‘এক ব্যক্তি দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। একই নিয়ম রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রেও। আমরা প্রধানমন্ত্রীশাসিত সরকার নয়, মন্ত্রিপরিষদশাসিত সরকারের প্রস্তাব দিয়েছি। জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল বা এনসিসির ফরমেশন নিয়ে আলোচনা করেছি। সাংবিধানিক কাউন্সিল সাংবিধানিক গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নিয়োগ দেবে।’
এনসিপির এই নেতা বলেন, তাঁরা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভাকে সমর্থন দিয়েছেন। এর মধ্যে উচ্চকক্ষ হতে হবে ভোটের আনুপাতিক, আসনের আনুপাতিক নয়। নির্বাচনের আগেই উচ্চকক্ষের প্রার্থীর ঘোষণা দিতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে। তাঁরা ১০০ আসনে নারী প্রার্থী প্রত্যক্ষ ভোটে প্রতিযোগিতা করে সংসদে যাওয়াকে সমর্থন করেছেন। কিন্তু এটার পদ্ধতির কয়েকটি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হলেও চূড়ান্ত হয়নি।
এ ছাড়া ইলেকট্রোরাল কলেজের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোট, বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তকরণে জন্য আলাদা সচিবালয় করা, আর্থিক স্বাধীনতা দেওয়া, বিভাগীয় বেঞ্চ তৈরি করা, জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা এবং উচ্চকক্ষের মতামত নেওয়া নিয়ে এনসিপি ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করেছে।
আরও পড়ুনস্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার সব রাস্তা বন্ধ করেই সামনে এগোবে এনসিপি, জানালেন নাহিদ৭ ঘণ্টা আগেনাহিদ বলেন, সংবিধানে প্রতিটি জাতিসত্তার স্বীকৃতি এবং অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত, নিরবচ্ছিন্নভাবে ইন্টারনেট প্রাপ্তির অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার করার আলোচনা হয়েছে।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বিষয়ে এনসিপির আহ্বায়ক বলেন, ‘সংসদ সদস্যের স্বাধীনতা এবং সংসদ বা সরকারের স্থায়িত্বশীলতা সাপেক্ষে সংস্কার করতে হবে। সে ক্ষেত্রে অর্থবিলের কথা বলা হয়েছে। স্বাধীন কমিশনের মাধ্যমে সংসদীয় সীমানা নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে। তবে পুলিশ সংস্কার কমিশনের স্প্রেডশিট না দেওয়ায় আমরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছি। এ ছাড়া দুদক, পুলিশ ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। সেটি পরবর্তী বৈঠকে আলোচনা হবে। এই আলোচনা চলমান থাকবে।’
বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে আহ্বান জানিয়ে নাহিদ ইসলাম বলেন, রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ এসেছে। সমঝোতার ক্ষেত্রে আলোচনার বিকল্প নেই। মৌলিক সংস্কারের বিষয়ে সবাই যাতে এক হন। তিনি বলেন, ‘শুধু ঐকমত্য কমিশন নয়, দলীয় উদ্যোগে আলোচনার পথটি খোলা রাখতে চাই। আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরাসরি বসব। নিজেদের মধ্যেও আলোচনা করব। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে সমঝোতায় আসতে পারলে সেটি রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর হবে।’
বিএনপির কাছ থেকে আলোচনার কোনো প্রস্তাব পেয়েছেন কি না, জানতে চাইলে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী সাংবাদিকদের বলেন, পরিবর্তনের যে সুযোগ এসেছে, সেখানে সবাই একসঙ্গে অংশগ্রহণ করতে হবে। কিন্তু ক্ষমতার লোভে বা অন্য কোনো কারণে কেউ বেরিয়ে পড়লে সেই সুযোগ তারা মিস করবে। তিনি আশা করেন, রাজনৈতিক দলগুলো এই বোঝাপড়ায় আসবে।
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, ‘কমিশন প্রস্তাব করেছে, অর্থবিল রেখে অন্যান্য ক্ষেত্রে দলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া যাবে কি না। আমরা মনে করি, অর্থবিল, অর্থাৎ বাজেট ও অনাস্থা—এই দুটো ক্ষেত্র বাদে অন্যান্য যেকোনো ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যরা দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবেন। এ অধিকার তাদের থাকা উচিত।’
এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামকরণের ক্ষেত্রে অবশ্যই “নির্বাচনকালীন” শব্দ যুক্ত করতে হবে। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচনের যে দায়িত্ব পালন করবে, আমরা সেদিকে গুরুত্বারোপ করেছি। সেই রূপরেখা কেমন হতে পারে, উপদেষ্টা হিসেবে কারা থাকতে পারেন, সে বিষয়ে আলাপ–আলোচনা চলছে। এটি নিয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ আছে বলে মনে করি।’
আলোচনায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, ইফতেখারুজ্জামান, সফররাজ হোসেন ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য) মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে এনসিপির আট সদস্যের প্রতিনিধিদলে আরও ছিলেন দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন, দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ, যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব নাহিদা সারোয়ার।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন হ দ ইসল ম র প রস ত ব এনস প র ক ষমত সরক র সদস য
এছাড়াও পড়ুন:
ঐকমত্য কমিশনে যারা আছেন, তারা নিজেদের কাজে ফিরে যান: খসরু
ঐকমত্য কমিশনে যারা আছেন, তারা আগে যে কাজ করতেন, তাদেরকে সে কাজে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
শনিবার (১ নভেম্বর) দুপুরে রাজশাহী বিভাগের ব্যবসায়ীদের এক সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ অনুরোধ জানান।
ঐকমত্য কমিশনের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টার অভিযোগ তুলে আমীর খসরু বলেন, “জোর করে আরেকটি দলের অথবা দুটি দলের বা তিনটি দলের মতামত বাকি দলগুলোর ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। আমরা একটা রাজনৈতিক দল, তারাও একটি রাজনৈতিক দল। এখানে ঐকমত্যের বাইরে গিয়ে তাদের দাবি আমাদের ওপর চাপাতে চাচ্ছে, জনগণের ওপর চাপাতে চাচ্ছে। অথচ, ঐকমত্য কমিশন করার উদ্দেশ্য ছিল, ঐকমত্য যতটুকু হবে, সেটা নিয়ে আমরা জনগণের কাছে যাব।”
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, “ঐকমত্য হয়েছে, সই হয়েছে, তার বাইরে গিয়ে এখন নতুন নতুন দাবি নিয়ে আসছে। তাদের দাবি মানতে হবে, না মানলে এটা হবে, সেটা হবে...। আবার তাদের সাথে যুক্ত হয়েছে ঐকমত্যের কিছু লোকজন। তাদেরও আবার মতামত আছে। রাজনীতিবিদদের মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে তারা তাদেরটা চাপাতে চাচ্ছে। আবার ঐকমত্য কমিশনেরও একটা নিজস্ব মতামত আছে। ঐকমত্য কমিশনের মতামতের জন্য তো তাদেরকে সেখানে রাখা হয়নি। এখন তাদেরও মতামত আছে এবং ওটা আমাদেরকে মানতে হবে।”
দেশের মানুষকেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বিএনপির এই জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, “ঐকমত্য কমিশনে যারা আছেন, যাদের দাবি রাজনীতিবিদদের ওপর চাপাতে চান, জনগণের ওপর চাপাতে চান; তাদের প্রতি আমার অনুরোধ- আপনারা যে যেই কাজ করতেন আগে, ওই জায়গায় ফিরে যান। বাংলাদেশের মানুষকে তাদের সিদ্ধান্ত নিতে দেন। আমি অনুরোধ করছি, আপনারা স্ব স্ব কাজে ফিরে যান। বাংলাদেশের মানুষকে তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য দয়া করে তাদের ওপরেই ছেড়ে দেন। আপনাদেরকে এই দায়িত্ব কেউ দেয় নাই।”
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ আগামী নির্বাচনে তাদের সিদ্ধান্ত দেবে। যেসব দল তাদের দাবি-দাওয়া চায়, তাদেরকে জনগণের কাছে যেতে হবে তো। জনগণের মতামত নিতে হবে তো। জনগণের ম্যান্ডেট নিতে হবে তো। মতামত জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া চলবে না।”
নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা চলছে, অভিযোগ করে আমীর খসরু বলেন, “ব্যবসায়ীরা আমাকে প্রতিনিয়ত বলছেন, ফেব্রুয়ারি নয়; পারলে এখনই নির্বাচন করে আমাদেরকে একটু মুক্ত করেন। আমাদের ব্যবসা ধ্বংস হওয়ার উপক্রম। আমরা কোনো বিনিয়োগ করতে পারছি না। বিদেশিরা কোনো বিনিয়োগ করছে না। সুতরাং, এই নির্বাচনকে যারা বিলম্বিত করতে চায় তাদের স্বার্থের জন্য, এখানে ব্যবসায়ীদেরকে সোচ্চার হতে হবে। দ্রুতই নির্বাচনের দিকে যেতে হবে।”
রাজশাহী জেলা পরিষদ মিলনায়তনে এই বিভাগীয় ব্যবসায়ী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। রাজশাহী বিভাগীয় ব্যবসায়ী ফোরাম এর আয়োজন করে। এতে বিএনপি চেয়ারপারসনের অন্যতম উপদেষ্টা ও সাবেক সিটি মেয়র মিজানুর রহমান মিনুসহ রাজশাহী বিভাগের আট জেলার ব্যবসায়ীরা অংশ নেন। সভাপতিত্ব করেন রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি লুৎফর রহমান।
ঢাকা/কেয়া/রফিক