আজ ২২ এপ্রিল, ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের জন্মদিন। ১৯১৭ সালে সংঘটিত রুশ বিপ্লবের অগ্রনায়ক লেনিন ছিলেন মার্ক্সের সফল উত্তরাধিকারী। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ইতিহাসের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। একটি পশ্চাৎপদ পুঁজিবাদী দেশে বিপ্লব সংঘটনের পথ বের করেন তিনি। চিন্তা ও প্রয়োগের মেলবন্ধন ঘটানোর দক্ষতাই ছিল তাঁর সাফল্যের অন্যতম কারণ। মার্ক্স সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা বলেন। কিন্তু রাশিয়ার মতো দেশে যেখানে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটেনি, সেখানে শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক বিপ্লব করে নতুন পথ দেখালেন। লেনিনের এই গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পথ ধরেই চীনসহ পিছিয়ে পড়া পুঁজিবাদী দেশে বিপ্লব হয়েছে। ইতিহাসের কোনো পর্বকেই লাফ দিয়ে ডিঙিয়ে যাওয়া যায় না। বিপ্লবকে ইতিহাসের ভেতর দিয়েই যেতে হয়– এটি ছিল লেনিনের শিক্ষা।
লেনিন দেখিয়েছেন রাষ্ট্রযন্ত্র কোন প্রক্রিয়ায় বল প্রয়োগ করে টিকে থাকে এবং শাসক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করে। তাঁর রাষ্ট্রচিন্তা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের ফ্যাসিস্ট রূপ বুঝতে সহায়তা করে। তিনি বল প্রয়োগের মাধ্যমে বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্র উচ্ছেদের কথা বলেন। গ্রামসি বলেন, শুধু বল প্রয়োগ নয়; শাসক শ্রেণি সাংস্কৃতিক ও মতাদর্শিক আধিপত্য বজায় রাখার মধ্য দিয়েও টিকে থাকে। ব্যবস্থার পক্ষে সম্মতি উৎপাদন করে। ফুকোর মতে, ক্ষমতা শুধু রাষ্ট্রে কেন্দ্রীভূত নয়; সমাজের পরতে পরতে ছড়িয়ে থাকে। আধুনিক সমাজ শুধু বল প্রয়োগের মাধ্যমে শাসন করে না; তা মানুষের জীবন ও কর্তাসত্তার মনোজগৎ গঠনেরও নিয়ন্ত্রণ নেয়। ফুকো এর নাম দিয়েছেন বায়োপলিটিকস– জীবন ও মগজ দখল- নিয়ন্ত্রণের রাজনীতি। ফুকো ক্ষমতা কী করে কাজ করে তার বর্ণনা দিলেও ক্ষমতাকে কীভাবে প্রতিরোধ ও উচ্ছেদ করতে হয়, তা দেখাননি। সেটা দেখিয়েছেন লেনিন। তার মানে এই নয়, আমাদের বলশেভিক মডেলই অনুসরণ করতে হবে।
বাংলাদেশের রাষ্ট্র নিবর্তনমূলক ও দুর্নীতিবাজ। গণতন্ত্রের লোভ দেখানো নির্বাচন, উন্নয়ন, ধর্মরাষ্ট্র, স্বর্গ– এসব ফ্যান্টাসি তৈরি করে রেখেছে। এসব ফ্যান্টাসি ভাঙতে হবে। আমাদের মুক্তির বিকল্প বয়ান তৈরি করতে হবে। মানুষের কাছে সেটা তুলে ধরতে পারলে বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব। বুর্জোয়া রাষ্ট্রের খোলনলচে না বদলে শুধু কিছু সংস্কার দিয়ে বিদ্যমান সংকটের সমাধান সম্ভব হবে না।
লেনিনের শিক্ষার একটা বড় দিক হলো, অসংগঠিত স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন দিয়ে ব্যবস্থার অবসান ঘটানো যায় না। এ জন্য চাই বিপ্লবী মতাদর্শ ও সুসংগঠিত রাজনৈতিক সংগঠন। যাকে তিনি বলেছেন বিপ্লবী পার্টি। লড়াইকে তিনি স্বতঃস্ফূর্ততার ওপর ছেড়ে না দিয়ে সচেতন সংগঠিত রাজনৈতিক লড়াই চালানোর কথা বলেন। শুধু জীবনদান আর অভ্যুত্থান করলেই হবে না; সেই অভ্যুত্থানের রাজনীতি ও শ্রেণি প্রশ্নটি পরিষ্কার থাকতে হবে। অভ্যুত্থান-উত্তর পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে অভ্যুত্থানকারী শক্তির সংগঠন থাকতে হয়। চব্বিশের অভ্যুত্থানে এর কোনোটাই নেই। নেই কোনো সুনির্দিষ্ট রাজনীতি ও শক্তিশালী সংগঠন। এ ধরনের ভয়ানক দুর্বলতার পরিণতিতে পর্বতের মূষিক প্রসব ঘটতে পারে।
স্বৈরতান্ত্রিক জারের ভয়ানক নির্যাতনে লেনিনের জীবন কখনোই স্থির ছিল না। বন্দি ও পলাতক জীবন এবং নির্বাসনের মধ্যে স্ত্রী ক্রুপস্কায়াকে নিয়ে কেটেছে তাঁর জীবন। তবুও এক অমিত শক্তি নিয়ে তিনি অব্যাহত রেখেছেন বিপ্লবী কর্মযজ্ঞ। লিখেছেন অবিরাম ৫৫ খণ্ড। বিতর্কে লিপ্ত থাকতে হয়েছে তাঁকে সারাক্ষণ দলের ভেতর ও বাইরে। অব্যাহতভাবে প্রকাশ করেছেন ইস্ক্রা পত্রিকা। এভাবে একদিন নতুন সূর্যের ভোর আসে ১৯১৭ সালে; অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে।
রুশ বিপ্লবের পরে বেশি দিন বাঁচেননি লেনিন। ১৯১৮ সালে আততায়ীর গুলিতে আহত হন। এরপর কখনোই পুরোপুরি সুস্থ হননি। ১৯২৪ সালে লেনিন মস্কো থেকে দূরে তাঁর নিজ গ্রাম গোর্কিতে মারা যান।
১৯৪৮ সালে কার্ল মার্ক্স বলেছিলেন, ‘ইউরোপ ভূত দেখেছে; কমিউনিজমের ভূত।’ বিশ শতকজুড়ে ইউরোপ ও আমেরিকাকে কমিউনিজমের এ ভূত তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। সমাজতন্ত্র ধ্বংস করতে তারা চালিয়েছে কখনও সরাসরি যুদ্ধ, কখনও স্নায়ুযুদ্ধ।
বামপন্থিদের ও সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সে যুদ্ধ এখনও জারি আছে। এ যুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের আপাত পরাজয় হলেও তা নতুন এক অনিরুদ্ধ শক্তি নিয়ে আবারও ইতিহাসে আবির্ভূত হবে। পুঁজির শোষণ ও শাসনমুক্ত একটি সভ্য মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন মার্ক্স ও লেনিন। সেটা এখনও আরাধ্য। তা অর্জনে লুটেরা পুঁজিতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কোনো বিকল্প নেই। এ সংগ্রামে লেনিন শুধু প্রাসঙ্গিক নন, জরুরিও বটে। লেনিনের জন্মদিনে তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
ড.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত
এছাড়াও পড়ুন:
অন্তর্বর্তী সরকারের সব উদ্যোগে এবি পার্টির সমর্থন রয়েছে: ব্যারিস্টার ফুয়াদ
দেশের রাজনীতির চলমান ঘটনা প্রসঙ্গে আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির মহাসচিব ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান ড. ইউনূসের প্রতি আস্থা না রাখার কোনো ঘটনা এখনও ঘটেনি। জাতীয় ঐকমত্য গঠনে ইউনূস সরকার এ পর্যন্ত যত উদ্যোগ নিয়েছে, সবগুলোতে এবি পার্টির সমর্থন রয়েছে। শুক্রবার লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে ড. ইউনূসের বৈঠক নিয়ে ভালো কিছু হওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। বৃহস্পতিবার বরিশাল প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন ব্যারিস্টার ফুয়াদ।
দেশের শীর্ষ রাজনীতিবিদ ও আমলাদের চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার সমালোচনা করে তিনি বলেন, প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও আমলাদের দেশের সরকারি হাসপাতালেই চিকিৎসা নেওয়া উচিত। তাহলে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের দায়িত্বশীলরা সবসময় সতর্ক অবস্থানে থাকবেন। চিকিৎসা সরঞ্জামাদিও সর্বাক্ষণিক সচল রাখবেন। এর সুবিধা ভোগ করবেন সাধারণ মানুষ, যারা সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যান।
তখন সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বিদেশ গমন ও ফেরত আসা নিয়ে সরকারের ভূমিকা সম্পর্কে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন। এর জবাবে ফুয়াদ চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার ঘোর বিরোধিতা করে বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াসহ যে কোনো ভিআইপির চিকিৎসা নিতে বিদেশ যাওয়া ঠিক নয়। কিন্তু এ দেশে ভিআইপিদের একটা ঐতিহ্য হয়ে গেছে, বিদেশের হাসপাতালে চিকিৎসা না নিলে পরপারে গিয়ে জবাব দেওয়া লাগতে পারে– কেন তুমি গরিবের হাসপাতালে গিয়ে মরলা।
আবদুল হামিদের বিদেশ যাওয়ার পর সরকারে ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তাঁর (হামিদ) বিদেশে আসা-যাওয়ার বিষয়ে কোনো বিধিনিষেধ নেই। তাহলে কেন তাঁকে বিদেশ যেতে বাধা দেওয়া হবে। হামিদের বিদেশ যাওয়ার পর বিমানবন্দরের কয়েকজন কর্মকর্তাকে বরখাস্তের বিরোধিতা করেন ফুয়াদ।
ব্যারিস্টার ফুয়াদ ঈদের পর তাঁর নির্বাচনী এলাকা বাবুগঞ্জ-মুলাদী উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকা ঘুরেছেন। এর তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি বলেন, দেশে রাজনীতির নামে গুন্ডামি চলছে। সরকারি দপ্তরগুলোতে এখনও ঠিকাদারি কাজের জন্য নানাভাবে চাপ দেওয়া হয়। আগের সরকারের লোকজনদের কাজ দিয়েছেন, আমাদের কেন দেবেন না– এমন
হুমকি-ধমকি দেওয়া হয় কর্মকর্তাদের।
উন্নয়ন বরাদ্দ লুটপাট হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, সড়ক নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে ইউনিয়নে ৮৪ লাখ ও পৌর শহরে আড়াই কোটি টাকা বরাদ্দ হয়। অথচ ইউনিয়নে ৩০ লাখ ও পৌর শহরে ৮৪ লাখ টাকায় আন্তর্জাতিক মানের সড়ক নির্মাণ সম্ভব।