ভারতের মুসলমানদের ‘টার্গেট’ করে ওয়াক্ফ বিল পাস করা হয়েছে: জামায়াত নেতা জুবায়ের
Published: 22nd, April 2025 GMT
মুসলমানদের ‘টার্গেট’ করেই ভারতের লোকসভায় তড়িঘড়ি করে বিতর্কিত ওয়াক্ফ (সংশোধন) আইন পাস করা হয়েছে বলে মন্তব৵ করেছেন জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়ের। মুসলমানদের যাতে ‘বলির পাঁঠা’ বানানো যায়, সে কারণেই এটা করা হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
আজ মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া মিলনায়তনে ‘ভারতের সংখ্যালঘু নিরাপত্তার স্বরূপ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এহসানুল মাহবুব এ কথা বলেন। ‘গণশক্তি সভা’ নামের একটি সংগঠন এই সভার আয়োজন করে।
আলোচনায় এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, ওয়াক্ফ আইনের বিতর্কিত সংশোধন ঘিরে ভারতজুড়ে সংখ্যালঘু নির্যাতনে বাংলাদেশের মানুষ উদ্বিগ্ন। ওয়াক্ফ সম্পত্তির ওপর ভর করেই এই অঞ্চলের মানুষের শিক্ষা ও অগ্রগতি হয়ে আসছে। মুসলমানদের টার্গেট করেই তড়িঘড়ি করে লোকসভায় এ বিল পাস করা হয়েছে, যাতে মুসলমানদের বলির পাঁঠা বানানো যায়।
ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকার নোংরা সাম্প্রদায়িক প্রতিহিংসার বশীভূত হয়ে মুসলিম নিধনে নেমেছে বলে মন্তব্য করেন জামায়াতে ইসলামীর নেতা এহসানুল মাহবুব। তিনি বলেন, ‘মোদি সরকার যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে, তা এই উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে হুমকির মুখে ফেলবে। সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে ব্যবহার করে মুসলিমদের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার খেলা বন্ধ করতে হবে। শত শত কোটি ডলারের ওয়াক্ফ সম্পত্তি কুক্ষিগত করার নীলনকশা বাস্তবায়ন করছে মোদি সরকার।’
ভারত সরকার যদি অবিলম্বে ওয়াক্ফ বিল প্রত্যাহার না করে তাহলে বাংলাদেশের মানুষ বৃহত্তর কর্মসূচি দিয়ে ভারতকে উচিত জবাব দেবে বলে মন্তব্য করেন এহসানুল মাহবুব জুবায়ের।
সভায় সভাপতির বক্তব্যে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মো.
ভারতে মুসলমানদের ওপর নির্যাতন–নিপীড়নের প্রতিবাদ জানিয়ে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনে স্মারকলিপি দেওয়া হবে বলে জানান শহিদুল ইসলাম। বাংলাদেশের ‘ফ্যাসিবাদীরা’ পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তারা সেখান থেকে এ দেশের মানুষকে উসকানি দিচ্ছে, এ দেশে আরেকটি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ উসকে দেওয়ার জন্য ভারত চেষ্টা করছে। সেই চেষ্টাও তাদের বন্ধ করতে হবে। সে চেষ্টা যদি তারা বন্ধ না করে তাহলে এ দেশের মানুষ যেমন ফ্যাসিবাদকে তাড়িয়ে দিয়েছে, ভারতের বিরুদ্ধেও সেভাবে রুখে দাঁড়াবে।’
আয়োজক সংগঠনের সভাপতি সাদেক রহমানের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক হাবিবুর রহমান পলাশ। প্রবন্ধে তিনি বলেন, ‘ভারতে ইসলামবিদ্বেষ অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২৬ সালের রাজ্য (বিধান সভা) নির্বাচনে বিজেপির সাফল্য নিশ্চিত করার জন্য মুসলমানদের টার্গেট করা হচ্ছে। এটা কি শুধু নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার অপচেষ্টা? বিশ্ববাসীকে সজাগ থাকতে হবে যেন ভারত কোনোভাবেই আরেকটি ইসরায়েলে পরিণত না হয়।’
সভায় আরও বক্তব্য দেন কর্নেল (অব.) হাসিনুর রহমান, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আকবর হোসেন, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) ফেরদৌস আজিজ, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) সহসভাপতি রাশেদ প্রধান, অ্যাডভোকেট শেখ ওমর, অ্যাডভোকেট শাহ মোহাম্মদ মাহফুজুল হক, মো. হুমায়ুন কবির, জাতীয় নাগরিক পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল আহাদ নূর, জাতীয় স্বাধীন পার্টির চেয়ারম্যান এম এইচ খান মজলিস, বাংলাদেশ জনতা ফ্রন্টের চেয়ারম্যান আবু আহাদ আল মামুন, জাস্টিস পার্টির চেয়ারম্যান আবুল কাশেম মজুমদার, ভাসানী–ন্যাপের চেয়ারম্যান মোস্তাক আহমেদ ভাসানী, গবেষক আলাউদ্দিন কামরুল, রুহুল আমিন ইয়াসির আক্তার প্রমুখ।
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
শ্রম অধিকার ও সুস্থ কর্মপরিবেশ
আজ মহান মে দিবস। ১৮৮৬ সালের পহেলা মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটে শ্রমিকের মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারকারী মেহনতি মানুষদের স্মরণ করিবার দিন। তৎসহিত সকল শ্রমজীবী মানুষের জন্য মর্যাদাকর জীবন নিশ্চিতকরণের সংগ্রামে নূতন শপথ গ্রহণের দিন।
মে দিবস বিশ্বের শ্রমিকদের সংহতি যদ্রূপ বৃদ্ধি করিয়াছে, তদ্রূপ তাহাদিগকে অধিকার সচেতনও করিয়াছে; প্রেরণা জোগাইয়া চলিয়াছে শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাইয়া যাইতে। মে দিবস বাংলাদেশসহ বিশ্বের উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামের মধ্য দিয়া স্বাধীনতা অর্জনকারী দেশসমূহের জন্য বিপুল প্রেরণার উৎসরূপে কাজ করিয়াছে।
তাহারই প্রতিফলনস্বরূপ এই সকল দেশে ছুটিসহকারে জাতীয়ভাবে দিবসটি পালিত হয়। উন্নত দেশসমূহ এই দিবসে পৃথক ছুটির ব্যবস্থা না করিলেও উহার প্রভাব উপেক্ষা করিতে পারে নাই। তাই ভিন্ন প্রকারে সেই সকল দেশেও দিবসটি পালিত হয়। আন্তর্জাতিকভাবে আজিকে শ্রমমান লইয়া যে আলোচনা হয়, জাতীয় ন্যূনতম মজুরিসহ শ্রমিকের বহু অধিকার আজিকে যে ইউরোপ-আমেরিকাসহ বহু দেশে কার্যকর হইয়াছে, উহারও পশ্চাতে রহিয়াছে মে দিবসের চেতনা। তবে ইহা সত্য, বাংলাদেশে ঘটা করিয়া দিবসটি পালিত হইলেও মজুরি ও কর্মপরিবেশ প্রশ্নে খামতি সীমাহীন। প্রাতিষ্ঠানিক খাতসমূহে শ্রমিকদের জন্য এক প্রকার আইনি আশ্রয় থাকিলেও বিশাল অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে উহার লেশমাত্র নাই। শেষোক্ত খাতে কোটি কোটি শ্রমিক উপযুক্ত পারিশ্রমিক ও অন্যান্য অধিকার হইতে বঞ্চিত।
এই বৎসর শ্রমিক দিবস এমন সময়ে উপস্থিত, যখন গণঅভ্যুত্থানের ফসলস্বরূপ দেশে নূতন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করিয়াছে। সেই সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসাবে শ্রম খাতের সংস্কারেও উদ্যোগী। তাহাদের গঠিত শ্রম সংস্কার কমিশন ইতোমধ্যে প্রতিবেদনও দাখিল করিয়াছে, যথায় দেশের সাড়ে সাত কোটি শ্রমজীবী মানুষের মৌলিক অধিকার-সংক্রান্ত একগুচ্ছ সুপারিশ রহিয়াছে। প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক, সরকারি-বেসরকারি ও বিদেশি প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি পর্যায়ে নিয়োজিত সকল শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণে ‘জাতীয় ন্যূনতম মজুরি’ ন্যূনতম মানদণ্ডরূপে বিবেচিত হইবে– কমিশনের এই সুপারিশ যুগান্তকারী বলিয়া আমরা মনে করি। উপরন্তু কমিশন ইহাও বলিয়াছে, কোনো খাতের মজুরি কাঠামো নির্ধারণে পরিবারে একক উপার্জনকারী হিসাবে বিবেচনায় লইয়া এমন পরিমাণ নির্ধারণ করিতে হইবে, যাহাতে শ্রমিক তাঁহার পরিবারের প্রয়োজন মিটাইতে পারেন।
বিভিন্ন খাতের শ্রমিকের মজুরি তিন বৎসর অন্তর মূল্যায়ন ও পুনর্নির্ধারণ, মূল্যস্ফীতির ভিত্তিতে বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধি, রপ্তানিমুখী শিল্প খাতের জন্য আপৎকালীন তহবিল, ট্রেড ইউনিয়ন করিবার শর্ত শিথিল, স্থায়ী কাজের জন্য আউটসোর্সিং নিয়োগ বন্ধ, নারী শ্রমিকের মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস এবং স্থায়ী শ্রম কমিশন প্রতিষ্ঠা-সংক্রান্ত সুপারিশসমূহও প্রণিধানযোগ্য। একটা সময় ছিল যখন শ্রমিক আন্দোলন বলিতে কারখানা ভাঙচুর ও সম্পদ ধ্বংস বোঝাইত। পরিণামে নিজের রুটি-রুজি লইয়া শ্রমিকদেরই টানাপোড়েনে পড়িতে হইত। ইহার সমাধান দিয়াছিল ট্রেড ইউনিয়ন প্রথা। দুর্ভাগ্যবশত এই দেশে ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার বিগত দশকসমূহে ক্রমশ জটিল রূপ ধারণ করে। উহার সহিত সুস্থ ধারার শ্রমিক আন্দোলনও বিরল হইয়া পড়ে।
আমাদের বিশ্বাস, শ্রম সংস্কার কমিশনের ট্রেড ইউনিয়ন-সংক্রান্ত প্রস্তাবসমূহ আলোর মুখ দেখিলে শ্রমিক-মালিক উভয়েরই স্বার্থ রক্ষা হইবে। সর্বোপরি দেশের বিকাশমান শিল্প খাত হইবে লাভবান। উৎপাদন ব্যবস্থার মূল চালিকা শক্তিরূপে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে উদ্যোক্তার যদ্রূপ অবদান, তদ্রূপ শ্রমিকেরও অবদান ব্যাপক। তাই শ্রমজীবী মানুষের অধিকার নিশ্চিতকরণে আর কোনো অবহেলা নহে। এইবারের মে দিবসে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকলে এই অঙ্গীকার গ্রহণ করিবে– ইহাই আমাদের প্রত্যাশা। আমরা সমকালের পক্ষ হইতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল শ্রমজীবী মানুষকে মে দিবসের অভিনন্দন জানাই।