যুক্তরাষ্ট্রকে বাণিজ্য ছাড়ে ইউরো চেম্বারের উদ্বেগ
Published: 24th, April 2025 GMT
যুক্তরাষ্ট্রকে একতরফা বাণিজ্য ছাড় দেওয়ার প্রশ্নে বাংলাদেশের পদক্ষেপে উদ্বেগ জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশ-ইউরোচেম। এ ধরনের পদক্ষেপকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বৈষম্যমূলক বলা হয়েছে চেম্বারের পক্ষ থেকে। এ ধরনের বৈষম্য এড়াতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
গতকাল বুধবার ইউরোচেমের এক বিবৃতিতে চেয়ারপারসন নুরিয়া লোপেজ বলেন, ইইউ বাংলাদেশের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বাণিজ্য অংশীদার। বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের অর্ধেকই আসে ইইউ জোটের দেশগুলো থেকে। ২০০১ সাল থেকে এভরি থিং বাট আর্মস (ইবিএ) অর্থাৎ অস্ত্র ছাড়া সব পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত এবং কোটামুক্ত অগ্রাধিকারমূলক প্রবেশাধিকার পেয়ে আসছে বাংলাদেশ। অন্যান্য বাণিজ্য অংশীদারের তুলনায় ইইউর সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বেশি। গত বছর জোটের দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ২২ বিলিয়ন ইউরো। আর বাংলাদেশে ইইউর রপ্তানির পরিমাণ ছিল মাত্র ২ বিলিয়ন ইউরো। এর কারণ, উচ্চ শুল্ক এবং অশুল্ক বাধা ইইউ কোম্পানিগুলোর বাংলাদেশে ব্যবসা এবং রপ্তানি কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করছে।
ইইউ জোট এবং বাংলাদেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণে কাজ করে ইউরোচেম। ২৭ জাতির জোট ইইউ এবং বাংলাদেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য রয়েছে এমন প্রতিষ্ঠানগুলো ইউরোচেমের সদস্য।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বিধিবদ্ধ বাণিজ্য ব্যবস্থার প্রতি বাংলাদেশ সরকারের যে প্রতিশ্রুতি রয়েছে, তা উৎসাহিত করতে চায় ইউরোচেম; যা প্রয়োজনীয় বাণিজ্যনীতি, শুল্কসংস্কার ও সব বাণিজ্য অংশীদারের প্রতি ন্যায়সংগত আচরণ নিশ্চিত করে। বর্তমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এবং স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে মসৃণ উত্তরণ এবং টেকসই রূপান্তরে ইউরোচেমের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্য প্রবেশে নতুন করে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ হয়েছে গত ৫ এপ্রিল। এ ছাড়া ৬৫টি দেশের পণ্যে সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশসহ বিভিন্ন হারে শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। গত ২ এপ্রিল দেওয়া ঘোষণায় বাংলাদেশের পণ্যে ৩৭ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের কথা বলা হয়। গত ৯ এপ্রিল পরবর্তী ৩ মাসের জন্য এ শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়। এ বাস্তবতায় দুই দেশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে একটি বৈঠক বুধবার অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা।
এর আগে গত ৭ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টাম্পকে লেখা এক চিঠিতে তিন মাসের জন্য বাড়তি শুল্ক স্থগিত রাখার অনুরোধ করেন। একই দিন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি জ্যামিসন গ্রিয়ারকে চিঠি দেন। এতে আমদানি করা ১৯০ পণ্যের পাশাপাশি আরও ১০০ পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক তুলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। চিঠিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ শুল্কহার কমানো ও সব ধরনের অশুল্ক বাধা দূর করার উপায় খুঁজে দেখছে।
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
নেই নিয়োগপত্র, আইডি কার্ড ও ছুটি
নিয়োগপত্র নেই। এ কারণে চাকরির নিশ্চয়তাও নেই। দেওয়া হয় না পরিচয়পত্র। নেই কর্ম ঘণ্টার হিসাব। তবে রয়েছে মজুরিবৈষম্য ও জীবনের ঝুঁকি। এ চিত্র খুলনার বরফকলে কর্মরত বরফ শ্রমিকদের।
অবহেলিত ও অধিকার বঞ্চিত বরফকলের শ্রমিকেরা জানেন না মে দিবসের অর্থ। তারা শুধু এটুকু জানেন, কাজ থাকলে মজুরি পাবেন, অন্যথায় জুটবে না কিছু। খুলনার নতুন বাজার, রূপসা, শিপইয়ার্ড ও নিউমার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বরফ শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে উঠে এসেছে ঝুঁকি ও বৈষম্যের এই চিত্র।
সরেজমিনে জানা গেছে, লবণ পানি এবং অ্যামোনিয়া গ্যাসের সংমিশ্রণে বরফের প্রতিটি ক্যান তৈরি হয়। এ কাজে প্রচণ্ড ঝুঁকি রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- অ্যামোনিয়া গ্যাসের সিলিন্ডার লিকেজ হলে মৃত্যুসহ বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা। এছাড়াও অধিকাংশ সময় হাত-পা ভিজে ঠান্ডা থাকায় ক্ষত থেকে ইনফেকশন হয়। এর বাইরে বুকে ঠান্ডা লেগে সর্দি-কাশি জ্বরসহ ঠান্ডাজনিত অসুস্থতায় ভোগেন এখানকার শ্রমিকেরা। পাতলা বরফে অনেক সময় হাত-পা কেটে যায়। কিন্তু মালিক বা কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের জন্য কোন ধরনের অ্যাপ্রোন বা নিরাপত্তা সরঞ্জাম সরবরাহ করেন না। তবে দুর্ঘটনায় কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।
আরো পড়ুন:
ফুড ডেলিভারিম্যান: খাবারের রাজ্যে অতৃপ্ত দিনরাত
মহান মে দিবস: শ্রমিকের অধিকার রক্ষায় সংস্কারে জোর সরকারের
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, খুলনা মহানগরীর নতুন বাজার, নিউমার্কেট, শিপইয়ার্ড, রায়েরমহল এবং রূপসা উপজেলার পূর্ব রূপসা এলাকায় ছোট-বড় মিলিয়ে ১৫টি বরফকল রয়েছে। এর মধ্যে নতুন বাজার ও পূর্ব রূপসায় সর্বাধিক বরফকল রয়েছে। এসব কলে গড়ে দশ জন হিসেবে দেড় শতাধিক শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করেন।
রূপসার নতুন বাজার এলাকায় অবস্থিত ‘বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজে’ কাজ করেন মোহাম্মদ রাসেল হোসেন। তার গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরার আশাশুনি হলেও পরিবার নিয়ে রূপসার জাবুসা এলাকায় বসবাস করেন। দীর্ঘ সাত বছর ধরে এই বরফকলে কাজ করছেন তিনি। রাসেল জানান, তাদের মাসিক বেতন নেই। নেই নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র। মূলত উৎপাদনের উপর প্রতি পিস বরফের ক্যান অনুযায়ী ১২ টাকা হারে মজুরি পান। নামমাত্র এ মজুরিতে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির বাজারে সংসার ঠিকমতো চলে না।
‘‘তিন বছর আগে নির্ধারণ করা মজুরি এখনো চলছে। লোকসানের অজুহাতে মালিকপক্ষ মজুরি বাড়াতে চান না। তাদের মতো শ্রমিকদের কোন বেতন-বোনাস নেই। নো ওয়ার্ক, নো পে অর্থাৎ কাজ থাকলে মজুরি আছে কাজ না থাকলে নেই। মালিকদের এ সিদ্ধান্ত না মানলে চাকরিও থাকে না।’’ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন রাসেল হোসেন।
একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন মোঃ জাকির হোসেন। তিনি বলেন, ‘‘গড়ে প্রতিমাসে ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা মজুরি পাই। কিন্তু মাসিক খাবার খরচ প্রায় ৩ হাজার টাকা। বাসা ভাড়া বাবদ ৩ হাজার টাকা চলে যায়।’’
তবে জাকির হোসেন ব্যাচেলর হওয়ায় কারখানার মধ্যেই থাকেন। বিয়ের পর এ কাজ করার ইচ্ছা নেই বলে জানান তিনি।
বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ-১-এ অপারেটর হিসেবে কর্মরত রয়েছেন মোঃ সেলিম শেখ। তার জন্ম নড়াইলের লক্ষ্মীপাশা হলেও কর্মসংস্থানের কারণে রুপসার বাগমারা গ্রামে বসবাস করছেন। তিনি জানান, বর্তমান বয়স ৮৪। ২০ বছর বয়স থেকেই বরফ কারখানার সঙ্গে জড়িত। প্রথমে হেলপার হিসেবে ২৫০০ টাকা বেতনে কাজ শুরু করেন। বর্তমানে অপারেটর হিসেবে মাসিক ১৫ হাজার টাকা পান। প্রতিদিন ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে কাজ শুরু করতে হয়। তবে সবসময় উৎপাদন না থাকলেও ২৪ ঘণ্টা কারখানায় থাকতে হয়। ছুটি পান না।
‘অ্যামোনিয়া গ্যাসের অতিরিক্ত চাপের কারণে সিলিন্ডার লিকেজ হলে মৃত্যু ঝুঁকি রয়েছে। তবে তিনি কখনো বড় ধরনের দুর্ঘটনার সম্মুখীন হননি বলে জানান তিনি।
‘মায়ের দোয়া আইস এন্ড কোল্ড স্টোরেজে’র শ্রমিক জাকারিয়া হাওলাদার বলেন, ‘‘চার বছর বরফকলে কাজ করছি। চাকরির ভবিষ্যৎ নেই। শ্রম দিতে পারলে মজুরি হয়, না হলে হয় না। নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র দেন না মালিকপক্ষ। বেতন বাড়ানোর কথা বললে তারা আমলে নেন না।’’
একই এলাকার ‘ব্রাইট অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজে’ কাজ করছেন মোঃ মুন্না গাজী ও মোঃ হাসান শেখ। তারা নগরীর জিন্নাপাড়া এলাকায় বসবাস করেন। তারা দুজনেই মাসিক ১০ হাজার টাকা বেতন পান। এর বাইরে তেমন কোন সুযোগ সুবিধা নেই।
‘ব্রাইট অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজে’র ম্যানেজার আশিকুর রহমান বিষয়টি স্বীকার করে জানান, কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের সুরক্ষায় উদাসীন। এখানে অ্যামোনিয়া গ্যাসের সিলিন্ডার মাঝেমধ্যেই লিক হয়। তবে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি। প্রতিষ্ঠানটিতে ৫৩২টি আইস উৎপাদনের ক্যানের প্লান্ট রয়েছে। তবে প্রতিদিন গড়ে ২৫০ ক্যান বরফ উৎপাদন হয়। ছয়জন শ্রমিক কাজ করে বলে জানান তিনি।
‘বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ- ২'র ম্যানেজার জামাল উদ্দিন বলেন, ‘‘বরফের মূল ক্রেতা চিংড়ি ও সাদা মাছের ব্যবসায়ীরা। এর বাইরে গ্রীষ্ম মৌসুমে ভ্রাম্যমাণ ও দোকানে শরবত বিক্রেতারাও কারখানা থেকে বরফ কিনে নেন। গ্রীষ্ম মৌসুমের ৬ মাস চাহিদা থাকে এবং কিছুটা লাভের মুখ দেখা যায়। তবে শীত মৌসুমের ছয় মাস বরফের চাহিদা কম থাকে। তখন কারখানা ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিলসহ শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন ও মজুরি দিয়ে লোকসান গুণতে হয়।’’
জামাল উদ্দিন স্বীকার করেন কারখানায় নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকলেও তা এড়াতে কোন সরঞ্জাম নেই। তবে অপারেটরদের অ্যামোনিয়া গ্যাসের ঝুঁকি প্রতিরোধে মাক্স সরবরাহ করা হয়।
‘বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ-১'র মালিকপক্ষের প্রতিনিধি রিয়াদ-উল-জান্নাত সৈকত বলেন, ‘‘ব্যবসা খুব ভালো যাচ্ছে না। কখনো লাভ, কখনো লোকসান এভাবেই চলছে। গত বছর কারখানা ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিলসহ অন্যান্য খরচ বাবদ ৯ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে।’’
তবে লাভ হলে শ্রমিক কর্মচারীদের মজুরি ও অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা করা হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এ বিষয়ে শ্রমিকদের সংগঠন রূপসা বেড়িবাঁধ হ্যান্ডলিং শ্রমজীবী ইউনিয়নের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোঃ রিপন শেখ এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘‘নতুন বাজার এলাকায় অবস্থিত কয়েকটি বরফকলের ৪০ জন শ্রমিক তাদের ইউনিয়নের সদস্য। বিগত দেড় বছর আগে মজুরির সমস্যা নিয়ে মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে দুই একজন শ্রমিক অভিযোগ করলে ইউনিয়নের মাধ্যমে সেটির সমাধান করে দেন তারা। কিন্তু বর্তমানে অভিযোগ নিয়ে কেউ আসে না।’’
বরফকলের শ্রমিকদের নিয়ে তারা মে দিবসের কর্মসূচি পালন করেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তারা//