ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে গত মঙ্গলবার যে রক্তপাত ঘটল, সেটি ২০১৯ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত সেখানে সংঘটিত সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলার ঘটনা। হামলায় অন্তত ২৬ জন পর্যটক নিহত হয়েছেন।

হামলায় হতাহতের শিকার ব্যক্তিরা সেনাসদস্য বা সরকারি কর্মকর্তা নন। ভারতের অন্যতম সুন্দর নৈসর্গিক দৃশ্যের একটি স্থানে অবকাশ কাটাতে পর্যটক হিসেবে যাওয়া বেসামরিক ব্যক্তি তাঁরা। সেই দিক থেকে এ হামলা নিষ্ঠুর ও প্রতীকী উভয়ই। এটি শুধু মানুষের জীবন লক্ষ্য করেই চালানো হয়নি; বিতর্কিত অঞ্চলটিতে ভারত যে স্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করার ভঙ্গুর ধারণা তুলে ধরার চেষ্টা করছে, তার ওপরও একটি পরিকল্পিত আক্রমণ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাশ্মীরের ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ ইতিহাস বিবেচনা করলে দেখা যাবে, ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশই এর ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দাবি করেছে। তবে উভয়ে আলাদাভাবে কাশ্মীরের দুই অংশ শাসন করে। সর্বশেষ হামলায় ভারতের জবাব কেমন হবে, তা নির্ভর করবে অনেকটাই অভ্যন্তরীণ চাপের ওপরে।

এরই মধ্যে দিল্লি ত্বরিতগতিতে প্রতিশোধমূলক একগুচ্ছ পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে আছে পাকিস্তানের সঙ্গে প্রধান সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ পানি ভাগাভাগির চুক্তি স্থগিত করা ও কূটনীতিকদের বহিষ্কার।

আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের বক্তব্য। তিনি শুধু অপরাধীদের বিরুদ্ধে নয়; ভারতীয় মাটিতে ‘জঘন্য কর্মকাণ্ডের’ পেছনে থাকা মূল পরিকল্পনাকারীদের বিরুদ্ধেও ‘কঠোর ব্যবস্থা’নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের বক্তব্য। তিনি শুধু অপরাধীদের বিরুদ্ধে নয়; ভারতীয় মাটিতে ‘জঘন্য কর্মকাণ্ডের’ পেছনে থাকা মূল পরিকল্পনাকারীদের বিরুদ্ধেও ‘কঠোর ব্যবস্থা’নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

বিশ্লেষকদের মতে, ভারত সামরিক প্রতিক্রিয়া দেখাবে কি না, সেটি প্রশ্ন নয়; বরং প্রশ্ন হলো, কবে ও কীভাবে এটি হবে এবং এর মূল্য কতটা হতে পারে।

আরও পড়ুনকাশ্মীরে ৩ সন্দেহভাজন হামলাকারীর স্কেচ প্রকাশ করেছে ভারতের নিরাপত্তা সংস্থা২০ ঘণ্টা আগে

সামরিকবিষয়ক ইতিহাসবিদ শ্রীনাথ রাঘবন বিবিসিকে বলেছেন, ‘আমরা সম্ভবত একটা জোরাল প্রতিক্রিয়া দেখতে চলেছি। এটি অভ্যন্তরীণ দর্শক ও পাকিস্তানের ‘খেলোয়াড়’—উভয়ের জন্য একটা ইঙ্গিত দেয়। ২০১৬ সাল থেকে, বিশেষ করে ২০১৯ সালের পর দুই দেশের মধ্যে প্রতিশোধ গ্রহণের ধরন হয়ে উঠেছে সীমান্তে অনুপ্রবেশ করা বা বিমান হামলা চালানো।’

‘(ভারত) সরকারের তরফে এখন এর নিচে পদক্ষেপ নেওয়া কঠিন হবে। পাকিস্তান সম্ভবত আগের মতোই প্রতিক্রিয়া জানাবে। ঝুঁকির বিষয় হলো, সর্বদাই উভয় পক্ষের ভুল হিসাব-নিকাশ,’ বলেন রাঘবন।

আমরা সম্ভবত একটি জোরাল প্রতিক্রিয়া দেখতে চলেছি। এটি অভ্যন্তরীণ দর্শক ও পাকিস্তানের ‘খেলোয়াড়’—উভয়ের জন্য একটা ইঙ্গিত দেয়। ২০১৬ সাল থেকে, বিশেষ করে ২০১৯ সালের পর দুই দেশের মধ্যে প্রতিশোধ গ্রহণের ধরন হয়ে উঠেছে সীমান্তে অনুপ্রবেশ করা বা বিমান হামলা চালানো।শ্রীনাথ রাঘবন, সামরিকবিষয়ক ইতিহাসবিদ

এর আগে ২০১৬ ও ২০১৯ সালে ভারতের নেওয়া দুটি বড় প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপের প্রতি ইঙ্গিত করেন এই ঐতিহাসিক।

২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে উরি হামলায় ১৯ ভারতীয় সেনা নিহত হওয়ার পর নয়াদিল্লি ‘নিয়ন্ত্রণরেখা (এলওসি)’ নামে পরিচিত কার্যত সীমান্তে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ নামে আক্রমণ চালায়। ভারতের দাবি, তারা এ অভিযানে পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরে ‘সন্ত্রাসীদের’ ঘাঁটি নিশানা করেছে।

আরও পড়ুনকাশ্মীর: যে হামলা অনেক কিছু বদলে দিতে পারে২০ ঘণ্টা আগে

আবার ২০১৯ সালে, পুলওয়ামায় হামলায় আধা সামরিক বাহিনীর অন্তত ৪০ সদস্য নিহত হওয়ার পর ভারত বালাকোটে কথিত সন্ত্রাসীদের ঘাঁটিতে বিমান হামলা চালায়। ১৯৭১ সালের পর পাকিস্তানের এতটা ভেতরে এমন হামলার ঘটনা এটাই প্রথম। পাল্টা বিমান হামলা চালায় পাকিস্তানও। পাল্টাপাল্টি হামলার মধ্যে ভারতীয় এক বিমানচালককে কিছু সময়ের জন্য আটক করে পাকিস্তান। দুই পক্ষই শক্তির মহড়া দেখায়, কিন্তু পুরোদমে যুদ্ধ এড়িয়ে যায়।

এ ঘটনার দুই বছর পর ২০২১ সালে নিয়ন্ত্রণরেখায় যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠায় সম্মত হয় ভারত ও পাকিস্তান। এরপর ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে একাধিকবার সশস্ত্র হামলা হলেও যুদ্ধবিরতি অনেকটাই টিকে ছিল।

২০১৯ সালে, পুলওয়ামায় আধা সামরিক বাহিনীর অন্তত ৪০ সদস্য নিহত হওয়ার পর ভারত বালাকোটে কথিত সন্ত্রাসীদের ঘাঁটিতে বিমান হামলা চালায়। ১৯৭১ সালের পর পাকিস্তানের এতটা ভেতরে এমন হামলার ঘটনা এটাই প্রথম। পাল্টা বিমান হামলা চালায় পাকিস্তানও। তখন দুই পক্ষই শক্তির মহড়া দেখায়, কিন্তু পুরোদমে যুদ্ধ শুরু এড়িয়ে যায়।

পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান মনে করেন, সাম্প্রতিকতম এ হামলায় ভারতীয় বেসামরিক লোকজনকে নিশানা করায় ও মৃত্যুর সংখ্যা বেশি হওয়ায় ‘নয়াদিল্লি যদি এর সঙ্গে পাকিস্তানের কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা থাকাকে ধরে নেয় বা অনুমান করে, তবে ভারতের তরফে সামরিক প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকবে।’

কুগেলম্যান বিবিসিকে বলেন, ‘ভারতের জন্য এমন প্রতিক্রিয়া দেখানোর সবচেয়ে বড় সুবিধাটা হবে রাজনৈতিক। কেননা, ওই হামলার কঠোর জবাব দিতে ভারতের ওপর জনগণের বড় ধরনের চাপ আসবে।’

বিশ্লেষক কুগেলম্যান আরও বলেন, ‘প্রতিক্রিয়া দেখানোর আরেকটি সুবিধা, ভারত যদি সফলভাবে “সন্ত্রাসীদের” নিশানা বানাতে পারে, তবে তা তার প্রতিরোধক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে ও ভারতবিরোধী হুমকি হ্রাস করবে। আর অসুবিধা হলো, প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ গুরুতর সংকট এবং এমনকি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি করবে।’

আরও পড়ুনকাশ্মীরে হামলাকারীদের খুঁজতে ভারতের নিরাপত্তা বাহিনীর জোরালো অভিযান২৩ এপ্রিল ২০২৫ভারতের সামনে বিকল্প কী

গোপন অভিযানে দায় অস্বীকার করার সুযোগ থাকে। তবে তা প্রতিরোধ–সক্ষমতা দৃশ্যমানভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠার যে রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তা, সেটি মেটাতে পারে না। এমনটাই মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালবানি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিস্টোফার ক্ল্যারি। তিনি বলেন, ভারতের সামনে দুটি সম্ভাব্য পথ রয়েছে।

সাম্প্রতিকতম এ হামলায় ভারতীয় বেসামরিক লোকজনকে নিশানা করায় ও মৃত্যুর সংখ্যা বেশি হওয়ায় ‘নয়াদিল্লি যদি এর সঙ্গে পাকিস্তানের কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা থাকাকে ধরে নেয় বা অনুমান করে, তবে ভারতের তরফে সামরিক প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকবে’।মাইকেল কুগেলম্যান, পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক বিশ্লেষক

প্রথমত, ২০২১ সালে নিয়ন্ত্রণরেখায় প্রতিষ্ঠিত যুদ্ধবিরতি ফিকে হয়ে এসেছে এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আন্তসীমান্তে গোলাগুলি শুরু করার সবুজসংকেত দিতে পারেন।

দ্বিতীয়ত, ২০১৯ সালের মতো বিমান হামলা বা প্রচলিত ক্রুজ মিসাইল দিয়ে আক্রমণ চালানোর বিষয়ও আলোচনার টেবিলে আছে। তবে উভয় ক্ষেত্রেই পাল্টাপাল্টি আক্রমণের ঝুঁকি থাকবে।

কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার প্রতিবাদে ভারতে পাকিস্তানবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেন বিজেপির কর্মীরা.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ২০১৯ স ল র স ল র পর পদক ষ প র জন য ব ষয়ক

এছাড়াও পড়ুন:

মুক্তিপণ দিয়েও পাঁচ মাস ধরে ১৪ তরুণের খোঁজ পাচ্ছেন না স্বজনেরা

অবৈধ পথে ইতালির উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার ১৪ তরুণ। কিন্তু দুবাই হয়ে লিবিয়ায় পৌঁছানোর পর পাঁচ মাস ধরে তাঁদের আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। স্বজনদের দাবি, দালালের প্রলোভনে পড়ে জনপ্রতি ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকা মুক্তিপণও দিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু সন্ধান না পাওয়ায় চরম দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন তাঁরা।

ইউরোপের কোনো দেশে গেলে সচ্ছলতা আসবে, এমন ধারণা নিয়ে প্রতিবছর মাদারীপুর থেকে শত শত তরুণ সেখানে পাড়ি জমানোর চেষ্টা করছেন। তবে অবৈধ পথে ইউরোপ যেতে গিয়ে অনেকের মৃত্যু হয়েছে। কেউবা দালালের খপ্পরে পড়ে নির্যাতনের শিকার হয়ে কাটাচ্ছেন বন্দিজীবন। জেলা প্রশাসন ও পুলিশের তথ্য বলছে, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত জেলার ৪৫ জন লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার পথে মারা গেছেন। ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে নির্যাতনের শিকার হয়ে লিবিয়া থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসতে পেরেছেন অন্তত ৩৫০ তরুণ। নিখোঁজ আছেন তিন শতাধিক।

সবশেষ নিখোঁজ তরুণদের সবার বাড়ি রাজৈরের বাজিতপুর ইউনিয়নে। তাঁরা হলেন পাখুল্লা গ্রামের জাহাঙ্গীর ব্যাপারীর ছেলে সালমান ব্যাপারী, চৌরাশী গ্রামের মোসলেম শিকদারের ছেলে বাবুল শিকদার, একই গ্রামের মজিবর বয়াতীর ছেলে সাজ্জাদ বয়াতী, জাকির মাতুব্বরের ছেলে বাদল মাতুব্বর, কানাই রায়ের ছেলে লিটন রায়, নিরঞ্জন বাড়ৈর ছেলে বাঁধন বাড়ৈ, কিসমদ্দি বাজিতপুর গ্রামের আলম চৌকিদারের ছেলে ইমন চৌকিদার, অহিদুল মাতুব্বরের ছেলে নয়ন মাতুব্বর, আজিজ খালাসির ছেলে খলিল খালাসি, সোনা মিয়া চৌকিদারের ছেলে সোহেল চৌকিদার, নয়াকান্দি বাজিতপুর গ্রামের গৌরাঙ্গ বাড়ৈর ছেলে গৌতম বাড়ৈ, একই গ্রামের সামচু সরদারের ছেলে ইমরান সরদার, শ্রীনাথদী বাজিতপুরের জলিল বয়াতীর ছেলে আল আমিন বয়াতি ও শ্রীনদী গ্রামের সিদ্দিকুর রহমান ঘরামির ছেলে আলী ঘরামি। তাঁদের সবার বয়স ১৮ থেকে ২৮ বছরের মধ্যে।

স্বজনদের অভিযোগ, মানব পাচার চক্রের সক্রিয় সদস্য বাজিতপুর এলাকার বাবুল হাওলাদার ইতালি নেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে প্রত্যেক পরিবারের কাছ থেকে প্রথমে ১৬ লাখ টাকা করে নেন। পরে লিবিয়ায় বন্দী করে আদায় করেন আরও ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা। এর পর থেকে ঘরে তালা ঝুলিয়ে পালিয়েছেন অভিযুক্ত বাবুল ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা।

মাদারীপুরের ১৪ তরুণ ইতালি যেতে গত ফেব্রুয়ারি মাসে দালালের হাত ধরে ঘর ছাড়েন। নিখোঁজ তরুণদের সন্ধানে তাদের ছবি হাতে স্বজনেরা

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গোবিপ্রবিতে ২ বিভাগের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ, প্রক্টর-প্রাধ্যক্ষসহ আহত ১৫
  • মুক্তিপণ দিয়েও পাঁচ মাস ধরে ১৪ তরুণের খোঁজ পাচ্ছেন না স্বজনেরা
  • আইপিএলে কোহলিকে অধিনায়কত্ব থেকে সরাতে চেয়েছিলেন কারস্টেন