ঐকমত্য থাকা সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে না কেন?
Published: 1st, June 2025 GMT
নিবন্ধটি প্রকাশের দিন দুটি বড় ঘটনা ঘটার কথা। এক. জাতীয় বাজেট দেবেন অর্থ উপদেষ্টা। দুই. জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বিতীয় দফা সংলাপ শুরু হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের বাজেট-সংক্রান্ত কিছু ধারণা ইতোমধ্যে সংবাদমাধ্যমে এসে গেছে। রাষ্ট্র সংস্কার-বিষয়ক সংলাপে শেষতক কী মিলবে, সেটা নিয়ে সংশয়ই বেশি।
ঐকমত্য কমিশন যেগুলোকে ‘মৌলিক সংস্কার’ বলছে, তার সিংহভাগ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি প্রথম দফা সংলাপে। ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় একাধিক বৈঠক করেও সুফল মেলেনি। মাঠে থাকা দলগুলোর মধ্যে জামায়াত ও এনসিপিকে কাছাকাছি দেখা গেলেও এ ক্ষেত্রে বিএনপির ভিন্নমত স্পষ্ট। সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের উপায় নিয়েও তাদের মত ভিন্ন। জুলাইয়ের মধ্যে এ-সংক্রান্ত ‘চার্টার’ প্রকাশের কথা।
রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগ অবশ্য এক-এগারো সরকারের সময়েও নেওয়া হয়েছিল। নির্বাচিত সরকারের আমলে এর সিংহভাগই পরিত্যক্ত হয়। এই হলো আমাদের সংস্কারের অভিজ্ঞতা!
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চূড়ান্ত পর্যায়ে সরকারের পদত্যাগের পাশাপাশি রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি ওঠে। মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলে তারাও সংস্কারে জোর দেয়। বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনের এজেন্ডা নিয়ে এগোয় সরকার। তা নিয়ে শুরুতে আপত্তি তেমন ওঠেনি। তবে ক’মাস পর থেকেই ‘দ্রুত’, না দেরিতে নির্বাচন– এ নিয়ে মতভেদ বাড়তে থাকে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে।
উল্লেখ্য, সরকার গঠনের দু’মাসের মধ্যে সেনাপ্রধান রয়টার্সকে জানান, এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে সংস্কার ও নির্বাচন সম্পন্নের কাজে সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাবেন তারা। গণঅভ্যুত্থানের শেষ ভাগে সেনাবাহিনীর ভূমিকা ছিল ইতিবাচক। সরকার গঠনেও তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সেনাপ্রধানের বক্তব্যকে তাই সবাই নেয় গুরুত্বের সঙ্গে। এর পর প্রধান উপদেষ্টাও জানান, চলতি বছরের ডিসেম্বর কিংবা পরবর্তী বছর জুনের মধ্যে সংস্কার শেষে নির্বাচন হবে। সংস্কার কমিশন গঠন এবং তাদের সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক সংলাপ চলছে এ প্রেক্ষাপটেই।
এর মধ্যে রাজনীতিতে দুটি পক্ষ ক্রমে স্পষ্ট হয়েছে। এক পক্ষ ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন চায়। অপর পক্ষের জুনে কিংবা তার পরেও নির্বাচন হলে আপত্তি নেই। দ্বিতীয় পক্ষের একাংশ ইউনূস সরকারকে দীর্ঘদিন রেখে দিতে চায় বলেও কথা চালু রয়েছে। এর বাস্তবতা আছে বলে অবশ্য মনে হয় না। মুহাম্মদ ইউনূসও পরিষ্কার বলেছেন– ২০২৬ সালের জুনের পর এক দিনও তারা ক্ষমতায় থাকবেন না। এরই মধ্যে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জোরদার হয়েছে। খোদ সেনাপ্রধান এ বিষয়ে জানিয়েছেন স্পষ্ট অভিপ্রায়। সম্প্রতি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানও দাবি জানিয়েছেন– ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হতে হবে। এসব ঘিরে প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগও করতে চেয়েছিলেন। এত কিছু ঘটে যাওয়ার পর সংস্কারের বদলে নির্বাচনের সময়সীমা সুনির্দিষ্ট করার প্রশ্নই মনে হয় বেশি করে উপস্থিত।
সংস্কারে সরকারও আসলে কতটা আগ্রহী? সমকালের এক প্রতিবেদনে ‘আশু বাস্তবায়নযোগ্য’ ১২১টি সুপারিশের বাস্তবায়ন নিয়ে সরকারের গড়িমসির যে খবর এসেছে, তাতে এ প্রশ্ন উঠতেই পারে। সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন থেকে ওইসব সুপারিশ আলাদা করে সরকার বলেছিল, এগুলো নিয়ে রাজনৈতিক সংলাপের প্রয়োজন নেই। জনপরিসরেও ঐকমত্য রয়েছে। কিন্তু সুপারিশগুলোর বাস্তবায়নে আড়াই মাসেও অগ্রগতির খবর নেই। উদ্যোগ-আয়োজনও অনুপস্থিত।
প্রথম দফা সংস্কার সংলাপেও অনেক বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে। সেগুলোর বাস্তবায়ন শুরুরও খবর নেই। এদিকে সরকারের প্রায় ১০ মাস অতিক্রান্ত। এ সময়ে অতীতে তিনটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে তিনটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছে এ দেশে। তারাও একেবারে কম প্রতিকূলতা মোকাবিলা করেনি। প্রশাসনিক রদবদলসহ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কিছু বিধিবিধান পরিবর্তনেও তারা ছিল উদ্যোগী। এর সুফল পরবর্তীকালেও মিলেছে। বর্তমান সরকারের কাছে এ দাবি তো অনেক বেশি জোরালো। রাজনৈতিক ঐকমত্যে ‘মৌলিক সংস্কার’ করা গেলে তাতেও আপত্তি ছিল না কারও। কিন্তু কিছু বিষয়ে ঐকমত্য হচ্ছে না বলে কোনো সংস্কারই নয়– এটা কোনো গ্রহণযোগ্য অবস্থান হতে পারে না।
সরকার যে বাজেট দিতে যাচ্ছে, তাতেও গণঅভ্যুত্থানের পর অর্থনীতি বিষয়ে গঠিত কমিটি ও টাস্কফোর্সের সুপারিশ তেমন আমলে নেওয়া হচ্ছে না বলে সংবাদপত্রে খবর রয়েছে। এর ‘সুযোগ’ নাকি কম। অন্তর্বর্তীকালে অর্থনৈতিক সংস্কারে পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ কম থাকলে রাজনীতির মতো গুরুতর বিষয়ে ঐকমত্যের সুযোগ কতটা থাকে– সে প্রশ্নও তোলা যেতে পারে। মতপার্থক্য থাকলে তা দূরীকরণে আলোচনার প্রয়োজন অবশ্য কেউ অস্বীকার করে না। এ অবস্থায় মতপার্থক্য না থাকা সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করে ফেললে সেটা প্রশংসিতই হতো। সরকার সে পথে না গিয়ে মূল্যবান সময় নষ্ট করছে বলে অভিযোগ উঠলে তা কিন্তু উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। সংস্কার সংলাপে কালক্ষেপণ করে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার পথেই সরকার রয়েছে বলে সন্দেহ বরং এতে ঘনীভূত হবে।
ব্যাংক সংস্কার, রিজার্ভ বৃদ্ধি, পণ্যবাজার সামলানোর মতো বিষয় বাদে আর কোনো ক্ষেত্রেই অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য নেই বলা যায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় তার ব্যর্থতার সমালোচনা করছে সরকার সমর্থকরাও। নিবন্ধটি লেখার আগের দিন খোদ রাজধানীতে দুই যুবক নিহত হয় গণপিটুনিতে। গতকালের সমকালে ইউনূস সরকারের আমলে গ্রেপ্তার বৃদ্ধির চিত্রটি স্পষ্ট। এটাকে পুলিশের সক্রিয়তা বৃদ্ধির প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরা গেলেও এর সঙ্গে আইনশৃঙ্খলার চিত্র কিন্তু বেমানান। অর্থনীতিতেও আছে এর সুস্পষ্ট প্রভাব। উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা কাটছে না বলে সচল হচ্ছে না অর্থনীতি। সংস্কারের একটা হিল্লে করে সরকার নির্বাচনের দিকে গেলে এ ক্ষেত্রে গতিশীলতার সৃষ্টি হতো বৈকি! জননিরাপত্তা ও আস্থা না বাড়লে যে বাজেট দেওয়া হচ্ছে, তার বাস্তবায়নও সহজ হবে না। এক এনবিআর সংস্কার নিয়ে সরকার যে বিপাকে পড়েছে, তাতে চলতি অর্থবছরেই রাজস্ব আহরণে বেড়েছে সংকট। অর্থনীতি গতিশীল না হলে এমনিতেও রাজস্ব বাড়বে না। সরকারের নিয়মিত ব্যয় নির্বাহও কঠিন হবে তখন।
অর্থনীতিতে সৃষ্ট পরিস্থিতিও দ্রুত নির্বাচনের দাবিকে জোরালো করে তুলছে। এদিকে নির্বাচন অনুষ্ঠানে যত দেরি হবে, ততই বাড়বে ব্যাপক জনসমর্থনহীন শক্তিগুলোর প্রতাপ। বিগত ক’মাসের অভিজ্ঞতায় এটাই বেশি করে মনে হচ্ছে। সরকার এ পরিস্থিতিতে কঠোরতা অবলম্বনে ব্যর্থ। তার রাজনৈতিক নিরপেক্ষতাও কমবেশি প্রশ্নবিদ্ধ। সংস্কারেও তাকে সিদ্ধান্তহীন দেখা যাচ্ছে। এ অবস্থায় সংস্কার আলোচনা অর্থহীন মনে হতে পারে। নির্বাচনের সময়সীমা বিষয়ে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণের লক্ষ্যে সংলাপ বরং মনে হতে পারে জরুরি। ডিসেম্বর ও জুনের মধ্যবর্তী সময়ে, রমজানের আগে নির্বাচন আয়োজনের সম্ভাবনার কথা মাঝে শোনা গিয়েছিল। সে বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার আলোচনাও এ মুহূর্তে আশার সঞ্চার করতে পারে।
হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলাম লেখক
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত ড স ম বর র জন ত ক সরক র র ঐকমত য দলগ ল ইউন স
এছাড়াও পড়ুন:
বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে ঐকমত্য না হলে গণভোট ছাড়া উপায় নেই: এবি পার্টি
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে অংশ নিয়ে আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেছেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারলে গণভোট ছাড়া উপায় নেই।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে আজ বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক হয়। বৈঠকের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এবি পার্টির চেয়ারম্যান এ কথা বলেন।
ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে মজিবুর রহমান বলেছেন, ‘সংবিধান পরিবর্তন, সংস্কার, সংশোধন, নতুন করে লেখা বা বাতিলের চূড়ান্ত ক্ষমতা জনগণের। আমরা ঐক্যবদ্ধ মতামতের ভিত্তিতে জুলাই সনদ তৈরি করেছি, হয়তো কয়েকটি বিষয়ে কারও কারও “নোট অব ডিসেন্ট” (দ্বিমত) আছে। কিন্তু চূড়ান্ত কোনটা হবে, তা নির্ধারণের মূল ক্ষমতা জনগণের।’
কমিশনের আজকের প্রস্তাবে জুলাই ঘোষণাপত্রের ২২ নম্বর অনুচ্ছেদকে রেফারেন্স আকারে উল্লেখ করায় কোনো কোনো রাজনৈতিক দল ও নেতা জুলাই ঘোষণাপত্রের বৈধতা নিয়ে মন্তব্য করেন। এ বিষয়ে এবি পার্টির চেয়ারম্যান সাংবাদিকদের বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে যাঁরা আজ প্রশ্ন তুলছেন, কাল তাঁরা সংসদে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করবেন এবং এই সনদকে প্রশ্নবিদ্ধ করবেন না, তার নিশ্চয়তা কী?
এবি পার্টির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সানী আবদুল হক বলেন, সংবিধানে এটা নেই, ওটা নেই বলে সংবিধান সংস্কার করা যাবে না—এই ধারণা অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাপরিপন্থী। রাজনৈতিক দলগুলো যদি জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতির প্রশ্নে নিজেদের অবস্থান থেকে নমনীয় না হয়, তবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পুরো প্রচেষ্টা মুখ থুবড়ে পড়বে।
আশঙ্কা প্রকাশ করে এবি পার্টির এই নেতা বলেন, এমন পরিস্থিতি জাতিকে এক গভীর সংকটের দিকে ঠেলে দেবে। সুতরাং জাতীয় স্বার্থে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা জরুরি; অন্যথায় গণভোট ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
আরও পড়ুনবর্ধিত মেয়াদের আগেই জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি চূড়ান্ত করতে চায় কমিশন: আলী রীয়াজ৪ ঘণ্টা আগে