সিনহা হত্যাকাণ্ড: তদন্ত প্রতিবেদনে যা উঠে এলো
Published: 3rd, June 2025 GMT
পাঁচ বছর আগে কক্সবাজারের টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর তল্লাশি চৌকিতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান। ঘটনার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে সেদিন যা ঘটেছিল, সে তথ্য উঠে এসেছে।
সিনহা হত্যার ঘটনার এক মাসের মাথায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দেয়। তদন্ত কমিটির প্রধান চট্টগ্রামের তৎকালীন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে প্রতিবেদনটি জমা দেন।
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২০ সালের ৩১ জুলাই বিকেল সাড়ে তিনটায় প্রাইভেট কার ছুটে চলছে। কারটি চালাচ্ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো.
নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে নতুন মেরিন ড্রাইভ রাস্তার পাশে কারটি পার্কিং করে পাহাড়ের দিকে রওয়ানা হন তারা। সিনহার পরনে ছিল সেনাবাহিনীর পোশাকের মত কম্ব্যাট প্যান্ট ও কম্ব্যাট গেঞ্জি। পাহাড়ে ওঠার সময় মারিশ বুনিয়া মাথাভাঙ্গা মসজিদের ইমামের সঙ্গে সালাম বিনিময় হয় সিনহার। একটি ছোট ছেলের কাছ থেকে তারা পাহাড়ে ওঠার পথ জেনে নেন। পাহাড় ও সমুদ্রের মেল বন্ধনে সূর্যাস্তের টাইমল্যাপস ধারণ করতে করতে অন্ধকার হয়ে যায়।
রাত আটটা। মেজর সিনহাকে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলতে পাতা হয় ফাঁদ। দক্ষিণ মারিশবুনিয়া জামে মসজিদের ঘোষণা দেওয়া হয় পাহাড়ে ডাকাত দেখা যাচ্ছে। এ সময় জড়ো হয় কিছু লোক। কিন্তু পাহাড়ে কোনো সাড়াশব্দ বা লাইট না দেখা যাওয়ায় তারা চলে যায়। ভেস্তে যায় ফন্দিটি। কিন্তু তাতে দমে যায়নি পুলিশের ৩ সোর্স।
এর কিছুক্ষণ পর পাহাড় থেকে পুলিশের ওই তিন সোর্সের সামনে দিয়ে নেমে আসেন মেজর সিনহা ও সিফাত। এ সময় তারা, সিনহা ও সিফাতের মুখে টর্চ লাইটের আলো ফেলে নিশ্চিত হয় এই সেই ভিডিও দল। নুরুল আমিন, নিজাম উদ্দিন ও আইয়াজ এ তিনজন সিনহাকে অনুসরণ করে মেরিন ড্রাইভ পর্যন্ত আসে। এবং তারা কোন দিকে যাচ্ছেন তা নিশ্চিত হয়।
সোর্স নুরুল আমিনের কল পেয়ে ইন্সপেক্টর মো. লিয়াকত শামলাপুরে পুলিশ চেকপোস্টে যান। তড়িঘড়ি করে এসআই দুলালসহ মোটরসাইকেলে সেখানে পৌঁছে অস্ত্রসহ অবস্থান নেন তিনি। অপেক্ষা করতে থাকেন সিনহার গাড়ি পৌঁছানোর।
রাত ৯টা ২০ মিনিট। বিজিবি চেকপোস্ট অতিক্রম করে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার কারটি। ৫ মিনিটেই তা পৌঁছে যায় শামলাপুর চেকপোস্টে। এপিবিএন সদস্য কনস্টেবল রাজীব কারটি থামানোর সংকেত দেন। সংকেত পেয়ে থেমে যায় সিনহার কার। কনস্টেবল রাজীব পরিচয় জানতে চাইলে বাম পাশে বসা সাহেদুল ইসলাম রিফাত কারের জানালা খুলে দেন। এ সময় গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসা অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা নিজের পরিচয় দেন। কুশল বিনিময় শেষে কনস্টেবল রাজীব ও অন্য দুই এপিবিএন সদস্য এসআই শাহজাহান আলী ও কনস্টেবল আব্দুল্লাহ আল-মামুন ইমন স্যালুট দিয়ে গাড়িটি চলে যাওয়ার সংকেত দেন।
সংকেত পেয়ে গাড়িটি এগোতেই মেজর সিনহা নাম শুনেই পেছন থেকে চিৎকার করে সামনে চলে আসেন ইন্সপেক্টর লিয়াকত। আবার তাদের পরিচয় জিজ্ঞেস করেন। পুণরায় তিনি নিজেকে মেজর অবসরপ্রাপ্ত সিনহা বলে পরিচয় দেন। নাম শুনে উত্তেজিত হয়ে লাফ দিয়ে সামনে গিয়ে ব্যারিকেড টেনে রাস্তা বন্ধ করে দেন লিয়াকত। এতে লিয়াকতকে সহায়তা করেন এসআই নন্দ দুলালও।
লিয়াকত আলীর চোটপাটের মধ্যে দুই হাত উঁচু করে গাড়ি থেকে নেমে আসেন সাহেদুল ইসলাম রিফাত। ড্রাইভিং সিটে বসা সিনহা গাড়ি থেকে দুই হাত উঁচু করে নেমে লিয়াকত আলীকে শান্ত করার চেষ্টা করেন।
৯টা ২৫ মিনিটে শামলাপুর চেকপোস্টে পৌঁছে মেজর সিনহার গাড়ি। ৯টা ৩০ মিনিটে ১ মিনিট ১৯ সেকেন্ড এবং ৯টা ৪৫ মিনিটে ১৬ সেকেন্ড লিয়াকতের সঙ্গে কথোপকথন হয় ওসি প্রদীপের। ৯টা ৩৩ মিনিটে আইসি লিয়াকত আলী ঘটনাটি কক্সবাজারের পুলিশ সুপারকে জানান।
এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত কমিটিকে বলেন, লিয়াকত ব্যারিকেড দিয়ে অস্ত্র তাক করে গাড়ির সামনে দাঁড়ান। এরপর...শুট শুট বলেই গুলি করেন লিয়াকত।
এদিকে, বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রে ফোন করে এসআই নন্দ দুলাল শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে কিছু পুলিশ সদস্য পাঠানোর জন্য বলেন। নির্দেশ পেয়ে একটি সিএনজি অটোরিকশায় ছুটে আসেন এসআই লিটন, কনস্টেবল আব্দুল্লাহ আল মামুন, কামাল হোসেন আজাদ ও ছাফানুল করিম। তাদেরকে সিনহার গাড়ি তল্লাশির নির্দেশ দেন লিয়াকত। তল্লাশি করে গাড়ির সামনের দুই সিটের মাঝখান হতে একটি পিস্তল এবং ড্যাশ বোর্ডে কিছু কাগজপত্র, ক্যামেরা, সিডিবক্স, ও ভিডিও করার যন্ত্রপাতি পাওয়া যায়।
লিয়াকত আলীর ফোন পেয়ে ওসি প্রদীপ কুমার দাশ একটি সাদা মাইক্রোবাসে এবং তার সঙ্গে ফোর্স একটি পিকআপ ভ্যানে চড়ে ঘটনাস্থলে আসেন। তখন রাত ১০টা। ঘটনাস্থলে পৌঁছেই ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলীর সঙ্গে একান্তে আলাপ করেন।
তদন্ত কর্মকর্তার বিশ্লেষণ অনুযায়ী, সিনহাকে লিয়াকত গুলি করেন আনুমানিক রাত ৯টা ২৫ থেকে ৯টা ৩০ এর মধ্যে।হাসপাতালে নেওয়ার জন্য রাত দশটার কিছু আগে কনস্টেবল কামাল ও মামুন কোরবানির গরু বহনকারী একটি মিনি পিকআপ থামান। সিনহাকে হাসপাতালের উদ্দেশে গাড়িতে তোলা হয় রাত ১০টা ৪৪ মিনিটের দিকে। গাড়ি ছাড়াও ওসি প্রদীপ কুমার দাশ রাত ১০টার সময় একটি মাইক্রোবাস ও একটি পিকআপ নিয়ে ঘটনাস্থলে আসেন। ঘটনার প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টা পর সিনহাকে বহনকারী গাড়ি পৌঁছায় কক্সবাজার সদর হাসপাতালে। কর্তব্যরত ডাক্তার রাত ১১টা ৫৫ মিনিটে জানান, তাকে মৃত অবস্থায় আনা হয়েছে।
সিনহাকে গুলি করার ২০ থেকে ২৫ মিনিট পরে ওসি প্রদীপ ঘটনাস্থলে এলেও সিনহাকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ওসি প্রদীপ আসার ২২ মিনিট পর সিনহাকে ট্রাকে তোলা হয়।
কমিটি বলেছে, হাসপাতালে যেতে অস্বাভাবিক দেরি হওয়ায় বিনা চিকিৎসায় সিনহা মারা যান।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: তদন ত ক
এছাড়াও পড়ুন:
পাবনায় অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপককে কুপিয়ে জখমের ঘটনায় প্রতিবাদ অব্যাহত, একজন গ্রেপ্তার
পাবনা শহরের কালাচাঁদপাড়ার নিজ বাড়িতে জওহরলাল বসাক তুলশী (৭৭) নামের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপককে কুপিয়ে জখমের ঘটনায় প্রতিবাদ অব্যাহত রয়েছে। আজ মঙ্গলবার দুপুরে ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে শহরের আবদুল হামিদ সড়কে জেলা ছাত্রদল, যুবদল ও সেচ্ছাসেবক দল মানববন্ধন করেছে। মানববন্ধন থেকে অবিলম্বে হামলাকারীদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করা হয়েছে।
এদিকে ঘটনায় করা মামলায় জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) ঢাকা থেকে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। তবে তদন্তের স্বার্থে তাঁর নাম–পরিচয় প্রকাশ করেনি।
আরও পড়ুনপাবনা এডওয়ার্ড কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপককে কুপিয়ে জখম, বিচারের দাবিতে মানববন্ধন২৮ জুলাই ২০২৫স্থানীয় লোকজন ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঘটনার পর থেকেই জেলা শহরের বিভিন্ন মহলে প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় দুপুর ১২টার দিকে জেলা ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল যৌথভাবে মানববন্ধনের আয়োজন করে। প্রায় ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধন থেকে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়। সেই সঙ্গে অবিলম্বে ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার দাবি করা হয়।
মানববন্ধন চলাকালে বক্তব্য দেন জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক নুর মাসুম, জেলা যুবদলের আহ্বায়ক হিমেল রানা, জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক ইয়ামিন খান, সদস্যসচিব কমল শেখ, যুগ্ম আহ্বায়ক দীপঙ্কর সরকার প্রমুখ।
বক্তারা জানান, জহুরলাল বসাক সর্বজনশ্রদ্ধেয় একজন শিক্ষক। তিনি মানুষ গড়ার কারিগর। দেশব্যাপী তাঁর হাজার হাজার ছাত্র রয়েছে। তাঁর মতো একজন মানুষের ওপর এই হামলা ন্যক্কারজনক। এই হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে অবিলম্বে হামলাকারীদের গ্রেপ্তার দাবি করছেন মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারীরা।
নুর মোহাম্মদ মাসুম বলেন, ‘স্যার (জওহরলাল বসাক তুলশী) একজন সাদামাটা ও হাসিখুশি মানুষ। তাঁর মতো মানুষের ওপর হামলা আমাদের জন্য লজ্জাকর। আমরা ছাত্র হিসেবে এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। অবিলম্বে হামলাকারীদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি দাবি করছি।’
এ প্রসঙ্গে সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুস সালাম প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার পরই পুলিশের বিভিন্ন শাখা আসামিদের ধরতে অভিযান শুরু করেছে। ইতিমধ্যেই ডিবি পুলিশ অভিযান চালিয়ে ঢাকা থেকে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ওই ব্যক্তি হামলার কথা স্বীকার করেছেন। তাঁকে ঢাকা থেকে পাবনায় আনা হচ্ছে। ঘটনায় জড়িত অন্যজনকে ধরতে অভিযান চালানো হচ্ছে। তবে তদন্তের স্বার্থে এখনই বিস্তারিত বিছু বলা সম্ভব হচ্ছে না।
প্রসঙ্গত, আহত জওহরলাল বসাক পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। গত রোববার বিকেলে দুই ব্যক্তি তাঁর বাড়িতে ঢুকে তাঁকে কুপিয়ে আহত করে ও আসবাবপত্র তছনছ করে। এ ঘটনায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে থানায় একটি মামলা করেছেন জওহরলাল বসাক। এ ঘটনার প্রতিবাদে গতকাল সোমবার দুপুরে পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এবং শহরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্যানারে মানববন্ধন করেন।