কুমিল্লায় বার্ডের গাছে গাছে কাঁঠাল, ম-ম ঘ্রাণ
Published: 9th, June 2025 GMT
কুমিল্লার কোটবাড়ী এলাকায় অবস্থিত বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড) ক্যাম্পাস। লালমাই-ময়নামতি পাহাড় ও পাহাড়ের কোলে প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রতিষ্ঠিত বার্ড ক্যাম্পাসে ঢুকতেই নাকে ভেসে আসে পাকা কাঁঠালের ম-ম ঘ্রাণ। পুরো বার্ড ক্যাম্পাসেই এখন কাঁঠালের সমাহার। গাছে গাছে ঝুলে আছে কয়েক হাজার কাঁঠাল। শত শত গাছের মধ্যে কোনো কোনো গাছে ৪০ থেকে ৫০টি কাঁঠালও ধরেছে। বার্ডের এই কাঁঠাল সুমিষ্ট ও রসালো, তাই সবার কাছে বেশ চাহিদাও আছে।
বার্ডের বাগান শাখায় কর্মরতদের ভাষ্য, দীর্ঘদিন ধরে কাঁঠালের মৌসুম এলে নিলামের মাধ্যমে বার্ডের কাঁঠালগাছে গুনে গুনে সংখ্যা নির্ধারণের পর বিক্রি করা হয়। তবে এ বছর ‘সিন্ডিকেট’ করে দাম একেবারে কমিয়ে নিলামে নিতে চেয়েছিল একটি চক্র। এ কারণে শেষ পর্যন্ত বার্ড কাঁঠাল নিলামে বিক্রি করেনি। বার্ডের বাগান শাখার ব্যবস্থাপনায় এ বছর কাঁঠাল বিক্রি হচ্ছে। এতে নিলামের চেয়ে অনেক বেশি দরে বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে।
কুমিল্লা নগর থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কোটবাড়ী এলাকার নন্দনপুর থেকে ৩ কিলোমিটার পশ্চিমে বার্ডের অবস্থান। ১৯৫৯ সালের ২৭ মে সমাজবিজ্ঞানী আখতার হামিদ খান বার্ড প্রতিষ্ঠা করেন। লালমাই-ময়নামতি পাহাড় ও পাহাড়ের পাদদেশে ১৫৬ একর জায়গা নিয়ে বার্ড ক্যাম্পাস। বার্ড স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের অধীন একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান।
সম্প্রতি সরেজমিন দেখা গেছে, বার্ড ক্যাম্পাসজুড়ে থাকা অন্তত ৬০০ গাছে ধরে আছে কয়েক হাজার কাঁঠাল। একেবারে ছোট থেকে বড় আকারের কাঁঠাল আছে। তবে মাঝারি ও ছোট আকৃতির কাঁঠালের সংখ্যা বেশি। কোনো কোনো গাছে একসঙ্গে ৪০ থেকে ৫০টি কাঁঠালও ধরেছে। কোথাও কোথাও গাছে পেকে থাকা কাঁঠাল সুবাস ছড়াচ্ছে। পাকা কাঁঠালের ঘ্রাণে ম-ম করছে বার্ড এলাকা। বার্ড ক্যাম্পাসে থাকা উঁচু-নিচু টিলা, সমতল, বাগান, পুকুরপাড়, একাডেমি, প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন ভবনের পাশ, ক্রীড়া ও বিনোদন এলাকা, অফিস এলাকা ও অডিটরিয়ামের পাশের গাছগুলোয় এখন কাঁঠালের মেলা।
বার্ডের নীলাচল পাহাড়ের পাদদেশে দেখা গেছে, বাগান শাখার কর্মীরা গাছ থেকে কাঁঠাল নামাচ্ছেন। বিভিন্ন গাছ থেকে নামানোর পর কাঁঠালগুলো একটি স্থানে প্রথমে স্তূপ করে রাখা হচ্ছে। পরে সেখান থেকে ভ্যানে করে বার্ডের সামনেসহ কয়েকটি স্থানে বিক্রি করা হচ্ছে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বার্ডের ভেতরে এসে ছোট ছোট পাইকার কাঁঠাল পিস হিসাবে কিনে ভ্যানে করে নিয়ে যাচ্ছেন। আকারভেদে ৩০ থেকে ৫০ টাকার মধ্যে প্রতিটি কাঁঠাল পাইকারি বিক্রি হচ্ছে।
বার্ডের কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি মো.
বার্ডের বাগান শাখায় কর্মরত বাবর আলী নীলাচল পাহাড়ের পাদদেশে গাছ থেকে কাঁঠাল নামানোর কাজ করছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এ বছর বার্ডের বিক্রিযোগ্য কাঁঠালের পরিমাণ ৬ হাজার ৭৭৬টি। এর মধ্যে প্রায় ৩ হাজারের মতো কাঁঠালগাছ থেকে কেটে বিক্রি করা হয়েছে। অন্যগুলো সপ্তাহখানেকের মধ্যে বিক্রি হয়ে যাবে বলে তাঁর আশা।
বার্ডের মহাপরিচালক সাইফ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা এ বছরও চেয়েছিলাম নিলামেই কাঁঠাল বিক্রি করতে। দুই দফা নিলাম ডাকা হয়েছিল। কিন্তু যখন দেখলাম সিন্ডিকেট করে মাত্র ৭ টাকা দরে প্রতি পিস কাঁঠাল নিলামে নেওয়ার চেষ্টা চলছে, তখন আমরা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছি। তাই বাগান শাখার ব্যবস্থাপনায় কাঁঠাল বিক্রি চলছে। এরই মধ্যে অর্ধেক কাঁঠাল বিক্রি শেষ হয়ে গেছে। এতেই নিলামের চেয়ে বেশি অর্থ পাওয়া গেছে। নিজেরা বিক্রি করাতে বার্ড লাভবান হয়েছে।’
কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জোনায়েদ কবির খান বলেন, কুমিল্লা অঞ্চলে কাঁঠালের জন্য বার্ড ক্যাম্পাসের খ্যাতি আছে। বার্ডে প্রতিবছরই কাঁঠালের বাম্পার ফলন হয়। এর মূল কারণ হচ্ছে পাহাড়ি এলাকার লাল মাটি। এই লাল মাটিতে প্রচুর কাঁঠাল ধরে। এসব কাঁঠাল অতি সুস্বাদু ও রসে ভরা।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: এ বছর
এছাড়াও পড়ুন:
রাত জেগে থাকা দেড় শ বছরের একটি চামড়ার হাট
রাত বাড়ছে, বাড়ছে অনেক ধরনের মানুষের আনাগোনা। বাড়তে থাকে হাটের কর্মচঞ্চলতা। কারও দিকে কারও তাকানোর সময় নেই। অনেক রকম কাজ, যে যা পারছে—তাই করছেন। দেড় শতাধিক বছরের পুরোনো বালিকান্দি চামড়াবাজার বছরের একটা রাতে এ রকমই প্রাণচঞ্চল ও উৎসবমুখর হয়ে ওঠে।
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার চাঁদনীঘাট ইউনিয়নে মনু নদের পাড়ে বাজারটি গড়ে উঠেছিল, সেই থেকে এখনো ঐতিহ্য ধারণ করে চলছে। বাজারটিতে এই একটা রাত দিনের মতো। কোরবানির ঈদ উপলক্ষ করে যত রকম ব্যস্ততা যখন অন্য সবখানে স্থিমিত হয়ে আসতে থাকে, বালিকান্দি চামড়ার বাজারের রাতটি তখন আস্তে আস্তে প্রাণ পেয়ে জেগে ওঠে।
গতকাল শনিবার সন্ধ্যার দিকে বালিকান্দি চামড়ার বাজারে যাওয়ার পথে চামড়া হাটের ধারণাটা পাওয়া গেছে। সড়কে যানজট তৈরি হয়ে গেছে ততক্ষণে। দুদিক থেকেই অনেক ধরনের গাড়ি আসা-যাওয়া করছে। ছোট রাস্তা, সংগত কারণেই এত ভিড় নিতে পারছে না। পিকআপ ভ্যান, ছোট ট্রাক, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, টমটমে চামড়া বোঝাই করে লোকজন বাজারে আসতে থাকেন। কিছু গাড়ি আছে যেগুলো আগে থেকেই কারও ঠিকঠাক করা। গাড়ি নির্দিষ্ট স্থানে থামছে, লোকজন গাড়ি থেকে চামড়া নামিয়ে জায়গামতো রাখছেন। কিছু গাড়ি আসার পর দরদাম ঠিক করা হচ্ছে। বালিকান্দি বাজারে ঢোকার বেশ আগে থেকেই এই তৎপরতা দেখা গেছে।
এবার ১০০ চামড়া কিনেছি ৫৫০ টাকা দরে এবং ১০০ চামড়া কিনেছি ৪৫০ টাকা করে।মো. সাদিকুর রহমান, চামড়া ব্যবসায়ীস্থানীয় ব্যক্তিরা জানালেন, কোরবানির ঈদের দিন বেলা একটা-দুটা থেকে বাজারে লোক আসা শুরু হয়। তবে ভিড় শুরু হয়ে সন্ধ্যার পর থেকে। রাত আটটার দিকে জমে উঠতে থাকে বাজার। রাত বাড়লে লোকজনের এই কথার মিল পাওয়া গেছে। বাজারের প্রায় আধা কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এই কর্মচঞ্চলতা। যাঁরা চামড়া পরিষ্কার করেন, তাঁরা চামড়াপ্রতি পান ২০ টাকা। যাঁরা চামড়ায় লবণ মাখেন, তাঁরা পান ১০ টাকা। গোছানোর আলাদা মানুষ আছেন।
মো. সাদিকুর রহমান প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, তিনি ১৪ বছর ধরে চামড়ার ব্যবসা করেন। এবার ১০০ চামড়া কিনেছেন ৫৫০ টাকা দরে এবং ১০০ চামড়া কিনেছেন ৪৫০ টাকা করে। আরও চামড়া কিনবেন। সেগুলো প্রক্রিয়াজাত করে বিভিন্ন স্থানের আড়তদার ও ট্যানারির মালিকের কাছে বিক্রি করবেন। তাঁর কিছুটা ক্ষোভ আছে, আড়তদার ও ট্যানারির মালিকেরা বকেয়া টাকা সময়মতো দেন না। নানা অজুহাতে দিনের পর দিন টাকা ফেলে রাখেন। একটি চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে ১০ থেকে ১৫ কেজি লবণ লাগে।
ব্রিটিশ আমলে বালিকান্দি বাজার প্রতিষ্ঠা হয়। শুরু থেকেই এই হাটে চামড়ার ব্যবসা চলছে। সারা বছরই ফড়িয়া ও ছোট ব্যবসায়ীরা এখানে চামড়া নিয়ে আসেন।আরেক চামড়া ব্যবসায়ী আবদুল আহাদ বলেন, ‘এবার কোরবানি কম। এবার অনেকে দেশে নেই, বাড়িতে নেই। কোরবানি ঈদের দিন রাত আটটার দিকে বাজারে ভিড় বাড়তে থাকে। রাত ১২ট পর্যন্ত নানা জায়গা থেকে চামড়া আসতে থাকে। সারা রাত দোকান খোলা থাকে। পরদিন বেলা একটা-দুইটা পর্যন্ত কাজ চলে। এই একটা রাতে বাজারে কেউ ঘুমান না। আমাদের দাদার আমল থেকে বালিকান্দি বাজারে চামড়ার ব্যবসা দেখে আসছি।’
ব্যবসায়ী ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ব্রিটিশ আমলে বালিকান্দি বাজার প্রতিষ্ঠা হয়। শুরু থেকেই এই হাটে চামড়ার ব্যবসা চলছে। সারা বছরই ফড়িয়া ও ছোট ব্যবসায়ীরা এখানে চামড়া নিয়ে আসেন। প্রতিদিন বাজারে ২০ থেকে ২৫টি চামড়া আসে। তবে কোরবানির ঈদেই বসে চামড়ার বড় বাজার। বাজারে পাঁচ থেকে ছয়জন স্থায়ী ব্যবসায়ী আছেন, যাঁদের গুদাম আছে। যাঁরা সারা বছরই চামড়া কেনাবেচা করেন। এ ছাড়া ঈদের সময় প্রায় অর্ধশত মৌসুমি ব্যবসায়ী সক্রিয় হয়ে থাকেন। তবে ২০১৪ সালের পর থেকে বাজারটিতে এ রকম টানাপোড়ন চলছে। বাজারটি অনেকটা পুরোনো জৌলুশ হারিয়েছে। পুঁজি হারিয়ে অনেকে ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন।
বালিকান্দি চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. শওকত বলেন, ‘এবার ছোট গরু বেশি কোরবানি হয়েছে। চামড়ার সাইজ ছোট। হাজারে ১০-২০টি বড় চামড়া মিলছে।’ তিনি জানিয়েছেন, একটি চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে শ্রমিক, লবণসহ খরচ হয় ১৭৫ টাকা। ২০০ থেকে সাড়ে ৫০০ টাকা পর্যন্ত দামে চামড়া কিনছেন অনেকে।
অন্যদিকে মৌলভীবাজার শহরতলির চাঁদনীঘাটে মনু সেতুর কাছে বসেছে একবেলার মাংসের হাট। মনু সেতু ও সড়কের ফুটপাতে অনেকে মাংসের পুঁটলা ও ব্যাগ নিয়ে বসেছিলেন। তাতেও মৌলভীবাজার-কুলাউড়া সড়কের চাঁদনীঘাট থেকে শহরের টিসি মার্কেট এলাকা পর্যন্ত তৈরি হয় দীর্ঘ যানজটের। অনেকক্ষণ ধরে এই যানজট চলে। দরিদ্র নারী-পুরুষ বিভিন্ন গ্রাম ও বাসাবাড়ি ঘুরে মাংস সংগ্রহ করেছেন। কেউ কোরবানির গরু কাটাকুটি করে মাংস পেয়েছেন। নিজেদের জন্য চাহিদামতো রেখে বাকিটুকু বিক্রির জন্য নিয়ে এসেছেন ওই হাটে।
এবার ছোট গরু বেশি কোরবানি হয়েছে। হাজারে ১০-২০টি বড় চামড়া মিলছে। একটি চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে শ্রমিক, লবণসহ খরচ হয় ১৭৫ টাকা। মো. শওকত, সভাপতি, বালিকান্দি চামড়া ব্যবসায়ী সমিতিএই বিক্রেতারা মাংসের আনুমানিক ওজন অনুযায়ী দাম চাইছেন। ক্রেতারাও মোটামুটি আন্দাজ করে দাম বলছেন, দরদাম ঠিক হলে টাকা দিয়ে হাতে ব্যাগ নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিচ্ছেন। যাঁরা কোরবানি দিতে পারেননি, আবার কারও কাছ থেকে মাংস পাওয়ার বা সামাজিক কারণে চাওয়ার সুযোগ নেই; এই একবেলা মাংসের হাটের ক্রেতা হচ্ছেন তাঁরাই।