ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে হতে চলেছে, তা এখন জোর দিয়েই বলা যায়। বিশেষ করে লন্ডনে গত শুক্রবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক এ আস্থাই তৈরি করেছে।

এটি ঠিক, ওই বৈঠকের যৌথ বিবৃতিতে নির্বাচনের জন্য ফেব্রুয়ারির মধ্যেই ‘সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি‌ অর্জন করা প্রয়োজন হবে’ বলার কারণে একটি জটিলতা আঁচ করা যায়। উপরন্তু প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) রোববার সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে তারা কোনো নির্দেশনা পাননি। তবে মঙ্গলবার সমকাল জানিয়েছে, সোমবার রাতে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভায় সরকারপ্রধান লন্ডন বৈঠক বিষয়ে তাদের জানাতে গিয়ে বলেছেন, ‘ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের চিন্তা কথার কথা না। সংস্কার ও বিচারের অগ্রগতি সাপেক্ষে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে।’ 

সংস্কার নিয়ে ইতোমধ্যে দ্বিতীয় ধাপের বৈঠক শেষের পথে। সরকার যেগুলোকে ‘মৌলিক সংস্কার’ মনে করে, সেগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যও একেবারে হতাশাজনক নয়। সম্ভবত সে কারণেই জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি ড.

আলী রীয়াজকে এখন ‘জুলাই সনদ’ আগামী মাসেই চূড়ান্ত করার ব্যাপারে বেশ আস্থাবান মনে হচ্ছে। আগেই কথা হয়ে আছে, জুলাই সনদের যতটুকু সম্ভব এ সরকার বাস্তবায়ন করবে; বাকিটুকু তারা রেখে দেবে নির্বাচিত সরকারের জন্য। অর্থাৎ সংস্কারের জন্য নির্বাচন দেরি করার সুযোগ কমে গেছে। জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার নিয়েও বিএনপি যা বলেছে, তা স্পষ্ট এবং তাতে অন্য কারও দ্বিমত পোষণের অবকাশ নেই। বিএনপি বলেছে, বিচার আদালতের বিষয়। এ নিয়ে সময় বেঁধে দিলে তা আদালতের ওপর চাপ তৈরির শামিল হবে, যা গোটা বিচার প্রক্রিয়াকেই দেশ-বিদেশে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। তাই বিচারকে বিচারের মতো চলতে দেওয়াই সমীচীন। সব মিলিয়ে বলা যায়, নতুন কোনো সমস্যা তৈরি করা না হলে নির্বাচনটি ফেব্রুয়ারির প্রথম ভাগেই হতে চলেছে।

প্রশ্ন হতে পারে, নির্বাচনটি কেমন হবে? প্রধান উপদেষ্টা বহুবার বলেছেন, সর্বশেষ ১১ জুন লন্ডনের চ্যাথাম হাউসের মতবিনিময় সভায়ও বলেছেন, আগামী নির্বাচন হবে ‘ইতিহাসের সবচেয়ে সুন্দর নির্বাচন’। সমকালের মঙ্গলবারের প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, গত ২২ মে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব না হলে তিনি দায়িত্বে থাকতে চান না। নির্বাচনে কারচুপি হলে তাঁর সারাজীবনের অর্জন শেষ হয়ে যাবে দুনিয়ার সামনে। একই শঙ্কা তিনি নাকি লন্ডনের বৈঠকেও তারেক রহমানকে জানিয়েছেন। নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে বিএনপিরও ক্ষতি হবে বলে বিএনপির শীর্ষ নেতাকে সতর্ক করেছেন। অন্যদিকে তারেক রহমানও নাকি সরকারপ্রধানকে আশ্বস্ত করেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বিএনপি সহযোগিতা করবে। ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরিতে ভূমিকা রাখবে। 

অন্তর্বর্তী সরকার বিএনপির বাইরে যে দুটো দলকে এখন প্রধান দলের মর্যাদা দিচ্ছে, সেই জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) অবশ্য ইতোমধ্যে সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে; যে প্রশ্ন এতদিন ছিল বিএনপির। বলা হতে পারে, এ দলগুলো ‘কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে’ লড়াই করেই বিগত সরকারকে হটিয়েছে; বর্তমান সরকারকেও তারা ক্ষমতায় বসিয়েছে। অতএব এগুলো সাময়িক মান-অভিমান ভিন্ন কিছু নয়। যেমন জামায়াত লন্ডন বৈঠকের সূত্র ধরে ‘প্রতীকী’ প্রতিবাদস্বরূপ জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মঙ্গলবারের সভা বয়কট করলেও প্রধান উপদেষ্টার ফোন পেয়ে কমিশনের বুধবারের সভায় যোগ দিয়েছে। তেমনিভাবে নির্বাচন ঘিরে দলগুলো যতই অভিযোগ তুলুক, তা সামাল দেওয়া সরকারের পক্ষে দুরূহ হবে না।

প্রশ্ন কি এখানেই শেষ? তিনটি দলের প্রত্যেকেই আগামী নির্বাচনের ফল নিজের দিকে টানতে প্রবলভাবে আগ্রহী। কিন্তু মাঠের শক্তিতে বিশেষত বিএনপির সঙ্গে বাকি দুই দলের সম্মিলিত শক্তিও একেবারে তুল্য নয়। সেই হিসাবে নির্বাচনটি কি আদৌ প্রতিদ্বন্দ্বিতাময় হবে? তা না হলে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে বিপুল প্রত্যাশা কীভাবে পূরণ হবে? এমন নির্বাচন কি গ্রহণযোগ্য হবে?

এটিও তো সত্য, ঐতিহাসিক এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক নানা কারণে দেশের ভোটারকুল মোটাদাগে দুটো ধারায় বিভক্ত। এ কারণে ইতোপূর্বে, বিশেষত ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্রের ফিরে আসার পর থেকে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যেই রাষ্ট্রক্ষমতা হাতবদল হয়েছে। জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের মতো মোটামুটি জনসমর্থনপুষ্ট দল থাকলেও এদের ওই দু’দলেরই কোনো একটার অ্যাপেন্ডিক্স হয়ে টিকে থাকতে হয়েছে। ধারণা করা হয়েছিল, ৫ আগস্টের ধাক্কায় আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সেই রাজনৈতিক সমীকরণ পাল্টে যাবে। গত ১০ মাসের অভিজ্ঞতা কি তা বলে?

যে পৃথক দুই রাজনৈতিক ন্যারেটিভ বা বয়ানের ওপর ওই দুই ধারার রাজনীতি এতদিন চলেছে, সেগুলো এখনও বেশ শক্তভাবেই টিকে আছে। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সক্রিয় নেই সত্য; তবে যে বয়ানের ওপর তার রাজনীতি চলেছে, তাকে ধারণ করার মতো বিকল্প শক্তি তৈরি হয়নি। এ অবস্থায় আগামী নির্বাচনটি যদি একতরফা হয় এবং এমন পরিস্থিতিতে সুযোগ সন্ধানীদের দৌরাত্ম্যে নির্বাচনটি যদি প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তাহলে বিস্ময়ের কোনো কারণ থাকবে না।

সম্ভবত, এ ভাবনা থেকেই ইতোপূর্বে সেনাপ্রধানসহ দেশি-বিদেশি অনেক মুরব্বিই আগামী নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক হওয়ার ওপর জোর দিয়েছিলেন। যদিও দেশের ভেতরে এখন এ নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা শোনা যাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক মহলও এ নিয়ে মুখ বন্ধ রেখেছে, তা বলা যায় না। যেমন সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ৫৯তম মানবাধিকার পরিষদে পেশ করা বার্ষিক প্রতিবেদনে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক বলেছেন, ‘আমি অনুপ্রাণিত বোধ করছি যে, অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো সংলাপের মাধ্যমে অগ্রগতি অর্জন করছে। সংস্কার, অবাধ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে অর্থবহভাবে এগিয়ে যেতে আমি আহ্বান জানিয়েছি। অবশ্য রাজনৈতিক দল ও সংগঠন নিষিদ্ধের সুযোগ তৈরি করে সম্প্রতি আইনে পরিবর্তন আনা এবং এ সংক্রান্ত সব কর্মকাণ্ড নিয়ে আমি 
উদ্বিগ্ন। এটি সংগঠনের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সমাবেশের স্বাধীনতা সীমিত করবে’ (সমকাল, ১৬ জুন ২০২৫)।

প্রসঙ্গত, ১১ মে সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িত এমন ব্যক্তি বা সত্তা এবং তাদের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করার বিধান যুক্ত করে সন্ত্রাসবিরোধী (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর খসড়া নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন করে উপদেষ্টা পরিষদ। এই অধ্যাদেশের আলোকে আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীর বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়। এর ফলে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ অসম্ভব হয়ে পড়েছে, বলা যায়।

অন্তত প্রধান উপদেষ্টার সুন্দর নির্বাচনের স্বপ্ন বাস্তবায়নে ভলকার তুর্কের এ উদ্বেগ যে গুরুত্বপূর্ণ, তা কি অস্বীকার করা যায়?

সাইফুর রহমান তপন: সহকারী সম্পাদক, সমকাল

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন ত ন র ব চনট র জন ত ক সরক র র ব এনপ র ঐকমত য র জন য র র জন বল ছ ন আওয় ম সমক ল র ওপর দলগ ল স গঠন রহম ন

এছাড়াও পড়ুন:

শুক্রবার জরুরি বৈঠকে বসছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ, অংশ নেবে ইসরায়েল

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার সংঘাত নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসতে যাচ্ছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। আগামীকাল শুক্রবার এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। ইসরায়েল এই বৈঠকে অংশ নেবে বলে জানিয়েছেন দেশটির রাষ্ট্রদূত ড্যানি ড্যানন।

ইরান, রাশিয়া, চীন, পাকিস্তান ও আলজেরিয়ার অনুরোধে এ বৈঠক হবে। চলমান উত্তেজনাকর পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা হওয়ার কথা জানিয়েছে বিবিসির মার্কিন অংশীদার সিবিএস নিউজ।

নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকে ইসরায়েল অংশ নেবে বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘে নিযুক্ত ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত ড্যানি ড্যানন। খবর বিবিসির

সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা বলছে, ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে চলমান উত্তেজনা নিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ শুক্রবার নিউইয়র্ক সময় সকাল ১০টায় জরুরি বৈঠকে বসতে চলেছে। এর আগে ইরান জাতিসংঘে এক চিঠিতে জানায়, সংঘাত বিপজ্জনকভাবে বেড়ে গেছে এবং এতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের “ক্রমবর্ধমান ও অনস্বীকার্য প্রমাণ” রয়েছে।

এই অভিযোগ তুলে ইরান জরুরি বৈঠকের অনুরোধ করে জানায়। আর সেটিই সমর্থন করে রাশিয়া, চীন, পাকিস্তান ও আলজেরিয়া।

ইরানের দাবি অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র শুধু ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তাই দিচ্ছে না, বরং ইরানি ভূখণ্ডে হামলার পরিকল্পনাতেও যুক্ত রয়েছে। তাই বিষয়টি নিয়ে এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের এই বৈঠকে পরিস্থিতি শান্ত করার সম্ভাব্য কূটনৈতিক পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ