কোনো এক মুনসুনে তুমি এসো বাংলাদেশে
খুব বৃষ্টির দিনে হঠাৎ হঠাৎ সেই যুবকের কথা মনে পড়ে। কী নাম ছিল ওর? আলেকজান্ডার? সম্ভবত। জার্মানিতে বন শহরে, এক থেরাপি সেন্টারে তার সঙ্গে দেখা। সেও এক যুগেরও আগের কথা।
অফিসের টাইমিং মিলিয়ে থেরাপি নিতাম। সাধারণত যেতাম বিকেলের স্লটে। আমার স্লটে বেশির ভাগ সময়েই ডিউটিতে থাকত আলেকজান্ডার। গোলগাল ধরনের মুখ। গড়পড়তা জার্মান যুবকদের চেয়ে দেখতে সে কিছুটা ছোটখাটো। থেরাপির সময়ে টুকটাক এটা-ওটা নিয়ে কথা হয়। সে ভেবেছে আমি ইন্ডিয়ান স্টুডেন্ট, পড়তে গেছি।
একদিন কী কথায় যেন জিজ্ঞেস করল কোথায় পড়ি বা এই জাতীয় কিছু। তখন বললাম, চাকরি করি। পড়তে আসিনি। শুনে সে খানিক অবাক হয়ে বলে, ওহ! আমি তো ভেবেছি, তুমি ইউনিভার্সিটিতে পড়ো। তোমাকে দেখলে খুবই কম বয়সী লাগে! বড়জোর ১৮ কী ২০।
আমি তখন বললাম, নো! আই আম ২৮! এটা শুনে ভিরমি খেয়ে সবিস্ময়ে সে বলে উঠল, ‘হোয়াট! টোয়েন্টি এইট! ইউ আর টোয়েন্টি এইট! মাই গুডনেস! ইউ আর আ ওমেন!’ ওর এই সোজাসাপ্টা-সরল প্রকাশে সশব্দে হেসে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার বয়স কত? জানাল, ২২।
তো বিকেলের বদলে একদিন আমি থেরাপির জন্য স্লট নিলাম সকালে। একেবারে প্রথম স্লটে। সেদিন গিয়ে দেখি আলেকজান্ডার। ও সাধারণত বিকেলের দিকে থাকে। ওকে দেখে বললাম, তুমি? জানা গেল, ওর সহকর্মীর কী যেন একটা প্রয়োজন হয়েছে। তাই সহকর্মীর স্লটটাও সে কাভার করছে।
আমার থেরাপির প্রথম পার্ট শেষে, পিঠে গরম সেক দেওয়ার জন্য তক্তপোষে রাখা তপ্ত একটা জিনিসে সোজা হয়ে শুয়ে থাকতে হতো। শুয়ে থাকার সময়টায় সাধারণত চোখ বন্ধ করে রাখতাম।
সেদিনই আরেকটা ঘটনা হলো। আমার থেরাপি চলার সময় আলেকজান্ডার বলল, ‘লাকি ইউ! আজকে তোমার পরের স্লটে যে ক্লায়েন্ট আসার কথা, সে একটু আগে জানিয়েছে, আসবে না। অতএব, ওই সময়টা আজকে তোমাকে দিতে পারি। এক্সট্রা সময় শুয়ে থাকতে পারবে।’
বললাম, হাউ কাইন্ড অব ইউ! কিন্তু তুমি তো বিশ্রাম নিতে পারতে বা অন্য কিছু করতে পারতে। আমার জন্য তোমার সময় নষ্ট করবে! ও বলল, সমস্যা নাই। তোমার সাথে গল্প করা যাবে।
ওইদিন হটথেরাপি নেওয়ার জন্য আলেকজান্ডার আমার বিছানায় সব ঠিকঠাক করে গুছিয়ে দিয়ে বলল, ‘শুয়ে পড়ো। আর তুমি যদি চাও তো আমি তোমার মাথায়ও খানিক ম্যাসাজ করে দিতে পারি!’
অবাক না হয়ে উপায় নেই! বললাম, আর ইউ শিওর! ও হেসে বলে, হোয়াই নট! আজকে আমি গুড মুডে আছি। কাজেরও কোনো চাপ নেই। আর তুমিই প্রথম ক্লায়েন্ট। পরেরজনও আসবে না। অতএব, হোয়াটস দ্য বিগ ডিল!
চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছি তপ্ত বিছানায়। আমার মাথার চাঁদি বরাবর টুল নিয়ে বসে আলেকজান্ডার ম্যাসাজ শুরু করছে। নানান বিষয়ে টুকটাক কথাও হচ্ছে। এক পর্যায়ে বলল, শুনেছি, ইন্ডিয়ায় নাকি প্রচুর বৃষ্টি হয়। বৃষ্টি দেখতে আমি একবার ইন্ডিয়া যাব। বৃষ্টি আমার খুব ভালো লাগে। তখন ওকে বাংলাদেশের বর্ষা নিয়ে বললাম। ঘন কালো মেঘ, একটানা সারাদিন-সারারাত, টানা তিন-চার-পাঁচ দিন ধরে বর্ষণের কথা বললাম। ধীরবৃষ্টি, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, মুষলধারে বৃষ্টির কথা বললাম। গাদলার কথা বললাম। বর্ষার ফুলের কথা বললাম। বললাম, বৃষ্টিতে আমাদের যে কত রকমের খাবারদাবার হয়– চাল ভাজা-চিড়া ভাজা-বুট-বাদাম-কাঁঠালবিচি-সিদ্ধ/ভাজা-ঝালমুড়ি-চানাচুর-খিচুড়ি-পেঁয়াজ-আর-শুকনো লাল মরিচের-ভর্তা-বেগুনভাজি-ডিমভাজি ইত্যাদি!
বৃষ্টিতে দলবেঁধে ছেলে-বুড়ো সকলের হুটোপুটি করে ভেজার কথা হলো। বৃষ্টি না হলে শৈশবে, বৃষ্টি নামানোর জন্য গান গাইতে গাইতে আমরা যে ব্যাঙের বিয়ে দিতাম সেইসব বললাম।
আলেকজান্ডারের কাছে আমার কথা মনে হচ্ছিল যেন রূপকথার গল্প! এ রকমও হয়! ঝুমবৃষ্টি! একটানা তিন-চার-পাঁচ দিন! ও বললো, তোমাদের কী সৌভাগ্য! কত বৃষ্টি হয় তোমাদের দেশে!
বাংলাদেশ যে একটা মায়াভরা দেশ, সেটা বোঝা যায় ভরা বর্ষায়! ওকে বললাম, বৃষ্টি দেখতে হলে কোনো এক মুনসুনে তুমি এসো বাংলাদেশে।
এমন ঘনঘোর বরিষায়
আমার পিঠের নিচে উষ্ণতা। শবাসনের মতন শুয়ে আরামে চোখ মুদে আছি। মাথায় পেলব করে ম্যাসাজ করে দিচ্ছে এমন এক বিদেশি যুবক বৃষ্টি দেখতে যে একদিন ভারত যেতে চায়! আদতে সেই ঘরভরা তখন বৃষ্টি। বাংলার বৃষ্টি। রবীন্দ্রনাথের বৃষ্টি। ‘এমন দিনে তারে বলা যায়/ এমন ঘনঘোর বরিষায়।’– মন পেলব করা বৃষ্টি।
সেদিন আমার অফিস ছিল না। থেরাপি শেষে একা একা শহরে বেরিয়েছি, ম্যাকডোনাল্ডসে খেয়েছি। ফুলের দোকানে ফুল কিনে ট্রাম ধরে ডর্মে ফিরেছি। বৃষ্টি নিয়ে আলাপ-সালাপের ফল কিনা জানি না, প্রবাসে হঠাৎ একদিন আমার খুব ব্যাঙের ডাক শুনতে ইচ্ছে হলো, কদমের ঘ্রাণ পেতে ইচ্ছে হলো! সেই প্রথম আমার মনে হলো, ব্যাঙ কী মিষ্টি-গভীর-মন্দ্রসুরে ডাকে: ‘মেঘ অ, মেঘ অ’!
ছোটবেলায় বৃষ্টির আগে-পরে ‘গতা’ ব্যাঙের দল পাড়াজুড়ে এমন ডাকত। আমাদের বাড়ির পেছনের ছোট্ট সবুজ পতিত জমিটাতে ব্যাঙ এভাবে ডাকতে শুরু করলেই আমরাও ব্যাঙের স্বর নকল করে ডাকতে শুরু করতাম, ‘মেঘ অ, মেঘ অ, মেঘ অ’। বৃষ্টি নিয়ে বাঙালির আবেগের অন্ত নাই। বৃষ্টি আর নদীকে বাংলার খানা-খাদ্য-চাষ-কৃষি-ধর্ম-দর্শন তথা বাঙালির চিরায়ত চরিত্র থেকে আলাদা করার উপায় নেই। বৃষ্টি আর নদী ছাড়া বাংলার কবিদেরও চিন্তা করা যায় না।
‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে’ মন আকুল হয়। হৃদয়ে আটকে রাখা কথার ভার অনেক। সেই ভার বইতে বইতে মানুষের ভেতরে জমে ক্লান্তি ও ক্লেদ। আষাঢ়-শাওন-ভাদরে ঝমঝম করে ঝরতে থাকে বৃষ্টি। জমা সব মেঘ ঝরে গেলে আকাশ পরিষ্কার হয়। আবার উঠে ঝকমকে রোদ। কথা-ব্যথা-আবেগ জমতে-জমতে মানুষের হৃদয়েও হয় ‘শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা’।
মেঘ তো ঝরে গেলেই মুক্তি। কিন্তু মানুষের উপায় কী! তার তো বুক ফাটে, মুখ ফোটে না দশা। তাই বৃষ্টির দিনে প্রকৃতির ইশারা অনুসরণ করে মানুষের মনও বার্তা পাঠায়– ‘এমন দিনে তারে বলা যায়/ এমন ঘনঘোর বরিষায়।’ তাই মানুষ ভাবে– ‘আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল, শুধাইলো না কেহ।’
আমার বিনাশ নাই, আমি শক্তি: শিবশম্ভু
কাব্যিক আকুলতা আর হৃদয়ের ব্যাকুলতার বাইরেও আমার কাছে বৃষ্টির রয়েছে আরও গভীর গূঢ়ার্থ। ভারতীয় দর্শনে আছে জন্মান্তরবাদ, আছে রূপ বদল করে ফিরে আসার কথা। আছে শক্তির অবিনশ্বরতার কথা। জলীয় বাষ্প হয়ে যে জলবিন্দু সকল উড়ে যায় ঊর্ধ্বাকাশে, জলাধারে থেকে যাওয়া সমবেত জলেদের কাছে তারা হয়তোবা মৃত। হয়তো স্থিতাবস্থায় থেকে যাওয়া সলিল জানে না যে, রূপান্তরই জীবনের গুহ্যসূত্র আর স্থিতিতে প্রকৃত মরণ। ঊর্ধ্বাকাশে জমতে জমতে নিজের ভারেই একসময় ভেঙে পড়ে মেঘ। জমাটবদ্ধ নীরদ সকল গলে ফের বারিধারা হয়ে যায়। তখনও কি আবার মেঘের মরণ হয় না? যে জলধর থেকে যায় আসমানে, সে কি গলে যাওয়া মেঘের মরণদৃশ্য দেখে কেঁদে-কেটে হয় একাকার?
গলা জল ভূমিতে ফেরে। ফেরে সে নদী ও সাগরে আবার। ফেরে শস্য ও বীজের ভেতর। এভাবেই চক্রাকারে বারবার মরে গিয়ে সে আসলে নিজেকে বাঁচায়। বাঁচা কোনো একার কাজ নয়। বাঁচতে হলে যৌথতা চাই। বৃষ্টি হলো আমাদের চোখের সামনে নিত্যদিনের বাঁচা-মরার রহস্য ভেদের ইশারা। বৃষ্টি হলো যৌথতা রচনার তাগিদ।
তাই, বৃষ্টি হলে প্রায় সকল মানুষেরই মন কেমন করে। এই মরে যেতে মন চায় তো এই বেঁচে থাকতে তীব্র ইচ্ছে হয় তো এই চেনা জীবনের সকল হিসাব ভন্ডুল করে দিয়ে তুমুল প্রেমের বোধ প্রেমের মানুষটিকে, পাওয়া না-পাওয়ার হিসাবের ঊর্ধ্বে ওঠে, শুধু প্রেমখানি জানিয়ে দিতে ইচ্ছে হয়।
টোনা ও টুনির জন্য মায়ের উপহার
বৃষ্টির মায়াজাদুর আরেকটা গল্প ছোট্ট করে বলব। তার আগে এই গৌরচন্দ্রিকা:
শৈশবে বৃষ্টি আমার খুব প্রিয় ছিল। বৃষ্টি হলে এমনও দিন গেছে আক্ষরিক অর্থেই সারাদিন ভিজতাম। ভিজতে ভিজতে কখনওবা পাড়ায় বাড়ি-বাড়ি ঘুরতাম। সমবয়সী অন্যদেরকেও পটিয়ে-টটিয়ে ভিজতে নামাতাম। ভিজতে ভিজতে চোখ লাল হয়ে যেত, ঠোঁট নীল হয়ে যেত, ত্বক কুঁচকে যেত, শীতে গা-কাঁপুনি দিত। আম্মির ভয় দেখিয়ে দাদু বলত, ‘আজজ্যোয়া তোরে মাইরে টানছে! ঠোঁট নীল অইয়া গেছে! উঠ! উঠ! ঘরঅ আয়!’ ঘরের চালে ঝমঝমঝমঝমঝমঝম বৃষ্টি! আহা! বড় হতে হতে দেখলাম, বৃষ্টি-প্রিয় সেই আমারই বৃষ্টি-বিরাগ। বিরাগ বললেও কম হয়। একেবারে বৃষ্টি-বিদ্বেষ। ঢাকায় আসার পর সেটি তীব্র হয়েছে। দুই চোখে দেখতে পারি না বৃষ্টি। তার ওপর বাড়িতে আমার ‘বৃষ্টি রাশি’ বলে ‘দুর্নাম’। আমার জন্মের দিন বৃষ্টি, বিয়ের দিন বৃষ্টি। মরার দিনেও বুঝি বৃষ্টি হবে। কোনো বিশেষ অনুষ্ঠানে ঘটনাচক্রে খটখটা রোদের দিনেও হঠাৎ বৃষ্টি আমাকে ধরে। বৃষ্টির প্রতি আমার এই বিদ্বেষ বছর কয়েক আগে একদিন আমাকে বেশ ভাবিয়ে তুলল। মনে হলো, কেন আমার এমন পরিবর্তন, বোঝা দরকার। নিজের পোস্টমর্টেম করতে গিয়ে পেলাম, আরে! বৃষ্টি তো আমার এখনও একই রকম প্রিয়! কিন্তু বৃষ্টি-পরবর্তী বিড়ম্বনাটা নিতে না পেরে বিরক্তিটা ক্রমে বৃষ্টির প্রতি পড়ছে। আদতে বৃষ্টি নয়, মুক্তি চাই বিড়ম্বনা থেকে।
ব্যাপারটা আত্মহত্যার মতন। যিনি আত্মহনন করেন, আপাত অর্থে মনে হয়, তিনি জীবন থেকে মুক্তি চান। প্রকৃতার্থে বিষয়টা তা না। ব্যক্তি যখন জীবনের চাপ আর নিতে পারেন না কিন্তু চাপমুক্তির কোনো রাস্তাও পান না, তখন উপায়ন্তর না দেখে তিনি নিজেকেই হনন করেন। হননের মাধ্যমে তিনি আদতে ব্যথা থেকে মুক্তি চান। এই পোস্টমর্টেম আমার উপকার করেছে। পুরাতন প্রেমের কাছে ফেরা গেছে সানন্দে। গৌরচন্দ্রিকা শেষ, এবার টোনাটুনির গল্প:
আমি ও আমার বর গিয়েছি খাগড়াছড়ি। সাজেক যাবার কোনো পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু মা প্রকৃতির পরিকল্পনা আমাদের জানা ছিল না। খাগড়াছড়িতে গিয়ে দেখলাম, বেশ একটা রাজকীয় বন্দোবস্ত হয়ে গেছে। সাজেক যেতে হবে। যাব শুধু আমরা দুইজন– টোনা আর টুনি।
টোনা ও টুনির আগে-আগে যায় রাজার শাস্ত্রীদল। তাদের নিবাস হয় এক দারুণ কুটির। কুটিরের শ্রেষ্ঠতম কক্ষটি পায় তারা। কক্ষের সাথে আছে বিরাট অলিন্দ। অলিন্দে দাঁড়ালে পুবের পৃথিবী বুকখোলা ঝিনুকের মতন উন্মুক্ত করে নিজেকে দেখায়।
সেই গিরিস্বর্গে সন্ধেবেলায় হঠাৎ নামল বৃষ্টি। যেই-সেই বৃষ্টি নয়। মুষলধারে বর্ষণ। একটানা বর্ষণের ধারে স্বর্গপুরে সন্ধেতেই নিশি ঘনায়। আনন্দপুরে সেদিন ছিল আর যত পরিব্রাজক, সকলেই অগত্যা নিজ নিজ কুটিরে সেঁধান।
বৃষ্টি আসার আর দিন-ক্ষণ পেল না, ভরাট চাঁদটা আর দেখা যাবে না– এই ভেবে টোনার খানিক খেদ হলো মনে। টুনির ভেতর থেকে কেউ যেন বলল, খেদের কারণ নেই। মা যা দিয়েছেন, তাই নাও অঞ্জলি ভরে।
তাই হলো। টোনা আর টুনি বৃষ্টি দ্যাখে, গপসপ করে, খুনসুটি করে, একে অন্যকে আদরে ভরায়। এইসব করে-করে যামিনী গভীর। রাত প্রায় ২টা কি আড়াইটা। বৃষ্টি থেমে গেছে। আকাশে সাদাটে মেঘ আর মেঘেঢাকা জোছনার মায়াখেলা চলছে। টোনা তখন টুনিরে বলে, চলো বাইরে যাই। সদর দুয়ার তখন বন্ধ। অতএব, চুপচাপ সীমানাপ্রাচীরে থাকা কাঁটাতার পেরিয়ে টোনা আর টুনি দেয় চম্পট। রাতের পাহাড়। জনমানব নেই। বৃষ্টিধোয়া বাতাস। মাথার ওপর মেঘভাঙা চাঁদের আলো। টোনা আর টুনি হাত ধরে চুপচাপ হাঁটে, দাঁড়ায়, মেঘের ফাঁকে আবছা চাঁদ দেখে, দেখে তারকারাজি। তাদের মুখে কোনো কথা নেই। নৈঃশব্দ্য সেরে দেয় তাদের আলাপ।
আবার হঠাৎ বৃষ্টি আসার উপক্রম হয়। টোনাটুনি তখন দৌড়ে ফেরে নিজেদের বিরাটাকার বারান্দায়। তারাও অলিন্দে ফেরে, বৃষ্টিও ফুরায়। আদতে তারা তো বোঝেনি, মা প্রকৃতি টোনা আর টুনির জন্য পাঠিয়েছে উপহার। এখন উপহার নিয়ে এসে ডাকপিয়ন যদি দেখে, প্রাপক বাড়িতে নেই তো তার কী হবে বিহিত? তাই, বৃষ্টির ভাব করে একটা দৌড়ানি দিয়ে টোনা আর টুনিকে মা-ই পাঠান বারান্দায়। অলিন্দে বসে টোনাটুনি দেখে, আদিগন্ত বিস্তৃত এক মেঘের চাঁই আসছে বারান্দার দিকে। মেঘ আসতে থাকল। আসতে থাকল। আরও কাছে। নিকট থেকে নিকটতর হলো ঘন পয়োধর। আকাশ থেকে পাহাড়ের ঢাল অব্দি ভরে গেল মেঘে। বারান্দায় বসা টোনা আর টুনিকে মেঘ এসে আদরে মুড়ে দিল। মনে হলো, যেন সাদা এক হাওয়াই মিঠাই। তার ভেতরে টোনা ও টুনি দুইজন বিস্ময়ে হতবাক। শীতল পরশ দিয়ে পুব থেকে এসে মেঘ গিরিকুটির ছাপিয়ে পশ্চিমে চলে গেল। মেঘের পরশে তনু-মন-অন্তরাত্মা হলো বরফ-শীতল। চুমু খেয়ে চলে গেল মেঘ। আকাশে উদিত হলো বড় চাঁদ। বিমুঢ় টোনাটুনি দেখে শেষরাতে চাঁদের কিরণে দুনিয়া ভাসে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: গল প আর ট ন প রক ত র ভ তর অল ন দ র বর ষ র জন য দ ন আম বর ষ য় আম দ র একদ ন র সময় প রথম বলল ম তখন ব
এছাড়াও পড়ুন:
সরকারের কি কিছুই করার নেই
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সীমান্ত অঞ্চল এক বিভীষিকাময় বাস্তবতার মুখোমুখি। স্থলমাইন বিস্ফোরণ সেখানকার মানুষের স্বাভাবিক জীবনের জন্য বড় আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিগত সাড়ে আট বছরে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম, দোছড়ি, সদর এবং রুমার রেমাক্রীপ্রাংসা ইউনিয়নে অন্তত ৫৭ জন মাইন বিস্ফোরণে হতাহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৫ জন নিহত এবং ৪৪ জন পা হারিয়েছেন। সীমান্ত এলাকাটির জন্য এটি বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মূলত ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনে রোহিঙ্গাদের বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের পর থেকেই সীমান্তে স্থলমাইন বিস্ফোরণের ঘটনা বেড়েছে। একসময় মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির নিয়ন্ত্রণে থাকা এই সীমান্ত অঞ্চল ২০২৩ সাল থেকে দেশটির সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) দখলে চলে যাওয়ার পর মাইন বিস্ফোরণের ঘটনা আরও বেড়ে যায়। আর এর শিকার হয়ে পঙ্গু হয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। উপার্জনক্ষম ব্যক্তি অক্ষম হয়ে যাওয়ায় পরিবার যেমন ভুগছে, সেসব ব্যক্তিও হয়ে পড়ছেন পরিবারের বোঝা।
বিজিবির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে মাইন বিস্ফোরণ সীমান্তের শূন্যরেখার ওপারে মিয়ানমারের ভূখণ্ডে হচ্ছে। বিজিবির টহল ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করার কারণেই লোকজন হতাহত হচ্ছেন। সীমান্ত এলাকার মানুষকে বারবার সতর্ক করা হচ্ছে বলেও জানানো হয়। মিয়ানমার যেহেতু জাতিসংঘের মাইন নিষিদ্ধকরণ চুক্তিতে অনুস্বাক্ষর করেনি, তাই তাদের মাইন ব্যবহারে জবাবদিহির কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। আগে বিজিপির সঙ্গে প্রতিবাদ ও আলোচনার সুযোগ থাকলেও এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণের কারণে সেই সুযোগও নেই।
শুধু মানুষের দায়ের বিষয়টি স্পষ্ট করে এ সংকট মোকাবিলা করা কীভাবে সম্ভব? সীমান্ত এলাকার নিরীহ ও দরিদ্র মানুষ ঝাড়ুফুল কাটতে গিয়ে বা পেটের তাগিদে সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় যাচ্ছেন, তাঁদেরকে সে কাজ থেকে কীভাবে রোধ করা যায়, তাঁদের কর্মসংস্থান বা জীবন–জীবিকা নিশ্চিত করার বিষয়টিও ভাবতে হবে। গরিব মানুষগুলোর এই অসহায়ত্বের সুযোগ নিচ্ছে যারা, তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করা জরুরি। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরাম ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কাছে বিষয়টি নিয়মিত তুলে যেতে হবে।
কার্যকর ও তৎপরমুখী কূটনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়া এখানে গুরুত্বপূর্ণ। আর যেসব পরিবার মাইন বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। শুধু সতর্ক করলেই হবে না, ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াতে হবে, তাঁদের বেঁচে থাকার অবলম্বন জোগাতে হবে। সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করার পাশাপাশি সীমান্তবাসীদের জন্য সচেতনতামূলক কার্যক্রম আরও বাড়াতে হবে এবং তাঁদের বিকল্প আয়ের উৎস সৃষ্টিতে সহায়তা করতে হবে। এর জন্য সরকার, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও স্থানীয় সব মহলের সম্মিলিত উদ্যোগ এখন সময়ের দাবি।