গঙ্গাচড়ায় হিন্দুবাড়িতে হামলা ঠেকাতে ‘পর্যাপ্ত’ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি
Published: 1st, August 2025 GMT
তখন বেলা দুইটা। নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার সিঙ্গেরগাড়ি বাংলাবাজার থেকে একটি মিছিল তিন কিলোমিটার পশ্চিমে পাড়ের হাটের দিকে যায়। মিছিলে ৩০০-৪০০ মানুষ ছিলেন। তবে মিছিলটি যখন সিঙ্গেরগাড়ি বাংলাবাজারে ফিরে আসে, তখন লোকে লোকারণ্য। মিছিলে পাঁচ-ছয় হাজার মানুষ। এরপর তাঁরা রংপুরের গঙ্গাগড়া উপজেলার বেতগাড়ি ইউনিয়নের আলদাদপুর গ্রামের দিকে রওনা দেন।
হিন্দুদের বসতবাড়িতে হামলার আগে এভাবেই প্রস্তুতি নেওয়ার বর্ণনা দিলেন নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের মাগুরা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আখতারুজ্জামান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি দেখছি, দুজন ছিল গাড়ির ভেতরে। একজন ড্রাইভার, একজন এসআই (উপপরিদর্শক)। আমি বললাম, ভাইয়া, আমার সঙ্গে থাকেন, নিবৃত্ত করি। ওরা ভয়ে মনে হয় পিছিয়ে গিয়েছে! মাইকিং করে যেহেতু এত বড় কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে, ওনাদের (পুলিশ) আরও সক্রিয় ভূমিকা নেওয়া উচিত ছিল।’
আলদাদপুর গ্রামের এক কিশোরের ফেসবুকে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.
আলদাদপুর গ্রামটি পাশের জেলা নীলফামারীর মাগুরা ইউনিয়নের সীমানা লাগোয়া। স্থানীয় ব্যক্তি ও ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর ভাষ্য, সিঙ্গেরগাড়ি বাংলাবাজার থেকে মিছিল নিয়ে এসে দুই দফা হামলা চালানো হয়। রোববার সকাল থেকে মাগুরা ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় মাইকিং করে সিঙ্গেরগাড়ি বাংলাবাজারে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশে যোগ দেওয়ার কথা বলা হয়। দুপুর ১২টার দিকে স্থানীয় কয়েকটি মসজিদের মাইকেও মানববন্ধনের বিষয়টি প্রচার করা হয়।
আমি দেখছি, দুজন ছিল গাড়ির ভেতরে। একজন ড্রাইভার, একজন এসআই (উপপরিদর্শক)। আমি বললাম, ভাইয়া, আমার সঙ্গে থাকেন, নিবৃত্ত করি। ওরা ভয়ে মনে হয় পিছিয়ে গিয়েছে! মাইকিং করে যেহেতু এত বড় কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে, ওনাদের (পুলিশ) আরও সক্রিয় ভূমিকা নেওয়া উচিত ছিল।মাগুরা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আখতারুজ্জামানগঙ্গাচড়া উপজেলা প্রশাসনের হিসাবে, ১৫টি বসতঘরে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশ গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত যে পাঁচ তরুণকে গ্রেপ্তার করেছে, তাঁদের বাড়ি মাগুরা ইউনিয়নে।
সিঙ্গেরগাড়ি বাংলাবাজার, হাজির হাট ও পাড়ের হাটের অন্তত ২০ জনের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা বলেছেন, সেদিন মিছিলে অনেক অপরিচিতি তরুণ ছিলেন। মাইকিং করে হাজার হাজার মানুষ সিঙ্গেরগাড়ি বাংলাবাজারে জড়ো করা হলেও পুলিশের ভূমিকা ছিল দর্শকের মতো। মাগুরার ইউপি সদস্য রুহুল আমিনও অভিন্ন অভিযোগ করেন। বেতগাড়ির ইউপি সদস্য পরেশ চন্দ্র বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গাফিলতি না করলে হামলা ঠেকানো যেত।
তবে কিশোরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আশরাফুল ইসলাম দাবি করেন, তাঁরা ওই দিন সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়েছিলেন।
বিষয়টি জানার পর থানার ওসি ও ইউপি চেয়ারম্যানকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছিলেন বলে জানান কিশোরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) প্রীতম সাহা।
গঙ্গাচড়া থানার ওসি আল এমরান বলেন, তিনিসহ থানা ও পুলিশ লাইনসের ৩৫ সদস্য ছিলেন। কিন্তু খিলালগঞ্জ বাজার থেকে উচ্ছৃঙ্খল দেড় হাজার থেকে দুই হাজার তরুণ গ্রামটিতে ঢুকে পড়েন। তাঁদের বাধা দিতে গিয়ে এক কনস্টেবল আহত হন।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ঙ গ রগ ড় ক শ রগঞ জ উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
দারফুরে ধর্ষণ-মুক্তিপণ-হত্যা: আরএসএফের ভয়াবহ নিপীড়নের বর্ণনা দিলেন পালিয়ে আসা মানুষেরা
সুদানের পশ্চিমাঞ্চলীয় দারফুর শহরে আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স (আরএসএফ)–এর কাছ থেকে পালিয়ে আসা ক্ষুধার্ত এবং নির্যাতিত মানুষেরা বিভিন্ন সংস্থা ও সংবাদমাধ্যমের কাছে তাঁদের ভয়ংকর অভিজ্ঞতাগুলো বর্ণনা করছেন। তবে তাঁরা পালাতে পারলেও হাজার হাজার মানুষ এখনো নিখোঁজ রয়েছেন।
উত্তর দারফুরের রাজধানী এল-ফাশের শহর ছিল রাজ্যটিতে সুদানি সেনাবাহিনীর সর্বশেষ ঘাঁটি। গত রোববার আরএসএফ বাহিনী এটির দখল নেয়। এরপর থেকে জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা স্থানীয় মানুষের পরিণতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। এরই মধ্যে দারফুরে ধর্ষণ, মুক্তিপণ ও গণহত্যাসহ অন্যান্য নির্যাতনের কথা সামনে আসছে।
আলখেইর ইসমাইল নামের এক সুদানি তরুণ দারফুর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার (৩১ মাইল) দূরের তাবিলা শহরে পালিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, রোববার এল-ফাশের থেকে পালানোর চেষ্টার সময় ৩০০ জনকে আটক করে আরএসএফ। তিনিও ওই দলে ছিলেন। তবে আটককারীদের একজন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পরিচিত হওয়ায় তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
ইসমাইল বলেন, ‘খার্তুমের বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সঙ্গে পড়াশোনা করেছেন এমন একজন তরুণ সেখানে ছিলেন। তিনি তাঁদের বললেন, “ওকে হত্যা করো না”। এরপর তাঁরা আমার সঙ্গে থাকা সব তরুণ ও আমার বন্ধুদের হত্যা করেন।’
তাবিলা এলাকায় পালিয়ে আসা অন্য নাগরিকেরাও তাঁদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। তেমনই একজন তাহানি হাসান। তিনি বলেন, ‘হঠাৎ করেই তাঁরা সেখানে হাজির হলেন। কোথা থেকে এলেন জানি না। ভিন্ন ভিন্ন বয়সী তিন তরুণকে দেখা গেল। তাঁরা আকাশে গুলি ছুড়লেন এবং বললেন, ‘থামো, থামো’। তাঁরা আরএসএফের পোশাকে ছিলেন।’
আলখেইর ইসমাইল নামের এক সুদানি তরুণ দারফুর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার (৩১ মাইল) দূরের তাবিলা শহরে পালিয়ে এসেছেন। আলখেইর বলেছেন, রোববার এল-ফাশের থেকে পালানোর চেষ্টা করার সময় ৩০০ জনকে আটক করে আরএসএফ। তিনিও ওই দলে ছিলেন। তবে আটককারীদের একজন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পরিচিত ব্যক্তি হওয়ায় তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।তাহানি হাসান বলেন, ‘এই তরুণেরা আমাদের বেধড়ক মারধর করেছেন। আমাদের পোশাক মাটিতে ছুড়ে ফেলেছেন। এমনকি আমি একজন নারী হওয়ার পরও আমাকে তল্লাশি করা হয়েছে। হামলাকারীরা সম্ভবত বয়সে আমার মেয়ের চেয়েও ছোট হবে।’
ফাতিমা আবদুলরহিম তাঁর নাতি–নাতনিদের সঙ্গে তাবিলাতে পালিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, পাঁচ দিন ধরে অনেক কষ্ট করে হেঁটে তাবিলাতে পৌঁছাতে পেরেছেন।
ফাতিমা বলেন, ‘তাঁরা (আরএসএফের সদস্যরা) ছেলেশিশুগুলোকে মারলেন এবং আমাদের সব সম্পদ কেড়ে নিলেন। আমাদের কিছুই রাখা হলো না। আমরা এখানে পৌঁছানোর পর জানতে পারলাম, আমাদের পর যেসব মেয়ে এসেছে, তাদের ধর্ষণ করা হয়েছে। তবে আমাদের মেয়েরা বেঁচে গেছে।’
পালিয়ে আসা তরুণী রাওয়া আবদাল্লা বলেছেন, তাঁর বাবা নিখোঁজ।
গত বুধবার রাতে দেওয়া এক বক্তৃতায় আরএসএফের প্রধান মোহাম্মদ হামদান দাগালো বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য তাঁর যোদ্ধাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। হামদান ‘হেমেদতি’ নামেও পরিচিত।
২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে সুদানি সেনাদের সঙ্গে আরএসএফ সদস্যদের লড়াই চলছে। গত বৃহস্পতিবার আরএসএফ দাবি করে, নির্যাতনের অভিযোগে বেশ কয়েকজন যোদ্ধাকে আটক করেছে তারা।
তবে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তাবিষয়ক প্রধান টম ফ্লেচার সাধারণ নাগরিকদের ওপর আরএসএফ সদস্যদের নিপীড়নের অভিযোগ তদন্তে বাহিনীটির দেওয়া প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আরএসএফের একজন উচ্চপদস্থ কমান্ডার এই ঘটনাগুলো ‘গণমাধ্যমের অতিরঞ্জন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর দাবি, এল–ফাশেরে নিজেদের পরাজয় ও ক্ষয়ক্ষতি আড়াল করতে সেনাবাহিনী এবং তাদের মিত্ররা এমন অপপ্রচার চালাচ্ছে।
জাতিসংঘের তথ্য বলছে, এ সংঘাত চলাকালে আরএসএফ ও সেনাবাহিনী—দুই পক্ষের বিরুদ্ধেই অভিযোগ উঠেছে। সংঘাতে কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। সংঘাতকে কেন্দ্র করে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় তৈরি হয়েছে। বিরাজ করছে ব্যাপক দুর্ভিক্ষের অবস্থা। পাশাপাশি কলেরা ও অন্যান্য প্রাণঘাতী রোগের সংক্রমণ বাড়ছে।
দারফুর থেকে পালিয়ে আসা লোকজন তাবিলা এলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন। ২৯ অক্টোবর, ২০২৫