আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে এবার এক নতুন আলোচনায় এসেছে গণভোট আয়োজনের সম্ভাবনা। রাজনৈতিক দলগুলোর নানামুখী প্রস্তাব ও অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্ত বিবেচনায় নিয়ে নির্বাচন কমিশন (ইসি) বলেছে, সরকার যদি চায় তাহলে সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে একযোগে বা আলাদা দিনেও গণভোট আয়োজন সম্ভব। এজন্যই কমিশন সরকারের ৩১টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে আগাম প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ দিয়েছে।

বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিনের সভাপতিত্বে এই আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন, অর্থ, আইন, পররাষ্ট্র, শিক্ষা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, স্থানীয় সরকার, তথ্য, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, সড়ক পরিবহনসহ ৩১টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিব উপস্থিত ছিলেন।

ইসির কর্মকর্তারা জানান, বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য ছিল- একদিকে আসন্ন সংসদ নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি পর্যালোচনা, অন্যদিকে গণভোট আয়োজনের সম্ভাব্য পরিস্থিতি বিবেচনায় আগাম পরিকল্পনা গ্রহণ।

গণভোটের প্রস্তুতি নির্দেশনা
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, বৈঠকের শুরুতেই সিইসি নাসির উদ্দিন বলেন, “গণভোট নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। তবে এটি হবে কি না, কবে হবে তা নির্ধারণ করবে সরকার। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, যদি গণভোট আয়োজনের নির্দেশ আসে, তাহলে যেন তা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করা যায় সে জন্য প্রস্তুতি রাখা।”

নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.

) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ সভায় বলেন, “সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একসঙ্গে হলে ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা বাড়বে। সেক্ষেত্রে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার সংখ্যাও বাড়াতে হবে। এজন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যেন তারা আগে থেকেই বিদ্যালয়গুলো প্রস্তুত রাখে।”

সভায় আরো জানানো হয়, দুটি ভোট একসঙ্গে হলে ব্যয় বৃদ্ধি পাবে, এজন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় অর্থ সংস্থানের প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। ইসি ইতোমধ্যে খসড়া ভোটকেন্দ্র তালিকা তৈরি করেছে। এই তালিকা অনুযায়ী কেন্দ্রগুলোর রাস্তা, বিদ্যুৎ সংযোগ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঠিক রাখার নির্দেশও দেওয়া হয়।

ভোটকেন্দ্র, অবকাঠামো ও লজিস্টিক প্রস্তুতি
সভায় আলোচনা হয়, দেশের ৪২ হাজারের বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ভোটকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের প্রস্তুতি নিতে হবে। যেসব স্থানে ভবন সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে, স্থানীয় সরকার ও শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরকে দ্রুত সংস্কার সম্পন্ন করতে বলা হয়েছে।

ইসির নির্দেশে জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনকে বলা হয়েছে, প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে যাতায়াতের রাস্তা যেন ভোটের আগে মেরামত ও প্রবেশযোগ্য হয়। দূরবর্তী ও দুর্গম এলাকায় হেলিপ্যাড সংস্কারের নির্দেশও দেওয়া হয়েছে, যাতে প্রয়োজনে জরুরি পরিবহন বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চলাচলে সমস্যা না হয়।

এছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সিসি ক্যামেরা সচল রাখা, ভোটের দিন নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং নির্বাচনি কর্মকর্তাদের লজিস্টিক সহায়তা ও যানবাহন নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

মেডিকেল টিম ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা
সভায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিনিধিরা জানান, নির্বাচনের দিন প্রতিটি উপজেলায় একটি মেডিকেল টিম গঠন করা হবে। প্রতিটি টিমে একজন চিকিৎসক, একজন নার্স ও প্রয়োজনীয় ওষুধ থাকবে। দুর্গম এলাকায় ইউনিয়নভিত্তিক সহায়ক টিমও থাকবে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বিজিবি, পুলিশ, আনসার ও র‌্যাবকে যৌথভাবে প্রস্তুত রাখা হবে। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে অন্তত একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট থাকবেন, যিনি আচরণবিধি প্রতিপালন তদারকি করবেন।

প্রযুক্তি ও নজরদারি ব্যবস্থা
ইসি জানিয়েছে, ভোটগ্রহণ ও ফলাফল প্রেরণে এবার সর্বাধুনিক ডিজিটাল ভোট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (ডিভিএমএস) ব্যবহার করা হবে। এতে কেন্দ্র থেকে সরাসরি ফলাফল জেলা ও জাতীয় পর্যায়ে পাঠানো সম্ভব হবে।

ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ বলেন, “আমরা চাই ফলাফল যেন দ্রুত ও নির্ভুলভাবে ঘোষণা করা যায়। সেই জন্যই প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো হচ্ছে।”

তিনি আরো জানান, ভুয়া খবর ও বিভ্রান্তি রোধে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক একটি মনিটরিং সেল গঠন করা হচ্ছে, যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভ্রান্ত তথ্য ছড়িয়ে পড়লে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেবে।

গণভোটের সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের সংবিধানে ১৪২(১)-এর উপধারায় বলা আছে যদি সংবিধান সংশোধন বা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনমত জানতে হয়, তবে গণভোট আয়োজন করা যেতে পারে।

সরকার ও রাজনৈতিক মহলে সম্প্রতি সংবিধানের কিছু অনুচ্ছেদে সংস্কার এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। সেই সূত্রেই গণভোটের বিষয়টি সামনে এসেছে।

তবে রাজনৈতিকভাবে বিষয়টি সংবেদনশীল। কিছু দল মনে করছে, একই সঙ্গে নির্বাচন ও গণভোট আয়োজন করলে প্রশাসনিক চাপ বেড়ে যাবে; আবার কেউ কেউ বলছে, এতে ব্যয় কমবে ও জনসম্পৃক্ততা বাড়বে।

একজন জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কর্মকর্তা বলেন, “ইসি প্রস্তুতি নিচ্ছে এমনভাবে, যেন সরকার যেদিন গণভোটের সিদ্ধান্ত দেবে, সেদিনই কাজ শুরু করা যায়।”

অর্থনৈতিক প্রস্তুতি ও বাজেট বরাদ্দ
ইসি সূত্রে জানা গেছে, সংসদ নির্বাচন একা আয়োজনের জন্য যে বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে তা প্রায় ৮,২০০ কোটি টাকা। কিন্তু গণভোট যুক্ত হলে ব্যয় আরো ৩,০০০ থেকে ৩,৫০০ কোটি টাকা পর্যন্ত বাড়তে পারে।

অর্থ বিভাগের সচিব বৈঠকে জানান, বাজেট সংস্থান বিষয়ে প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে এবং ব্যয় সাশ্রয়ী হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় খরচ না করে শুধু অপরিহার্য খাতে অর্থ ব্যয় করতে বলা হয়েছে।

ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা ও প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা
ইসি সচিব বলেন, “আমরা প্রিজাইডিং, সহকারী প্রিজাইডিং ও পোলিং কর্মকর্তাদের একটি পূর্ণাঙ্গ প্যানেল তৈরি করছি। শিক্ষক, সরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা ও অন্যান্য দপ্তরের কর্মচারীরা এতে থাকবেন।”

ইসি চায়, ভোটগ্রহণে যেন নিরপেক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করেন। এজন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নিরপেক্ষ শিক্ষকদের তালিকা দিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

তথ্য মন্ত্রণালয় ও প্রচার কৌশল
ভোটার সচেতনতা বাড়াতে ইসি সংসদ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) এয়ারটাইম ব্যবহার করবে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভোটাধিকার ও আচরণবিধি বিষয়ে সচেতনতামূলক ভিডিও প্রচার করা হবে। তথ্য মন্ত্রণালয় ও ইসি যৌথভাবে এই প্রচার অভিযান পরিচালনা করবে।

বিদেশি পর্যবেক্ষক ও প্রবাসী ভোটার
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, বিদেশি পর্যবেক্ষকদের ভিসা ও অনুমতি প্রক্রিয়া দ্রুত করা হবে। একই সঙ্গে ইসি প্রবাসী বাংলাদেশি ভোটারদের জন্য ডিজিটাল পোস্টাল ব্যালট সিস্টেম চালু করছে। আগামী ১৬ নভেম্বর এর ট্রায়াল অ্যাপ উদ্বোধন হবে বলে জানিয়েছেন সচিব আখতার আহমেদ।

সরকারি সফরে সচিবদের দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দিল ইসি
বৈঠকে সিইসি কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আপনারা সরকারি সফরে দেশের যেখানেই যান না কেন, নির্বাচনী প্রস্তুতি সম্পর্কে খোঁজখবর নেবেন। এটি আমাদের জাতীয় দায়িত্ব।”

তিনি আরো বলেন, “নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতিতে সরকারের পূর্ণ সহায়তা চায়। কারণ নির্বাচন কমিশন একা এই বিশাল আয়োজন করতে পারে না, সব মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় জরুরি।”

সাবেক নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা ও ঢাকা-১৪ আসনের ভোটার তৌহিদুর রহমান বলেন, “সব মিলিয়ে নির্বাচন কমিশনের এই বৈঠক শুধু প্রশাসনিক নয়, বরং রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক প্রেক্ষাপটেও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটি ইঙ্গিত দেয় যে সরকার গণভোটের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছে এবং ইসি চাইছে আগেভাগে প্রস্তুত থাকতে যাতে কোনো অঘটন বা বিলম্ব না ঘটে।”

তিনি বলেন, “এখন অপেক্ষা সরকারের সিদ্ধান্তের। সংসদ নির্বাচন ও গণভোট কি একসঙ্গে হবে, নাকি আলাদা দিনে। যেভাবেই হোক, নির্বাচন কমিশনের এই আগাম প্রস্তুতি বাংলাদেশের নির্বাচনি ব্যবস্থাকে আরো সংগঠিত ও প্রযুক্তিনির্ভর হবে।”

ঢাকা/এস

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ভ টক ন দ র ক প রস ত ত ন ও গণভ ট কর মকর ত র জন ত ক গণভ ট র ব যবস থ সরক র র ব যবহ র মন ত র গ রহণ এজন য

এছাড়াও পড়ুন:

বিস্মৃতির ছোবল

গতকালও ওরা এখানেই ছিল। চায়ের দোকানের পাশে যে অ্যালোভেরার ঝোপ, তার ঠিক পাশেই বেঞ্চি পেতে বসেছিল ওরা তিনজন। অথচ ওদের মধ্যে একজনের অ্যালোভেরাগাছগুলোকে ছোট ছোট সাপ বলে ভ্রম হয়, অনেক দিন ধরেই। তারপরও ওই ঝোপের পাশেই ওরা বসেছিল।

ওদের মধ্যে একজন কখনো হাসে না। এ বিষয়ে ওর কাছ থেকে কোনো হৃদয়বিদারক গল্প ওরা শুনতে পায়নি। কেবল পরিচয়ের শুরু থেকেই ওরা জানত, ও কখনো হাসবে না। হৃদয়ের অনুভূতি প্রকাশের জন্য ওদের কাছে হাসিটাকে কখনো গুরুত্বপূর্ণ মনেও হয়নি। বরং কান্না, কান্নাকে সব সময়ই ওদের কাছে খাঁটি একটা অনুভূতি বলে মনে হয়। মনে হয়, বৃষ্টি আর কান্না, এই দুইজন বেরিয়ে আসে কেবল আকাশ যখন ফেটে পড়ে তখনই।

তাই বলে গতকাল, অ্যালোভেরা ঝোপের পাশে বসে, ওরা কাঁদছিলও না। ওদের কান্নার নিজস্ব সময় আছে, সূর্যাস্ত আর সূর্যোদয়ের মতোই। শিশুর মতো যখন–তখন কেঁদে ফেলার বাতিক ওদের নেই। যদিও ঠিক এই সময়টায় না কাঁদলে, আর কখন কাঁদা উচিত, সেটাও ওরা বুঝতে পারছিল না।

‘আমাদের নিশ্চয়ই আবার দেখা হবে। সাধারণত শেষ দেখা বলতে আমরা যা বুঝি, তা আরও অনেক বেশি বিয়োগাত্মক হওয়ার কথা। আমার মনে হয় না এত শান্ত একটা বিদায়, শেষবারের মতো হতে পারে।’—না হাসতে পারা মানুষটা বলল।

‘কোনটা শেষবার, তা কি আসলেই কখনো জানা সম্ভব? এমনকি মৃত্যুও এভাবে বলেকয়ে আসে না। কেবল হয়তো মৃত্যুদণ্ডের আসামিদের ব্যাপারটা বাদ দিলে’—মেয়েটা জবাব দিল।

‘কিন্তু তারপরও, ফাঁসির আসামি হলেও, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত জীবনের আশা সবারই থেকেই যায়। একদম সত্যিকারের মরে যাওয়ার আগে, কেউ কি বিশ্বাস করে যে সে মরে গেছে?’—ওদের মধ্যে প্রথমে যে এসেছিল এই চায়ের দোকানটায়, সে নিজের অভিমত জানাল।

অথচ আশ্চর্য ব্যাপার হলো, ও চা খায় না। এমনকি যেবার শ্রীলঙ্কা থেকে চা এল বলে বাসায় খুব হইচই হলো, সেবারও, ও এক চুমুক চা মুখে দেয়নি। এমনকি ও সিগারেটও খায় না। কিন্তু তবু, চায়ের দোকানে ও–ই প্রথমবার এসেছিল। এসেছিল আসলে অ্যালোভেরার ঝোপের কথা জানতে পেরে।

‘আমাদের নিশ্চয়ই আবার দেখা হবে। সাধারণত শেষ দেখা বলতে আমরা যা বুঝি, তা আরও অনেক বেশি বিয়োগাত্মক হওয়ার কথা। আমার মনে হয় না এত শান্ত একটা বিদায়, শেষবারের মতো হতে পারে।’—না হাসতে পারা মানুষটা বলল।

না! পেটের বা যৌনাঙ্গের কোনো ব্যারামই ওকে অ্যালোভেরার খোঁজে এত দূর নিয়ে আসেনি। আপনারা যতটা ভাবছেন, চায়ের দোকানটা অত কাছেও না, যে বিনা পয়সার অ্যালোভেরার লোভে ও এত দূর আসবে। অ্যালোভেরার ঝোপের কাছে ও এসেছিল, কারণ সুদূর অতীতে এমন কোনো অ্যালোভেরার ঝোপের ভেতরেই, সে তার শৈশব হারিয়ে ফেলেছিল। এরপর একটু বড় হওয়ার পর থেকে, কারও মুখে অ্যালোভেরার ঝোপের গল্প শুনলেই, সেখানে সে হাজির হয়।

শৈশব ফিরে পাওয়ার কোনো প্রকল্প হাতে নিয়ে কিন্তু সে ঘুরে বেড়ায় না। কারণ একে একে কৈশোর, যৌবন বা আরও যা কিছু নিয়ে সবাই হাপিত্যেশ করে, তার সবকিছু অকালেই হারিয়ে ফেলার পর, ফিরে আসার জন্য অ্যালোভেরার ঝোপ ছাড়া ওর আসলে আর কিছু ছিল না।

‘মরে যাওয়ার নিশ্চয়তার বিষয়টা নিয়ে কথা বলার জন্য আমরা কিন্তু ঠিক জুতসই মানুষ নই’—খেই ধরে না হাসতে পারা মানুষটা ‘বরং এই আলোচনা আমরা রাস্তার ওই পাশের বাসিন্দাদের জন্য ছেড়ে দিতে পারি। ওখানে ওদের, মৃত্যুর বাইরে আর কী নিয়েই–বা কথা বলার আছে।’

রাস্তার ওপাশে একঝাঁক ফিঙে হঠাৎ আকাশে উড়াল দিল। কিন্তু ওই ফিঙেরা ওর আলাপের বিষয়বস্তু নয়। বরং ফিঙেদের আকাশটাকে ঢেকে রেখে যে গাছগুলো গোঁয়ারের মতো দাঁড়িয়ে আছে, তার পেছনের কবরস্থানটার দিকেই তার ইঙ্গিত।

‘আমার মনে হয় না’ মেয়েটা দ্বিমত করে। ‘মৃত্যু নিয়ে আমাদের এত অবসেশন, কারণ জন্ম নেওয়ার পর থেকে জীবনের সবচেয়ে নিশ্চিত বিষয়টা মেনে নিতে, আমাদের বড় কষ্ট হয়। ওপাশে, ওদের এপিটাফে লেখা সন তারিখের ওপরও শেওলা পড়ে গেছে অনেক বছর আগে। আমার মনে হয়, তার চেয়ে জীবন নিয়ে কথা বলতেই ওরা বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে। মৃত্যু পুরোপুরিই জীবিতদের বিষয়।’

তিনজনের কান্নার নিজস্ব সময়টা তিনটা ঘড়ির কাঁটার অঙ্কের মতো, একই সঙ্গে একই ঘরে না আসতে পারায়, ওরা কাঁদছিল না। কিন্তু এ কথা সত্যি, সময়টা কান্নারই ছিল। আর এই বেদনামুখর সময়কে আরও গুরুগম্ভীর করে তোলার জন্য মৃত্যুর চেয়ে ভারী বিষয় আর কী–ই বা হতে পারত?

অবাক করা বিষয় হলো, মৃত্যু নিয়ে কথা বলতে ওদের ভালোই লাগছিল। একটা কুকুরের মৃত্যু যেমন করে মাঝেমধ্যে মানুষকে পারমাণবিক বোমার কথা ভুলিয়ে দেয়, হয়তো তেমনি করেই। তাই মৃত্যুর আলাপটা শেষ করতে চাইছিল না কেউ।

অথচ অবাক করা বিষয় হলো, মৃত্যু নিয়ে কথা বলতে ওদের ভালোই লাগছিল। একটা কুকুরের মৃত্যু যেমন করে মাঝেমধ্যে মানুষকে পারমাণবিক বোমার কথা ভুলিয়ে দেয়, হয়তো তেমনি করেই। তাই মৃত্যুর আলাপটা শেষ করতে চাইছিল না কেউ। সে জন্যই কিছুটা অপ্রাসঙ্গিকভাবে কথাটা তুলল হাসতে না পারা মানুষটা।

‘আমার সাপটা মরে গেছে, গতকাল রাতে। সকালেও ওকে খাবারদাবার খাইয়ে বের হয়েছিলাম। রাতে ফিরে দেখলাম, মরে পড়ে আছে। একটা ইঁদুর মুখে নিয়ে মরেছিল ও, অথচ খাঁচাটার মধ্যে ইঁদুর ঢোকার মতো কোনো রাস্তাই নেই।’ প্রিয় পোষ্যর মৃত্যুতে শোকগ্রস্ত হওয়ার চেয়ে, বিষয়টার রহস্যময়তা সম্পর্কেই ওর আগ্রহ বেশি মনে হলো। অথবা হয়তো মৃত্যু সম্পর্কেই, কে জানে।

বাকিরা কিন্তু এবার বেশ শোকগ্রস্ত হয়ে পড়ল। সাপটার সঙ্গে ওদেরও অনেকবার দেখা হয়েছে। বরং এটাই খুব আশ্চর্যের বিষয় যে সাপটাকে জ্যান্ত খাবার খেতে দেওয়ার সময়, মৃত্যু বিষয়টা ওদের কখনো বিচলিত করেনি।

‘আহা!’ বলল মেয়েটা। ‘প্রচণ্ড বিষধর হলেও, ও কিন্তু বেশ লাজুক ছিল। শুধু খাওয়ার সময়টা বাদে। বাকি সময় কেমন চুপটি করে পড়ে থাকত খাঁচার কোনায়। আমার মনে হয় আমাদেরকে চিনতে পারত, ঘরে ঢুকলেই দেখেছি কেমন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত।’

এই দৃষ্টির বিষয়টা নিয়ে, স্বীকার না করলেও, ওদের কিন্তু একটা ভাবনা আছে। সে জন্যই সাপের পাশাপাশি, সাপের খাঁচাটার কথাও ওদের বিশেষ করে মনে পড়ে। না হাসতে পারা বন্ধুটি থাকে চিলেকোঠায়। এই চিলেকোঠায় সরাসরি ঘরের ভেতরের সিঁড়ি দিয়ে ওঠা যায় না। কোনো একটা নিরাপত্তাজনিত কারণেই হয়তো বাইরের একটা ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে সেখানে উঠতে হয়। সিঁড়িটা আবার ঘেরা একটা তারের জাল দিয়ে। যতবারই এই সিঁড়ি দিয়ে ওরা ওঠে, ওদের মনে হয় ওরা একটা খাঁচার মধ্যে ঢুকে পড়ছে ধীরে ধীরে। দূর থেকে কেউ দেখলে হয়তো ভাবত সাপের লেজটাই এঁকেবেঁকে ঢুকছে। চিলেকোঠায় ঢোকার পর সাপটাকে দেখতে দেখতে, ওদেরও নিজেদের বন্দী মনে হতো। পার্থক্য কেবল সাপটার মতো নিজেদের এই বন্দিত্ব নিয়ে ওরা এতটা নিস্পৃহ থাকতে পারত না। বরং সাপটার আধবোজা চোখের দিকে তাকিয়ে ওদের মনে হতো ওই চোখে ওদের জন্য উপচে পড়ছে উপহাস। খাঁচার কোন পাশে কে দাঁড়িয়ে আছে, তা বুঝতে না পারাদের দিকে, একজন বোদ্ধার চোখের ভাষা যেমন হয়।

সাপের মুখে থাকা মরা ইঁদুরের দিকে শুরুতে সাপের মালিকের মতো এত মনোযোগ না দিলেও, একটা সময় ওরা ইঁদুরটার কথাও ভাবতে শুরু করে। বাসাটায় খুব একটা ইঁদুরের উপদ্রব আছে বলে ওরা কখনো শোনেনি। ওই ঘোরালো সিঁড়ি বেয়ে একটা ইঁদুর চিলেকোঠায় পৌঁছে, সাপের সরু জালির খাঁচায় কী করে ঢুকে পড়ল, তার হদিস কিছুতেই ওদের মিলছিল না।

‘ইঁদুর বোধ হয় মানুষের মতোই, তাই না? যখন তার ডাক আসে, তখন যেমন করেই হোক একটা সাপ খুঁজে নিয়ে তার খাঁচায় ঢুকে পড়বেই। মানুষের জীবনে ঢুকে পড়ার মতো একটা সাপের খাঁচার কখনো অভাব হয় না, তাই না? বা ঢোকার পথের? যতই সুখের জীবন থাকুক তার; থাকুক নিরাপত্তা, একটা সাপ কিন্তু সব সময় তাকে ডাকতেই থাকে। সবকিছু ছেড়েছুড়ে ওই সাপের বিষদাঁত আলিঙ্গন করার তাড়নাতেই যেন মানুষ ছুটে চলেছে, সৃষ্টির আদি থেকে।’ হাসতে না–পারা মানুষটার নিজের জীবনের কথাই যেন মনে হয়।

আগন্তুকেরা ক্ষণিকের জন্য আসে, আবার চলে যায়। ওরা তিনজন জানে, ওরা আর এখানে কখনো ফিরবে না। কখনো কখনো মৃত্যুর চেয়েও বড় কোনো অন্ধকার, মানুষকে আড়াল করে ফেলে। তারা আর ফিরে আসতে পারে না।

‘হুম, আর সাপেরও কখনো অভাব হয় না নিজস্ব একটা মানুষের। যদিও ওরা বলে, সাপের কোনো স্মৃতি নেই, শত্রু–মিত্র চেনার ক্ষমতাও নেই, আমার কিন্তু কথাটা বিশ্বাস হয় না। আমার মনে হয়, বিষ নিজেই একটা স্মৃতি। বিষদাঁতের পথ বেয়ে যে খুঁজে ফেরে নিজের অতিক্রান্ত অতীতকে। আর খুঁজে না পেয়ে আতঙ্কিত হয়েই ছোবল দিতে থাকে একে-তাকে’—কথাগুলো বলতে বলতে প্রথমবার আসা মানুষটা খানিকটা চঞ্চল হয়ে উঠল। হঠাৎ করে তার মনে হলো, অনেক দিন আগে যাকে সে অ্যালোভেরার ঝোপে হারিয়ে ফেলেছিল, সেটা কি তার শৈশব? নাকি কোনো একটা সাপ? নাকি একটা অতিদীর্ঘ সাপের বিষদাঁত হয়ে সে নিজের অতিক্রান্ত অতীতকেই খুঁজে ফিরছে ঝোপঝাড়ে?

তার অন্যমনস্কতা অন্য দুজনের মধ্যেও সংক্রমিত হলো। একজন ডুবে গেল তার মৃত সাপটির স্মৃতিচারণায়। আরেকজন সময়কে একটা সাপের আদলে কল্পনা করতে করতে নিজেই যেন একটা ফণা হয়ে দুলতে লাগল মৃদু ছন্দে। আর মেয়েটা, তার মন এখনো পড়ে আছে ওপাশের কবরগুলোর মধ্যেই। সত্যিই কি মৃতরা কেবল জীবনের কথাই ভাবে? নাকি মরে যাওয়ার পরে, এসব ভাবনা খস খস শব্দ করে উড়ে যাওয়া বাদুড়গুলোর মতোই অর্থহীন মনে হয়?

একটা সময় আলো নিভে আসে। চায়ের দোকানের আগন্তুকেরা ক্ষণিকের জন্য আসে, আবার চলে যায়। কিন্তু ওরা তিনজন জানে, ওরা আর এখানে কখনো ফিরবে না। কখনো কখনো মৃত্যুর চেয়েও বড় কোনো অন্ধকার, মানুষকে আড়াল করে ফেলে। তারা আর ফিরে আসতে পারে না।

কিন্তু শব্দ? শব্দ বেঁচে থাকে। যা কিছু উচ্চারিত হলো, তাই ধ্বনিত হবে ইথারে, আরও অনেক যুগ পরেও। আমাদের শ্রবণসীমার বাইরে চলে গেলে, শব্দগুলোকে আমরা মৃত ভাবি। নিজেদের কানের ক্ষমতা সম্বন্ধে কোনো দ্বিধাই আমাদের মধ্যে জন্ম নেয় না। অথচ শব্দ অমর, অক্ষয়, অজর। যা কিছু উচ্চারিত হলো, সাপের খোলসের মতো হয়তো সে বারবার নিজেকে পাল্টাবে। কিন্তু সেটা প্রস্থান নয়, পুনরায় ফিরে আসার সংকেত মাত্র। হয়তো মৃত্যুও, আমাদের অনুভূতির বা বোধের সংকীর্ণতারই আরেক নাম। হয়তো আমাদের বোধের সীমার বাইরে, সচেতন সত্তার কখনো মৃত্যু হয় না।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • কর্মদিবসের শেষ দিনে প্রধান শিক্ষকের মৃত্যু
  • প্রশিক্ষকদের দায়িত্বে উদাসীনতাসহ যেসব অসংগতি উঠে এল প্রাথমিক তদন্তে
  • চবি ছাত্রদলের ৪২০ জনের কমিটিতে নারী মাত্র ১১
  • চলন্ত গাড়ির নিচে পড়েও অক্ষত অবস্থায় ফিরল ৩ বছরের শিশুটি
  • মানবাধিকার কমিশনকে শক্তিশালী ও কার্যকর করতে নতুন অধ্যাদেশ অনুমোদন
  • যমুনা ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যান বেলাল হোসেন
  • এই তিন কন্যার একজন ঢালিউডের জনপ্রিয় নায়িকা, স্বামীও নায়ক
  • নিকোলাই গোগোলের নগরে
  • বিস্মৃতির ছোবল