পতিত কর্তৃত্ববাদী শাসনামলে সংঘটিত গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের সেনা হেফাজতে রাখার সিদ্ধান্ত সাংবিধানিক অঙ্গীকার ও আইনের সমান প্রয়োগের মানদণ্ডে প্রশ্নবিদ্ধ বলে মনে করছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটি এ নিয়ে উদ্বেগও প্রকাশ করেছে।

আজ মঙ্গলবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি ‘বৈষম্যমূলক’ এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে টিআইবি। মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের ঠিক কোন বিবেচনায় ও যুক্তিতে অন্য অভিযুক্তদের থেকে পৃথক ব্যবস্থাপনায় রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে, সে বিষয়ে সরকারের ব্যাখা জানতে চেয়েছে সংস্থাটি।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের বিচারপ্রক্রিয়ায় ব্যক্তির পেশাগত পরিচয় বা পদমর্যাদা বিবেচনায় নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এভাবে কাউকে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা প্রদান বা মূল্যায়ন, ন্যায়বিচারের পরিপন্থী।

অন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিরা যদি যথানিয়মে বেসামরিক কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যবস্থায় কারা হেফাজতে থাকতে পারেন, তাহলে অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের জন্য আলাদাভাবে বিশেষায়িত সাবজেলের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্নও তুলেছেন ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেছেন, সরকারের এই বৈষম্যমূলক আচরণ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারপ্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে, যা ভুক্তভোগী ও তাঁদের পরিবারসহ জনমনে সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে বিভ্রান্তির ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। বিচারপ্রক্রিয়ার নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি।

আরও পড়ুনহেফাজতে ১৫ সেনা কর্মকর্তা, আত্মগোপনে একজন১১ অক্টোবর ২০২৫

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে উল্লিখিত ‘‘আইনের দৃষ্টিতে সমতা’’ ও সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক আইনের মৌলভিত্তি অনুযায়ী মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত কেউই বিশেষ কোনো সুবিধা লাভের উপযোগী নয়, যা সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।’

বাংলাদেশ রোম স্ট্যাটিউট অব দ্য ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট স্বাক্ষরকারী দেশ উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘যার ২৭ ধারায় (ইররেলিভেন্স অব অফিশিয়াল ক্যাপাসিটি) বলা আছে, ব্যক্তির রাজনৈতিক পরিচয় ও সামরিক অবস্থান নির্বিশেষে অভিযুক্তরা বিচারপ্রক্রিয়ায় বিশেষ কোনো সুবিধাপ্রাপ্ত হবে না। একইভাবে নুরেমবার্গ প্রিন্সিপল, যা আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী অপরাধসংক্রান্ত আইনের ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়, এর পিন্সিপল-৩ অনুযায়ী দাপ্তরিক পদ বা অফিশিয়াল অবস্থান ও দায়িত্ব ব্যক্তির সংঘটিত অপরাধ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার বিবেচ্য হিসেবে পরিগণিত হবে না। এমনকি এ ব্যাপারে জাতীয় আইনের অধীনে সংশ্লিষ্ট দেশের সামরিক আইনে যা-ই উল্লেখ থাকুক না কেন, মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের জন্য তা প্রযোজ্য হবে না।’

আরও পড়ুনঢাকা সেনানিবাসের একটি ভবনকে সাময়িকভাবে কারাগার ঘোষণা ১৩ অক্টোবর ২০২৫

ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর দ্য প্রটেকশন অব অল পারসনস ফ্রম এনফোর্সড ডিসেপিয়ারেন্স (আইসিপিপিইডি)’ শীর্ষক গুমবিষয়ক জাতিসংঘের কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ, যেখানে ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সরকার অঙ্গীকার করেছে। এ ক্ষেত্রে বিচারপ্রক্রিয়ায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের পেশাগত বা প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়, পদপদবি কিংবা সামাজিক অবস্থান বিবেচনায় নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

অভিযুক্ত অন্য একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছিল, যা আমরা ইতিবাচক দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখছি। মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত হিসেবে তিনি সিভিল নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যবস্থাপনায় আটক আছেন। অথচ অভিযুক্ত অন্য সেনা কর্মকর্তাদের কেন সেনা হেফাজতে রাখার প্রয়োজন হলো, এর ব্যাখ্যা দেওয়া সেনা কর্তৃপক্ষ তথা সরকারের জন্য জরুরি। এ ধরনের আচরণ ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিতে সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে জনমনে সন্দেহ তৈরি করবে।’

মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের পৃথক ব্যবস্থাপনায় রাখার বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ট আইব র ন র ব হ কর মকর ত দ র ম নবত ব র ধ ব যবস থ সরক র র উল ল খ আইন র অপর ধ

এছাড়াও পড়ুন:

রাজনৈতিক সহিংসতায় ১৩ মাসে ১৬০ জন নিহত, বিএনপির কোন্দলেই ৮৫ জন

অন্তর্বর্তী সরকারের ১৩ মাসে (সেপ্টেম্বর ২০২৪—সেপ্টেম্বর ২০২৫) দেশে রাজনৈতিক সহিংসতায় অন্তত ১৬০ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৮ হাজার ৫০ জন। শুধু বিএনপির অন্তঃকোন্দলে নিহত হয়েছেন ৮৫ জন। আহত হয়েছেন ৫ হাজার ১৭ জন।

আজ মঙ্গলবার হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালের আগস্টে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের পর নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করলেও রাজনৈতিক সহিংসতা, মানবাধিকার ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রত্যাশিত উন্নতি হয়নি। বরং নানা ধরনের সহিংসতা ও অপরাধের ঘটনায় জনমনে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

সহিংসতার বিস্তার

এইচআরএসএসের তথ্যমতে, গত ১৩ মাসে অন্তত ১ হাজার ৪৭টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক প্রতিশোধ, সমাবেশকেন্দ্রিক সংঘর্ষ, কমিটি গঠন নিয়ে বিরোধ, চাঁদাবাজি ও স্থাপনা দখল—এসব কারণেই অধিকাংশ সহিংসতা ঘটেছে।

বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোর অন্তঃকোন্দলে সবচেয়ে বেশি সহিংসতা ঘটেছে। শুধু বিএনপির ভেতরেই ৫৩৯টি ঘটনায় দলটির ৮৫ নেতা-কর্মী নিহত ও ৫ হাজার ১৭ জন আহত হয়েছেন। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে ২২১টি সংঘর্ষে ৩৪ জন নিহত হন। আহত হয়েছেন ১ হাজার ১৪১ জন। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে ৪০টি সহিংসতার ঘটনায় ২ জন নিহত হন।

আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের মধ্যে ১১টি সংঘর্ষের ঘটনায় ২ জন, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মধ্যে ২০টি ঘটনায় ১ জন এবং আওয়ামী লীগের অন্তঃকোন্দলে ২৪টি সংঘর্ষের ঘটনায় ১২ জন নিহত হন। বিএনপি ও এনসিপির মধ্যে ১৮টি সহিংসতার ঘটনায় আহত হন ১৪০ জন।

ছাত্ররাজনীতিতেও সহিংসতা কমেনি। ছাত্রদলের অন্তঃকোন্দলে ৩৮টি ঘটনায় ৩ জন নিহত ও ৩২০ জন আহত হয়েছেন। এ সময়ে সন্ত্রাসী ও দুষ্কৃতকারীদের হাতে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ওপর হামলার অন্তত ১৭১টি ঘটনায় ১২০ জন নিহত হয়েছেন। রাজনৈতিক কার্যালয়, বাড়িঘর, দোকানপাট ও যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে সাত হাজারের বেশি।

সহিংসতার উল্লেখযোগ্য ঘটনা

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ৫ থেকে ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের ভার্চ্যুয়াল অনুষ্ঠানে প্রচারের ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ঢাকায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বর, সুধা সদন ও দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের কার্যালয় ও নেতাদের বাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।

এ ছাড়া ১৬ জুলাই গোপালগঞ্জে এনসিপির ‘জুলাই পদযাত্রা’–কেন্দ্রিক সংঘর্ষে পাঁচজন নিহত ও শতাধিক আহত হন। ৯ জুলাই পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে যুবদলের কর্মী মো. সোহাগকে নির্মমভাবে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ২৯ আগস্ট কাকরাইলে জাতীয় পার্টির কার্যালয়ের সামনে গণ অধিকার পরিষদ ও জাতীয় পার্টির সংঘর্ষের ঘটনায় গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হকসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। পরদিন সেখানে অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে ৪৬০টি ঘটনায় ৮২ জন, ২০২২ সালে ৭৫৮টি ঘটনায় ৯২ জন এবং ২০২৩ সালে ৯২১টি ঘটনায় ৯৬ জন নিহত হয়েছিলেন। আর গত ১৩ মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬০ জনে।

এইচআরএসএসের দাবি, গুম ও ক্রসফায়ারের মতো ঘটনা না ঘটলেও রাজনৈতিক সহিংসতা, মব (উচ্ছৃঙ্খল জনতার সংঘবদ্ধ আক্রমণ) সহিংসতা, গণপিটুনি, নারী নির্যাতন, সাংবাদিকদের ওপর হামলা, সংখ্যালঘু নির্যাতন, কারাগারে মৃত্যু, সভা-সমাবেশে বাধা—এসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে।

মানবাধিকার সংস্থাটি মনে করে, আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বৃদ্ধি করতে না পারলে মানবাধিকার পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ