জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশের দিকে তাকিয়ে দলগুলো
Published: 21st, October 2025 GMT
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোট করার বিষয়ে ঐকমত্য হলেও সনদের আইনি ভিত্তি কী হবে, গণভোট কখন হবে, ভিন্নমত থাকা প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন কী হবে—মোটাদাগে এই তিন বিষয়ে রাজনৈতিক মতপার্থক্য কাটেনি। এখন সনদ বাস্তবায়নে ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশের দিকে তাকিয়ে আছে দলগুলো। চলতি সপ্তাহের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারকে সনদ বাস্তবায়নের সুনির্দিষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ সুপারিশ দিতে চায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
কমিশনের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক দীর্ঘ আলোচনার অভিজ্ঞতায় কমিশন মনে করছে, সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে তারা যে সুপারিশই দিক না কেন, তাতে কোনো কোনো পক্ষ বা দল অসন্তুষ্ট হবে। তবে সুপারিশ চূড়ান্ত করার আগপর্যন্ত কমিশন দলগুলোর সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চালিয়ে যাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সনদ বাস্তবায়নে সরকারকেই শক্ত ভূমিকা নিতে হবে বলে মনে করছেন কমিশন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে তৈরি জুলাই জাতীয় সনদে গত শুক্রবার ২৪টি দল ও জোট সই করেছে। সনদের আইনি ভিত্তির বিষয়টি নির্ধারিত না হওয়ায় এখনো সই করেনি এনসিপি। এ ছাড়া বামধারার আরও চারটি দলও সনদে সই করেনি।
সুপারিশ দেওয়ার আগে এখনই কিছু বলা ঠিক হবে না।সালাহউদ্দিন আহমদ, স্থায়ী কমিটির সদস্য, বিএনপিজুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি দিতে একটি বিশেষ আদেশ জারি করে গণভোট এবং আগামী জাতীয় সংসদকে দ্বৈত ভূমিকা (সংবিধান সংস্কার পরিষদ ও জাতীয় সংসদ) পালনের ক্ষমতা দেওয়ার মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ করার পথে এগোচ্ছে কমিশন। বিশেষ আদেশের ভিত্তি, আদেশে কী থাকবে, তা ঠিক করে একটি খসড়া তৈরির কাজ করছেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও আইনজীবীদের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্যরা।
ঐকমত্য কমিশন সূত্র জানায়, কমিশন সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ ২৪ অক্টোবরের মধ্যে সরকারের কাছে জমা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কমিশনের মেয়াদ আছে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত। কমিশন আশা করে, এ সময়ের মধ্যে সরকার জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি করবে। এ জন্য সরকার যাতে অন্তত এক সপ্তাহ সময় পায়, সেটি বিবেচনায় নিয়ে সুপারিশ জমা দেবে কমিশন।
ঐকমত্য কমিশন বিশেষজ্ঞ কমিটির সঙ্গে বসেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর যেসব বক্তব্য ছিল, প্রস্তাব ছিল, পরামর্শ ছিল—এগুলো সংকলন করে তাঁরা একটা পূর্ণাঙ্গ সুপারিশ দেবেন। হয়তো তাতে বিকল্প প্রস্তাবও থাকবে। এরপর যদি আমাদের কথা বলতে হয় সেটার ওপরে, তখন দেখা যাবে। সুপারিশ দেওয়ার আগে এখনই কিছু বলা ঠিক হবে না।’বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদদলগুলো যা বলছেসনদ বাস্তবায়নের উপায় নির্ধারণ করার বিষয়টি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কর্মপরিধিতে ছিল না। কয়েকটি রাজনৈতিক দলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ৩১ জুলাইয়ের পরে ঐকমত্য কমিশন সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে দলগুলো ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করে। ৯ অক্টোবর এই আলোচনা শেষ হয়। আলোচনায় গণভোটের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়নে ঐকমত্য হয়। কিন্তু গণভোটের ভিত্তি, সময় ও পথপদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর মধ্যে ভিন্নমত থেকে যায়। কমিশনের সুপারিশ শেষ পর্যন্ত সব দল মানবে কি না, তা এখনো পরিষ্কার নয়।
ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশের আগে এ বিষয়ে কথা বলা সমীচীন হবে না বলে মনে করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঐকমত্য কমিশন বিশেষজ্ঞ কমিটির সঙ্গে বসেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর যেসব বক্তব্য ছিল, প্রস্তাব ছিল, পরামর্শ ছিল—এগুলো সংকলন করে তাঁরা একটা পূর্ণাঙ্গ সুপারিশ দেবেন। হয়তো তাতে বিকল্প প্রস্তাবও থাকবে। এরপর যদি আমাদের কথা বলতে হয় সেটার ওপরে, তখন দেখা যাবে। সুপারিশ দেওয়ার আগে এখনই কিছু বলা ঠিক হবে না।’
আরও পড়ুনজুলাই সনদ স্বাক্ষরকারীরাও সেই কলম পেতে পারেন১৯ অক্টোবর ২০২৫এরই মধ্যে জামায়াতে ইসলামী ও সমমনা সাতটি দল সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে সংসদ নির্বাচন, জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি দিতে নভেম্বরে গণভোট আয়োজনসহ পাঁচ দাবিতে কর্মসূচি শুরু করেছে। তারা অপেক্ষায় আছে সনদ বাস্তবায়নে ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশের দিকে। কথা বলে জানা গেছে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি মনঃপূত না হলে দলগুলোর আন্দোলন কর্মসূচি আরও জোরদার করার নীতিগত সিদ্ধান্ত আছে।
প্রশ্ন আসে, যারা গণভোট ও সংসদ নির্বাচন একসঙ্গে চায়, তারা আসলে সংস্কার কার্যকর হোক, সেটা চায় কি না।হামিদুর রহমান আযাদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল, জামায়াতে ইসলামীজামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বলেছি গণভোট হবে আগে এবং সেটার যুক্তিও তুলে ধরেছি। অতীতে ১৭ থেকে ২১ দিনের মধ্যে গণভোট আয়োজনের নজির আছে। তাহলে গণভোট করার সময় আছে, সুযোগ আছে, নির্বাচন কমিশনও প্রস্তুত। তাহলে গণভোট আগে হতে অসুবিধা কোথায়? এখানেই প্রশ্ন আসে, যারা গণভোট ও সংসদ নির্বাচন একসঙ্গে চায়, তারা আসলে সংস্কার কার্যকর হোক, সেটা চায় কি না।’
এখনো জুলাই জাতীয় সনদে সই করেনি জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। তবে দলটি ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক আলোচনা থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেবে না। তারা শেষ পর্যন্ত সনদে সই করবে কি না, তা নির্ভর করছে বাস্তবায়ন নিয়ে কী সুপারিশ আসে তার ওপর।
আরও পড়ুনজুলাই সনদ বাস্তবায়নে বিশেষ আদেশে গণভোটের চিন্তা কমিশনের ১৯ অক্টোবর ২০২৫এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব প্রথম আলোকে বলেন, ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সুপারিশ দেওয়ার পর সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াটা স্পষ্ট হবে। কমিশনের মেয়াদও বেড়েছে। এর মধ্যেই আমরা কিছু আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় অংশ নেব। পরিস্থিতি অনুযায়ী আমরা স্বাক্ষর করা না করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।’
পরিস্থিতি অনুযায়ী আমরা স্বাক্ষর করা না করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।আরিফুল ইসলাম আদীব, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক, এনসিপি চার দলের স্মারকলিপিসিপিবি, বাসদ, বাসদ (মার্ক্সবাদী) ও বাংলাদেশ জাসদ জুলাই সনদে সই করেনি। গতকাল সোমবার এ চার দলের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে একটি স্মারকলিপি দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, সংবিধানে বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি এবং ১৫০(২) অনুচ্ছেদের ক্রান্তিকালীন বিধানের তফসিল পরিবর্তনে সম্মতি প্রদান ও আদালতে প্রশ্ন করা যাবে না, এমন বিষয়ে অঙ্গীকার এবং ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কথা অনুল্লেখ থাকা এমন কোনো সনদে ভিন্নমত দিয়ে তারা স্বাক্ষর করতে পারে না।
যে উপায় ভাবছে কমিশনসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রাথমিক খসড়া অনুযায়ী আদেশটির নাম হতে পারে ‘জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন (সংবিধান) আদেশ’। এটি সংবিধান ও অন্যান্য আইনের পরিপূরক হবে। এ আদেশের ভিত্তি হবে গণ–অভ্যুত্থান অর্থাৎ গণ–অভ্যুত্থানের ক্ষমতা বলে বিশেষ পরিস্থিতিতে এ আদেশ জারি করা হবে। আদেশের পরিশিষ্টে থাকবে জুলাই জাতীয় সনদ। এ আদেশের ওপর হবে গণভোট।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় পাওয়া মতামতের ভিত্তিতে সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ তৈরি করবে কমিশন। এ ক্ষেত্রে কমিশনের বিবেচনার দিক হচ্ছে এটাকে বাস্তবায়নে সরকারের দিক থেকে যেন সুনির্দিষ্ট কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যায়।জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভিন্নমত থাকা প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের বিষয়টি সনদে কীভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হবে, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। গত রোববার কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলেছেন, ভিন্নমত থাকা প্রস্তাবগুলো কমিশনের প্রস্তাব অনুসারে বাস্তবায়িত না হলে সংস্কারের মাধ্যমে বড় কোনো পরিবর্তন আসবে না।
সূত্র জানায়, ভিন্নমত বাস্তবায়নের বিষয়টিও আদেশে রাখার কথা ভাবা হচ্ছে। সেটি কীভাবে রাখা হবে, তা এখনো ঠিক হয়নি। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ ও সনদ বাস্তবায়ন চান কি না, এ রকম প্রশ্ন গণভোটে রাখা হতে পারে। আরেকটি হতে পারে, ভিন্নমত থাকা প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন চান কি না, এই প্রশ্নে গণভোট। এর বিকল্প হিসেবে উচ্চকক্ষে পিআর, সংবিধান ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির মতো কয়কেটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গণভোট দেওয়া হতে পারে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় পাওয়া মতামতের ভিত্তিতে সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ তৈরি করবে কমিশন। এ ক্ষেত্রে কমিশনের বিবেচনার দিক হচ্ছে এটাকে বাস্তবায়নে সরকারের দিক থেকে যেন সুনির্দিষ্ট কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যায়।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জ ল ই জ ত য় সনদ কম ট র সদস য ভ ন নমত থ ক প রথম আল ক প রস ত ব ক র যকর গণভ ট র র ব ষয়ট অন য য় শ ষ পর র ওপর সরক র ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
ফাঁকা বুলির রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্ন আসছে কেন
সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক আলোচনায় সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দটি সম্ভবত ‘সংস্কার’। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই শুরু হয় সংস্কার নিয়ে আলোচনা ও তৎপরতা। গঠিত হয় অনেকগুলো কমিশন, টাস্কফোর্স ও কমিটি। এসব কমিশন, টাস্কফোর্স ও কমিটি থেকে শত শত সুপারিশ ও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের ১৫ মাসের মাথায় এসে দেখা যাচ্ছে, মৌলিক আর্থসামাজিক বিষয়ের সংস্কারগুলো আলোচনাতেই নেই।
রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়ে পাঁচটি সংস্কার কমিশনের সহস্রাধিক সুপারিশ থেকে ঐকমত্য কমিশনে আলোচনা হয়েছে মাত্র ১৬৬টি নিয়ে। এর মধ্যে আবার অনেক মৌলিক সংস্কার বিষয়েই রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আর যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলোর বাস্তবায়নেও প্রত্যাশিত অগ্রগতি নেই। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলো রহস্যজনকভাবে বাদ পড়ে যাচ্ছে বা বদলে দেওয়া হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ পুলিশ ও দুদক সংস্কারের কথা বলা যেতে পারে।
আরও পড়ুনগণ–অভ্যুত্থানের পরও কেন আমলাতন্ত্রের সংস্কার হলো না০৩ নভেম্বর ২০২৫পুলিশ বাহিনীকে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রভাবমুক্ত রেখে পেশাদারির সঙ্গে পরিচালনার জন্য অনেক দিন ধরেই আলোচিত হচ্ছে স্বাধীন পুলিশ
কমিশন গঠনের বিষয়টি। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে এই পুলিশ কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে ঠিকই; কিন্তু যেভাবে তা গঠিত হচ্ছে, তাতে এই কমিশন বর্তমান দুদকের মতোই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ও আমলাতন্ত্রের বশীভূত নখদন্তহীন একটি প্রতিষ্ঠান হবে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
পুলিশের মূল সমস্যা হলো অবৈধ আদেশ ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার। এ প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয় নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও পদায়ন ঘিরে। যদি স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের মাধ্যমে এ কাজগুলো করা যায়, তাহলে পুলিশে রাজনৈতিক প্রভাব কমে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার পুলিশ কমিশন গঠনের জন্য যে অধ্যাদেশের খসড়া তৈরি করেছে, সেখানে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির ক্ষমতা পুলিশ কমিশনকে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়নি।
অর্থাৎ এগুলো আগের মতোই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় করবে। কমিশনের কাজ হবে এ–সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন ও সুপারিশ করা। তবে সেগুলো বাস্তবায়নে বাধ্যবাধকতার বিষয়ে অধ্যাদেশে কিছু নেই। এমনকি আইজিপি নিয়োগে স্বচ্ছতার জন্য কমিশনকে তিন সদস্যের একটি প্যানেল গঠনের ক্ষমতা দেওয়ার যে প্রস্তাব করেছিল আইন উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন কমিটি, সেটিও খসড়া থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ কমিশনের সদস্য বাছাইয়ের জন্য যে কমিটি করা হবে, তার সভাপতি হবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ফলে বাছাই কমিটি কতটা নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারবে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে, পুলিশকে আগের মতোই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন রাখার মাধ্যমে কার্যত পুলিশ কমিশনকে ‘নখদন্তহীন’ করে রাখার তৎপরতা চলছে আমলাদের দিক থেকে। কোনো কোনো রাজনৈতিক মহলও তা–ই চাইছে। (পুলিশ কমিশনের খসড়ায় আমলাতন্ত্রের ‘হস্তক্ষেপ’, প্রথম আলো, ৩০ নভেম্বর ২০২৫)
পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনেও আমলাতন্ত্রের বাধার বিষয়টি উঠে এসেছিল। সেখানে বলা হয়েছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের পক্ষ থেকে পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করা হয়েছে।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের কাছে পাঠানো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতামত থেকে দেখা যায়, সেখানে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘স্বাধীন পুলিশ কমিশন করলে নিয়ন্ত্রণকারী কোনো কর্তৃপক্ষ থাকবে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম পরিচালনা এবং পুলিশ বাহিনীকে যৌক্তিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা যাবে না। সুতরাং স্বাধীন পুলিশ কমিশন করার প্রস্তাবের সঙ্গে জননিরাপত্তা বিভাগ যৌক্তিক কারণে দ্বিমত পোষণ করছে।’ (পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন, সংলগ্নী-৯) সম্ভবত এ দ্বিমতের প্রতিফলনই ঘটেছে পুলিশ কমিশনবিষয়ক খসড়া অধ্যাদেশে।
পরিস্থিতি এ রকম যে একদিকে বহু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না, অন্যদিকে যেসব সংস্কার বাস্তবায়িত হচ্ছে, সেগুলোর অনেকগুলো দায়সারাভাবে করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত এ ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা।যেনতেনভাবে কোনো কমিশন গঠন করলেই যে উদ্দেশ্য সফল হয় না, তার সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত হলো দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। একসময় দেশে দুর্নীতি দমনের জন্য বিশেষায়িত সংস্থা হিসেবে কাজ করত দুর্নীতি দমন ব্যুরো। এই ব্যুরো নির্বাহী বিভাগের অধীন থাকায় এর স্বাধীনতা, কার্যকারিতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে ছিল ব্যাপক সংশয় ও জন-অসন্তোষ।
এ রকম একটি পটভূমিতেই দুর্নীতি দমন আইন ২০০৪–এর মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগের অধীন ব্যুরোর পরিবর্তে স্বাধীন কমিশন হিসেবে দুদক গঠন করা হয়। আইন অনুসারে দুদক একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন হলেও বাস্তবে তা গঠিত হওয়ার পরের দুই দশক স্রেফ ক্ষমতাসীন দলের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করেছে। এর অন্যতম কারণ হলো বর্তমানে বাছাই কমিটির মাধ্যমে যেভাবে দুদকের কমিশনার নিয়োগ করা হয়, তাতে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সুস্পষ্ট প্রভাব থাকে।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত দুদক সংস্কার কমিশন এ সমস্যার সমাধানে কমিশনার নিয়োগে বিদ্যমান ‘বাছাই কমিটি’র বদলে একটি ‘বাছাই ও পর্যালোচনা কমিটি’ গঠনের সুপারিশ করেছিল, যেখানে সরকারের নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের প্রতিনিধিত্বের পাশাপাশি বিরোধী দল ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে অভিজ্ঞ নিরপেক্ষ ব্যক্তির অন্তর্ভুক্তির কথা বলা হয়েছিল। এই কমিটি সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড অনুসরণ করে স্বচ্ছতার সঙ্গে নিরপেক্ষ ও অভিজ্ঞ কমিশনার বাছাই করবে। সেই সঙ্গে দুদকের কাজের ষাণ্মাসিক পর্যালোচনা, গণশুনানি আয়োজন ও পরামর্শ প্রদান করবে।
আরও পড়ুনরাজনীতি ও আমলাতন্ত্রে সংস্কার ছাড়া দুর্নীতি দমন অসম্ভব০৮ ডিসেম্বর ২০২৪এ বিষয়ে জুলাই সনদে সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐকমত্যও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) অভিযোগ করেছে, অন্তর্বর্তী সরকার বাছাই ও পর্যালোচনা কমিটি গঠনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সুপারিশ বাদ দিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন অধ্যাদেশ চূড়ান্ত অনুমোদন করেছে।
জুলাই সনদে স্বাক্ষরকারী সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য ও সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সম্মতির পরও চূড়ান্ত অধ্যাদেশে এ সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার বিষয়টি রাষ্ট্র সংস্কারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সরকারের অনাগ্রহের ইঙ্গিত বলে উল্লেখ করেছে টিআইবি। বাছাই ও পর্যালোচনা কমিটি ছাড়াও চূড়ান্ত অধ্যাদেশে আরও কিছু ঐকমত্য অর্জিত গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সুপারিশ বাদ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে টিআইবি, যা সরকারের অভ্যন্তরে স্বার্থান্বেষী ও প্রভাবশালী মহলের দুর্নীতি-সহায়ক ও সংস্কার পরিপন্থী অবস্থান ছাড়া আর কিছু হতে পারে না বলে মনে করে টিআইবি। (রাষ্ট্র সংস্কার কি সরকারের কাছে শুধুই ফাঁকা বুলি, প্রশ্ন টিআইবির, প্রথম আলো, ২৮ নভেম্বর ২০২৫)
এভাবে নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতির ক্ষমতা ছাড়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন বাছাই কমিটির সুপারিশে গঠিত পুলিশ কমিশন নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারবে না। একইভাবে বাছাই ও পর্যালোচনা কমিটি–সংক্রান্ত সুপারিশ বাস্তবায়িত না হলে দুদকে আগের মতোই ক্ষমতাসীনদের কথায় চলবে। অন্যদিকে পুলিশ ও দুদক সংস্কার হয়ে গেছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলে দেওয়া হবে। এভাবে চালাকি করে ওপরে ওপরে সংস্কার করে বাহবা নেওয়া গেলেও তা গণতান্ত্রিক রূপান্তরে কোনো ভূমিকা রাখবে না।
পরিস্থিতি এ রকম যে একদিকে বহু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না, অন্যদিকে যেসব সংস্কার বাস্তবায়িত হচ্ছে, সেগুলোর অনেকগুলো দায়সারাভাবে করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত এ ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা।
শুধু সংখ্যা নয়, সংস্কারের গুণগত মান নিশ্চিত করাও গুরুত্বপূর্ণ। সুপারিশে ঠিক কী ছিল আর বাস্তবায়ন ঠিক কতটুকু হয়েছে, সেটিও পরিষ্কার করতে হবে। এ জন্য সরকারকে সব কমিশন, টাস্কফোর্স ও কমিটিগুলোর দেওয়া সব সুপারিশের তালিকার পাশে কোনটা কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে, একটা কেন্দ্রীয় ওয়েবসাইটে তার বিস্তারিত প্রকাশ করতে হবে।
কল্লোল মোস্তফা বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক
ই–মেইল: [email protected]
*মতামত লেখকের নিজস্ব