মার্কিন সরকারের নতুন শুল্কনীতিতে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য যুদ্ধের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। কানাডা, মেক্সিকো এবং চীন ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন নীতির বিরুদ্ধে নিজ নিজ অবস্থান থেকে পাল্টা পদক্ষেপ নিয়েছে ইতোমধ্যে। মেক্সিকো ও কানাডার জন্য ২৫ শতাংশ এবং চীনের পণ্যের জন্য ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপের আদেশ দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ২০১৮ সালেও চীনের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধ করেছেন তিনি। চীনা পণ্যে ২৫ শতাংশ কর বসিয়েছিলেন। সেবারও চীন পাল্টা ২৫ শতাংশ করা বসিয়েছে আমেরিকান পণ্যে। সমানে সমান। এবার শুধু চীন নয়। দুই প্রতিবেশী ছাড়াও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোকেও এ তালিকায় আনছেন ট্রাম্প। ফলে বিশ্বের পরাশক্তির সঙ্গে সম্পর্ক কোন দিকে যাবে তা কঠিন সমীকরণের বিষয়। 


মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ক্লাউদিয়া সেনবাউম ও চীনের পক্ষ থেকে পাল্টা ব্যবস্থার হুমকি দিলেও কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ইতোমধ্যে ১৫৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যের মার্কিন পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে দিয়েছেন। তাৎক্ষণিকভাবে ৩০ বিলিয়ন ডলারের ওপর শুল্ক কার্যকর হলেও বাকি ১২৫ বিলিয়ন ডলারের মূল্যের মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক কার্যকর হবে ২১ দিনের মধ্যে।
বিশ্বের অনেক বড় ক্রেতা আটলান্টিক পারের দেশটি। আমেরিকার সঙ্গে বিভিন্ন দেশের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ অনেক। ২০২১ সালে দেশটির আমদানি ও রপ্তানির ব্যবধান ছিল আট লাখ ৮৪ হাজার ৭০ মিলিয়ন ডলার। ২০২২ সালে ৯ লাখ ৪৪ হাজার ৭৬২ ডলার। ২০২৩ সালে ৭ লাখ ৮৪ হাজার ৮৯০ ডলার। ২০২৩ সালে আমেরিকা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করেছে ৩ দশমিক শূন্য ৭ ট্রিলিয়ন ডলারের পণ্য ও সেবা; যার বিপরীতে তারা আমদানি করেছে তিন দশমিক ৮৫ ট্রিলিয়ন ডলারের। সেবা ও সার্ভিসে আমেরিকা এগিয়ে থাকলেও পণ্যের (গুডস) জন্য নির্ভরশীল থাকতে হয় অন্যান্য দেশের ওপর। আমদানি পণ্যের ৪০ শতাংশের যোগান দেয় চীন, কানাডা ও মেক্সিকো। এই সময়ে চীন, ব্রাজিল, ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরব ও ব্রিকসের অন্যান্য দেশে প্রায় ২৯৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য জোগান দেয়। এসব দেশ থেকে আমদানি করা হয় প্রায় ৬৫০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। ২০২৩ সালের চীনের রপ্তানি তথ্যের হিসাবে আমেরিকা তাদের তৃতীয় শীর্ষ রপ্তানি বাজার। তবুও পরস্পরের মধ্যে চলছে পাল্টাপাল্টি শুল্ক আরোপ যুদ্ধ!


অল্প কিছুদিন আগে পুরো বিশ্ব একটি মহামারি মোকাবিলা করেছে। করোনা মহামারির ধকল এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি বিশ্বের অনেক দেশ। ভেঙে পড়া অর্থনীতির মেরুদণ্ড সোজা করতে শুরু করার দেশগুলোর জন্য ব্যাপক ভোগান্তি অপেক্ষা করছে এই নতুন বাণিজ্য যুদ্ধের দামামায়। তার ওপর মধ্যপ্রাচ্য এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষত বহন করতে হচ্ছে পুরো বিশ্বকে। চলমান এবং নিকট অতীতের দগদগে ক্ষতগুলোর মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হলে ফসল উৎপাদনকারী দেশগুলো নিজেদের চাহিদার বাইরে আর উৎপাদন করবে না। বাণিজ্য বিপণন সংকোচনের কারণে উৎপাদনকারী দেশগুলো যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তেমনি ভোক্তা দেশগুলোর গ্রাহকদের জীবনযাত্রার ব্যয়ও বেড়ে যাবে। শুল্কবৃদ্ধি করে উৎপাদিত পণ্যের বাজার সংকুচিত করতে গিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের পাশাপাশি ইউরোপীয় দেশগুলোকেও সংকটের মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছে কিনা তাও ভাবনার বিষয়। 
ভোক্তা, ব্যবসায়ী এবং উৎপাদনকারী তিন পক্ষের ব্যাপক ক্ষতির শুধু আশঙ্কা নয়, নিশ্চয়তাই হচ্ছে বৈশ্বিক বাণিজ্যিক যুদ্ধ।


সর্বশেষ বাণিজ্য যুদ্ধ ধরা হয় ২০১৮ সালে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টাপাল্টি ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপকে। চীনা পণ্যের ওপর ৩ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলারের শুল্ক আরোপ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। জবাবে চীন সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫৪৫টি পণ্যের ওপর একই হারে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে; যার আর্থিক পরিমাণ প্রায় ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার ছিল। তখনকার বাণিজ্য যুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্বে জিন্স, মোবাইল ফোন, ছাতা, খেলনা, নিত্যপ্রয়োজনীয় ও গৃহস্থালি সামগ্রী এমনকি যৌন সামগ্রীর দামও বেড়ে যায় হুহু করে। প্রভাব পড়ে বিশ্বের অপরাপর দেশগুলোর ওপরও। এবারের মার্কিন শুল্কের চাপ যেহেতু শুধু চীন নয় মেক্সিকো এবং কানাডার ওপরও দেওয়া হয়েছে তাই শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, ভারত এবং ভিয়েতনামের জন্য বাণিজ্যে প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার দরজা খুলতে পারে। এ দেশগুলোর বিপণন ঝুড়িতে যেসব সামগ্রী রয়েছে তার বেশির ভাগই যুক্তরাষ্ট্র আমদানি করত চীন থেকে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের চাহিদা অনুযায়ী এরা জোগান নিশ্চিত করতে পারে না। 

বর্তমান সময়ে বিশ্ব অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে চলমান বাণিজ্য যুদ্ধ। এরমধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্টের নতুন নীতিতে যুক্ত হয়েছে মেক্সিকো, কানাডা আর ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো। পুরোনো বাণিজ্যিক বৈরিতার পাশাপাশি চীনের সঙ্গে দ্বন্দ্বকে নতুন মেয়াদে দায়িত্ব নিয়েই আরও এক ধাপ উস্কে দিলেন ট্রাম্প। পুরো বিষয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি সারা দুনিয়ার জন্য কতটা বিপর্যয় ডেকে আনবে তা কেবল সময় বলতে পারে। 


প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে বিশ্বায়নের ধস এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে বিশ্বায়নের পুনরুত্থান দাবি করা হয়। কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বনেতাদের আন্তরিক এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে বিশ্ব বাণিজ্যের বাধাগুলো পুরোপুরি দূর করা না গেলেও চেষ্টা শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে বৈদেশিক বাণিজ্যের বাধাগুলো কমে আসতে শুরু করে। 
১৯৮৬-১৯৯৪ সালে উরুগুয়ে সম্মেলনের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ডব্লিউটিও; যার মূল লক্ষ্য ছিল বাণিজ্য সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা দূর করে সবার জন্য সমান ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা তাদের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য হিসেবে বিশ্ব বাণিজ্যের প্রসার; মুক্ত বাণিজ্যের প্রসার; বাণিজ্যের অশুল্ক বাধাগুলো দূর করা; বাণিজ্য বাধা দূর করা; এবং বিরোধ নিষ্পত্তিতে সহায়তা করা–এ পাঁচটি বিষয়কে উল্লেখ করলেও মার্কিন প্রশাসনের এই নতুন শুল্ক নীতিতে কী করতে পারবে তা দেখার অপক্ষা করতে হবে। খুব বেশি কিছু করতে পারবে এমনটা আশা করাটাও বোকামি হতে পারে। তবুও আশা করতে দোষ নেই। প্রত্যাশা মানুষকে নিয়ে, মানুষের জন্য চলমান থাকুক মানবিক অর্থনীতির চাকা।


মো: আবু সাঈদ: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: শ শ ল ক আর প আম র ক র জন য দ র কর আমদ ন উৎপ দ

এছাড়াও পড়ুন:

সুদানে কারা গণহত্যা চালাচ্ছে, আরব আমিরাতের ভূমিকা কী

২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে সুদান এক ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের মধ্যে পড়ে। ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নিতে দেশটির সামরিক বাহিনী এবং শক্তিশালী আধা সামরিক গোষ্ঠী র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের (আরএসএফ) মধ্যে শুরু হওয়া তীব্র লড়াই থেকে এই গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে পশ্চিম দারফুর অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হয় এবং সেখানে গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার অভিযোগও ওঠে।

সম্প্রতি আরএসএফ এল-ফাশের শহরটি দখল করার পর এর বাসিন্দাদের নিয়ে বড় ধরনের উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এই সংঘাতে এখন পর্যন্ত সারা দেশে দেড় লাখের বেশি মানুষ মারা গেছেন এবং প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন। জাতিসংঘ এটিকে বিশ্বের বৃহত্তম মানবিক সংকট বলে অভিহিত করেছে।

পাল্টাপাল্টি অভ্যুত্থান ও সংঘাতের শুরু

১৯৮৯ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা দীর্ঘদিনের প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরকে ২০১৯ সালে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকেই দফায় দফায় যে উত্তেজনা চলছিল, তার সর্বশেষ পরিস্থিতি হচ্ছে বর্তমান গৃহযুদ্ধ।

বশিরের প্রায় তিন দশকের শাসনের অবসানের দাবিতে বিশাল জনবিক্ষোভ হয়েছিল। তারই প্রেক্ষিতে তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয় সেনাবাহিনী। কিন্তু দেশটির মানুষ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন চালিয়ে যায়। যার পরিপ্রেক্ষিতে একটি যৌথ সামরিক-বেসামরিক সরকার গঠিত হয়। কিন্তু ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে আরও একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকারটিকে উৎখাত করা হয়। এই অভ্যুত্থানের কেন্দ্রে ছিলেন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান ও দেশটির কার্যত প্রেসিডেন্ট জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান এবং তাঁর ডেপুটি ও আরএসএফ নেতা জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালো।

এই দুই জেনারেল দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ ও বেসামরিক শাসনে ফিরে যাওয়া নিয়ে প্রস্তাবিত পদক্ষেপে একমত হতে পারেননি। তাঁদের মধ্যে মূল বিরোধের বিষয় ছিল প্রায় এক লাখ সদস্যের আরএসএফ-কে সেনাবাহিনীর সঙ্গে একীভূত করার পরিকল্পনা এবং নতুন এই যৌথ বাহিনীর নেতৃত্ব নিয়ে। ধারণা করা হয়, দুজন জেনারেলই তাঁদের ক্ষমতা, সম্পদ ও প্রভাব ধরে রাখতে চেয়েছিলেন।

আরএসএফ সদস্যদের দেশের বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন করা হলে সেনাবাহিনী বিষয়টিকে নিজেদের জন্য হুমকি হিসেবে দেখে। এ নিয়ে ২০২৩ সালের ১৫ এপ্রিল দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি শুরু হয়। সেই লড়াই দ্রুত তীব্র আকার ধারণ করে এবং আরএসএফ খার্তুমের বেশির ভাগ অংশ দখল করে নেয়। যদিও প্রায় দুই বছর পর সেনাবাহিনী খার্তুমের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায়।

জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান (বামে) এবং আরএসএফ নেতা জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালো (ডানে)

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সুদানে কারা গণহত্যা চালাচ্ছে, আরব আমিরাতের ভূমিকা কী