ইউরোপে বিভক্তি তৈরির মার্কিন চেষ্টা
Published: 22nd, February 2025 GMT
ডোনাল্ড ট্রাম্পের মার্কিন সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার একমাসও হয়নি, এর মধ্যেই তারা বিশ্বজুড়ে রণহুঙ্কার ছাড়ছে। নিজেদের অর্থনৈতিক সুবিধা নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র ইচ্ছাকৃতভাবে ইউরোপ তথা ইউরোপীয় ইউনিয়নকে দুর্বল ও বিভাজন তৈরির চেষ্টা করছে বলে বলা হচ্ছে। জার্মানির মিউনিখে সদ্য সমাপ্ত নিরাপত্তা সম্মেলনে সেই বার্তাই পেয়েছেন ইউরোপীয় নেতারা।
তিন দশক আগেই পূর্ব আর পশ্চিমের মধ্য স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হয়েছে। তবু এখন ইউক্রেন আর গাজা উপত্যকার যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বড় অশান্তি তৈরি হয়েছে দুনিয়াজুড়ে। এর প্রতিক্রিয়ায় ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। এমন একসময়ে নিরাপত্তা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো মিউনিখে।
নব্বইয়ের দশকে স্নায়ুযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক অবসানের আগেই জার্মানির রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবী সমাজ শান্তি ও নিরাপত্তার পক্ষে নানা উদ্যোগ নিতে শুরু করে। এমনকি তীব্র স্নায়ুযুদ্ধের কালেও ১৯৬৩ সালে রাজনীতিক, গবেষক ও নাগরিক সমাজকে নিয়ে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার বিষয়ে মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনের উদ্যোগ শুরু হয়। তবে প্রথম এক দশক সেই সম্মেলন ব্যাপক আন্তর্জাতিক সাড়া জাগাতে পারেনি। শুধু যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো জোটভুক্ত দেশগুলোই এতে অংশ নিত। পরবর্তীকালে এর ব্যাপ্তি বেড়েছে।
১৪ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া ৬১তম মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনের প্রথম দিনেই মার্কিন ভাইস জে ডি ভ্যান্স তাঁর বক্তব্যে ইউরোপীয় মিত্রদের তীব্র আক্রমণ করে কথা বলেন। সতর্ক করেন গণতন্ত্রের জন্য হুমকির বিষয়গুলো নিয়ে। তিনি ইউরোপের বেশির ভাগ দেশগুলোর সমালোচনা করে বলেন, ইউরোপের দেশগুলো তাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ থেকে সরে আসছে। তিনি দেশগুলোর অভিবাসন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি কথিত হুমকির সমালোচনা করেন। এই বক্তব্যে জে ডি ভ্যান্স ইউরোপের নানা দেশে কট্টরবাদী দলগুলোকে আরও মুক্তভাবে রাজনীতি ও সহযোগিতা করার কথা বলেন।
বিশ্বব্যাপী ডানপন্থী রাজনীতি ক্রমেই প্রভাব বিস্তার করছে। এর বিস্তার ঘটেছে ইউরোপের নানা দেশেও। জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরিতে এখন কট্টরপন্থী দলগুলোর রমরমা। ২০২৪ সালের ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচনে রক্ষণশীল ও অতি ডানপন্থী দলগুলো বড় সফলতা পেয়েছে।
ইউরোপীয় রাজনীতিতে এই ডানপন্থা রাজনীতির সুযোগে তাকে আরও উসকে দিচ্ছেন সদ্য ক্ষমতাসীন মার্কিন রাজনীতিকেরা। এই কৌশলের একটি মূল চালিকাশক্তি হলো মার্কিন রাজনীতিতে অর্থনৈতিক অভিজাতদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব। আদতে মার্কিন এসব রাজনীতিকদের কাছে ন্যায়নীতি, শান্তি বা সৌহার্দ্যের কোনো বার্তা নেই। যা আছে, তা হলো বিদ্বেষ ও পুঁজিবাদী অর্থনীতির উন্নয়ন।
মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনের বিদায়ী চেয়ারম্যান ক্রিস্টোফ হিউসজেন এ বছরের সম্মেলনটিকে ‘এখন পর্যন্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা সম্মেলনগুলোর মধ্যে একটি’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ভ্যান্সের বক্তব্যের পর, ‘আমাদের সাধারণ মূল্যবোধ আর এত সাধারণ নেই’ তাই আশঙ্কার কারণ রয়েছে বলে জানিয়েছেন।১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির পর মধ্য ইউরোপের ভগ্নপ্রায় দেশগুলো নিজেদের মধ্যে আবার ইউরোপীয় ঐক্য প্রচেষ্টার ওপর জোর দিয়েছিল। নব্বইয়ের দশকে স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তির পর পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে উঠছিল। তখন থেকেই মার্কিনদের কাছে ইউরোপীয় ঐক্য প্রচেষ্টা পছন্দ হচ্ছিল না। ইউরোপে অকারণে ন্যাটো জোটের সম্প্রসারণ এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কিছু উসকানিমূলক সিদ্ধান্ত ইউরোপের বৃহত্তম ঐক্য প্রচেষ্টায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
পশ্চিমা রাজনীতির অনেক সমালোচনা বা ক্ষেত্র বিশেষে যুদ্ধবাজ মার্কিনদের পক্ষে লেজুড়বৃত্তি করলেও ইউরোপ অন্য মহাদেশের তুলনায় উন্নত গণতন্ত্র, মৌলিক অধিকার, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হোতা জার্মানি বিশ্ব–যুদ্ধোত্তর রাজনৈতিক নেতারা নাৎসি অতীতকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করে সহনশীলতা, সংহতি ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের ওপর ভিত্তি করে একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ভিত্তি রচনা করেছেন। জার্মান গণতন্ত্র একটি স্পষ্টনীতি অনুসরণ করেছে। তা হলো বহুত্ববাদবিরোধী শক্তিগুলোকে বাদ দেওয়া উচিত নয়। তাই নব্য নাৎসি দলগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়নি শুধু এই কারণে যে গোষ্ঠীগুলো নিষিদ্ধ হলে গোপনে আরও বিপজ্জনকভাবে কাজ করতে পারে। এ ধরনের নীতি মধ্য ইউরোপের অনেক দেশেই বহাল আছে।
ক্ষমতায় আসার চার সপ্তাহ পূর্ণ না হতেই ইউরোপীয় রাজনীতিকদের সমালোচনায় মেতেছে মার্কিন রাজনীতিকেরা। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্সের সমালোচনার জবাবে চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজসহ জার্মান রাজনীতিকেরা জে ডি ভ্যান্সকে রাজনীতিতে সংযত হতে বলেছেন।
১৪ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া ৬১তম মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনের প্রথম দিনেই মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্সের বক্তব্যকে জার্মানির সংবাদ মাধ্যমগুলোসহ ইউরোপীয় রাজনীতিকেরা তীর্যক চোখে দেখছেন। সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ আসন্ন জার্মান নির্বাচনী প্রচারণায় বিদেশি যেকোনো নেতার হস্তক্ষেপের প্রত্যাখ্যান করেন। শলৎজ তাঁর বক্তব্যের শুরুতে জে ডি ভ্যান্সকে মিউনিখ শহরের নিকটবর্তী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ডাখাউ বন্দিশিবির ও স্মৃতিসৌধ পরিদর্শনের জন্য ধন্যবাদ জানান। আর ইউরোপের নাৎসিবাদী দলগুলোর সঙ্গে তাদের মাখামাখির সমালোচনা করেন।
উল্লেখ্য জার্মানির মিউনিখে পৌঁছানোর পরই মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং তাঁর স্ত্রী মিউনিখের অনতিদূরে ডাখাউ বন্দিশিবির পরিদর্শন করেন। বন্দিশিবিরে গিয়ে জে ডি ভ্যান্স বলেছিলেন যে নাৎসিবাদের পুনরাবৃত্তি কখনো হওয়া উচিত নয়। অথচ পরের দিনই তিনি যাঁরা সেই ভয়াবহ ঘটনাগুলো তুচ্ছ করে দেখেন, জার্মানির সেই নব্য নাৎসি অলটারনেটিভ ফর ডয়েচল্যান্ড দলের নেত্রীর সঙ্গে সৌহার্দ্যমূলক আলোচনা করেন।
সেই বক্তব্যে জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ আরও বলেন, ‘আমরা আমাদের গণতন্ত্রে, আমাদের নির্বাচনে, আমাদের মতামত গঠনে বহিরাগতদের হস্তক্ষেপ মেনে নেব না। .
জার্মানির ভাইস চ্যান্সেলর রবার্ট হ্যাবেক মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্সের সাম্প্রতিক বক্তব্য নিয়ে বলেন, ‘তাঁর আচরণে আমরা উদ্বিগ্ন। যুক্তরাষ্ট্রে মৌলিক গণতান্ত্রিক ধারণাগুলো যখন নির্মমভাবে হ্রাস করা হচ্ছে, তখন সেই দেশের একজন রাজনীতিকের মুখে এ কথা শোভা পায় না।’ তিনি জে ডি ভ্যান্সকে কর্তৃত্ববাদী রাজনীতির ধারক বলে উল্লেখ করেন।
নিরাপত্তা সম্মেলনে ভ্যান্সের বক্তব্যের পর ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিন নোয়েল ব্যারোট বলেন, এই পরিস্থিতিতে ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ ‘শীঘ্রই ইউরোপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোকে’ আলোচনার জন্য একত্র করবেন।
জার্মানি ক্রিশ্চিয়ান গণতান্ত্রিক দলের নেতা এবং সম্ভাব্য আগামী চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্ৎস একটি সার্কুলার ইমেলে লিখেছেন যে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে এখন সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। তিনি লেখেন, ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে ক্ষমতাসীন হওয়ায় ইউরোপের রাজনৈতিক শৃঙ্খলা এখন হুমকির মুখে। এটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে আগামীতে আন্তআটলান্টিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ফাটল দেখা দিতে পারে।’
মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনের বিদায়ী চেয়ারম্যান ক্রিস্টোফ হিউসজেন এ বছরের সম্মেলনটিকে ‘এখন পর্যন্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা সম্মেলনগুলোর মধ্যে একটি’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ভ্যান্সের বক্তব্যের পর, ‘আমাদের সাধারণ মূল্যবোধ আর এত সাধারণ নেই’ তাই আশঙ্কার কারণ রয়েছে বলে জানিয়েছেন।
সম্মেলনের শেষ দিন মিউনিখ শহরের ঐতিহ্যবাহী শান্তিমিছিলের প্ল্যাকার্ডগুলোতে লেখা ছিল বিশ্বজুড়ে শান্তি আর সৌহার্দ্যের কথা। সেখানে অনেকে বহন করে, ‘ভ্যান্স গো হোম’ লেখা প্ল্যাকার্ড।
সরাফ আহমেদ প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি
ই–মেইল: [email protected]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন র জন ত ক র গণত ন ত র ক গণতন ত র ইউর প য় ইউর প র আম দ র জন ত র র জন য র র জন দলগ ল প রথম সবচ য ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেভাবে সুষ্ঠু ভোটে বাধা হতে পারে
বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিয়ে ইতিমধ্যে প্রশ্ন ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সেখানে এআইয়ের (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) ব্যবহার এক নতুন ধরনের হুমকি নিয়ে এসেছে। এটি শুধু প্রচলিত কারচুপির পদ্ধতিগুলোকেই আরও সফিসটিকেটেড বা কৌশলী করে তুলবে না; বরং আমাদের গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি যে জনগণের বিশ্বাস, সেটিই নষ্ট করে দিতে পারে।
নির্বাচনে এআইয়ের প্রভাব কোনো কাল্পনিক গল্প নয়, এটি একটি বাস্তব ঝুঁকি। এআই-চালিত টুলগুলো ব্যবহার করে রাজনৈতিক নেতা বা কর্মকর্তাদের অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য ‘ডিপফেক’ (ভুয়া অডিও, ভিডিও এবং ছবি) তৈরি করা সম্ভব।
এই ডিপফেকগুলো সহজেই মিথ্যা কেলেঙ্কারি ছড়াতে পারে, যা ভোটারদের বিভ্রান্ত করে তাঁদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এআই-চালিত বটগুলো সেকেন্ডের মধ্যে এমন সব মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দিতে পারে, যা একটি রাজনৈতিক দলের জন্য ব্যাপক জনসমর্থনে বা বিরোধিতায় ভূমিকা রাখতে পারে।
যখন জনগণ দেখতে পাবে, তারা যা দেখছে বা শুনছে, তার মধ্যে কোনটা আসল আর কোনটা নকল, তা বোঝা কঠিন, তখন স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্যে সংবাদমাধ্যম, নির্বাচন কর্তৃপক্ষ এবং পুরো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিষয়ে সন্দেহ ঢুকে যাবে। এটি একটি দেশের স্থিতিশীলতার জন্য দীর্ঘমেয়াদি হুমকি।
এআই অ্যালগরিদমগুলো বিশাল পরিমাণ ডেটা বিশ্লেষণ করে নির্দিষ্ট ভোটারদের লক্ষ করে তাদের ব্যক্তিগত আগ্রহ ও দুর্বলতা অনুযায়ী রাজনৈতিক বার্তা পাঠাতে পারে। এই ‘মাইক্রো টার্গেটিং’-এর মাধ্যমে ভোটারদের মনোভাবকে প্রভাবিত করা বা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে ভোটদানের সময় বা স্থান সম্পর্কে ভুল তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে তাদের ভোটদান থেকে বিরত রাখাও সম্ভব।
আমাদের গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখতে হলে এই নতুন প্রযুক্তির ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবেএআই শুধু মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, এটি নির্বাচনী পরিকাঠামোর ওপর সাইবার হামলাও জোরদার করতে পারে। এআই-চালিত টুলগুলো আরও সফিসটিকেটেড ফিশিং আক্রমণ তৈরি করে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের অ্যাকাউন্ট হ্যাক করতে বা এমন ম্যালওয়্যার তৈরি করতে পারে, যা প্রচলিত নিরাপত্তাব্যবস্থা এড়িয়ে যেতে সক্ষম। এ ধরনের আক্রমণ ভোটার ডেটাবেজ বা ভোটিং মেশিনকে লক্ষ্য করে করা যেতে পারে। সেটি নির্বাচনের ফলাফল পরিবর্তন বা পুরো প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করতে পারে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিপত্তির সমাধান কী? এ প্রশ্নের জবাব হিসেবে প্রথমেই মনে রাখা দরকার, এই গুরুতর চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় একটি সমন্বিত ও কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন। এখানে এক্সপ্লেইনেবল এআই (এক্সএআই) একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এআই মডেলের সিদ্ধান্তগুলো মানুষের কাছে বোধগম্য করে তোলে এক্সএআই। এটি এআইয়ের স্বচ্ছতা বাড়ায়।
ডিপফেক শনাক্তকরণ: এক্সএআই ব্যবহার করে এমন টুল তৈরি করা সম্ভব, যা কেবল ডিপফেক শনাক্ত করে না; বরং কেন একটি বিষয়বস্তু জাল বলে চিহ্নিত হয়েছে, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যাও দেয়। এর ফলে মানব ফ্যাক্ট-চেকাররা বিশ্লেষণ যাচাই করতে পারেন এবং জনগণের আস্থা তৈরি হয়।
প্রচারণার নিরীক্ষা: এক্সএআই রাজনৈতিক প্রচারণায় এআই ব্যবহারের নিরীক্ষা করতে পারে। এটি বিশ্লেষণ করে দেখাতে পারে, কীভাবে একটি অ্যালগরিদম তার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা পক্ষপাতদুষ্ট বা কারসাজিমূলক টার্গেটিং কৌশলগুলো প্রকাশ করতে সাহায্য করে।
নিরাপত্তা বৃদ্ধি: সাইবার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এক্সএআই হুমকির শনাক্তকরণ সিস্টেমকে উন্নত করতে পারে। এটি ব্যাখ্যা করতে পারে, কেন একটি নির্দিষ্ট কার্যকলাপকে ক্ষতিকর বলে মনে করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়া নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের দ্রুত এবং কার্যকরভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে সাহায্য করে।
অংশগ্রহণকারীদের করণীয়: এআইয়ের হুমকি মোকাবিলায় সব গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণকারীকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। প্রথমত, রাজনৈতিক দলগুলো এবং নেতাদের প্রকাশ্যে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে, তাঁরা প্রতারণামূলক এআই জেনারেটেড কনটেন্ট বা ভুল তথ্য ছড়ানোর প্রচারে জড়িত হবেন না। তাঁদের উচিত এআইয়ের যেকোনো বৈধ ব্যবহার সম্পর্কে স্বচ্ছ থাকা এবং এআই জেনারেটেড কনটেন্টে সুস্পষ্ট লেবেল ব্যবহার করা। দ্বিতীয়ত, নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক প্রচারে এআই ব্যবহারের বিষয়ে সুস্পষ্ট নিয়ম ও প্রবিধান তৈরি এবং প্রয়োগ করতে হবে। তাদের উচিত এআই-চালিত টুলগুলোতে বিনিয়োগ করা এবং ভোটারদের সচেতন করার জন্য বড় আকারের প্রচার চালানো।
এ ছাড়া একটি যৌথ গবেষণা ও উন্নয়ন দল গঠন করা প্রয়োজন, যারা নির্বাচনের আগপর্যন্ত কমিশনকে এআই এবং সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে নিরবচ্ছিন্ন সহায়তা দেবে। তৃতীয়ত, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সংবাদমাধ্যম এবং সুশীল সমাজকে এআইয়ের হুমকি সম্পর্কে তথ্য আদান-প্রদান করতে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে পড়লে তা দ্রুত মোকাবিলা করার জন্য একটি সুস্পষ্ট প্রটোকল স্থাপন করা জরুরি। সংবাদমাধ্যম এবং সুশীল সমাজের উচিত ফ্যাক্ট-চেকিং এবং জনগণের মধ্যে মিডিয়া লিটারেসি বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা।
আমাদের গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখতে হলে এই নতুন প্রযুক্তির ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে। এআইয়ের ক্ষমতা যেমন বিশাল, তেমনি এর অপব্যবহারের বিপদও কম নয়।
জনগণের বিশ্বাস এবং একটি ন্যায্য নির্বাচনের অধিকার নিশ্চিত করতে এখনই আমাদের সবাইকে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো, বাংলাদেশ সরকারের একটি সম্মিলিত গবেষণা ও উন্নয়ন (আরএনডি) দল গঠন করা। এই বিশেষজ্ঞ দল এআই-সম্পর্কিত ঝুঁকিগুলো ক্রমাগত বিশ্লেষণ ও অনুমান করবে এবং দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করবে।
অধ্যাপক ড. আলমগীর হোসেন এআইয়ের সাবেক অধ্যাপক, যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজে অবস্থিত এআরআইটিআইয়ের সাবেক পরিচালক