রাষ্ট্র ও রাজনীতির পুরোনো ক্ষতের পুনরাবৃত্তি
Published: 24th, February 2025 GMT
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের সমাজ ও রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন হবে– এটি মানুষের ন্যূনতম প্রত্যাশা। শাসন কাঠামোতে যে আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদ জগদ্দল পাথরের মতো গেড়ে বসেছিল, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সেখান থেকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণ সম্পূর্ণ হবে– এই বিবেচনা নিয়েও দ্বিমত থাকবার কথা নয়। সরকার ইতোমধ্যে নির্বাচন ও আইন-সংবিধানসহ প্রাসঙ্গিক বিষয়ে ৬টি সংস্কার কমিটির রিপোর্ট নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাজও শুরু করেছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনে পুরোনো ক্ষতের পুনরাবৃত্তি আমাদের শঙ্কিত করে তুলছে। সমকাল জানাচ্ছে, “জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি যেভাবে নেওয়া হচ্ছে, তাতে নতুনত্বের কিছু নেই। শেষ তিন সংসদ নির্বাচন বিতর্কিত হওয়ার পেছনে যারা ‘বড় অনুঘটক’ হিসেবে কাজ করেছে, সেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আর মাঠ প্রশাসনের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের নেই কোনো পরিকল্পনা” (২৪.
অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা বাহুল্য। কার্যত আমরা দেখছি, সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে আছে নির্বাচন কমিশন। প্রধান উপদেষ্টা বা উপদেষ্টাদের ভাষা অনুসরণে তাদের কথাবার্তা আমরা শুনছি। রোববার কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত সভায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার একেএম নাসিরউদ্দীন বলেছেন, ঈদের মতো আনন্দময় উৎসবের মতো করে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
প্রাতিষ্ঠানিক, আইনি ও কাঠামোগত সংস্কার না করে নির্বাচনে আনন্দ উৎসবের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে আওয়ামী লীগ আমলের নির্বাচন কমিশনের কোনো পার্থক্য আমরা দেখি না। সর্বশেষ ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ যখন প্রধান বিরোধী বিএনপিকে ছাড়াই যে কোনো উপায়ে ছলচাতুরীর নির্বাচন আয়োজনের বন্দোবস্ত চূড়ান্ত করছিল, তখন প্রতিবাদ-প্রতিরোধের মুখে ৯ নভেম্বর, ২০২৩ রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের পর বঙ্গভবনের সামনে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের বলেন, ‘যে কোনো মূল্যে আগামী ২৯ জানুয়ারির আগেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন করতে হবে’ (সমকাল, ১০ নভেম্বর, ২৩)।
প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে বাইরে রেখে নির্বাচনের আয়োজন চূড়ান্ত করবার জন্য এই ধনুর্ভঙ্গ পণ কেন করতে হয় সিইসি-কে? কেন তিনি বলতে পারেন না, সব দলের অংশগ্রহণে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরিতে বাধ্য সরকার। তখন আওয়ামী লীগের দুঃশাসন চলছিল। সিইসি তাদের হাতের পুতুল ছিলেন; তাই পারেননি। এখন? বর্তমান সিইসি নিশ্চয়ই অন্তর্বর্তী সরকারের ইশারায় চলেন না; তিনি বা তাঁর পরিষদের কেউই সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যেসব আইনি শৃঙ্খলার প্রয়োজন, তা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিচ্ছেন না। কেন? পুলিশ বাহিনীর তৎপরতা আগের তিনটি নির্বাচনে সরকারপক্ষের ছলচাতুরী বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। এবার পুলিশ বাহিনীর কার্যক্রম কোন প্রকারে নিরপেক্ষ রাখা হবে? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যারা নিজেরাই নির্বাচনে আইন ভঙ্গ করবেন, তাদের শনাক্ত করে বিচারের আওতায় নিয়ে আসবার প্রক্রিয়া নিয়ে নির্বাচন কমিশন আদৌ চিন্তিত? আমরা এই নিয়ে তাদের কোনো উদ্বেগের খবর পর্যন্ত জানি না।
আর নির্বাচনে একটি দলের প্রভাব? আওয়ামী লীগের বদলে অন্য কোনো দল যে এবারের নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারবে না– সেটি নিশ্চিত করবার পদক্ষেপের কথাও আমরা জানি না। নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ পত্রিকায় বলেছেন, ‘অতীতের নির্বাচনের পুনরাবৃত্তির কোনো সুযোগ নেই। আগের তিন নির্বাচনে যারা মাঠের দায়িত্বে ছিলেন, তাদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।’ মাঠ প্রশাসনকে ইসির নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য রদবদল একমাত্র উপায় নয়; এর জন্য প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট আইনি কাঠামো। সেটি নির্ধারণ না করে ‘তার’ লোকের বদলে ‘আমার’ লোক বসালে নির্বাচন আদৌ সুষ্ঠু হবে? ভোটার তালিকা চূড়ান্ত, রাজনৈতিক দল নিবন্ধন, সীমানা নির্ধারণসহ নির্বাচনী আইন সংশোধন ছাড়া নির্বাচনের দিন ‘ঈদ উৎসবের মতো আনন্দ’ সৃষ্টির বক্তব্য গত এক দশকে তিন নির্বাচনের সিইসির প্রগল্ভতা মনে করিয়ে দেয়। ঘরপোড়া গরুর সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পাওয়ারই কথা অবশ্য।
২.
গভীর রাতে সংবাদ সম্মেলন করে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম দুষলেন ‘আওয়ামী দোসরদের’– এই খবর বিডিনিউজ জানিয়েছে ২৪ ফেব্রুয়ারি। ভিডিওতে দেখতে পেলাম, মধ্যরাতে ঘুম থেকে উঠে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলছেন, দেশ থেকে প্রচুর টাকা নিয়ে গেছে আওয়ামী লীগাররা। তারা দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির জন্য এসব অর্থ ব্যয় করছে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কণ্ঠে আওয়ামী লীগ সরকারের কর্তাব্যক্তিদের মতো ‘কেষ্টা ব্যাটাই চোর’ বলার সেই পুরোনো কায়দা দেখতে পাই। সরকারের চেয়েও আওয়ামী লীগ লুটেরাদের দাপট বেশি? একজন উপদেষ্টা– দায়িত্বে বসে এ ধরনের কথা কোন যুক্তিতে বলেন? সরকার কি তাদের শনাক্ত করতে পেরেছে? কোনো প্রমাণ উপস্থিত করতে পেরেছেন?
রাজধানীতে ছিনতাই, রাহাজানি বেড়েছে। সামাজিক মাধ্যমে সাধারণ মানুষ লিখছেন, রাস্তায় বেরুতে তারা এটিএম কার্ড বহন করবার মতো সাহস পাচ্ছেন না! সন্ধ্যার পর বাসা থেকে বেরুতে ভয় পান বলেও অনেকে উল্লেখ করছেন। যেসব ধর্ষণকাণ্ডের কথা আমরা জানতে পারছি, তা সভ্য মানুষের মাথা নত করে দেয়। ধর্ষণ, নারী নির্যাতন ও আইনশৃঙ্খলার অবনতির প্রতিবাদে রাজধানীসহ দেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করছেন। ধর্ষণ, ছিনতাই, খুন নিয়ন্ত্রণ ও বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে না পারা সরকারের ব্যর্থতা। এটা স্বীকার করে সেই মতে পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে ‘সব দায় আওয়ামী দোসরদের’ উচ্চারণকে নিতান্ত ‘অসহায়ের আর্তনাদ’ বললেও কম বলা হয়। কথা নয়, কাজেই প্রকৃত সমাধান।
৩.
সমাজ ও রাজনীতির এসব পুরোনো ক্ষতের কি উপশম নেই? ছাত্র-জনতার ক্ষমতার অভ্যুত্থান হয়েছে দেশের ক্ষমতা কাঠামোয় পালাবদলসহ সাধারণ মানুষের জীবনযাপনে ইতিবাচক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষায়। নির্বাচন কমিশন বা উপদেষ্টাদের অনেকের কথা-আচরণ সেই আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই মেলে না।
রাজপথে সুযোগ সন্ধানও করছেন অনেকে। কথায় কথায় আন্দোলন, ভাঙচুরের মাধ্যমে অরাজকতা সৃষ্টির পেছনে কেবল পলাতক আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীকে দোষ দেওয়া সমাধান নয়। অধ্যাপক রওনক জাহান শনিবার সায়েমের সম্মেলনে বলেছেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্যাগিং আর নানা কারণে লোকজন স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারছে না। তাহলে আমরা সত্য কীভাবে প্রতিষ্ঠা করব?’
সব ধরনের ট্যাগিং সংস্কৃতির বাইরে বেরিয়ে আসতে হবে। গত এক যুগ জাতীয় নির্বাচনে যে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড দাবি করে এসেছে বিএনপি, এখন তাদের মুখে সে দাবি নেই কেন? নাকি এখন নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড আর লাগবে না? দেশের আনাচে-কানাচে প্রান্তিক গ্রামাঞ্চলে মানুষের ঘরে ঘরে মামলার আসামি। এক খুনের মামলায় দেড়শো, দুশো আসামি। অনেকেই ঘরে থাকতে পারছেন না। জুলাই-আগস্টে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও পুলিশের হাতে নৃশংসভাবে প্রায় দেড় হাজার মানুষ খুন হয়েছে, এটা যেমন সত্য; এ-ও সত্য যে, আওয়ামী লীগের কর্মী-নেতা সকলেই খুনি নন। আওয়ামী লীগ নিয়ে যৌক্তিক সমাধানে পৌঁছা তাই জরুরি। আর এসবের মাঝে সরকারের বড় এক দায়– গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের রক্ত আর আত্মার কাছে– হত্যাকাণ্ডের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করা।
চতুর্মুখী চাপের মধ্যে অবাধ গণতান্ত্রিক নির্বাচনই দেশকে সুষ্ঠু পথের সন্ধান দেবে। নির্বাচন কমিশনসহ অংশী সব পক্ষ যার যার কাজ সততার সঙ্গে পালন করলেই কেবল তা সম্ভব।
মাহবুব আজীজ: উপসম্পাদক, সমকাল; সাহিত্যিক
mahbubaziz01@gmail.com
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত সরক র র উপদ ষ ট র জন য ন ত কর র জন ত আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
এসএসসিতে অনুপস্থিতির বড় কারণ বাল্যবিবাহ
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অধীন এ বছরের এসএসসি পরীক্ষায় ছয় হাজারের বেশি পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল। তাদের মধ্য থেকে পাওয়া ১ হাজার ২০৩ জনের তথ্য বলছে, প্রায় ৪০ শতাংশের (৪৮১) বিয়ে হয়ে গেছে।
বিয়ে হওয়ার এ হার মেয়ে ও ছেলে মিলিয়ে। এ ছাড়া ৭ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল পারিবারিক অসচ্ছলতার জন্য কর্মক্ষেত্রে যোগ দেওয়ার কারণে। বাকিরা অসুস্থতা, প্রস্তুতি ভালো না থাকাসহ নানা কারণে পরীক্ষায় অংশ নেয়নি।
উদ্বেগের বিষয় হলো অনুপস্থিত ওই সব পরীক্ষার্থীর মধ্যে যাদের তথ্য পাওয়া গেছে, তাদের প্রায় ৫১ শতাংশ আর পড়াশোনা করবে না। বাকিরা বলেছে, পরবর্তী বছরে পরীক্ষা দেবে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ তাদের অধীন বিদ্যালয়গুলো থেকে এসব তথ্য পেয়েছে। এখন এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠানো হবে।
সারা দেশে এবারের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ফরম পূরণ করা পরীক্ষার্থীর সংখ্যা গতবারের চেয়ে প্রায় এক লাখ কম ছিল। বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে এবারই সবচেয়ে কম ছাত্রছাত্রী পরীক্ষা দিয়েছে।
বিয়ে হওয়ার এ হার মেয়ে ও ছেলে মিলিয়ে। এ ছাড়া ৭ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল পারিবারিক অসচ্ছলতার জন্য কর্মক্ষেত্রে যোগ দেওয়ার কারণে। বাকিরা অসুস্থতা, প্রস্তুতি ভালো না থাকাসহ নানা কারণে পরীক্ষায় অংশ নেয়নি।আবার এবার পরীক্ষার ফরম পূরণ করে অংশ না নেওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও ছিল অন্যান্যবারের তুলনায় বেশি। ১১টি শিক্ষা বোর্ডের অধীন এসব পরীক্ষার প্রথম দিনেই অনুপস্থিত ছিল ২৬ হাজার ৯২৮ পরীক্ষার্থী। অথচ গত বছর এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় প্রথম দিনে অনুপস্থিত ছিল ১৯ হাজার ৩৫৯ পরীক্ষার্থী।
প্রতিবছরই শিক্ষার্থীরা অনুপস্থিত থাকে, কিন্তু কারণ জানা হয় না। এ জন্য বিশেষজ্ঞরা অনুপস্থিতির প্রকৃত কারণ বের করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে নিজেদের বোর্ডের অধীন পরীক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির কারণ অনুসন্ধানের উদ্যোগ নেয় ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড। এ জন্য অনুপস্থিত পরীক্ষার্থীদের তথ্য নির্ধারিত গুগল ফরমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়। অনুপস্থিতির কারণ জানার জন্য পরীক্ষার্থী বা অভিভাবকের সঙ্গে সশরীর বা মুঠোফোনে যোগাযোগ করে তথ্য সংগ্রহ করা এবং কোন কোন পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত, তা জানার জন্য সংশ্লিষ্ট কেন্দ্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে নির্দেশ দিয়েছিল ঢাকা বোর্ড।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, এবার তাদের বোর্ডের অধীন ৬ হাজার ৩৮৯ পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল। তাদের সবার তথ্য জানা যায়নি। ১ হাজার ২০৩ পরীক্ষার্থীর অনুপস্থিতির কারণসহ তথ্য পেয়েছে ঢাকা বোর্ড। তার ভিত্তিতে একটি খসড়া প্রতিবেদন করা হয়েছে। এসব পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ফরম পূরণ করেও পরীক্ষা দেয়নি।
দেশে সাধারণত মেয়েরা বাল্যবিবাহের শিকার হয়। অনেক ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েদের পড়াশোনা বাদ দিতে হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা দেখেছেন, অনুপস্থিত মেয়ে পরীক্ষার্থীদের পাশাপাশি কিছু ছেলেরও বিয়ে হয়েছে।ঢাকা শিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, খসড়া প্রতিবেদন অনুযায়ী তথ্য পাওয়া ১ হাজার ২০৩ জন অনুপস্থিত পরীক্ষার্থীর মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশই ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের। ২৩ শতাংশ মানবিক বিভাগের ও ১৭ শতাংশ বিজ্ঞান বিভাগের। সাধারণত বিদ্যালয়গুলোয় পড়াশোনায় তুলনামূলকভাবে এগিয়ে থাকা শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান বিভাগে পড়ে। প্রাপ্ত তথ্য বলছে, এ বিভাগের শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির হার কম।
অনুপস্থিত থাকাদের মধ্যে নিয়মিত পরীক্ষার্থী প্রায় ৭০ শতাংশ। বাকি ৩০ শতাংশ অনিয়মিত পরীক্ষার্থী। উল্লেখ্য, আগের বছর অকৃতকার্য বা দু–এককটি বিষয়ে অকৃতকার্য হয়ে যারা এবার পরীক্ষা দিয়েছে, তাদের অনিয়মিত পরীক্ষার্থী বলা হয়।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, এবার তাদের বোর্ডের অধীন ৬ হাজার ৩৮৯ পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল। তাদের সবার তথ্য জানা যায়নি। ১ হাজার ২০৩ পরীক্ষার্থীর অনুপস্থিতির কারণসহ তথ্য পেয়েছে ঢাকা বোর্ড।ঢাকা বোর্ডের তথ্য বলছে, গ্রাম এলাকার শিক্ষার্থীরাই বেশি অনুপস্থিত থাকে। তথ্য প্রাপ্ত ১ হাজার ২০৩ জনের মধ্যে ৭৬ শতাংশের বেশি গ্রাম এলাকার শিক্ষার্থী। প্রায় ২৪ শতাংশ শহর এলাকার। সমতল এলাকায় মোট পরীক্ষার্থী বেশি হওয়ায় অনুপস্থিতিও সেখানে বেশি।
জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক এস এম কামাল উদ্দিন হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা যেসব তথ্য পেয়েছেন, সেগুলো প্রতিবেদন আকারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠাবেন, যাতে পরবর্তী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া যায়।
যেসব কারণে অনুপস্থিতিযেসব কারণে পরীক্ষার্থীরা অনুপস্থিত ছিল, সেগুলোও জানার চেষ্টা করেছে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড। বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, অনুপস্থিত পরীক্ষার্থীদের মধ্যে যাদের তথ্য পাওয়া গেছে (১ হাজার ২০৩ জন), তাদের প্রায় ৪০ শতাংশের বিয়ে হয়েছে।
দেশে সাধারণত মেয়েরা বাল্যবিবাহের শিকার হয়। অনেক ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েদের পড়াশোনা বাদ দিতে হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা দেখেছেন, অনুপস্থিত মেয়ে পরীক্ষার্থীদের পাশাপাশি কিছু ছেলেরও বিয়ে হয়েছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে অনুপস্থিত পরীক্ষার্থীদের মধ্যে কতজন মেয়ে এবং কতজন ছেলে, তা উল্লেখ করা হবে।
প্রাপ্ত তথ্য বলছে, ২১ জন (প্রায় ২ শতাংশ) মেয়ে পরীক্ষার্থী গর্ভধারণের কারণে পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিল।
আইনানুযায়ী, বাংলাদেশে মেয়েদের ১৮ বছর ও ছেলেদের ২১ বছরের নিচে বিয়ে হলে সেটিকে বাল্যবিবাহ বলা হয়। এসএসসি পরীক্ষার্থীদের বয়স সাধারণত ১৮ বছরের নিচে হয়। অবশ্য ব্যতিক্রমও আছে।
নিজের অসুস্থতার জন্য ২৪ শতাংশের (১ হাজার ২০৩ জনের মধ্যে) বেশি পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল। আর প্রস্তুতি ভালো না থাকার কারণে অনুপস্থিত ছিল ১১ শতাংশের বেশি। দারিদ্র্যের কারণও উঠে এসেছে এ তথ্যে। ৭ দশমিক ৩২ শতাংশ শিক্ষার্থী পারিবারিক অসচ্ছলতার জন্য কর্মক্ষেত্রে যোগ দিয়েছে। অনুপস্থিত পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ১৭ জন মারা গেছেন। এ ছাড়া পরিবারের কোনো সদস্যের অসুস্থতা, মৃত্যুসহ অন্যান্য কারণে বাকিরা অনুপস্থিত ছিল।
এবার যারা এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে, তারা ২০২০ সালে যখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল, সেই বছরই দেশে করোনার সংক্রমণ শুরু হয়। এর প্রভাবে একবার টানা দেড় বছর এবং পরে আবারও কয়েক মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। সেই ক্ষতির রেশ দীর্ঘ মেয়াদে পড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। করোনার প্রভাবের কারণে অনেকেই বিভিন্ন স্তরে ঝরে পড়েছে। এসবের পাশাপাশি বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রমসহ একাধিক কারণের কথা বলে আসছিলেন বিশেষজ্ঞরা। এখন অনুপস্থিত পরীক্ষার্থীদের মধ্যে যাদের তথ্য পাওয়া গেছে, তাদের বড় অংশেরই বিয়ে হয়ে যাওয়ার তথ্য পেল ঢাকা শিক্ষা বোর্ড।
প্রথমত, সরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে অনুপস্থিতির কারণ জানার প্রয়াসকে সাধুবাদ জানাই। কারণগুলো চিহ্নিত করতে পারলে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হয়।সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী‘সরকারকেই বেশি উদ্যোগী হতে হবে’বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ একটি বড় সমস্যা। আফ্রিকার কয়েকটি দেশ ছাড়া বিশ্বের আর কোথাও বাংলাদেশের মতো এত বেশি বাল্যবিবাহ নেই।
জাতিসংঘের জনসংখ্যাবিষয়ক সংস্থা ইউএনএফপিএর বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, দেশের ৫১ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে ১৮ বছর হওয়ার আগেই। আবার ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী এক হাজার মেয়ের মধ্যে ৭১ জন এক বা একাধিক সন্তানের মা। গত মঙ্গলবার ইউএনএফপিএর বৈশ্বিক জনসংখ্যা পরিস্থিতি ২০২৫–বিষয়ক এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
এবার যারা এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে, তারা ২০২০ সালে যখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল, সেই বছরই দেশে করোনার সংক্রমণ শুরু হয়। এর প্রভাবে একবার টানা দেড় বছর এবং পরে আবারও কয়েক মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। সেই ক্ষতির রেশ দীর্ঘ মেয়াদে পড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রথমত, সরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে অনুপস্থিতির কারণ জানার প্রয়াসকে সাধুবাদ জানাই। কারণগুলো চিহ্নিত করতে পারলে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হয়।’ তিনি বলেন, বাল্যবিবাহের পেছনে অসচ্ছলতা একটি বড় কারণ। এখনো দেখা যায়, অনেক অভিভাবক মেয়েদের জন্য বেশি ব্যয় করার চেয়ে ছেলে সন্তানের পেছনে ব্যয় করাকে বেশি প্রাধান্য দেন। আবার নিরাপত্তাহীনতাও মেয়েদের বাল্যবিবাহের একটি অন্যতম কারণ।
বাল্যবিবাহ রোধে সরকারকেই বেশি উদ্যোগী হতে হবে উল্লেখ করে রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, এ জন্য বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। আন্তমন্ত্রণালয় সভা করে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি সংস্থাগুলোকেও কাজে লাগানো যেতে পারে।