নদী ও খাল থেকে অবৈধ বালু উত্তোলন, ইটভাটা, পাহাড় কাটাসহ নানা খাতে চাঁদাবাজি চলছে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলায়। চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসীদের দাপটে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের আগে চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ ছিল আওয়ামী লীগ নেতাদের হাতে। এখন এসবের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন জামায়াতের ‘ত্যাগী কর্মীরা’।

প্রতিটি ইউনিয়নে তাদের দাপট। সাংগঠনিকভাবে পদে না থাকলেও তাদের পরিচয় দলের কর্মী। তারা নিজেদের সাবেক সংসদ সদস্য ও চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতের আমির শাহজাহান চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচয় দেন। এসব বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নীরব। সাতকানিয়ার তিন ইউনিয়নে তিনটি ‘সন্ত্রাসী বাহিনী’ তৎপর। তাদের নেতা ছিলেন গত সোমবার গণপিটুনিতে নিহত নেজাম উদ্দিন। তবে জামায়াতে ইসলামীর দাবি, তারা কর্মীদের কোনো অপরাধকে প্রশ্রয় দেয় না। পুলিশের দাবি, অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

স্থানীয় সূত্র জানায়, ২০১৬ সালের ১৬ অক্টোবর এওচিয়া ইউনিয়নের ছনখোলা এলাকায় কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী আবুল বশর ওরফে বদাইয়া নিহত হন। বশর স্থানীয়ভাবে জামায়াতের ক্যাডার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর ‘ডান হাত’ ছিলেন নেজাম উদ্দিন। গত সোমবার রাতে লোকজন নিয়ে অস্ত্রসহ ছনখোলা এলাকায় গেলে গণপিটুনিতে নেজামসহ দুই জন নিহত হন। আওয়ামী লীগ আমলে এওচিয়া এলাকায় একক আধিপত্য ছিল স্থানীয় চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মানিকের। সে সময় পালিয়ে থাকা নেজাম এলাকায় ফেরেন সরকার পতনের পর। তিনি এলাকায় জামায়াত ক্যাডার হিসেবে পরিচিত। এলাকায় ফিরেই মানিক চেয়ারম্যানের বাড়িঘর, গরুর খামারসহ অর্থ-সম্পদ লুট করেন নেজাম ও তাঁর বাহিনী। তাদের চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসে কাঞ্চনা, এওচিয়া, চরতি, আমিলাইশসহ আশপাশের এলাকাবাসী অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। গত সোমবারও লুটপাটের উদ্দেশ্যে তারা ছনখোলা গ্রামে গিয়েছিলেন বলে ধারণা স্থানীয় বাসিন্দাদের।

এদিকে দু’জনকে পিটিয়ে মারার দুই দিন পার হলেও থানায় কেউ মামলা করেনি। এ ঘটনায় কাউকে গ্রেপ্তারও করেনি পুলিশ। গত সোমবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে উপজেলার ছনখোলা পশ্চিমপাড়া এলাকায় মসজিদের মাইকে ডাকাত এসেছে– ঘোষণা দেওয়ায় লোকজন জড়ো হয়ে দু’জনকে পিটিয়ে হত্যা করেন। 

আমিলাইশে নেজাম বাহিনীর প্রধান মোজাম্মেল হক চৌধুরী। তাঁর দলে আছেন– মাহফুজ আলম, গিয়াস উদ্দিন, জহির আহমেদ, আব্দুল বারি পেয়ারু, মোহাম্মদ মোরশেদ, মোরশেদুল আলম ও মো.

জিসান। আমিলাইশ সরোয়ার বাজার এলাকায় অবৈধ বালু উত্তোলন ও বালুবাহী গাড়ি থেকে চাঁদা আদায় করে মোজাম্মেল হকের বাহিনী। এতে বাধা দেন ফয়সাল নামে স্থানীয় এক যুবক। এর জের ধরে গত ২৮ জানুয়ারি ফয়সালের ভাই কামরুল হাসান মুন্নাকে ছুরিকাঘাত করা হয়। গত ১৭ জানুয়ারি কাস্টমস কর্মকর্তা হুমায়ুন চৌধুরী পরিবার নিয়ে বাড়িতে যান। তাঁর কাছ থেকে মাসে ২০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করা হয়। চাঁদা দিতে রাজি না হওয়ায় রাতে তাদের বাড়ি লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়। পরদিন তারা চট্টগ্রাম শহরে ফিরে আসেন। সমকালের হাতে আসা একটি ভিডিওতে দেখা যায়, আলী হোছন নামে এক রিকশাচালককে মারধর করে কান ধরে মাটিতে সিজদা দিতে বাধ্য করেন মোজাম্মেল। বালুবাহী ট্রাক থেকে চাঁদাবাজি বিএনপি করে বলে প্রচার করার জন্য তাঁকে শপথ করান।  

অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মোজাম্মেল হক বলেন, ‘৫ আগস্টের পর আমিলাইশের সরোয়ার বাজারে জুয়ার আসর, মাদক বিক্রি ও কিশোর গ্যাং বন্ধ করেছি। এ জন্য তারা আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করছে।’ তাঁর দাবি, তিনি শিবিরের সাথী ছিলেন। জামায়াতের রুকন প্রার্থী ছিলেন। আমিলাইশ ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি ছিলেন। দলের জন্য কাজ করলেও ষড়যন্ত্র করে তাঁর পদ স্থগিত করা হয়েছে। তিনি এখন ঢাকায় থাকেন।

দক্ষিণ চরতিতে নেজাম বাহিনীর প্রধান কফিল উদ্দিন। তাঁর সহযোগীরা হলেন– সাইফুল ইসলাম, আনসার, আব্দুল আলিম, দেলোয়ার, মাঈনুদ্দিন ও মো. সামির। দ্বীপ চরতির ঘাট থেকে আমিলাইশের সরোয়ার বাজার পর্যন্ত অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে বিক্রি করে তারা। তাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগও আছে। 

নেজামের বাড়ি কাঞ্চনা ইউনিয়নের লতাপীর বাজার এলাকায়। তাঁর সহচর ছিলেন আবু ছালেক ও মোহাম্মদ এরশাদ। আবু ছালেক গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন। গত ১০ জানুয়ারি প্রতিপক্ষের লোকজন নেজামকে গুলি করলে তা এরশাদের গায়ে লাগে। নেজামের মৃত্যুর পর এলাকায় তাঁর বাহিনীর প্রধান হয়ে উঠেছেন এরশাদ। তাঁর সঙ্গে রয়েছে– খোকন ওরফে হাম্বা খোকন, ইকবাল মাহমুদ, আলমগীর, আবু তাহের আদাইয়া, রিফাত, শাহাদাত, হামিদ, ফরহাদ, জাহেদ, মাবুদ, ফারুক, শেখ মোহাম্মদ, পেয়ারু ও আব্দুল খালেক। লতাপীর বাজার এলাকায় প্রতিটি বালুর ট্রাক থেকে ২০০ টাকা আদায় করে তারা। এ ছাড়া ইটভাটা মালিক, প্রবাসী ও ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর বাড়িঘরে লুটপাটের অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে।

এসব প্রসঙ্গে জানতে জামায়াতের চট্টগ্রাম মহানগর আমির শাহজাহান চৌধুরীর মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলেও সাড়া পাওয়া যায়নি। সাতকানিয়া উপজেলা জামায়াতের সেক্রেটারি মুহাম্মদ তারেক হোছাইন বলেন, ‘জামায়াতের পরিচয়ে কেউ অনিয়ম করলে দ্রুত আমরা ব্যক্তিগত ও সামষ্টিকভাবে সংশোধনের পদক্ষেপ গ্রহণ করি। বারবার সতর্ক করি। কোনো অপরাধকে প্রশ্রয় দিই না।’ কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলেন তিনি।

সাতকানিয়া থানার ওসি জাহেদুল ইসলাম বলেন, ‘কেউ অভিযোগ নিয়ে এলে আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিই। কিন্তু অভিযোগ না এলে আমরা কার বিরুদ্ধে কীসের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেব? আমি দায়িত্ব নেওয়ার আগে নেজামের বিরুদ্ধে এক ব্যক্তিকে গুলি করার অভিযোগ ছিল। বিষয়টি তদন্তাধীন।’

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র এল ক য় ম হ ম মদ ব যবস থ ইসল ম ছনখ ল

এছাড়াও পড়ুন:

কাজের আনন্দই জীবনের সার্থকতা

জন্মদিনের অনুষ্ঠান নয়, তবে অনানুষ্ঠানিক আয়োজনটি ছিল সে উপলক্ষেই। আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষাবিদ ও সুবক্তা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের জন্মদিন ছিল গত ২৫ জুলাই। তাঁর অগণিত অনুরাগীরা চেয়েছিলেন তাঁকে নিয়ে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে মিলিত হতে। উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের যে হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে গেছে, তারপর আর জন্মদিনের অনুষ্ঠান করতে কিছুতেই সম্মত হননি তিনি।

শুক্রবার সন্ধ্যায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ষষ্ঠতলায় কেন্দ্রের প্রাক্তনী ও তাঁর কিছু ঘনিষ্ঠজন আলাপচারিতার এক ঘরোয়া আয়োজন করেছিলেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে নিয়ে। সেখানে তিনি বললেন, কাজের মধ্য দিয়ে জীবনে যে আনন্দ পেয়েছেন, সেটিই জীবনের সার্থকতা। এই আনন্দই তাঁকে অনুপ্রাণিত করে, শক্তি জোগায়।

এ আয়োজনে অংশগ্রহণকারীরা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে বিভিন্ন প্রশ্ন করেছেন। তিনি তাঁর চিরপরিচিত সরস অথচ বুদ্ধিদীপ্ত গভীর তাৎপর্যময় কথায় উত্তর দিয়েছেন। কবিতা, সাহিত্য, শিল্প থেকে শিক্ষা, ইতিহাস, দর্শন, ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংগঠন, প্রেম–ভালোবাসা—সবকিছু উঠে আসে প্রশ্নোত্তরভিত্তিক কথোপকথনে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল থেকে শুরু করে বিশ্বসাহিত্যের বহু কালজয়ী লেখকের রচনা থেকে প্রচুর উদ্ধৃতি দিয়েছেন তিনি। এক অন্তরঙ্গ প্রাণবন্ত আবহ বিরাজমান ছিল সন্ধ্যা থেকে অনেকটা রাত অবধি এই আয়োজনে।

আবৃত্তিশিল্পী জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় শুরুতেই আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের একটি কবিতা আবৃত্তি করে জানতে চান, তিনি কবিতার চর্চা করেননি কেন? জবাবে তিনি বলেন, কবি শামসুর রাহমান একবার তাঁকে বলেছিলেন, তাঁর মধ্যে কবিত্বের ঘাটতি আছে। তাঁর নিজেরও সে রকম মনে হয়েছে। তারপর সাহিত্য পত্রিকা কণ্ঠস্বর প্রকাশ ও অনেক রকম কাজ করতে গিয়ে আর কবিতা লেখা হয়ে ওঠেনি।

অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য প্রশ্ন করেন, এখন একটা কঠিন সময় যাচ্ছে। তরুণ প্রজন্মকে কীভাবে দেখেন, কী আশা করেন তাদের কাছে?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, ‘তরুণেরা কী হবে, তা তরুণদের ওপরে নির্ভর করে না। সেটা নির্ভর করে আমরা তাদের কী বানাতে চাই, তার ওপর। দেখতে হবে তরুণদের গড়ার মতো আমাদের ক্ষমতা কতটা আছে। অর্থাৎ শিক্ষক কেমন হবে, তার ওপরে নির্ভর করে তাঁর ছাত্র কেমন হবে। সক্রেটিস শিক্ষক ছিলেন বলে ছাত্র প্লেটো হয়েছেন। প্লেটোর শিক্ষা পেয়ে ছাত্র অ্যারিস্টটল হতে পেরেছেন। বড়দের যদি বড়ত্ব না থাকে, তবে ছোটরা বড় হতে পারে না। দুর্ভাগ্য যে আমরা বড়রা তাদের সামনে আদর্শ দাঁড় করাতে পারিনি। ফলে এখন বড়দেরই ছোটদের পেছনে দাঁড়াতে হচ্ছে।’

ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনাম জানতে চান, তিনি এত বিচিত্র ধরনের এত বিপুল কাজ করেছেন। এই প্রাণশক্তি পান কেমন করে?

উত্তর দিতে গিয়ে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, ‘শক্তি আসে আনন্দ থেকে। কাজ করতে পারাটাই আনন্দের। আর সব সময় আশাবাদী থাকি। আশা কখনো শেষ হয় না। আশা শেষ মানে আমি শেষ।’

আলাপচারিতায় আরও অংশ নেন দুদক চেয়ারম্যান এম এ মোমেন, ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ, চিকিৎসক আমজাদ হোসেন, অভিনয়শিল্পী খায়রুল আলম সবুজ, কথাশিল্পী আনিসুল হক, ছড়াকার আমিরুল ইসলাম, উপস্থাপক আবদুন নূর তুষার, অভিনয়শিল্পী আফসানা মিমি, মশিউর রহমান, আলী নকী প্রমুখ। সঞ্চালনা করেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রাক্তনী খাদিজা রহমান।

সম্পর্কিত নিবন্ধ