Samakal:
2025-06-16@08:45:43 GMT

শতবর্ষে অমর এলিজি ‘কবর’

Published: 13th, March 2025 GMT

শতবর্ষে অমর এলিজি ‘কবর’

ক্লাসে পড়াতে গিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অশ্রুসিক্ত হননি, এমন বিষয় বিরল। অগণিত পাঠকের হৃদয়জয়ী এমন কবিতা জসীম উদ্‌দীনের ‘কবর’। ‘কবর’ শতবর্ষে পদার্পণ করেছে। বাংলা কাব্যের এমন আরও শতবর্ষী দুটো কবিতা কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ ও জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’।
কবর কবিতা বাংলা সাহিত্যে পল্লিকবি জসীম উদ্‌দীনের এক তুলনারহিত ও অনন্য সৃষ্টি। এটি কবির ‘‘রাখালী’’ কাব্যের অন্তর্ভুক্ত। এটি একটি কাহিনি কবিতা; যা ষাণ্মাত্রিক মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত। এ ধরনের কবিতাকে বলা হয় ‘ড্রামাটিক মনোলগ’। একজন গ্রামীণ বৃদ্ধের একে একে সকল প্রিয়জন হারানোর বেদনা কবি জসীম উদ্‌দীন দক্ষ বর্ণনায় ফুটিয়ে তুলেছেন। দীর্ঘ এ কবিতার চরণ সংখ্যা ১১৮। কবিতাটি Elegy বা শোক কবিতা।
১ জানুয়ারি ১৯০৩ সালে ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে কবির জন্ম। কবি যে ঘরে থাকতেন সে বাড়ির সামনে সিঁড়ি, সিঁড়ির দু’দিকে লেবু গাছ, মাঝখানে ডালিম গাছ। এই জায়গাটিই তাঁর কবিতার সৃষ্টির উৎসভূমি। তাঁর লেখনীতে উঠে এসেছে পল্লিমানুষের জীবনের হালচাল নিয়ে। ১৯২৫ সালে কবি জসীম উদ্‌দীন রচিত ‘কবর’ কবিতাটি প্রথম কল্লোল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
কবি সে সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএ ক্লাসের ছাত্র। কল্লোল পত্রিকার তৃতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যায় ‘গ্রাম্য কবিতা’ পরিচয়ে মুদ্রিত ‘কবর’ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই পাঠকমহলে বিপুল সাড়া জাগিয়েছিল। কবি ছাত্র থাকা অবস্থায় কবিতাটি পাঠ্যপুস্তকে স্থান পাওয়ায় ব্যাপক সাড়া পড়ে যায় সাহিত্য ও পাঠকমহলে।


জসীম উদ্‌দীন বাঙালি কবি, গীতিকার, ঔপন্যাসিক ও লেখক। ‘পল্লিকবি’ উপাধিতে ভূষিত, জসীম উদ্‌দীন আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে লালিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ আধুনিক কবি। ঐতিহ্যবাহী বাংলা কবিতার মূল ধারাটিকে নগরসভায় নিয়ে আসার কৃতিত্ব জসীম উদ্‌দীনের।
তাঁর নকশী কাঁথার মাঠ ও সোজন বাদিয়ার ঘাট বাংলা ভাষার গীতিময় কবিতার উৎকৃষ্টতম নিদর্শনগুলোর অন্যতম। তাঁর কবিতা বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তাঁর লেখা অসংখ্য পল্লিগীতি এখনও গ্রামবাংলার মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়। যেমন– ‘আমার হাড় কালা করলাম রে’, ‘আমায় ভাসাইলি রে’, ‘বন্ধু কাজল ভ্রমরা রে’ ইত্যাদি।
জসীম উদ্‌দীন ছিলেন প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী। তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা।
জসীম উদ্‌দীন প্রেসিডেন্টের প্রাইড অব পারফরম্যান্স পুরস্কার (১৯৫৮), বাংলাদেশ সরকারের একুশে পদক (১৯৭৬) ও স্বাধীনতা পুরস্কারে (মরণোত্তর, ১৯৭৮) ভূষিত হন। তিনি ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন।
রবীন্দ্র প্রভাবমুক্ত কল্লোল পত্রিকাকে ঘিরে তিরিশের দশকে কবিতার আধুনিকতা নির্মাণ করলেন জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু বিষ্ণু দে ও সমর সেন। আরও এক কবি যুক্ত হলেন, তিনি জসীম উদ্‌দীন। কিন্তু কল্লোল পত্রিকার প্রথম দুই সংখ্যায় তাঁর কবিতা ছাপা হলেও তা তেমন সাড়া জাগাতে পারেনি। তবে কল্লোলের তৃতীয় সংখ্যায় ‘কবর’ কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার পর পাঠকমহল থেকে শুরু করে সাহিত্যের বিদগ্ধজনও জসীমের কাব্যপ্রতিভার সন্ধান পেলেন। এটি শতাধিক চরণের এক দীর্ঘ আখ্যান কবিতা। শোকবিহ্বল চিত্তে পিতামহ তাঁর একমাত্র দৌহিত্রকে দাদি, বাবা-মা, ফুফু ও বড় বোনের কবর দেখিয়ে অতীত স্মৃতি বর্ণনা করে চলেছেন। মানুষমাত্রই এ কবিতায় আবেগ আপ্লুত হবে, সন্দেহ নেই। বারংবার মৃত্যুকথা এর শোকাবহ আবহটিকে একঘেয়ে করে তোলেনি শুধু কবির অসাধারণ উপস্থাপনার কারণে। মৃত্যুর উপর্যুপরি উপস্থাপনা সত্ত্বেও এখানে ছিল কৃচ্ছ্রতা, সরলতা ও আবেগের তীব্রতা। আর কবিতার ভাষায় ছিল প্রমিত বাংলার সঙ্গে কিছু আঞ্চলিক শব্দের সার্থক প্রয়োগ। এর ছন্দ ও অলংকারও সাদামাটা, কেবল আন্তরিকতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা ‘কবর’ কবিতাকে পাঠকের মর্মমূলে গেঁথে দিয়েছে। ‘আঞ্চলিক স্বাদগন্ধ গোবিন্দচন্দ্র দাসের আঞ্চলিক আবহের চেয়েও কিছু অধিক কবিতাটিকে আলাদা করে দিয়েছিল বাংলা কবিতার মূলধারা থেকে তা সে রাবীন্দ্রিক বা আধুনিক যা-ই হোক না কেন।’ (জসীম উদ্‌দীন, আনিসুজ্জামান)
জসীম উদ্‌দীন মূলত বাংলার শ্যামল গাঁয়ের জল-মাটি-হাওয়া ও তার মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনাকে আধুনিক সময়ের প্রেক্ষাপটে  উন্মোচিত করতে চেয়েছেন।
খণ্ড কবিতা ও কাহিনিকাব্য এই দুই ভাগে জসীম উদ্‌দীনের সমগ্র কাব্যপ্রয়াসকে চিহ্নিত করা চলে। কবির প্রথম কাব্য রাখালী খণ্ড কবিতার গোত্রভুক্ত। অন্যদিকে নকশী কাঁথার মাঠ বা সোজন বাদিয়ার ঘাট কাহিনিকাব্য হিসেবে পরিচিতি পায়। আর এসব গ্রন্থই চিরকালীন আধুনিক বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল। ওই রাখালীর সূচিতে ঠাঁই করে নেয় ‘কবর’ কবিতা।
জসীম উদ্‌দীনের কবিতার বিষয় মূলত প্রেম ও মাতৃস্নেহ, প্রকৃতি ও পল্লিজীবন, জনজীবনস্পর্শী সামাজিক ঘটনা ও রাজনীতি। এ থেকেই বোঝা যায়, কবি হিসেবে জসীম উদ্‌দীন তাঁর সময়, সমাজ ও মানুষ থেকে বিযুক্ত ছিলেন না। আর আঞ্চলিক শব্দের সঙ্গে প্রচলিত ছন্দ ও প্রমিত ভাষার সমন্বয়ে এক নিজস্ব কাব্যভাষা নির্মাণে কবি জসীম উদ্‌দীন সক্ষম হন; যা তাঁকে তাঁর সময়কালের অন্য কবিদের থেকে আলাদা বিশিষ্টতায় চিহ্নিত করতে সাহায্য করে।
‘কবর’ কবিতায় বৃদ্ধ পিতামহ একমাত্র জীবিত দৌহিত্রকে তাঁর প্রেমময়ী স্ত্রী, উপযুক্ত পুত্র, লক্ষ্মী পুত্রবধূ, আদরের নাতনি এবং স্নেহের পুত্তলি মেয়ের বিয়োগান্ত বিদায়ের কথা জানাতে গিয়ে এক দুর্বিষহ জীবনের দুঃস্বপ্নকে বর্ণনা করেছেন। এক দুঃসহ বেদনায় তাঁর অস্তিত্বকে বহন করে বেঁচে থাকার শোকময় বোধের গ্লানি তিনি ব্যক্ত করতে চান। আর তাই দিন-রাত মৃত্যু কামনা তার সব ভাবনাকে তাড়িত করে ‘ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিছে ঘন আবিরের রাগে/ অমনি করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে’।
বাস্তব জীবনাভিজ্ঞতা, পারিপার্শ্বিকের অকুণ্ঠ স্বীকৃতি ও হৃদয়ানুভূতির সার্থক সমাবেশে ‘কবর’ কবিতাটি দুর্লভ শিল্পসার্থকতার অধিকারী। পল্লিবৃদ্ধের দুঃসাহস বেদনার চিত্র যেন সব পল্লিবাসীরই মর্মবেদনার এক স্থানিক চিত্র। এই বৃদ্ধের ভেতর দিয়ে বাংলার পাড়াগাঁয়ের সব অশীতিপরের যুগ-যুগান্তের পুঞ্জীভূত শোক-বেদনায় মূর্ত হয়ে উঠেছে ‘কবর’ কবিতায়। ব্যক্তিগত সুখ এখানে সব মানব-অন্তরের শোকবিহ্বল চেতনাকে প্রকাশ করেছে। বাংলা কাব্যে সাধারণ মানুষের জীবনের দুঃখ-বেদনার এমন মহিমাময় শিল্পসম্মত প্রকাশ খুব একটা নজরে আসে না। অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত ‘কবর’ কবিতাকে বাংলা কবিতার নতুন দিগদর্শন বলে চিহ্নিত করে এর অনন্য সৃষ্টি-মহিমারই স্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।
ঐতিহ্য থেকে বিষয়বস্তুতে কবি তাঁর খণ্ড কবিতাগুলোতে লোকাচারে রূপদান করেছেন বাংলা কবিতার একটি নতুন ধারার।
‘কবর’ কবিতায় যে বেদনাবিধুর আর্তি ধ্বনিত হয়েছে, তা কেবল গ্রামীণ জনপদের নয়; বরং এসব সময়ের আধুনিক-অনাধুনিক, উঁচু-নিচু, বালক-বৃদ্ধ সবার। কবিতাটির আবেদনও তাই কাল-পাত্র-পরিবেশ ছাপিয়ে বিশ্ব-চরাচরে গৃহীত হয়েছে মানব-অন্তরের গভীর অনুভূতির আয়নায়। আবহমান গ্রামবাংলার চিরপরিচিত চিত্র ও প্রসঙ্গ রূপায়ণ করতে গিয়ে জসীম উদ্‌দীন প্রেম ও রোমান্টিকতার মোহময়তা নির্মাণ করেছেন সুকৌশলে, বাস্তব অভিজ্ঞতার স্নিগ্ধ আলোয়। তার এই পরিচয় সব মহলে প্রতিষ্ঠিত। গ্রামীণ জীবনের গীতলতায় নিমগ্ন, সৌন্দর্য ও প্রেমভাবনা চিত্রণে সাবধানি কবি জসীম উদ্‌দীনকে আমরা নতুনভাবে আবিষ্কার করি তাঁর কবিতার কথামালায়। আর তাই স্বকীয় ধারায় আপন গতিপথে কাব্যস্রোত প্রবাহিত করে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন। 
এ কথা সর্বজনবিদিত, গ্রামজীবনের প্রতিচিত্র নির্মাণের পাশাপাশি জসীম উদ্‌দীন বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও মানববোধকে লালন ও সমৃদ্ধ করেছেন। তবে এও সত্য, স্বমহিমায় প্রোজ্জ্বল জসীম উদ্‌দীনের কাব্য-পরিসরের যথার্থ মূল্যায়ন তাঁর সময়কালে যেমন উপেক্ষিত হয়েছে, তেমনি উত্তরকালের পাঠক-বিশ্লেষকরাও তার মর্মার্থ অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছেন। মানতে দ্বিধা নেই, মানবপ্রীতি আর জীবন-সংকটের সঙ্গে একাত্ম যে জসীম উদ্‌দীন, তাঁকে আমরা হারাতে বসেছি ‘পল্লিকবি’ পরিচিতি ব্যাপ্তির বেড়াজালে। অথচ ‘কবর’ কবিতা সূচিভুক্ত করে কবির প্রথম কাব্য রাখালী (১৯২৭) প্রকাশের পরপরই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথসহ আরও অনেক সুধীজনের প্রশংসা লাভে সমর্থ হয় এই কবিতাগ্রন্থটি।
গবেষক মামুন মুস্তাফার মূল্যায়ন মূল্যবান। তিনি লিখেছেন, “যদিও কবি জসীম উদ্‌দীন গাঁয়ের রূপরসগন্ধ সহকারে সেই জনপদের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ-বেদনার কথা বুনেছেন কবিতায়, তবু তাঁর কবিতায় উপজীব্য হয়ে ওঠে সব কালের, সব মানুষের প্রতিচ্ছবি। আর তাই আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে যেমন ‘বিদ্রোহী কবি’ অভিধায় তাঁর কবিসত্তাকে খণ্ডিত করা হয়; তেমনি ‘পল্লিকবি’ বিশেষণে জসীম উদ্‌দীনকেও খণ্ডিত করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুখপাত্র। অথচ তাঁর প্রতিবাদী প্রবল কণ্ঠস্বরটি আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরেই রয়ে গেল আজ অবধি। ‘সন্দেহ নেই জসীম উদ্‌দীন একজন আদর্শনিষ্ঠ খাঁটি বাঙালি বড় কবি। তিনি যুগের কবি ছিলেন না বটে, কিন্তু জাতির কবি।’ তাঁর কবিতায় বাঙালি জাতিসত্তার যে বীজ রোপিত, তা বাংলা কাব্যসভায় অনন্য সাধারণ।”
জসীম উদ্‌দীনের কবর কবিতা বাংলা সাহিত্যে অদ্বিতীয় সৃষ্টি। শতবর্ষেও পুরোনো হয়নি, কাব্য আবেদনও ফুরোয়নি। তাই বলা যায়, শতবর্ষ আগে লিখিত হলেও কবর পাঠকনন্দিত আধুনিক কবিতা। v
 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: শতবর ষ কর ছ ন জ বন র প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

তুলশীগঙ্গার তীরে সন্ন্যাসতলীর শতবর্ষী ঘুড়ির মেলা

জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার মামুদপুর ইউনিয়নের মহব্বতপুর গ্রাম ঘেঁষে তুলশীগঙ্গা নদীর অদূরে সন্ন্যাসতলীর বটতলা। জায়গাটিতে প্রায় একশ বছর আগে থেকে বাংলা জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ শুক্রবার আয়োজন হয় ঘুড়ির মেলা। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। অন্তত ৫০ গ্রামের হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে শুক্রবার সন্ন্যাসতলী ঘুড়ি উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। 

মেলার দিনক্ষণ মনে রেখে সময়মতো দোকানিদের পাশাপাশি দর্শনার্থীরা ভিড় জমান নিভৃত পল্লীতে। আগে মেলার দিন বৃষ্টি হওয়া যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটেছে। প্রচণ্ড গরম ও তাপপ্রবাহের মধ্যেই চলে এ আয়োজন। বৈরী পরিবেশের কারণে উৎসবের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

স্থানীয় প্রবীণ বাসিন্দারা বলছেন, সন্ন্যাসতলীর এ ঘুড়ি উৎসব শুরুর দিন বিকেলে বটতলায় স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায় সন্ন্যাস পূজা পালন করেন। তাদের এ পূজা-অর্চনা ঘিরেই মূলত এ মেলার উৎপত্তি। তবে শুরুর কথা কেউ বলতে পারেননি। প্রবীণরা শুধু জানেন, একশ বছরের বেশি সময় ধরে তারা এ মেলার আয়োজন দেখে আসছেন।

মেলার নিজস্ব জায়গা না থাকলেও এর ব্যাপ্তি প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে। প্রচণ্ড গরমের মধ্যেই এক দিনের এ মেলা ঘিরেই জেলার জামালগঞ্জ চারমাথা থেকে ঐতিহাসিক আছরাঙ্গাদীঘি পর্যন্ত রকমারি পণ্যের দোকান বসে। এখান থেকে সংসারের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন আসবাব থেকে শুরু করে ছোট মাছ ধরার বাঁশের তৈরি পণ্য খলসানি, টোপা, ডালা, চালুন কিনে নেন অনেকে।

সুতার তৈরি তৌরা জাল, গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত দ্রব্যাদি, বিভিন্ন ধরনের খেলনা, মিষ্টান্ন, প্রসাধনী, মাটির তৈজসপত্রসহ বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রি হয়। শিশুদের বিনোদনের জন্য ছিল নাগরদোলার ব্যবস্থাও। আর মেলার বড় আকর্ষণ ঘুড়ি ওড়ানো ও বিক্রি। পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা এসেছিলেন ঘুড়ি বিক্রি করতে।

প্রচণ্ড গরমের পাশাপাশি তেমন হাওয়া-বাতাস না থাকায় এবার ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা সেভাবে জমে ওঠেনি। তবে ঘুড়ি বেচাকেনা ও শিশু-কিশোরদের উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো। এ উপলক্ষে আসা হাজার হাজার দর্শনার্থীর নিরাপত্তার জন্য মেলায় সার্বক্ষণিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের টহল ছিল।

আদমদীঘির শিববাটি গ্রামের ঘুড়ি ব্যবসায়ী সালাম হোসেনের ভাষ্য, সন্ন্যাসতলীর মেলা বড় হওয়ায় তিনি এসেছেন ঘুড়ি বিক্রির জন্য। মেলায় প্রত্যাশা অনুযায়ী ঘুড়ি বিক্রি করতে পেরে তিনি খুশি। জয়পুরহাটের পার্বতীপুর এলাকার ঘুড়ি ব্যবসায়ী মফিজ উদ্দিন ও মজনু সরদার বলেন, পূর্বপুরুষের আমল থেকে এ মেলার কথা শুনে আসছেন তারা।

মেলা উদযাপন ও পূজা কমিটির সদস্য মহব্বতপুর গ্রামের মন্টু মণ্ডল বলেন, মেলাটি হিন্দু সম্প্রদায়ের হলেও এটি আসলে সব ধর্মালম্বীর মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। 

মামুদপুর ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান মিলন হোসেনের ভাষ্য, এক দিনের আয়োজনে যে এত লোকের সমাগম হতে পারে, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। মেলায় যেন অনৈতিক কর্মকাণ্ড না হয়, সে ব্যাপারে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

ক্ষেতলাল থানার ওসি মোহাম্মদ ফরিদ হোসেন বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এবং মেলায় আসা দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ প্রশাসন সতর্ক আছে। মেলায় অনৈতিক আচরণ লক্ষ্য করা গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • তুলশীগঙ্গার তীরে সন্ন্যাসতলীর শতবর্ষী ঘুড়ির মেলা