ক্লাসে পড়াতে গিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অশ্রুসিক্ত হননি, এমন বিষয় বিরল। অগণিত পাঠকের হৃদয়জয়ী এমন কবিতা জসীম উদ্দীনের ‘কবর’। ‘কবর’ শতবর্ষে পদার্পণ করেছে। বাংলা কাব্যের এমন আরও শতবর্ষী দুটো কবিতা কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ ও জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’।
কবর কবিতা বাংলা সাহিত্যে পল্লিকবি জসীম উদ্দীনের এক তুলনারহিত ও অনন্য সৃষ্টি। এটি কবির ‘‘রাখালী’’ কাব্যের অন্তর্ভুক্ত। এটি একটি কাহিনি কবিতা; যা ষাণ্মাত্রিক মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত। এ ধরনের কবিতাকে বলা হয় ‘ড্রামাটিক মনোলগ’। একজন গ্রামীণ বৃদ্ধের একে একে সকল প্রিয়জন হারানোর বেদনা কবি জসীম উদ্দীন দক্ষ বর্ণনায় ফুটিয়ে তুলেছেন। দীর্ঘ এ কবিতার চরণ সংখ্যা ১১৮। কবিতাটি Elegy বা শোক কবিতা।
১ জানুয়ারি ১৯০৩ সালে ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে কবির জন্ম। কবি যে ঘরে থাকতেন সে বাড়ির সামনে সিঁড়ি, সিঁড়ির দু’দিকে লেবু গাছ, মাঝখানে ডালিম গাছ। এই জায়গাটিই তাঁর কবিতার সৃষ্টির উৎসভূমি। তাঁর লেখনীতে উঠে এসেছে পল্লিমানুষের জীবনের হালচাল নিয়ে। ১৯২৫ সালে কবি জসীম উদ্দীন রচিত ‘কবর’ কবিতাটি প্রথম কল্লোল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
কবি সে সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএ ক্লাসের ছাত্র। কল্লোল পত্রিকার তৃতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যায় ‘গ্রাম্য কবিতা’ পরিচয়ে মুদ্রিত ‘কবর’ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই পাঠকমহলে বিপুল সাড়া জাগিয়েছিল। কবি ছাত্র থাকা অবস্থায় কবিতাটি পাঠ্যপুস্তকে স্থান পাওয়ায় ব্যাপক সাড়া পড়ে যায় সাহিত্য ও পাঠকমহলে।
জসীম উদ্দীন বাঙালি কবি, গীতিকার, ঔপন্যাসিক ও লেখক। ‘পল্লিকবি’ উপাধিতে ভূষিত, জসীম উদ্দীন আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে লালিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ আধুনিক কবি। ঐতিহ্যবাহী বাংলা কবিতার মূল ধারাটিকে নগরসভায় নিয়ে আসার কৃতিত্ব জসীম উদ্দীনের।
তাঁর নকশী কাঁথার মাঠ ও সোজন বাদিয়ার ঘাট বাংলা ভাষার গীতিময় কবিতার উৎকৃষ্টতম নিদর্শনগুলোর অন্যতম। তাঁর কবিতা বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তাঁর লেখা অসংখ্য পল্লিগীতি এখনও গ্রামবাংলার মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়। যেমন– ‘আমার হাড় কালা করলাম রে’, ‘আমায় ভাসাইলি রে’, ‘বন্ধু কাজল ভ্রমরা রে’ ইত্যাদি।
জসীম উদ্দীন ছিলেন প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী। তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা।
জসীম উদ্দীন প্রেসিডেন্টের প্রাইড অব পারফরম্যান্স পুরস্কার (১৯৫৮), বাংলাদেশ সরকারের একুশে পদক (১৯৭৬) ও স্বাধীনতা পুরস্কারে (মরণোত্তর, ১৯৭৮) ভূষিত হন। তিনি ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন।
রবীন্দ্র প্রভাবমুক্ত কল্লোল পত্রিকাকে ঘিরে তিরিশের দশকে কবিতার আধুনিকতা নির্মাণ করলেন জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু বিষ্ণু দে ও সমর সেন। আরও এক কবি যুক্ত হলেন, তিনি জসীম উদ্দীন। কিন্তু কল্লোল পত্রিকার প্রথম দুই সংখ্যায় তাঁর কবিতা ছাপা হলেও তা তেমন সাড়া জাগাতে পারেনি। তবে কল্লোলের তৃতীয় সংখ্যায় ‘কবর’ কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার পর পাঠকমহল থেকে শুরু করে সাহিত্যের বিদগ্ধজনও জসীমের কাব্যপ্রতিভার সন্ধান পেলেন। এটি শতাধিক চরণের এক দীর্ঘ আখ্যান কবিতা। শোকবিহ্বল চিত্তে পিতামহ তাঁর একমাত্র দৌহিত্রকে দাদি, বাবা-মা, ফুফু ও বড় বোনের কবর দেখিয়ে অতীত স্মৃতি বর্ণনা করে চলেছেন। মানুষমাত্রই এ কবিতায় আবেগ আপ্লুত হবে, সন্দেহ নেই। বারংবার মৃত্যুকথা এর শোকাবহ আবহটিকে একঘেয়ে করে তোলেনি শুধু কবির অসাধারণ উপস্থাপনার কারণে। মৃত্যুর উপর্যুপরি উপস্থাপনা সত্ত্বেও এখানে ছিল কৃচ্ছ্রতা, সরলতা ও আবেগের তীব্রতা। আর কবিতার ভাষায় ছিল প্রমিত বাংলার সঙ্গে কিছু আঞ্চলিক শব্দের সার্থক প্রয়োগ। এর ছন্দ ও অলংকারও সাদামাটা, কেবল আন্তরিকতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা ‘কবর’ কবিতাকে পাঠকের মর্মমূলে গেঁথে দিয়েছে। ‘আঞ্চলিক স্বাদগন্ধ গোবিন্দচন্দ্র দাসের আঞ্চলিক আবহের চেয়েও কিছু অধিক কবিতাটিকে আলাদা করে দিয়েছিল বাংলা কবিতার মূলধারা থেকে তা সে রাবীন্দ্রিক বা আধুনিক যা-ই হোক না কেন।’ (জসীম উদ্দীন, আনিসুজ্জামান)
জসীম উদ্দীন মূলত বাংলার শ্যামল গাঁয়ের জল-মাটি-হাওয়া ও তার মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনাকে আধুনিক সময়ের প্রেক্ষাপটে উন্মোচিত করতে চেয়েছেন।
খণ্ড কবিতা ও কাহিনিকাব্য এই দুই ভাগে জসীম উদ্দীনের সমগ্র কাব্যপ্রয়াসকে চিহ্নিত করা চলে। কবির প্রথম কাব্য রাখালী খণ্ড কবিতার গোত্রভুক্ত। অন্যদিকে নকশী কাঁথার মাঠ বা সোজন বাদিয়ার ঘাট কাহিনিকাব্য হিসেবে পরিচিতি পায়। আর এসব গ্রন্থই চিরকালীন আধুনিক বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল। ওই রাখালীর সূচিতে ঠাঁই করে নেয় ‘কবর’ কবিতা।
জসীম উদ্দীনের কবিতার বিষয় মূলত প্রেম ও মাতৃস্নেহ, প্রকৃতি ও পল্লিজীবন, জনজীবনস্পর্শী সামাজিক ঘটনা ও রাজনীতি। এ থেকেই বোঝা যায়, কবি হিসেবে জসীম উদ্দীন তাঁর সময়, সমাজ ও মানুষ থেকে বিযুক্ত ছিলেন না। আর আঞ্চলিক শব্দের সঙ্গে প্রচলিত ছন্দ ও প্রমিত ভাষার সমন্বয়ে এক নিজস্ব কাব্যভাষা নির্মাণে কবি জসীম উদ্দীন সক্ষম হন; যা তাঁকে তাঁর সময়কালের অন্য কবিদের থেকে আলাদা বিশিষ্টতায় চিহ্নিত করতে সাহায্য করে।
‘কবর’ কবিতায় বৃদ্ধ পিতামহ একমাত্র জীবিত দৌহিত্রকে তাঁর প্রেমময়ী স্ত্রী, উপযুক্ত পুত্র, লক্ষ্মী পুত্রবধূ, আদরের নাতনি এবং স্নেহের পুত্তলি মেয়ের বিয়োগান্ত বিদায়ের কথা জানাতে গিয়ে এক দুর্বিষহ জীবনের দুঃস্বপ্নকে বর্ণনা করেছেন। এক দুঃসহ বেদনায় তাঁর অস্তিত্বকে বহন করে বেঁচে থাকার শোকময় বোধের গ্লানি তিনি ব্যক্ত করতে চান। আর তাই দিন-রাত মৃত্যু কামনা তার সব ভাবনাকে তাড়িত করে ‘ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিছে ঘন আবিরের রাগে/ অমনি করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে’।
বাস্তব জীবনাভিজ্ঞতা, পারিপার্শ্বিকের অকুণ্ঠ স্বীকৃতি ও হৃদয়ানুভূতির সার্থক সমাবেশে ‘কবর’ কবিতাটি দুর্লভ শিল্পসার্থকতার অধিকারী। পল্লিবৃদ্ধের দুঃসাহস বেদনার চিত্র যেন সব পল্লিবাসীরই মর্মবেদনার এক স্থানিক চিত্র। এই বৃদ্ধের ভেতর দিয়ে বাংলার পাড়াগাঁয়ের সব অশীতিপরের যুগ-যুগান্তের পুঞ্জীভূত শোক-বেদনায় মূর্ত হয়ে উঠেছে ‘কবর’ কবিতায়। ব্যক্তিগত সুখ এখানে সব মানব-অন্তরের শোকবিহ্বল চেতনাকে প্রকাশ করেছে। বাংলা কাব্যে সাধারণ মানুষের জীবনের দুঃখ-বেদনার এমন মহিমাময় শিল্পসম্মত প্রকাশ খুব একটা নজরে আসে না। অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত ‘কবর’ কবিতাকে বাংলা কবিতার নতুন দিগদর্শন বলে চিহ্নিত করে এর অনন্য সৃষ্টি-মহিমারই স্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।
ঐতিহ্য থেকে বিষয়বস্তুতে কবি তাঁর খণ্ড কবিতাগুলোতে লোকাচারে রূপদান করেছেন বাংলা কবিতার একটি নতুন ধারার।
‘কবর’ কবিতায় যে বেদনাবিধুর আর্তি ধ্বনিত হয়েছে, তা কেবল গ্রামীণ জনপদের নয়; বরং এসব সময়ের আধুনিক-অনাধুনিক, উঁচু-নিচু, বালক-বৃদ্ধ সবার। কবিতাটির আবেদনও তাই কাল-পাত্র-পরিবেশ ছাপিয়ে বিশ্ব-চরাচরে গৃহীত হয়েছে মানব-অন্তরের গভীর অনুভূতির আয়নায়। আবহমান গ্রামবাংলার চিরপরিচিত চিত্র ও প্রসঙ্গ রূপায়ণ করতে গিয়ে জসীম উদ্দীন প্রেম ও রোমান্টিকতার মোহময়তা নির্মাণ করেছেন সুকৌশলে, বাস্তব অভিজ্ঞতার স্নিগ্ধ আলোয়। তার এই পরিচয় সব মহলে প্রতিষ্ঠিত। গ্রামীণ জীবনের গীতলতায় নিমগ্ন, সৌন্দর্য ও প্রেমভাবনা চিত্রণে সাবধানি কবি জসীম উদ্দীনকে আমরা নতুনভাবে আবিষ্কার করি তাঁর কবিতার কথামালায়। আর তাই স্বকীয় ধারায় আপন গতিপথে কাব্যস্রোত প্রবাহিত করে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন।
এ কথা সর্বজনবিদিত, গ্রামজীবনের প্রতিচিত্র নির্মাণের পাশাপাশি জসীম উদ্দীন বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও মানববোধকে লালন ও সমৃদ্ধ করেছেন। তবে এও সত্য, স্বমহিমায় প্রোজ্জ্বল জসীম উদ্দীনের কাব্য-পরিসরের যথার্থ মূল্যায়ন তাঁর সময়কালে যেমন উপেক্ষিত হয়েছে, তেমনি উত্তরকালের পাঠক-বিশ্লেষকরাও তার মর্মার্থ অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছেন। মানতে দ্বিধা নেই, মানবপ্রীতি আর জীবন-সংকটের সঙ্গে একাত্ম যে জসীম উদ্দীন, তাঁকে আমরা হারাতে বসেছি ‘পল্লিকবি’ পরিচিতি ব্যাপ্তির বেড়াজালে। অথচ ‘কবর’ কবিতা সূচিভুক্ত করে কবির প্রথম কাব্য রাখালী (১৯২৭) প্রকাশের পরপরই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথসহ আরও অনেক সুধীজনের প্রশংসা লাভে সমর্থ হয় এই কবিতাগ্রন্থটি।
গবেষক মামুন মুস্তাফার মূল্যায়ন মূল্যবান। তিনি লিখেছেন, “যদিও কবি জসীম উদ্দীন গাঁয়ের রূপরসগন্ধ সহকারে সেই জনপদের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ-বেদনার কথা বুনেছেন কবিতায়, তবু তাঁর কবিতায় উপজীব্য হয়ে ওঠে সব কালের, সব মানুষের প্রতিচ্ছবি। আর তাই আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে যেমন ‘বিদ্রোহী কবি’ অভিধায় তাঁর কবিসত্তাকে খণ্ডিত করা হয়; তেমনি ‘পল্লিকবি’ বিশেষণে জসীম উদ্দীনকেও খণ্ডিত করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুখপাত্র। অথচ তাঁর প্রতিবাদী প্রবল কণ্ঠস্বরটি আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরেই রয়ে গেল আজ অবধি। ‘সন্দেহ নেই জসীম উদ্দীন একজন আদর্শনিষ্ঠ খাঁটি বাঙালি বড় কবি। তিনি যুগের কবি ছিলেন না বটে, কিন্তু জাতির কবি।’ তাঁর কবিতায় বাঙালি জাতিসত্তার যে বীজ রোপিত, তা বাংলা কাব্যসভায় অনন্য সাধারণ।”
জসীম উদ্দীনের কবর কবিতা বাংলা সাহিত্যে অদ্বিতীয় সৃষ্টি। শতবর্ষেও পুরোনো হয়নি, কাব্য আবেদনও ফুরোয়নি। তাই বলা যায়, শতবর্ষ আগে লিখিত হলেও কবর পাঠকনন্দিত আধুনিক কবিতা। v
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: শতবর ষ কর ছ ন জ বন র প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
শতবর্ষী বিদ্যাপীঠ আনন্দ মোহনে ‘অচলাবস্থা’
দেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আনন্দ মোহন কলেজ। ১১৭ বছরের পুরোনো এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ‘জ্ঞানের আঁতুড়ঘর’ হিসেবে পরিচিত। তবে বর্তমানে নানা সংকটে ধুঁকছে।
বর্তমানে কলেজটিতে ২১ বিভাগে স্নাতক (সম্মান) ও ২০ বিভাগে স্নাতকোত্তর চালু আছে। আছে উচ্চমাধ্যমিকও। সব মিলিয়ে বর্তমানে শিক্ষার্থী রয়েছেন ৪১ হাজার ৮৮৩ জন। এই বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষক আছেন মাত্র ১৮০ জন। যদিও শিক্ষকের অনুমোদিত পদের সংখ্যা ২০৮।
এ ছাড়া শ্রেণিকক্ষের অভাব, আবাসনসংকট রয়েছে। পরিবহনও অপ্রতুল। এর বাইরে প্রায় দুই মাস ধরে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষের কক্ষে তালা লাগিয়ে রেখেছেন শিক্ষার্থীরা। সাত দফা দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছেন তাঁরা। সব মিলিয়ে ‘অচলাবস্থা’ তৈরি হয়েছে।
বাইরে মেসে থাকতে মাসে পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়। হলে সুযোগ পেলে খরচ বাঁচত, পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারতাম। মোরসালিন মিয়া, প্রথম বর্ষ, ইংরেজি বিভাগশ্রেণিকক্ষের সংকট
ইংরেজি বিভাগে শ্রেণিকক্ষ আছে মাত্র দুটি। স্নাতক তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘আজ (২১ অক্টোবর) এক ক্লাস শেষ হতেই রুম ছেড়ে দিতে হয়েছে, মাস্টার্স পরীক্ষা চলছে। অন্তত পাঁচটি শ্রেণিকক্ষ দরকার, কিন্তু আছে মাত্র দুটি।’
কলেজে ৪১ হাজার ৮৮৩ শিক্ষার্থীর জন্য ৭৬টি শ্রেণিকক্ষ। গড়ে ৫৫১ শিক্ষার্থীর জন্য একটি কক্ষ। কলেজ কর্তৃপক্ষ জানায়, আরও অন্তত ৫০টি শ্রেণিকক্ষের প্রয়োজন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের তিনটি শ্রেণিকক্ষ। পরীক্ষার সময় অন্য বিভাগের কক্ষ ব্যবহার করতে হয়। আরও দুটি কক্ষ থাকলে ভালো হতো।’
এদিকে বিভিন্ন বিভাগে রয়েছে শৌচাগারের সংকট। ইংরেজি বিভাগের একমাত্র শৌচাগারে কল নষ্ট, পানি নেই। শিক্ষার্থী মমিনুল ইসলাম বলেন, ‘ছেলে-মেয়ে সবাই একই টয়লেট ব্যবহার করি, ফ্লাশ কাজ করে না।’
বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী নেসার আহমেদ বলেন, ‘আমাদের বিভাগের শৌচাগারই নেই, অন্য বিভাগে যেতে হয়।’
বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ শামীম সিদ্দিকী বলেন, ‘সিঁড়ির পাশে থাকা শৌচাগার ব্যবহার করা হয়, স্থায়ী সমাধান দরকার।’
পর্যাপ্ত নয় পরিবহন
৪২ হাজার শিক্ষার্থীর বিপরীতে কলেজের নিজস্ব বাস আছে মাত্র তিনটি। মুক্তাগাছা, ফুলপুর ও হালুয়াঘাট রুটে চলে সেগুলো। ভালুকা-ময়মনসিংহ রুটে একটি ভাড়ায় নেওয়া বাস রয়েছে।
ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্রী হাফিজা আক্তার বলেন, ‘বাসে ৪০ জনের সিট, কিন্তু ঠাসাঠাসি করে ৮০ জন যাতায়াত করি। বাস মিস করলে ১৫০ টাকা খরচ হয়ে যায়। পরিবহন বাড়ানো খুব দরকার।’
কলেজ কর্তৃপক্ষ বলছে, জেলার ১৩ উপজেলার শিক্ষার্থীরা যাতায়াত করেন। কিন্তু পর্যাপ্ত বাস না থাকায় রুট বাড়ানো যাচ্ছে না।
নিয়ম এখন ‘অতিরিক্ত সিট’
কলেজে ছেলেদের তিনটি ও মেয়েদের চারটি হল আছে। ধারণক্ষমতা ছেলেদের ৩৫০ ও মেয়েদের ৪৫০, কিন্তু বাস্তবে থাকেন আরও বেশি।
কাজী নজরুল ইসলাম হলের শিক্ষার্থী আহমেদ জুনাইদ বলেন, ‘চারজনের রুমে এখন পাঁচজন থাকা নিয়ম হয়ে গেছে।’
খালেদা জিয়া হলের ছাত্রী আঞ্জুমান নাহার বলেন, ‘ছয়জনের রুমে থাকি ১২ জন। বছরে ৬ হাজার ৭০০ টাকা দিতে হয়, প্রতিদিন ৬০ টাকা মিল খরচ। কিন্তু ঠাসাঠাসিতে পড়াশোনা করা যায় না।’
যদিও হলের সুপার ও বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ঝরনা বেগম দাবি করেন, ‘রুমে ১০ জনের বেশি কেউ নেই, পুরোনো সমস্যাগুলো সমাধান করা হয়েছে।’
কলেজ কর্তৃপক্ষ জানায়, ছেলেদের নতুন পাঁচতলা হলের কাজ প্রায় শেষ। আরও একটি নতুন হল নির্মাণাধীন। তবে শিক্ষার্থীর তুলনায় আবাসন এখনো অপ্রতুল।
ইংরেজি বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী মোরসালিন মিয়া বলেন, ‘বাইরে মেসে থাকতে মাসে পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়। হলে সুযোগ পেলে খরচ বাঁচত, পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারতাম।’
রিডিং রুম নেই, গ্রন্থাগারও অচল
মেয়েদের চারটি হলে (সৈয়দা নাফিসা ইসলাম, তারামন বিবি, খালেদা জিয়া ও শহীদজননী জাহানারা ইমাম) কোনো রিডিং রুম নেই। তাঁরা ডাইনিং রুমেই পড়াশোনা করেন।
অর্থনীতি বিভাগের ছাত্রী সালিহা জাহান বলেন, ‘ডাইনিংয়ে কেউ খাবার না খেলে সেখানে বসেই পড়ি।’
গ্রন্থাগারে আছে প্রায় ৫০ হাজার বই, কিন্তু ভবন নির্মাণের কারণে দুই বছর ধরে অস্থায়ী কক্ষে চলছে কার্যক্রম। সেখানে বই থাকলেও নেই পাঠের জায়গা। নিবন্ধিত পাঠক মাত্র ৪২০ জন।
গ্রন্থাগারের কর্মী লাকি আক্তার বলেন, আগে সবাই এসে পড়ত, এখন জায়গা নেই বলে বই নিতে আসে কম।
তিন হলে এক ডাইনিং
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম হল, আবু সালেহ হল (তরুণ হল) ও জসীমউদ্দীন হল—ছেলেদের এ তিন হলের জন্য একটি ডাইনিং রয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ১৮৫ জনের খাবার রান্না হয়। তিন বেলা খাওয়ার জন্য লাগে ৭০ টাকা।
শিক্ষার্থী আহমেদ জুনাইদ বলেন, ‘প্রতিদিন একেক রুম থেকে মিল ম্যানেজার দায়িত্ব নেয়। টাকাটা আমরা নিজেরাই তুলি।’
ডাইনিংয়ের কর্মী আলাল উদ্দিন বলেন, ‘৭০ টাকায় তিন বেলা খাবার দেওয়া হয়। টাকার হিসাবে খাবার খারাপ নয়। কিন্তু টাকা ভালো হলে খাবারও ভালো হতো।’
সংকট সুরাহার দাবি
কলেজের অধ্যক্ষ আমান উল্লাহকে গত ৩১ জুলাই ওএসডি করা হয়। এরপর ৩ আগস্ট উপাধ্যক্ষ সাকির হোসেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হন। তবে ১২ আগস্ট থেকে শিক্ষার্থীদের একাংশ আন্দোলনে নামেন। অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষের কক্ষে তালা ঝুলিয়ে চেয়ার বাইরে ফেলে দেন তাঁরা।
এখনো অফিসে যেতে পারছেন না ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। শিক্ষার্থীরা ২১ অক্টোবর সাত দফা দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। তাঁদের দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে অনতিবিলম্বে অধ্যক্ষ পদায়ন করতে হবে; হিন্দু হল দ্রুত চালু করতে হবে; প্রশাসনিক কার্যক্রমে সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া কলেজ ক্যাম্পাসে একটি পুলিশ বক্স চান শিক্ষার্থীরা।
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সাকির হোসেন বলেন, এত বড় কলেজে সমস্যা থাকবেই, পর্যায়ক্রমে সমাধান হবে। তবে কিছু শিক্ষার্থীর আন্দোলনের কারণে কাজ ব্যাহত হচ্ছে।
বাঙালি শিক্ষাবিদ, সমাজসংস্কারক ও রাজনীতিক আনন্দ মোহন বসুর নামে ১৯০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কলেজটি। তবে কার্যক্রম শুরু হয় পরের বছর, ১৯০৯ সালে। একসময় ময়মনসিংহ অঞ্চলের জ্ঞানচর্চার প্রাণকেন্দ্র ছিল আনন্দ মোহন কলেজ। কিন্তু এখন শ্রেণিকক্ষ, আবাসন, গ্রন্থাগার, পরিবহন—সব ক্ষেত্রেই সংকটে রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি। ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ তার পুরোনো মর্যাদা ফিরে পাক, এটাই শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের চাওয়া।