শতবর্ষী বিদ্যাপীঠ আনন্দ মোহনে ‘অচলাবস্থা’
Published: 31st, October 2025 GMT
দেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আনন্দ মোহন কলেজ। ১১৭ বছরের পুরোনো এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ‘জ্ঞানের আঁতুড়ঘর’ হিসেবে পরিচিত। তবে বর্তমানে নানা সংকটে ধুঁকছে।
বর্তমানে কলেজটিতে ২১ বিভাগে স্নাতক (সম্মান) ও ২০ বিভাগে স্নাতকোত্তর চালু আছে। আছে উচ্চমাধ্যমিকও। সব মিলিয়ে বর্তমানে শিক্ষার্থী রয়েছেন ৪১ হাজার ৮৮৩ জন। এই বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষক আছেন মাত্র ১৮০ জন। যদিও শিক্ষকের অনুমোদিত পদের সংখ্যা ২০৮।
এ ছাড়া শ্রেণিকক্ষের অভাব, আবাসনসংকট রয়েছে। পরিবহনও অপ্রতুল। এর বাইরে প্রায় দুই মাস ধরে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষের কক্ষে তালা লাগিয়ে রেখেছেন শিক্ষার্থীরা। সাত দফা দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছেন তাঁরা। সব মিলিয়ে ‘অচলাবস্থা’ তৈরি হয়েছে।
বাইরে মেসে থাকতে মাসে পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়। হলে সুযোগ পেলে খরচ বাঁচত, পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারতাম। মোরসালিন মিয়া, প্রথম বর্ষ, ইংরেজি বিভাগশ্রেণিকক্ষের সংকট
ইংরেজি বিভাগে শ্রেণিকক্ষ আছে মাত্র দুটি। স্নাতক তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘আজ (২১ অক্টোবর) এক ক্লাস শেষ হতেই রুম ছেড়ে দিতে হয়েছে, মাস্টার্স পরীক্ষা চলছে। অন্তত পাঁচটি শ্রেণিকক্ষ দরকার, কিন্তু আছে মাত্র দুটি।’
কলেজে ৪১ হাজার ৮৮৩ শিক্ষার্থীর জন্য ৭৬টি শ্রেণিকক্ষ। গড়ে ৫৫১ শিক্ষার্থীর জন্য একটি কক্ষ। কলেজ কর্তৃপক্ষ জানায়, আরও অন্তত ৫০টি শ্রেণিকক্ষের প্রয়োজন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের তিনটি শ্রেণিকক্ষ। পরীক্ষার সময় অন্য বিভাগের কক্ষ ব্যবহার করতে হয়। আরও দুটি কক্ষ থাকলে ভালো হতো।’
এদিকে বিভিন্ন বিভাগে রয়েছে শৌচাগারের সংকট। ইংরেজি বিভাগের একমাত্র শৌচাগারে কল নষ্ট, পানি নেই। শিক্ষার্থী মমিনুল ইসলাম বলেন, ‘ছেলে-মেয়ে সবাই একই টয়লেট ব্যবহার করি, ফ্লাশ কাজ করে না।’
বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী নেসার আহমেদ বলেন, ‘আমাদের বিভাগের শৌচাগারই নেই, অন্য বিভাগে যেতে হয়।’
বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ শামীম সিদ্দিকী বলেন, ‘সিঁড়ির পাশে থাকা শৌচাগার ব্যবহার করা হয়, স্থায়ী সমাধান দরকার।’
পর্যাপ্ত নয় পরিবহন
৪২ হাজার শিক্ষার্থীর বিপরীতে কলেজের নিজস্ব বাস আছে মাত্র তিনটি। মুক্তাগাছা, ফুলপুর ও হালুয়াঘাট রুটে চলে সেগুলো। ভালুকা-ময়মনসিংহ রুটে একটি ভাড়ায় নেওয়া বাস রয়েছে।
ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্রী হাফিজা আক্তার বলেন, ‘বাসে ৪০ জনের সিট, কিন্তু ঠাসাঠাসি করে ৮০ জন যাতায়াত করি। বাস মিস করলে ১৫০ টাকা খরচ হয়ে যায়। পরিবহন বাড়ানো খুব দরকার।’
কলেজ কর্তৃপক্ষ বলছে, জেলার ১৩ উপজেলার শিক্ষার্থীরা যাতায়াত করেন। কিন্তু পর্যাপ্ত বাস না থাকায় রুট বাড়ানো যাচ্ছে না।
নিয়ম এখন ‘অতিরিক্ত সিট’
কলেজে ছেলেদের তিনটি ও মেয়েদের চারটি হল আছে। ধারণক্ষমতা ছেলেদের ৩৫০ ও মেয়েদের ৪৫০, কিন্তু বাস্তবে থাকেন আরও বেশি।
কাজী নজরুল ইসলাম হলের শিক্ষার্থী আহমেদ জুনাইদ বলেন, ‘চারজনের রুমে এখন পাঁচজন থাকা নিয়ম হয়ে গেছে।’
খালেদা জিয়া হলের ছাত্রী আঞ্জুমান নাহার বলেন, ‘ছয়জনের রুমে থাকি ১২ জন। বছরে ৬ হাজার ৭০০ টাকা দিতে হয়, প্রতিদিন ৬০ টাকা মিল খরচ। কিন্তু ঠাসাঠাসিতে পড়াশোনা করা যায় না।’
যদিও হলের সুপার ও বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ঝরনা বেগম দাবি করেন, ‘রুমে ১০ জনের বেশি কেউ নেই, পুরোনো সমস্যাগুলো সমাধান করা হয়েছে।’
কলেজ কর্তৃপক্ষ জানায়, ছেলেদের নতুন পাঁচতলা হলের কাজ প্রায় শেষ। আরও একটি নতুন হল নির্মাণাধীন। তবে শিক্ষার্থীর তুলনায় আবাসন এখনো অপ্রতুল।
ইংরেজি বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী মোরসালিন মিয়া বলেন, ‘বাইরে মেসে থাকতে মাসে পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়। হলে সুযোগ পেলে খরচ বাঁচত, পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারতাম।’
রিডিং রুম নেই, গ্রন্থাগারও অচল
মেয়েদের চারটি হলে (সৈয়দা নাফিসা ইসলাম, তারামন বিবি, খালেদা জিয়া ও শহীদজননী জাহানারা ইমাম) কোনো রিডিং রুম নেই। তাঁরা ডাইনিং রুমেই পড়াশোনা করেন।
অর্থনীতি বিভাগের ছাত্রী সালিহা জাহান বলেন, ‘ডাইনিংয়ে কেউ খাবার না খেলে সেখানে বসেই পড়ি।’
গ্রন্থাগারে আছে প্রায় ৫০ হাজার বই, কিন্তু ভবন নির্মাণের কারণে দুই বছর ধরে অস্থায়ী কক্ষে চলছে কার্যক্রম। সেখানে বই থাকলেও নেই পাঠের জায়গা। নিবন্ধিত পাঠক মাত্র ৪২০ জন।
গ্রন্থাগারের কর্মী লাকি আক্তার বলেন, আগে সবাই এসে পড়ত, এখন জায়গা নেই বলে বই নিতে আসে কম।
তিন হলে এক ডাইনিং
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম হল, আবু সালেহ হল (তরুণ হল) ও জসীমউদ্দীন হল—ছেলেদের এ তিন হলের জন্য একটি ডাইনিং রয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ১৮৫ জনের খাবার রান্না হয়। তিন বেলা খাওয়ার জন্য লাগে ৭০ টাকা।
শিক্ষার্থী আহমেদ জুনাইদ বলেন, ‘প্রতিদিন একেক রুম থেকে মিল ম্যানেজার দায়িত্ব নেয়। টাকাটা আমরা নিজেরাই তুলি।’
ডাইনিংয়ের কর্মী আলাল উদ্দিন বলেন, ‘৭০ টাকায় তিন বেলা খাবার দেওয়া হয়। টাকার হিসাবে খাবার খারাপ নয়। কিন্তু টাকা ভালো হলে খাবারও ভালো হতো।’
সংকট সুরাহার দাবি
কলেজের অধ্যক্ষ আমান উল্লাহকে গত ৩১ জুলাই ওএসডি করা হয়। এরপর ৩ আগস্ট উপাধ্যক্ষ সাকির হোসেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হন। তবে ১২ আগস্ট থেকে শিক্ষার্থীদের একাংশ আন্দোলনে নামেন। অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষের কক্ষে তালা ঝুলিয়ে চেয়ার বাইরে ফেলে দেন তাঁরা।
এখনো অফিসে যেতে পারছেন না ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। শিক্ষার্থীরা ২১ অক্টোবর সাত দফা দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। তাঁদের দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে অনতিবিলম্বে অধ্যক্ষ পদায়ন করতে হবে; হিন্দু হল দ্রুত চালু করতে হবে; প্রশাসনিক কার্যক্রমে সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া কলেজ ক্যাম্পাসে একটি পুলিশ বক্স চান শিক্ষার্থীরা।
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সাকির হোসেন বলেন, এত বড় কলেজে সমস্যা থাকবেই, পর্যায়ক্রমে সমাধান হবে। তবে কিছু শিক্ষার্থীর আন্দোলনের কারণে কাজ ব্যাহত হচ্ছে।
বাঙালি শিক্ষাবিদ, সমাজসংস্কারক ও রাজনীতিক আনন্দ মোহন বসুর নামে ১৯০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কলেজটি। তবে কার্যক্রম শুরু হয় পরের বছর, ১৯০৯ সালে। একসময় ময়মনসিংহ অঞ্চলের জ্ঞানচর্চার প্রাণকেন্দ্র ছিল আনন্দ মোহন কলেজ। কিন্তু এখন শ্রেণিকক্ষ, আবাসন, গ্রন্থাগার, পরিবহন—সব ক্ষেত্রেই সংকটে রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি। ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ তার পুরোনো মর্যাদা ফিরে পাক, এটাই শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের চাওয়া।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গ রন থ গ র ল ইসল ম কল জ ক ন বল ন র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
আগে চা পরে লাঞ্চ—বদলে যাচ্ছে ক্রিকেটের শতবর্ষ পুরোনো এক রীতি
চা আগে না লাঞ্চ আগে, জিজ্ঞেস করলে বেশির ভাগই হয়তো লাঞ্চের কথা বলবেন। চা খেয়ে লাঞ্চ করার চেয়ে লাঞ্চ করে চা খাওয়ার চলই সাধারণত দেখা যায়। যে রীতি প্রচলিত টেস্ট ক্রিকেটেও।
টেস্ট ম্যাচে দিনে দুবার বিরতি দেওয়া হয়। প্রথম বিরতিকে বলা হয় লাঞ্চ ব্রেক বা মধ্যাহ্ন বিরতি, দ্বিতীয় বিরতিকে টি ব্রেক বা চা বিরতি।
তবে শত বছরের বেশি সময় ধরে চলা এই রীতির ব্যতিক্রম হতে যাচ্ছে এবার। আগে হবে চা, এরপর লাঞ্চ। ব্যতিক্রমী এই ঘটনা ঘটতে চলেছে আগামী ২২ নভেম্বর শুরু ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা টেস্টে। আসামের গুয়াহাটির বর্ষাপাড়া ক্রিকেট স্টেডিয়ামে হতে যাওয়া ম্যাচটিতে প্রথম সেশনের পর দেওয়া হবে চা বিরতি। লাঞ্চ বিরতি হবে দ্বিতীয় সেশনের পর। এই ম্যাচ দিয়েই টেস্ট অভিষেক হচ্ছে বর্ষাপাড়া স্টেডিয়ামের।
টেস্ট ক্রিকেটে চা বিরতি হয় ২০ মিনিটের, লাঞ্চ বিরতি ৪০ মিনিটের। এই দুই বিরতির সময় দুই দলের খেলোয়াড়েরা মাঠ ছেড়ে ড্রেসিংরুমে চলে যান। দীর্ঘদিন ধরে চলা আগে লাঞ্চ বিরতি পরে চা বিরতির রীতি ভাঙতে চলেছে দিনের দৈর্ঘ্যের কারণে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের গুয়াহাটিতে নভেম্বরের শেষার্ধে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের মধ্যে সময় কম থাকে। দিনের খেলা আগেভাগে শেষ করতে শুরুও করতে হবে সকালে। যে কারণে স্থানীয় সময় সকাল ৯টায় প্রথম সেশন শুরু হয়ে ১১টায় শেষ হবে।
প্রচলিত রীতি অনুসারে এ সময় ৪০ মিনিটের লাঞ্চ বিরতি হওয়ার কথা। তবে ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে ১১টায় হবে চা বিরতি, অর্থাৎ ২০ মিনিটের বিরতি।
এরপর দ্বিতীয় সেশন ১১টা ২০ মিনিটে শুরু হয়ে চলবে ১টা ২০ মিনিট পর্যন্ত। এই সেশনের বিরতি হবে লাঞ্চের, অর্থাৎ ৪০ মিনিটের। আঞ্চলিকভাবে এটিই দুপুরের খাবারের সময়। দুইটায় তৃতীয় সেশন শুরু হয়ে দিনের খেলা শেষ হবে বিকেল ৪টায়।
আগে চা, পরে লাঞ্চ বিরতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে জানিয়ে বিসিসিআইয়ের একটি সূত্র ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, ‘গুয়াহাটিতে দিন শুরু হয় আগেভাগে, শেষও হয় দ্রুত। যে কারণে প্রথমবারের মতো চা বিরতি আগে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে, যাতে মাঠে বাড়তি সময় পাওয়া যায়।
সাধারণত ভারতে টেস্ট ম্যাচ শুরু হয় সকাল সাড়ে নয়টায়। সাড়ে এগারোটায় লাঞ্চ বিরতির পর দ্বিতীয় সেশন শুরু হয় ১২টা ১০ মিনিটে। ২টা ১০ মিনিট থেকে পরের ২০ মিনিট থাকে চা বিরতি। আর আড়াইটা থেকে চারটা পর্যন্ত হয়ে থাকে দিনের তৃতীয় সেশনের খেলা। এ সময়ের মধ্যে ৯০ ওভারের খেলা না হলে ম্যাচ অফিশিয়ালরা আরও আধ ঘণ্টা খেলা চালিয়ে নিতে পারেন।
এর বাইরে পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তে টেস্টে দিনের খেলা শুরুর সময় ভিন্ন হয়ে থাকে। যেমন ইংল্যান্ডে গ্রীষ্মে খেলা শুরু হয় বেলা ১১টায়। দিবারাত্রির টেস্টে অবশ্য প্রথম সেশনের পর চা বিরতি আর দ্বিতীয় সেশনের পর ডিনার বিরতি দেওয়া হয়ে থাকে।
ভারত–দক্ষিণ আফ্রিকার ২ টেস্টের সিরিজ শুরু হবে ১৪ নভেম্বর কলকাতা টেস্ট দিয়ে।
 ‘ক্রিকেটারদের বর্ণবিদ্বেষী মন্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়’
‘ক্রিকেটারদের বর্ণবিদ্বেষী মন্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়’