জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেছেন, সংস্কার প্রক্রিয়াকে বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা দেশের বাইরে থেকেও হচ্ছে, ভেতর থেকেও হচ্ছে। যারা মনে করে, বর্তমান কাঠামো অব্যাহত রাখা দরকার। বিশেষ করে যারা পরাজিত শক্তি, তারা এটা মনে করে। তাই সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।

রাজধানীর তোপখানা রোডের সিরডাপ মিলনায়তনে বৃহস্পতিবার ‘রাষ্ট্র সংস্কারে রাজনৈতিক ঐকমত্য ও নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে তিনি এসব কথা বলেন। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) আয়োজিত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব ও সঞ্চালনা করেন সংগঠনের সম্পাদক ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড.

বদিউল আলম মজুমদার।

আলী রীয়াজ আরও বলেন, ‘দেশের শাসন ব্যবস্থার বিদ্যমান কাঠামো স্বৈরাচার তৈরিতে ভূমিকা রাখছে। তাই প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত সংস্কার জরুরি। তবে সংস্কারের সঙ্গে নির্বাচনের কোনো বিরোধ নেই। এটা একসঙ্গে চলতে পারে। কিছু জরুরি সংস্কার করে নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। কেউ কেউ বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো স্বাধীনতার এত বছরে প্রয়োজনীয় সংস্কার করেনি। তাই সংস্কার না করে কোনোভাবেই নির্বাচন দেওয়া যাবে না।’

সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবিত সুপারিশে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ তুলে দিয়ে বহুত্ববাদ ও রাষ্ট্রধর্ম রাখার মধ্যে স্ববিরোধিতা এবং বিভিন্ন কমিশনের সুপারিশে মতপার্থক্য আছে– এ নিয়ে এক বক্তার প্রশ্নের উত্তর দেন আলী রীয়াজ।

তিনি বলেন, ‘সব কমিশন স্বাধীন সুপারিশ করেছে। রাজনৈতিক দলের মতামতের ভিত্তিতে এটি চূড়ান্ত হবে। আর বিদ্যমান সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা থাকলেও বিভিন্ন সময় সংখ্যালঘু নির্যাতন হয়েছে। বহুত্ববাদ সবার প্রতিনিধিত্ব করবে। বিভিন্ন সময় প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকলেও রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করেনি। এর একটি রাজনৈতিক বাস্তবতা আছে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্যরা সব বিষয়ে ঐকমত্য হলেও রাষ্ট্রধর্ম রাখার বিষয়ে সবাই একমত হননি।’

ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের তিনটি ম্যান্ডেট রয়েছে। পতিত স্বৈরাচার যাতে ফিরে না আসতে পারে তার জন্য রাষ্ট্র সংস্কার করা, যারা মানুষ হত্যা করেছে তাদের বিচার এবং নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। এগুলো একটার সঙ্গে একটা সম্পৃক্ত, একসঙ্গেই চলতে পারে। বিশেষ করে সংস্কার ও নির্বাচন একে অপরের পরিপূরক। যারা বলেন, সংস্কার বাদ দিয়ে নির্বাচন অথবা নির্বাচন বাদ দিয়ে সংস্কার করতে হবে– দুটিই ঠিক নয়।’  

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সদস্য বিচারপতি এমদাদুল হক বলেন, ‘বিচার বিভাগ নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। এটা স্বাধীন কিংবা সঠিকভাবে কাজ করছে কিনা, সেই জায়গায় সংশয় আছে। এটা দূর করতে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন থেকে অনেকগুলো প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সুজন বা অন্যান্য নাগরিক সংগঠনগুলো উদ্যোগ নিলে সংস্কার সার্বিকভাবে সফল হবে।’   

সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান বলেন, ‘সংস্কার প্রস্তাবের কতগুলো বিষয়ে একমত পোষণ করি। কিন্তু কতগুলো নিয়ে বিতর্ক জুড়ে দেওয়া হয়েছে, এটা কাম্য নয়। প্রজাতন্ত্রের জায়গায় নাগরিকতন্ত্রকে নিয়ে আসার বিরোধিতা করি। ১৬ ডিসেম্বর লাখ লাখ লোকের রক্তে দেশ স্বাধীন হয়েছে। সেই জায়গায় কলমের এক খোঁচায় প্রজাতন্ত্র পরিবর্তন করার প্রয়োজন নেই।’ 

তিনি বলেন, ‘যৌক্তিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের অজর্নগুলো ধরে রাখতে হবে। এটা ঠিক বাহাত্তরের সংবিধানে অনেক ভুল রয়েছে, সেগুলো সংশোধন করা যেতে পারে। কিন্তু বাতিল করে নতুন করে লেখার কথা বলা অযৌক্তিক। ধর্মকে বিযুক্ত রেখেই রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে।’

সাবেক সচিব ও লেখক-গবেষক একেএম আবদুল আউয়াল মজুমদার বলেন, ‘রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে প্রতিটি জায়গায় সৎ ও দক্ষ লোককে নিয়োগ দিতে হবে। না হলে কাজটা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে না।’   

জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, ‘শেখ হাসিনার প্রায় ১৫ বছরের শাসনে সমস্ত প্রতিষ্ঠান ভঙ্গুর হয়ে গেছে। সেগুলোকে মেরামত করে নতুনভাবে তৈরি করতে হবে। সেজন্যই সংস্কার প্রয়োজন। সংস্কারের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপরও চাপ ধরে রাখতে হবে।’ 

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার বলেন, ‘৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর আমরা সংস্কারের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিতে পারছি। এ ক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তবে সংস্কার নিয়ে আশাবাদের জায়গা আছে। সরকার আশাবাদের জায়গাটা জোরালো আর হতাশার জায়গা সংকুচিত করার চেষ্টা করছে।’   

বৈঠকে মূল বক্তব্য তুলে ধরেন সুজনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার। আরও বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আসিফ মোহাম্মদ শাহান, ভয়েস ফর রিফর্মের সহসমন্বয়কারী ও প্রকাশক-গবেষক মাহরুখ মহিউদ্দীন, সুজনের ঢাকা মহানগর সভাপতি জোবায়েরুল ইসলাম নাহিদ প্রমুখ। 
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: আল র য় জ স স ক র কর র জন ত ক ঐকমত য সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে ঐকমত্য না হলে গণভোট ছাড়া উপায় নেই: এবি পার্টি

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে অংশ নিয়ে আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেছেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারলে গণভোট ছাড়া উপায় নেই।

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে আজ বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক হয়। বৈঠকের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এবি পার্টির চেয়ারম্যান এ কথা বলেন।

ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে মজিবুর রহমান বলেছেন, ‘সংবিধান পরিবর্তন, সংস্কার, সংশোধন, নতুন করে লেখা বা বাতিলের চূড়ান্ত ক্ষমতা জনগণের। আমরা ঐক্যবদ্ধ মতামতের ভিত্তিতে জুলাই সনদ তৈরি করেছি, হয়তো কয়েকটি বিষয়ে কারও কারও “নোট অব ডিসেন্ট” (দ্বিমত) আছে। কিন্তু চূড়ান্ত কোনটা হবে, তা নির্ধারণের মূল ক্ষমতা জনগণের।’

কমিশনের আজকের প্রস্তাবে জুলাই ঘোষণাপত্রের ২২ নম্বর অনুচ্ছেদকে রেফারেন্স আকারে উল্লেখ করায় কোনো কোনো রাজনৈতিক দল ও নেতা জুলাই ঘোষণাপত্রের বৈধতা নিয়ে মন্তব্য করেন। এ বিষয়ে এবি পার্টির চেয়ারম্যান সাংবাদিকদের বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে যাঁরা আজ প্রশ্ন তুলছেন, কাল তাঁরা সংসদে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করবেন এবং এই সনদকে প্রশ্নবিদ্ধ করবেন না, তার নিশ্চয়তা কী?

এবি পার্টির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সানী আবদুল হক বলেন, সংবিধানে এটা নেই, ওটা নেই বলে সংবিধান সংস্কার করা যাবে না—এই ধারণা অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাপরিপন্থী। রাজনৈতিক দলগুলো যদি জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতির প্রশ্নে নিজেদের অবস্থান থেকে নমনীয় না হয়, তবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পুরো প্রচেষ্টা মুখ থুবড়ে পড়বে।

আশঙ্কা প্রকাশ করে এবি পার্টির এই নেতা বলেন, এমন পরিস্থিতি জাতিকে এক গভীর সংকটের দিকে ঠেলে দেবে। সুতরাং জাতীয় স্বার্থে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা জরুরি; অন্যথায় গণভোট ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।

আরও পড়ুনবর্ধিত মেয়াদের আগেই জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি চূড়ান্ত করতে চায় কমিশন: আলী রীয়াজ৪ ঘণ্টা আগে

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সাংবিধানিক আদেশ ও গণভোটের সুপারিশ, একমত নয় দলগুলো
  • ‘সংবিধান আদেশ’ জারির সুপারিশ করতে পারে কমিশন: আলী রীয়াজ
  • জুলাই সনদের বাস্তবায়নে দেরি হলে জনগণ আবারও রাস্তায় নামবে: জামায়াত নেতা রফিকুল
  • কমিটি গঠন, প্রতিবেদন না আসা পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত 
  • বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে ঐকমত্য না হলে গণভোট ছাড়া উপায় নেই: এবি পার্টি
  • বর্ধিত মেয়াদের আগেই জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি চূড়ান্ত করতে চায় কমিশন: আলী রীয়াজ
  • বিএনপি নির্বাচনমুখী কর্মসূচিতে যাবে
  • দলগুলোর সঙ্গে বুধবার আবার আলোচনায় বসছে ঐকমত্য কমিশন
  • ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই নির্বাচন হতে হবে
  • জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ ফের এক মাস বাড়ল