ধর্ষণসহ নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় দেশজুড়ে প্রতিবাদ–সমাবেশ চলছে। নির্যাতন প্রতিরোধ ও দ্রুতবিচার নিশ্চিতের পাশাপাশি বিপদগ্রস্ত নারীদের সহায়তাব্যবস্থা আরও জোরদার করার বিষয়টিও এখন আলোচনায়। সরকার পুলিশের ‘হটলাইন’ সেবার পাশাপাশি ‘শর্ট কোড’ চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অথচ নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে সরকারের সবচেয়ে বড় যে প্রকল্প রয়েছে, সেটির অবস্থা নাজুক। এই প্রকল্পের আওতায় জাতীয় হেল্পলাইন ‘১০৯’ চলছে জোড়াতালি দিয়ে। প্রকল্প নিয়ে অনিশ্চয়তা, জনবলসংকট ও অনিয়মিত বেতনের কারণে দুই বছর ধরে অসন্তোষ চলছে প্রকল্পের কর্মকর্তা–কর্মচারীদের মধ্যে।

১১ মার্চ প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে শর্ট কোড চালুর সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। বর্তমানে যে জাতীয় হেল্পলাইন ‘৩৩৩’ রয়েছে, তার সঙ্গে আরেকটি ৩ যোগ করে ‘৩৩৩৩’ ডায়াল করে নারী নির্যাতনবিষয়ক যেকোনো অভিযোগ করা যাবে। অথবা ৩৩৩ নম্বরে ফোন করে সেবা অপশনে গিয়ে ৩ চাপলে পুলিশের কলসেন্টারে ফরোয়ার্ড হয়ে যাবে।

নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে একাধিক হটলাইনের পরিবর্তে ১৩ বছরের পুরোনো জাতীয় হেল্পলাইন ১০৯–কে আরও শক্তিশালী করার কথা বলছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় পরিচালিত ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টি সেক্টরাল প্রোগ্রাম (চতুর্থ পর্যায়)’– এর ৯টি কার্যক্রমের একটি হচ্ছে হেল্পলাইন ১০৯। বাকি ৮টি কার্যক্রম হচ্ছে—১৪টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থাপিত ওয়ান–স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি), জেলা সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৬৭টি ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেল, ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরি, আটটি বিভাগীয় ডিএনএ স্ক্রিনিং ল্যাবরেটরি, ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার, আটটি আঞ্চলিক ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার, মোবাইল অ্যাপ ‘জয়’, রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের জন্য বিশেষ কার্যক্রম এবং নির্যাতন প্রতিরোধে জনসচেতনতা কার্যক্রম।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম প্রথম আলোকে বলেন, হেল্পলাইনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এর প্রতি মানুষের আস্থা তৈরি করা। মানুষ বিপদে পড়েই কল করেন। কল করে যদি কেউ উপকার না পান বা হেল্পলাইন যদি সাড়া না দেয়, তাহলে ১০০টা হেল্পলাইন করেও লাভ হবে না। হেল্পলাইনকে নারী ও শিশু প্রতিরোধে আরও কার্যকর করার ওপর জোর দেন তিনি।

জোড়াতালির প্রকল্প

হেল্পলাইন ১০৯–এর অফিস রাজধানীর ইস্কাটন রোডে অবস্থিত মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরে। ২০১২ সালের শুরুতে ১০৯২১ নম্বরটি দিয়ে হেল্পলাইনটি চালু হয়। ২০১৭ সাল থেকে এটি ১০৯ নম্বরের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। ২০১৪ সাল থেকে এটি টোল ফ্রি অর্থাৎ বিনা মূল্যে কল করা যায়। ২০২০ সাল পর্যন্ত ১০৯–এ কল গ্রহীতা ৪০ জনের পাশাপাশি ২০ জন আউটসোর্সিং এবং সার্ক উন্নয়ন তহবিল প্রকল্প থেকে ১৮ জন মোট ৭৮ জনবল কাজ করতেন। বর্তমানে তিন পালায় ৩১ জন কাজ করছেন। দুই বছর ধরেই বেতন নিয়ে সংকটের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে হেল্পলাইনটিকে। সর্বশেষ দুই মাস ধরে প্রকল্পের কর্মকর্তা–কর্মচারীরা বেতন পাচ্ছেন না।

হেল্পলাইন ১০৯ যে প্রকল্পের আওতায় চলে, সেটি ২০০০ সালের জুলাই থেকে বাংলাদেশ ও ডেনমার্কের সরকারি সংস্থা ড্যানিশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির (ডানিডা) যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত হচ্ছিল। ২০২২ সালের জুনের পর ডানিডা প্রকল্প থেকে সরে যায়। তারা চলে যাওয়ায় ব্যয় কমিয়ে আনে সরকার। মন্ত্রণালয়ের পরিচালন বাজেট থেকে ব্যয় নিয়ে কোনো রকমে প্রকল্পটিকে চালু রাখা হয়েছে।

মানুষ বিপদে পড়েই কল করেন। কল করে যদি কেউ উপকার না পান বা হেল্পলাইন যদি সাড়া না দেয়, তাহলে ১০০টা হেল্পলাইন করেও লাভ হবে না। শাহীন আনাম, নির্বাহী পরিচালক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

১০৯–এর ইনচার্জ ও কর্মসূচি কর্মকর্তা রাইসুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, নানা সহায়তা চেয়ে ফোন আসে। ফলে এটিকে শুধু কল গ্রহণ করার পর্যায়ে রাখলে চলে না। ভুক্তভোগীদের উদ্ধার ও সরাসরি সহায়তা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ১০৯–কে শক্তিশালী করলে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে এই হেল্পলাইনই যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারবে।

শক্তিশালী করতে হলে কী কী করা প্রয়োজন জানতে চাইলে রাইসুল ইসলাম বলেন, জনবল বাড়াতে হবে। এত কমসংখ্যক জনবল দিয়ে ২৪ ঘণ্টায় এত বিপুলসংখ্যক কল ধরা সম্ভব নয়। হেল্পলাইনে কল ড্রপের হার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। ভুক্তভোগী কোথা থেকে কল করছেন তা শনাক্তের জন্য আধুনিক সফটওয়্যার, সার্ভারের সক্ষমতা ও নিজস্ব যানবাহন দরকার। হেল্পলাইনে পুলিশ, আইনজীবী, মনোসামাজিক কাউন্সিলর, চিকিৎসকদের সমন্বয়ে একটি দল থাকা দরকার, যাতে ভুক্তভোগী হেল্পলাইনে কল করে সরাসরি সহায়তা পেতে পারে।

হেল্পলাইন ১০৯–এর তথ্য অনুসারে, গত বছর ৯ লাখ ৩৯ হাজারের বেশি কল এসেছে। দিনে আড়াই হাজারের বেশি কল এসেছে। কলের মধ্যে ৮ লাখ ৪৫ হাজারের বেশি কল অর্থাৎ ৯০ শতাংশ কল করা ব্যক্তিদের তথ্য দিয়ে সহায়তা করা হয়েছে। ৩৩ হাজারের বেশি আইনি–সহায়তা, ১৪ হাজারের বেশি কাউন্সেলিং, প্রায় সাড়ে ১০ হাজার কল পুলিশের সহায়তা চেয়ে এবং প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কলের বিপরীতে চিকিৎসা–সহায়তা দেওয়া হয়েছে; বাকিগুলো অন্যান্য কারণে। আর এ বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে কল এসেছে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৮টি।

আগামী জুলাই মাসের মধ্যে সংকট সামলিয়ে পরিবর্তন আসবে বলে জানিয়েছেন ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টি সেক্টরাল প্রোগ্রাম’–এর প্রকল্প পরিচালক যুগ্ম সচিব প্রকাশ কান্তি চৌধুরী। প্রথম আলোকে তিনি জানান, পুরো প্রকল্পটি এখন একটি নতুন স্থানান্তরে যাচ্ছে বলে বেতনসহ কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। জুলাই মাসে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ ও প্রতিকারে সমন্বিত সেবা জোরদারকরণ এবং কুইক রেসপন্স টিমের কার্যক্রম’ শিরোনামে ৩৬০ কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ের ৫৫৩ জনবলের নতুন প্রকল্প আসছে। নতুন প্রকল্পে ১০৯–এর জনবল বেড়ে ৬০ হবে। অন্যান্য কার্যক্রমের ব্যাপকতাও বাড়ছে।

প্রকাশ কান্তি চৌধুরী বলেন, কুইক রেসপন্স টিম, ঘটনার নিয়মিত ফলোআপ ও ভুক্তভোগীকে সহায়তা, ভুক্তভোগীকে এক লাখ টাকা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে আত্ম–কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়ার মতো নতুন ব্যবস্থা থাকবে। নতুন প্রকল্প এলে চলমান প্রকল্পের ২৬২ কর্মকর্তা–কর্মচারী চাকরি হারাবেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, নতুন প্রকল্পের জনবলকে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ পাবে। পুরোনো জনবলও আউটসোর্সিং হিসেবে নিয়োগ পাবে। ধীরে ধীরে প্রকল্পের কার্যক্রমকে (জনবল ছাড়া) রাজস্ব কার্যক্রমে নেওয়া হবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রকল প র কর মকর ত পর চ ল র জন য সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সুনজর কখন পড়বে

চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়া ইউনিয়নে দ্বিতল ভবনবিশিষ্ট একটি মা ও শিশু কল্যাণকেন্দ্রে ওষুধ নেই, চিকিৎসক নেই, বিদ্যুৎ–সংযোগ নেই। ফলে তেমন একটা রোগীও নেই। এই ‘নাই নাই’ হাসপাতালটির নাম মাস্টারদা সূর্য সেন মা ও শিশু কল্যাণকেন্দ্র। এভাবে কি একটা হাসপাতাল চলতে পারে? প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে যাওয়ার এমন নমুনা আমাদের হতাশ করে। দেশজুড়ে এ রকম আরও চিত্র আমরা দেখতে পাই, যা আমাদের স্বাস্থ্য খাত নিয়ে ইতিবাচক কোনো বার্তা দেয় না।

প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, ১৯৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এবং ২০০৩ সালে চালু হওয়া এই ১০ শয্যার হাসপাতালটির মূল সমস্যা জনবলসংকট। ১৬টি পদের ১টিতেও স্থায়ী জনবল পদায়ন করা হয়নি। অন্য হাসপাতাল থেকে প্রেষণে এসে মাত্র তিনজন কর্মচারী (একজন উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার, একজন মিডওয়াইফ ও একজন আয়া) সপ্তাহে কয়েক দিন করে দায়িত্ব পালন করেন। এটি একটি জরুরি প্রসূতিসেবাকেন্দ্র, যা ২৪ ঘণ্টা চালু থাকার কথা। কিন্তু বিদ্যুৎ নেই, ডাক্তার নেই এবং প্রয়োজনীয় জনবলের অভাবে এর কার্যক্রম এখন প্রায় স্থবির।

হাসপাতালের বিদ্যুৎ বিল বকেয়া থাকায় প্রায় তিন মাস ধরে বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন। ফলে পানীয় জলের ব্যবস্থাও নেই। বিনা মূল্যের ওষুধ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে প্রায় ছয় মাস ধরে। এ পরিস্থিতিতে একজন রোগী কীভাবে এখানে স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসবেন? যেখানে হাসপাতালের বাইরের সাইনবোর্ডে জরুরি প্রসূতিসেবার জন্য ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকার কথা লেখা, সেখানে মূল ফটকে তালা ঝোলানো। এটি জনগণের সঙ্গে একধরনের প্রতারণা। হাসপাতালটি চালু না থাকায় মা ও শিশুদের স্বাস্থ্যসেবার জন্য স্থানীয় বেসরকারি হাসপাতাল বা চট্টগ্রাম শহরে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। এতে সময় ও অর্থ—দুটোরই অপচয় তো বটেই, চরম ভোগান্তিরও শিকার হতে হয় মানুষকে।

যে মিডওয়াইফরা এখানে কাজ করছেন, তাঁরা জানান, এখন মাসে মাত্র চার-পাঁচজন প্রসূতি সেবা নিতে আসেন, যেখানে আগে শতাধিক প্রসূতি সেবা পেতেন। নিরাপত্তা প্রহরীরা দুই বছর ধরে বেতন পাচ্ছেন না। তবু নিয়মিত বেতন পাওয়ার আশায় তাঁরা এখনো কাজ করে যাচ্ছেন। এ অসহনীয় দুর্ভোগের কারণ হলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চরম উদাসীনতা। উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা জানান, তাঁরা বারবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জনবলসংকটের কথা জানিয়েছেন, কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি।

একটি মা ও শিশু কল্যাণকেন্দ্রের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালু রাখতে কেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার ধরনা দিতে হবে? জনবল নিয়োগ, কর্মচারীদের বকেয়া বেতন পরিশোধ, বিদ্যুতের ব্যবস্থা কার্যকর করা—সব ধরনের সংকট দূর করতে হাসপাতালটির দিকে আন্তরিক মনোযোগ দেওয়া হবে, সেটিই আমাদের প্রত্যাশা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জনবল নিয়োগ দিচ্ছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী, পদ ৪৩০
  • হাতে ভোট গণনাসহ ছাত্রদলের ৬ দাবি, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সে ভোট গ্রহণের সিদ্ধান্ত
  • ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সুনজর কখন পড়বে
  • যে হাসপাতালে চিকিৎসক, ওষুধ, বিদ্যুৎ–সংযোগ কিছুই নেই