তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি আপিল শুনানির জন্য আপিল বিভাগের আগামীকাল মঙ্গলবারের কার্যতালিকায় উঠেছে। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের বেঞ্চে শুনানির জন্য আপিল দুটি রয়েছে। এর একটি আপিল সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তির, অন্যটি বিএনপির।

আজ সোমবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা যায়, আপিল বিভাগের মঙ্গলবারের কার্যতালিকায় ‘ড.

বদিউল আলম মজুমদার এবং অন্যান্য বনাম আব্দুল মান্নান খান এবং অন্যান্য’ শিরোনামে একটি আপিল ৬ নম্বর ক্রমিকে রয়েছে, সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর রিভিউ আবেদনসহ কয়েকটি রিভিউ আবেদন রয়েছে। আর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বনাম আব্দুল মান্নান খান এবং অন্যান্য শিরোনামে অপর আপিলটি কার্যতালিকার ৭ নম্বর ক্রমিকে রয়েছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে ১৪ বছর আগে আপিল বিভাগ রায় দিয়েছিলেন। তখন আওয়ামী লীগ ছিল ক্ষমতায়, আদালতের রায়ের পর তারা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধন এনে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী এই সরকারব্যবস্থা বাদ দেয় শাসনতন্ত্র থেকে।

গত বছর জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি আবেদন করেন। এরপর গত বছরের অক্টোবরে আবেদন করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল। তারপর ওই মাসে আরেকটি আবেদন করেন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। নওগাঁর রানীনগরের নারায়ণপাড়ার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেন আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে গত বছর আরেকটি আবেদন করেন। এ ছাড়া একটি সংগঠন ইন্টারভেনার (পক্ষ) হিসেবে যুক্ত হয়।

রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি শেষে গত ২৭ আগস্ট লিভ মঞ্জুর (আপিলের অনুমতি) করে আদেশ দেন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ। বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তির এবং বিএনপির মহাসচিবের করা রিভিউ আবেদন থেকে উদ্ভূত আপিলের সঙ্গে রিভিউ আবেদনগুলো শুনানির জন্য যুক্ত হবে বলে উল্লেখ করা হয়। আদেশে আপিলকারীপক্ষকে দুই সপ্তহের মধ্যে এবং বিবাদীপক্ষকে পরবর্তী দুই সপ্তাহের মধ্যে আপিলের সারসংক্ষেপ দায়ের করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে আপিল শুনানির জন্য ২১ অক্টোবর কার্যতালিকার শীর্ষে আসবে বলে আদেশে উল্লেখ করা হয়।

মামলার পূর্বাপর

১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই সংশোধনীর বৈধতা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এম সলিমউল্লাহসহ অন্যরা ১৯৯৮ সালে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছিলেন। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রুল দেন। হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট রায় দেন। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীকে বৈধ ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছিল সেই রায়।

রায়ের বিরুদ্ধে সরাসরি আপিলের অনুমতি দেওয়া হয়। এর ধারাবাহিকতায় ২০০৫ সালে আপিল করে রিট আবেদনকারীপক্ষ। এ আপিল মঞ্জুর করে ২০১১ সালের ১০ মে আপিল বিভাগ রায় ঘোষণা করেন। রায়ের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিলোপসহ বেশ কিছু বিষয়ে আনা পঞ্চদশ সংশোধনী আইন ২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে পাস হয়। ২০১১ সালের ৩ জুলাই এ-সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ করা হয়।

আরও পড়ুনতত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তির বিধান বাতিল, ফিরল গণভোট ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪

এদিকে পঞ্চদশ সংশোধনী আইন চ্যালেঞ্জ করে গত বছরের ১৮ আগস্ট বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি রিট আবেদন করেন। তার প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রুল দেন।

পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ১৬টি ধারার বৈধতা নিয়ে নওগাঁর রানীনগরের নারায়ণপাড়ার মোফাজ্জল হোসেন গত বছরের অক্টোবরে একটি রিট করেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে রুল হয়। রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রায় ঘোষণা করেন। রায়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তি-সংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ২০ ও ২১ ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটের বিধান পুনর্বহাল এবং পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের আরও চারটি ধারা বাতিল ঘোষণা করা হয়।

আরও পড়ুনতত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা যেভাবে বাতিল হয়েছিল০৯ আগস্ট ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আপ ল ব ভ গ র শ ন ন র জন য র ক র যত ল ক গত বছর র ব এনপ র আপ ল র আগস ট

এছাড়াও পড়ুন:

শেখ হাসিনার ‘মেটিকুলাস প্ল্যান’ ছিল: ট্রাইব্যুনাল

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি ‘মেটিকুলাস প্ল্যান’ ছিল বলে উল্লেখ করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল–১। ট্রাইব্যুনাল আরও বলেছেন, ওই সময় সবকিছুই শেখ হাসিনার নিয়ন্ত্রণে ছিল।

গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে করা মামলায় সোমবার আসামিপক্ষের আইনজীবীর যুক্তিতর্কের একপর্যায়ে ট্রাইব্যুনাল এসব কথা বলেন।

বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদার নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল–১–এ এই মামলার বিচার চলছে। এই ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

এদিন প্রথম দিনের মতো যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী মো. আমির হোসেন। তিনি এ মামলার পলাতক আসামি শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী।

যুক্তিতর্কের একপর্যায়ে আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, ছাত্রদের এই আন্দোলন (বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন) ছিল একধরনের ভুল প্রক্রিয়ায় করা। শেখ হাসিনা কোটা পদ্ধতি বিলোপ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে অন্য একজন হাইকোর্ট বিভাগে রিট করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে কোটা পদ্ধতি পুনর্বহাল হয়। বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহী বিভাগ কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না।

জবাবে ট্রাইব্যুনাল বলেন, ‘…আপনি যদি অ্যাকটিভলি পার্টিসিপেট না করেন, ডিসপোজালের কোনো ব্যবস্থা না করেন, কোর্টকে যদি কো–অপারেট না করেন, সেটাই তো ইনফ্লুয়েন্স (প্রভাব)।…একপর্যায়ে দেখা গেল এক দিনের মধ্যে, দুই দিনের মধ্যে আপনি ফিক্সড করলেন ফর হিয়ারিং (শুনানির দিন ধার্য)।…ইউ হ্যাড আ মেটিকুলাস প্ল্যান এবং এভরিথিং ওয়াজ…আন্ডার ইউর কন্ট্রোল (আপনার একটি ম্যাটিকুলাস প্ল্যান ছিল এবং সবকিছুই আপনার নিয়ন্ত্রণে ছিল)।’

জবাবে আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) যে হস্তক্ষেপ করেছেন, এ রকম কোনো ডকুমেন্ট আছে? ট্রাইব্যুনাল যেটা বলেছেন, সেটা অনুমানভিত্তিক।

তখন ট্রাইব্যুনাল বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী হস্তক্ষেপ করেননি, সেটা বলেন।

পরে ট্রাইব্যুনাল আরও বলেন, সব উপাদান সরকারের হাতে আছে। এই যে তাঁরা এখন মামলা করছেন, প্রসিকিউশন পক্ষ যদি কাজ না করে, তাহলে তাঁরা আদৌ কাজ করতে পারবেন না। সুতরাং সব উপাদান সরকারের হাতে থাকে।

এমন অবস্থায় আইনজীবী প্রশ্ন করেন, তাহলে কি তিনি ধরে নেবেন, এই বিচার রাষ্ট্র যা চাবে তা–ই হবে? জবাবে ট্রাইব্যুনাল বলেন, রাষ্ট্র যা চাবে তা করতে হবে না। রাষ্ট্রের হাতে সুইচগুলো আছে। অনেকগুলো সুইচ আছে। যেগুলো টিপ দিয়ে বন্ধ করে ফেলা যায়। আপনি কি একমত?

উত্তরে আইনজীবী বলেন, তাহলে তাঁরা ধরে নিতে পারেন, বর্তমান সরকার বা রাষ্ট্র সেই সুইচগুলো ব্যবহার করলেও করতে পারেন?

তখন ট্রাইব্যুনাল বলেন, ‘পারে, উই উইল নট কেয়ার (আমরা পরোয়া করব না)। রাষ্ট্র যদি তাঁর নিরাপত্তা বন্ধ করে দেয়, তিনি ট্রাইব্যুনালে আসতে পারবেন না। তাহলে তিনি কীভাবে কাজ করবেন। রাষ্ট্র যদি বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেয়, তাহলে কীভাবে কাজ করবেন। রাষ্ট্র আসামিপক্ষের আইনজীবীকে আটকে রাখলে তিনি আসতে পারবেন না। রাষ্ট্রের হাতে ব্যবস্থা আছে। সব ব্যবস্থা করে দেওয়ার পরে রায়ের প্রশ্ন যখন আসবে, দ্যান উই উইল নট কেয়ার গভর্নমেন্ট।’

মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ

প্রসিকিউশনের লক্ষ্যভিত্তিক নিপীড়নের বক্তব্য সঠিক নয় উল্লেখ করে যুক্তিতর্কে আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে কথিত মতে সম্ভবত দেড় হাজার আন্দোলনকারী ছাত্র–জনতা নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে সংগঠক আবু সাঈদ (বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী) ছাড়া আর কেউ মৃত্যুবরণ করেননি। লক্ষ্যভিত্তিক নিপীড়ন যদি হতো, তাহলে শেখ হাসিনা কর্মী বাহিনী ও পুলিশ বাহিনী দিয়ে হাসনাত আবদুল্লাহ, সারজিস আলম, নাহিদ ইসলামসহ অন্য যাঁরা নেতৃস্থানীয় ছিলেন, তাদের মেরে ফেলতে পারতেন, কিন্তু মারেননি। অর্থাৎ লক্ষ্যভিত্তিক নিপীড়নের বক্তব্য সঠিক নয়।

তখন ট্রাইব্যুনাল বলেন, টার্গেটেড (লক্ষ্যভিত্তিক) মানে সবাইকে মেরে ফেলবে, এটা বোঝায় না। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের শীর্ষ নেতা (শেখ মুজিবুর রহমান) তো পাকিস্তানিদের পকেটে ছিলেন। তাঁকে মেরেছে? আ স ম আবদুর রবকে মেরেছে? আরও যাঁরা নেতা ছিলেন, সবাইকে মেরেছে? কোনো নেতা মরেননি। যারা টার্গেট করে, তাদের স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) থাকে। কাকে মারবে, কতটুকু মারবে, কোথায় মারবে, কখন মারবে। স্বাধীনতাযুদ্ধে কোনো নেতা মারা যাননি।

উত্তরে আইনজীবী বলেন, ১৯৭১ সালে নেতারা সব ভারতে ছিলেন। তাঁরা মারা যাবেন কোত্থেকে?

সম্পর্কিত নিবন্ধ