রাষ্ট্র মেরামত জলে গেলে জনতা ছাড়বে না
Published: 28th, March 2025 GMT
সবাই দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন চান। গণঅভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তনের সময় মানুষের মূল চাহিদা ছিল ‘রাষ্ট্র মেরামত করা’। এই আকাঙ্ক্ষাই ছাত্রদের আলাদা শক্তি জোগান দিয়েছিল। এই শক্তি রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘ ১৫ বছর সংগ্রাম করেও অর্জন করতে পারেনি। কারণ তাদের সংস্কার বা রাষ্ট্র মেরামতের সাহসী কোনো কর্মসূচি ছিল না। অবশ্য বিএনপি শেষ প্রান্তিকে এসে ৩১ দফার একটি সংস্কার প্রস্তাবের কথা বলেছিল। সেখানে ইতিবাচক অনেক কথা ছিল, যদিও সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ ও আরও কিছু বিষয় নিয়ে সাহসের ঘাটতি ছিল।
আমাদের ইতিহাসের বড় বাঁকগুলোতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব অনেকাংশেই যথেষ্ট সাহস দেখাতে পারেনি। সে কারণেই এই দেশে বারবার জনতা এগিয়েছে, নেতৃত্ব থেকেছে পেছনে। দেশের স্বাধীনতাটা যুদ্ধ করেই এসেছে। তাই তার একটা চেতনা জনমনে ছিলই। তা না হরে যুদ্ধ করার সাহস ও প্রেরণা জনতা পেল কোথা থেকে?
এখন যারা ‘নির্বাচন কোনো অজুহাতে দীর্ঘায়িত করা যাবে না’ বলছেন, তারা কি সংস্কারের আগেই নির্বাচন চান? রাষ্ট্র মেরামতের আগেই নির্বাচন চান? কেন চান? নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর তিন জোটের রূপরেখার দলিল অপ্রয়োজনীয় কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। এ কারণেই পরের জেনারেশনকে আবারও রক্ত দিতে হলো। মাঝখানের এই ৩৪ বছর জাতির বেঘোরে কাটল। এর মধ্য থেকেই আমরা শিখেছি– গণতন্ত্র মানে শুধুই এক দিনের নির্বাচন নয়; সারাবছর চর্চার পরিবেশ তৈরি করার বিষয়। রাষ্ট্র মেরামত বা সংস্কার না করা গেলে ওই পরিবেশ তৈরি হবে না।
আমরা এ দেশেই নির্বাচিত কিন্তু অগণতান্ত্রিক সরকারও অনেক দেখেছি। দেশের সব রাজনৈতিক দল নির্বাচন এলেই অন্তর্বর্তী বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়। ওই অনির্বাচিত সরকারই ভালো নির্বাচন করতে পারবে বলে মানুষ মনে করেছে। মানুষের এই আস্থার নামই গণতন্ত্র। শুধু ভোটের দিন ভোটের আগে ‘ফোঁস করা পানি’ খাওয়ার নাম গণতন্ত্র নয়। এ দেশে বড় দলের বড় দায়িত্বশীলতা থাকতেই হবে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কথাবার্তা ইতোমধ্যে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তিনি দলকে ভালোভাবে গোছাতে চান বলেই মনে হয়েছে। কিন্তু সবকিছু চাইলেই পারা যায় না। রাজনীতিতে আমাদের মতো গরিব ও তস্য বেকারদের দেশে গণ-আয়তনে কাজ আছে, এমন সব দলেই ‘খাই খাই’ কালচার থাকে। সেই রাজনৈতিক সংস্কৃতি পাল্টাতে চাইলেও কিছু সময় দিতে এবং নিতে হবে।
আমি কিন্তু নির্বাচনবিরোধী নই। আমিও নির্বাচিত সরকার চাই, তবে অসময়ে নয়। নিজেরা কতটা গণতন্ত্রী; তা প্রমাণ দেওয়ার জন্য স্থানীয় সরকার এবং জাতীয় সংসদ– দুই নির্বাচনের কোনটা আগে হবে, নাকি একসঙ্গে, তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো সরকারকে বাদ দিয়েই একটা মতৈক্য তৈরি করে দেখাতে পারে। গণপরিষদ নির্বাচন ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে মতৈক্য তৈরি করার চেষ্টা চলতে পারে। তাতেই বোঝা যাবে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব কতটা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি অর্জন করতে পারল। পুরোনো রাজনৈতিক বড় দলগুলো ক্ষমতায় গেলে কতটা ফ্যাসিবাদী হতে পারে, তা আমরা জানি; দেখেছি।
নতুন দলের ক্ষেত্রেও নির্ভরতার সংকট আছে। তাদেরই কারও না কারও মদদে ৩২ নম্বরে এবং বাড়িঘরে হামলা হয়েছে। সেটা মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। আবার হুট করে সেকেন্ড রিপাবলিক বলে দিলেন– এসব অস্থিরতা। যখন কিনা আপনাদের দায় বিতর্ক নিষ্পত্তি করে মতৈক্য তৈরি, তখন নিজেরাই মতবিরোধ তৈরি করলে চলবে কেন? এসব কারণে ‘তারুণ্যের অস্থিরতা’ নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।
বর্তমান সরকার ভোটে পাস করে আসেনি, তবুও গণতান্ত্রিক সরকারই বটে। কেননা, মানুষ এই সরকার চেয়েছিল। অস্ত্র উঁচিয়ে বা ভেল্কিবাজি করে এই সরকার ক্ষমতায় আসেনি। মানুষের চাওয়াটাই তো গণতন্ত্র। কারবারিদের কোটি কোটি টাকার খেলা দেখিয়ে নামকাওয়াস্তে এমপি হয়ে আখের গোছানোর নিরবচ্ছিন্ন লুটপাট-চাঁদাবাজি মানে গণতন্ত্র নয়। ফলে সংস্কার কার্যক্রম শেষ করার আগ পর্যন্ত যতই ক্লান্ত হোক সরকার; জনতা ছাড়বে না।
যারা দেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তর চায়, সরকারের কাছে তাদের আশাবাদ অনেক, যা সরকার পূরণ করতে পারছে না বলে মনে হচ্ছে। সরকারের ভেতরে আরেক সরকার বিরাজ করছে বলেই আমরা ভাস্কর্য, স্থাপনা, মাজার ভাঙা দেখেছি; প্রতিকার দেখিনি। নারী নির্যাতন, ধর্ষণ দেখেছি; প্রতিকার দেখিনি। নানা ক্ষেত্রে তৌহিদি জনতার নামে মব ভায়োলেন্স উস্কে দেওয়া চলছে; তারও শক্ত হাতে নিবারণ দেখছি না। এটা যদি চলতে থাকে, অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজচিন্তা মার খাবে। চারদিকে বৈষম্যের বিষবৃক্ষ শিকড় বিস্তার করবে এবং দিন শেষে রাষ্ট্র মেরামত জলে গেলে জনতা কিন্তু এ সরকারকেও ছাড়বে না।
জহিরুল ইসলাম: সভাপতি, বাংলাদেশ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত র ষ ট র ম র মত গণতন ত র র জন ত ক ক সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ৭ দিনের রিমান্ডে
দুর্নীতি ও রায় জালিয়াতির অভিযোগের মামলায় সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
বুধবার (৩০ জুলাই) সকালে পুলিশ তার ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করলে ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম মো. ছানাউল্ল্যাহর আদালত সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
২০২৪ সালের ২৭ অগাস্ট শাহবাগ থানায় দুর্নীতি ও রায় জালিয়াতির অভিযোগের মামলা করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মুজাহিদুল ইসলাম শাহীন।
গত ২৪ জুলাই সকালে ঢাকার ধানমন্ডির বাসা থেকে সাবেক এ প্রধান বিচারপতিকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ।
সম্প্রতি তার গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম। সংগঠনটি দাবি করেছে, ‘বিচার বিভাগ ও গণতন্ত্র ধ্বংসের মূল কারিগর’ তিনি।
খায়রুল হক ২০১০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর দেশের ১৯তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন এবং ২০১১ সালের ১৭ মে বয়স অনুযায়ী অবসর গ্রহণ করেন। বিচারপতি হিসেবে তার সবচেয়ে আলোচিত এবং বিতর্কিত রায় ছিল সংবিধানের ১৩তম সংশোধনী, অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে। ওই রায়ের পর দেশে আর কোনো নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়নি।
বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ ২০১১ সালে এই রায় ঘোষণা করে। এতে বলা হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অসাংবিধানিক এবং গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পরিপন্থি। এরপর থেকে নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরাই সরকারে থেকে নির্বাচন পরিচালনা করছে। বিরোধী দলগুলোর দাবি, এই রায়ের মধ্য দিয়েই দেশে একতরফা নির্বাচন ও গণতন্ত্রহীনতার ভিত্তি তৈরি হয়।
২০১৩ সালের ২৩ জুলাই তাকে তিন বছরের জন্য আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ওই মেয়াদ শেষে কয়েক দফা কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে তাকে পুনর্নিয়োগ দেওয়া হয়। সেখানে তিনি আইন সংস্কার সংক্রান্ত নানা প্রস্তাব ও গবেষণায় যুক্ত ছিলেন। বিভিন্ন সময় আইনি সেমিনার, বক্তৃতা এবং পরামর্শমূলক কাজে অংশ নিয়েছেন তিনি।
আওয়ামী লীগপন্থি আইনজীবী ও মহলগুলো তাকে ‘সংবিধান রক্ষার সাহসী রূপকার’ হিসেবে অভিহিত করলেও, বিএনপি ও তাদের সহযোগী সংগঠনগুলোর মতে তিনি ‘বিচার বিভাগের রাজনৈতিকীকরণের পথপ্রদর্শক’।
জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম বলেছে, ‘তত্ত্বাবধায়ক বাতিল করে তিনি দেশের নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংস করেছেন।’
ঢাকা/কেএন/ইভা