২০২৪-এর জুলাই গণ–অভ্যুত্থান এ অঞ্চলে একাত্তরের জনযুদ্ধের পর একটি অনন্যসাধারণ নতুন ঘটনা। বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের বা দলসমূহের নেতৃত্বে এ অভ্যুত্থান ঘটেনি, বিভিন্ন দলের নেতা-কর্মী এ অভ্যুত্থানের পেছনে ছিলেন বটে, তবে তাঁরা জনগণের সঙ্গে মিলেমিশে, একাকার হয়ে।

অনেকে বলবেন, উনসত্তরের আইয়ুববিরোধী অভ্যুত্থান, বাংলাদেশে এরশাদবিরোধী অভ্যুত্থান কি হয়নি? তা হয়েছে বটে, কিন্তু তার নেতৃত্বে ছিল বিশেষ বিশেষ রাজনৈতিক দল বা দলসমূহ। তাদের নেতৃত্বে সেই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন ব্যাপক পেশাজীবী ও সর্বস্তরের জনগণ।

বলাই বাহুল্য, পাকিস্তানি শাসকশ্রেণি ও সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে একাত্তরের গণ-অভ্যুত্থান রূপ নিয়েছিল জনযুদ্ধে, যোগ দিয়েছিলেন কিছু ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে পূর্ববাংলার সব রাজনৈতিক দলের কর্মী, নানা পেশাজীবী ও ছাত্র–যুবক-সৈনিক এবং কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষ।

সামরিক-স্বৈরশাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলনও শেষে অভ্যুত্থানে রূপ নিয়েছিল, কিন্তু সেই অভ্যুত্থান ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের মতো একটি সফল গণ-অভ্যুত্থানে রূপলাভ করতে পারিনি। তার আগেই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বুর্জোয়া-পেটিবুর্জোয়া দলগুলোর নেতৃত্ব অভ্যুত্থানের লাগাম টেনে ধরে এরশাদ নেতৃত্বের সঙ্গে আপসরফা করে তথাকথিত ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা’র নামে পুরোনো রাষ্ট্রকে রক্ষার তাগিদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তত্ত্ব হাজির করে ক্ষমতা হস্তান্তর করে।

সেই ঘটনাকে বিচার করে দেখলে বলা যায়, এরশাদশাহির ক্ষমতা ভোগকারী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ ও বিদ্রোহ অবশেষে ক্ষমতাবহির্ভূত বুর্জোয়া-পেটিবুর্জোয়া (আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামাত ও ৫ দলীয় বামজোট) দলগুলোর নেতৃত্বের কাছে বৈঠকের মাধ্যমে আপসরফার ক্ষমতা হস্তান্তরে পরিণত হয়।

এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় বিরোধী সব দল তখন মাসের পর মাস বলে এসেছিল, এরশাদের শাসনাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র একটি স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং সেই রাষ্ট্রের সংবিধান একটি কলুষিত জনবিরোধী সংবিধান।

অতএব তারা এরশাদের পতন চান। সেই চিন্তা থেকে তখনকার আন্দোলনকারী নেতৃত্ব সবাই ঐকমত্য হয়ে ‘তিন জোটের রূপরেখা’ নামের একটি রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা তৈরি করেছিলেন এবং তাতে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে সব দল স্বাক্ষর করেছিল। এসব কথা নিয়ে তখনকার সংবাদপত্র বড়বড় হেডলাইন করেছিল, আমাদের মনে আছে।

এ ধারণার বিতর্কটি শুধু ২৪ জুলাই অভ্যুত্থানের পর উঠেছে বলে এখনো জনগণের কাছে, এমনকি রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যেও ধারণাটির অস্পষ্টতা কাটেনি। যতই বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক ও আলোচনা-সমালোচনা জনগণের সামনে হাজির করবে, ততই গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধারণার বিকাশ ঘটবে বলে আশা করি।

এরশাদের পতন যখন আসন্ন, এরশাদের স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও তাঁর সংবিধানের বিরুদ্ধে জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা ও রাষ্ট্র পরিবর্তনের প্রচণ্ড ক্ষোভকে তখনকার আন্দোলনকারী নেতৃত্ব একজন শাসক ব্যক্তির বিরুদ্ধে নিয়ে গিয়ে অগণতান্ত্রিক স্লোগান তোলে ‘একদফা এক দাবি এরশাদ তুই কবে যাবি’ বলে।

এতে স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও তার অগণতান্ত্রিক সংবিধানের বিরুদ্ধে জনগণের উত্থিত ক্ষোভকে একজন ব্যক্তি এরশাদের বিরুদ্ধে নিয়ে যেতে তখনকার আন্দোলনকারী নেতৃত্ব সফল হয়েছিলেন। অতএব নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী আপসরফার ক্ষমতা হস্তান্তরের তথাকথিত ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিতা’র ক্ষমতা হাতবদলের অভ্যুত্থান আর ২০২৪–এর জুলাইয়ের জনগণের সার্বিক অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বে সংঘটিত অভ্যুত্থানের মধ্যে মৌলিকভাবে পার্থক্য রয়েছে।

এরশাদবিরোধী অভ্যুত্থানের উপসংহার টানা হয়েছিল সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার ধুয়া তুলে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করার প্রস্তাবে সবার সম্মতি জ্ঞাপনের মাধ্যমে। সেই প্রস্তাবের ভিত্তিতেই প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের ক্ষমতা গ্রহণ। উল্লিখিত সব কথা আমাদের জানা বিষয়, আলোচনার সুবিধার জন্য শুধু পাঠকদের মনে করিয়ে দেওয়ামাত্র।

এরশাদের কাছ থেকে ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা’র বদৌলতে প্রাপ্ত স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রটি অক্ষত ও অপরিবর্তিত অবস্থায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণ পায়। সেদিন ১৯৯০ সালে গণতন্ত্র পাওয়া বলতে আন্দোলনকারী দলগুলোর নেতৃত্ব জনগণকে বোঝাতে চাইলেন, এমনকি বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন, শুধু একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমেই জনগণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পাবে।

তখনই কেউ-কেউ প্রশ্ন তুলেছিলেন, শুধু নির্বাচন, এমনকি শতভাগ নিরপেক্ষ নির্বাচন হলেও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম হয় না, যত দিন না রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য একটি গণতান্ত্রিক কনস্টিটিউশন গঠিত হয়। তাঁদের মতে, এরশাদের পতনের পর তখন প্রয়োজন হয়ে উঠেছিল স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রটিকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরের জন্য গণতান্ত্রিক কনস্টিটিউশন তৈরির পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

কিন্তু তখন সেই দাবি প্রধান হয়ে ওঠেনি এবং তা গুরুত্বও পায়নি। কারণ, আন্দোলনের অবসান হয়েছিল ‘একদফা এক দাবি, এরশাদ তুই কবে যাবি’ নামের অগণতান্ত্রিক স্লোগানের মাধ্যমে এবং একটি আপসরফার ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা’র চুক্তির মাধ্যমে। এতেই সবার বিজয় হয়েছিল বলে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক কর্মীরা এক ভ্রান্তির বিভ্রমে নিমজ্জিত হয়েছিল। এই ভ্রান্তির মোহমুক্তি ঘটতে বেশি দিন লাগেনি।

তত্ত্বাবধায়ক সকারের প্রধান সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে বহুল আলোচিত নিরপেক্ষ নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠন করলে জনগণ দেখতে পেলেন, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার মাধ্যমে প্রাপ্ত স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও তার সংবিধানের ধারালো নখ-দন্ত এরশাদ আমলের মতোই সক্রিয় হয়ে উঠেছে এবং বিএনপি ‘তিন জোটের রূপরেখা’ নামের অঙ্গীকার করা রাষ্ট্র সংস্কারের চুক্তি বেমালুম ভুলে যেতে পারল এবং অস্বীকার করল। আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টের বিরোধী আসনে বসে অঙ্গীকারে স্বাক্ষর করা ‘তিন জোটের রূপরেখা’ বিষয়ে কোনো রা শব্দ উচ্চারণ করল না।

এমনকি পরবর্তী মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তারাও বিএনপির পদাঙ্ক অনুসরণ করে রাষ্ট্র সংস্কারের ‘তিন জোটের রূপরেখা’ ভুলিয়ে দিতে পেরেছিল। জনগণ এ থেকে শিক্ষা নিতে পারে, কোনো নিরপেক্ষ নির্বাচন কিংবা নিরপেক্ষ নির্বাচনের বুর্জোয়া পার্লামেন্ট স্বৈরতান্ত্রিক বা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপ দিতে পারে না।

ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরের প্রসঙ্গে শুধু নির্বাচন ও পার্লামেন্টের দোহাই দেওয়া জনগণকে প্রতারণার শামিল। নির্বাচন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রাষ্ট্র পরিচালনার অনুষঙ্গ বটে, কিন্তু একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, নির্বাচনের মাধ্যমেই স্বৈরতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদ গেড়ে বসে। এরশাদ, হাসিনার একরোখা শাসন গেড়ে বসেছিল নির্বাচনের পথ ধরেই।

এ ছাড়া কোনো ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক রূপ দেওয়ার দায়িত্ব বা কাজ চার বা পাঁচ বছর মেয়াদের রাষ্ট্র পরিচালনার নিমিত্তে গঠিত পার্লামেন্টের নয়। নির্বাচিত পার্লামেন্টের কাজ রাষ্ট্রের কনস্টিটিউশন বা সংবিধান রূপান্তরের বা সংস্কারের নয়, তাদের কাজ রাষ্ট্রের বিদ্যমান কনস্টিটিউশনের আলোকে সরকার গঠন করে জনগণের কাছে দেওয়া অঙ্গীকারের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনা করা। রাষ্ট্রের সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তনের কাজ করতে পারে একমাত্র কনস্টিটিউশনাল অ্যাসেম্বলি বা নির্বাচিত গণপরিষদ। সেই কথাই প্রধান হয়ে উঠেছে এবারের ২০২৪-এর জুলাই অভ্যুত্থানের পর।

উল্লেখ্য, ২০২৪ জুলাইয়ের অভ্যুত্থান ক্ষমতামুখী বা নির্বাচনবাদী কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে সংঘটিত হয়নি। এ কথা অনায়াসে বিএনপি, জামায়াত স্বীকার করে নিয়েছে। এমনকি শুধু নির্বাচনের দাবিতেও এ অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়নি। আমরা সবাই জানি, এ অভ্যুত্থান সংঘটিত হওয়ার আগে আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ছাত্রদের কোটাবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে এবং পর্যায়ক্রমে এ আন্দোলন রূপ নেয় ছাত্র-তরুণ-জনগণের সম্মিলিত বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে।

সমাজে ও রাষ্ট্রে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন কথাটির গভীরতা ও তাৎপর্য ব্যাপক। এ বৈষম্যবিরোধী দাবির ভিত্তিতেই একাত্তরে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। গত ৫০ বছরে রাষ্ট্রের উদ্যোগে বৈষম্য সৃষ্টি এমন এক চরম আকার ধারণ করেছিল, যার প্রতিবাদে জুলাইয়ের অভ্যুত্থানে জনগণের সব পর্যায়ের মানুষকে আন্দোলনে শরিক হতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। অবশেষে তাতে যোগ দিয়েছিলেন রাষ্ট্রের সাধারণ সৈনিকেরাও। অতএব এ অভ্যুত্থানের মূল স্পিরিট রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক নীতির অবসান, অথবা বলা যায়, রাষ্ট্রের মাধ্যমে সাম্য প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা, কখনো শুধু নির্বাচন নয়। অতীতের কোনো নির্বাচন, শুধু নির্বাচন সমাজে ও রাষ্ট্রে বৈষম্য কমাতে সাহায্য করেনি, বরং বৈষম্য বেড়েছে।

অভ্যুত্থান–পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করে, অভ্যুত্থানকারীদের আকাঙ্ক্ষা ক্ষমতামুখী নির্বাচনবাদীদের মতো নির্বাচনের মাধ্যমে পার্লামেন্টে গিয়ে রাষ্ট্রের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নয়। অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী তরুণদের নতুন রাজনৈতিক দল যথার্থভাবেই দাবি তুলেছে রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের। তবে পার্লামেন্টে সরকার গঠনের নির্বাচন ও কনস্টিটিউশন রূপান্তরের নিমিত্তে গণপরিষদ নির্বাচন একই সঙ্গে হবে, নাকি আলাদাভাবে হবে, নাকি সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে কনস্টিটিউশনের রূপরেখা প্রস্তুত করে গণভোটের মাধ্যমে নির্ধারণ করবে, তা নির্ভর করে অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলসমূহের ঐকমত্যের ওপর।

যাঁরা তড়িঘড়ি করে নির্বাচন দিয়ে পার্লামেন্টে গিয়ে সরকার গঠন করে রাষ্ট্র সংস্কার করার দাবি তুলছেন, তাঁরা নেহাতই ভুলভাবে কথা বলছেন। তাঁদের দাবি দেশে দেশে চিরাচরিত নিয়মে কনস্টিটিউশন তৈরি বা রূপান্তরের নিয়মের সঙ্গে মেলে না। নির্বাচনের দোহাই দিয়ে পার্লামেন্টে গিয়ে সংবিধান সংশোধনের দাবি যাঁরা তুলছেন, তাঁদের সাহাবুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আয়োজিত নিরপেক্ষ নির্বাচনের পর পার্লামেন্টে বিএনপি-জামায়াতের প্রথম গঠিত সরকার কর্তৃক তিন জোটের রূপরেখার অঙ্গীকার ভঙ্গ করার ঘটনাকে মনে করে দেখতে অনুরোধ করব।

এ দেশে নির্বাচনের মাধ্যমে পার্লামেন্ট গিয়ে জনগণের সঙ্গে অঙ্গীকার ভঙ্গের ইতিহাস তো কম নেই। তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ নিকট অতীতের বিএনপি-জামায়াত কর্তৃক তিন জোটের রূপরেখা বাস্তবায়নের সঙ্গে বেইমানি! অতএব জনগণ অবশ্যই ভেবে দেখবে, ন্যাড়া মাথা বেলতলায় কয়বার যাবে!

শুধু নির্বাচনপন্থী দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি অন্যতম, জামায়াতও সেই পথের পথিক। আরও অনেক বামপন্থী বলে পরিচিত রাজনৈতিক দল উচ্চ কণ্ঠে নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার। যদিও কোনো রাজনৈতিক দলকে বামপন্থী বলে আখ্যায়িত করলে তার চরিত্র কিছুই বোঝা যায় না। একমাত্র গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমেই কোনো ফ্যাসিবাদী কনস্টিটিউশনকে গণমুখী বা গণতান্ত্রিক কনস্টিটিউশনে রূপান্তর করা যায়—এ কথা নির্বাচনের দাবিদার দলগুলো জেনেশুনেই এখনই নির্বাচনের দাবি তুলছে।

তাদের দাবি, নির্বাচিত পার্লামেন্টই রাষ্ট্র সংস্কার করবে। কিন্তু তারা প্রকাশ্যভাবে বলার নৈতিক সাহস হারিয়েছে যে সাবেক বা বর্তমান ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ও তার সংবিধান তারা রক্ষা করতে চায়! জনগণকে খুশি করার জন্য তাদেরও বলতে হচ্ছে, তারাও রাষ্ট্র সংস্কার চায়। পক্ষান্তরে ‘এখনই নির্বাচন দাও’ কথার অন্তর্নিহিত মর্ম হচ্ছে পুরোনো ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ও তার সংবিধানকে রক্ষা করা এবং ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টের গণহত্যার বিচারকে ভূলুণ্ঠিত করা। বলাই বাহুল্য, ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য নিহিত রয়েছে স্বয়ং বাহাত্তরের সংবিধানেই। অতএব গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংবিধানসভা একমাত্র পুরোনো ফ্যাসিবাদী সংবিধানের খোলনলচে বদলে নতুন গণতান্ত্রিক কনস্টিটিউশনের রূপদান করতে পারে।

অতীতে যাঁরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন শুধু নির্বাচনের দাবিতে যুগব্যাপী আন্দোলন করেছিলেন, তাঁরা ফ্যাসিবাদী একরোখা সরকারের নটবল্টু ঢিলা করতে পারেননি। কারণ, ব্যাপক জনগণ তাতে সাড়া দেয়নি। কারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচনের দাবিটি ছিল শুধু ৩০০ জন কোটিপতির পার্লামেন্টের ভোটে দাঁড়িয়ে নির্বাচিত হয়ে পার্লামেন্টে গিয়ে গদি দখলের রাজনৈতিক দাবি।

এটা দৈনন্দিন জীবনে বৈষম্যের হাহাকারে দিনাতিপাত করা নানা পেশাজীবী ও কৃষক-মজুর-শ্রমিকের বা কোনো মধ্যবিত্তের দাবি ছিল না। অতএব সেই আন্দোলন ব্যর্থ না হয়ে যায়নি। সাধারণ মানুষের ব্যর্থ দিনযাপনের অবসানের দাবি ছাড়া কোনো আন্দোলন সফল হতে পারে না। এই সাধারণ সত্য আড়াল করার জন্যই অনেকে ২৪ জুলাইয়ের সফল অভ্যুত্থানের পেছনে নানা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব হাজির করেছে।

এখন যে বিতর্ক দৃশ্যমান হচ্ছে, ফ্যাসিবাদী বাংলাদেশ রাষ্ট্রে জনগণের অংশগ্রহণে একটি সফল অভ্যুত্থান সংঘটিত হওয়ার পর একটি গণতান্ত্রিক কনস্টিটিউশন হাজির করার দায়িত্ব কার—সরকার গঠন করার জন্য নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের, নাকি গণতান্ত্রিক কনস্টিটিউশন তৈরির জন্য নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্যদের বা সংবিধানসভার? ইতিহাস বলে, অবশ্যই এ কাজ করতে পারে জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত সংবিধানসভা।

একটি গণতান্ত্রিক কনস্টিটিউশন তৈরির প্রক্রিয়া সেই পথেই হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের পর্যায়ে কনস্টিটিউশনাল অ্যাসেম্বলি বা সংবিধানসভার ধারণা অনেকটা অনালোচিত বলা যায়।

এ ধারণার বিতর্কটি শুধু ২৪ জুলাই অভ্যুত্থানের পর উঠেছে বলে এখনো জনগণের কাছে, এমনকি রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যেও ধারণাটির অস্পষ্টতা কাটেনি। যতই বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক ও আলোচনা-সমালোচনা জনগণের সামনে হাজির করবে, ততই গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধারণার বিকাশ ঘটবে বলে আশা করি।

মকবুল আহমেদ অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও সাবেক অধ্যক্ষ। সাবেক সদস্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু)।

ই-মেইল: [email protected]

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: গণত ন ত র ক র ষ ট র ব ধ ন ক ধ র ব হ কত ত ন জ ট র র পর খ র জন ত ক দ স ব ধ নসভ জনগণ র স জনগণ র ক র র জন য হ জ র কর র ক ষমত এরশ দ র দলগ ল র হয় ছ ল ন র পর কর ছ ল ক র কর আওয় ম ব এনপ গ রহণ র একট

এছাড়াও পড়ুন:

চীনের উত্থান ও ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের বাস্তবতা

মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধ সম্ভাবনা ক্ষীণ; কিন্তু দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং পূর্ব এশিয়ার ত্রিসংযোগস্থলে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তা জটিল করে তুলছে, ঠিক সেই সময়ে যখন চীন কৌশলগতভাবে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। 

চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মিজোরামের রাজধানী আইজলে একটি চমকপ্রদ রাজনৈতিক ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সীমানা ঘেঁষা এই রাজ্যে মিয়ানমারভিত্তিক দুটি জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠী একীভূত হওয়ার চুক্তি স্বাক্ষর করে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী লালদুহোমা। 
চিনল্যান্ড কাউন্সিল (সিসি) কয়েক বছর ধরে মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলের চিন রাজ্যে সক্রিয় ছিল। ২০২১ সালে ইন্টেরিম চিন ন্যাশনাল কনসালটেটিভ কাউন্সিল (আইসিএনসিসি) গঠিত হয়। এটি গঠিত হয় মূলত সিসি-এর কিছু ভিন্নমতাবলম্বী অংশের উদ্যোগে। উভয় গোষ্ঠীই ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে– গণতান্ত্রিক সরকারকে সরিয়ে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলকারী মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে– লড়াই করেছে। মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী লালদুহোমা গণমাধ্যমকে জানান, চিনের জনগণের সংগ্রামে সহায়তা করাই ছিল তার উদ্দেশ্য। সেই উদ্দেশ্য থেকেই তিনি এই একত্রীকরণে ভূমিকা রাখেন। একীভূত সংগঠনের নাম রাখা হয়– চিন ন্যাশনাল কাউন্সিল (সিএনসি)।
ভারতের মিজোরামে মিজো, পার্শ্ববর্তী মণিপুরের কুকি, মিয়ানমারের চিন ও তার আশপাশের রাজ্যের চিন জনগণ এবং বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের বম সম্প্রদায় একই জাতিগোষ্ঠীর অংশ, যাদের সম্মিলিতভাবে ‘জো জনগোষ্ঠী’ (মিজো-কুকি-চিন সম্প্রদায়ের সমষ্টিগত নাম) বলা হয়। আন্তর্জাতিক ও প্রাদেশিক সীমারেখা দ্বারা বিভক্ত হলেও তাদের মধ্যে একটি গভীর জাতিগত বন্ধন বজায় আছে। তবে একটি ভারতীয় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে মিয়ানমারের জাতিগত বিদ্রোহীদের ঐক্য গড়ার পদক্ষেপ নেওয়া নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর থেকে ভারত মিয়ানমার নিয়ে দ্বৈত নীতি অনুসরণ করে এসেছে। ভারত জান্তা সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না দিলেও, কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থ বজায় রাখতে সম্পর্ক অব্যাহত রেখেছে। এ ক্ষেত্রে দিল্লিতে গণতান্ত্রিক বিরোধী পক্ষের সদস্যদের একটি সেমিনারে আমন্ত্রণ জানানোর ঘটনাও উল্লেখযোগ্য।
এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে মণিপুর ও নাগাল্যান্ডের মেইতেই ও নাগা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর পক্ষ থেকে অভিযোগ ওঠে, ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর একটি অংশ মণিপুর ও মিয়ানমারভিত্তিক কুকি-চিন বিদ্রোহীদের সহায়তা করছে। এই কুকি-চিন বিদ্রোহীরা আক্রমণ চালাচ্ছে মিয়ানমারভিত্তিক মেইতেই ও নাগা বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর ওপর। মেইতেই ও নাগা বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলো আবার জান্তা সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে চলছে।
লালদুহোমার দলের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের জো জনগণের প্রতি সমর্থন প্রকাশের ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে– ভারত কি জো জাতিগোষ্ঠীভুক্ত চিন বিদ্রোহীদের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করছে, যে বিদ্রোহীরা বর্তমানে মিয়ানমার-ভারত সীমান্তবর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে?
এপ্রিল মাসে থাইল্যান্ডের ব্যাংককে বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের সঙ্গে দেখা করেন। অভ্যুত্থানের পর তাদের প্রথম সাক্ষাৎ। এ সাক্ষাৎ জান্তা সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা অব্যাহত রাখার বার্তা দেয়। মিয়ানমারে চলমান অস্থিরতা ভারত ও চীনের মতো দেশগুলোর জন্য এক কূটনৈতিক সংকটে পরিণত। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের পরিস্থিতি : ২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতপন্থি শেখ হাসিনা সরকার উৎখাত হওয়া এবং তাতে ভারতের কৌশলগত পরিবেশ আরও জটিল হয়ে ওঠা।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ভারত স্পষ্টভাবে হাসিনাপন্থি অবস্থান নিয়েছে। তিনি ও তাঁর দলের শীর্ষ নেতারা এখন ভারতের আশ্রয়ে রয়েছেন। এদিকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান মুহাম্মদ ইউনূস এখন চীনঘেঁষা নীতি নিয়েছেন। চলতি বছরের মার্চ মাসে তাঁর চার দিনের চীন সফরসহ বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে তা স্পষ্ট। ঢাকা থেকে বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউনূস সরকারের ওপর মার্কিন প্রভাবও বাড়ছে।
ভারতের ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতি সফল করতে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক জরুরি। কারণ এই নীতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ভারতের সংযোগ জোরদারে ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি এটি সীমান্তবর্তী মিয়ানমার ও বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোকে নিয়ন্ত্রণেও সহায়ক হতে পারে। তবে বাংলাদেশের ভেতরে ইসলামপন্থি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর পুনঃসংগঠনের ইঙ্গিত আসামে ও পশ্চিমবঙ্গে উদ্বেগ তৈরি করছে।
সতর্ক কৌশলের প্রয়োজন
ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত এক জটিল ভূকৌশলগত এলাকা। যেখানে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিষয়াবলির সীমানা প্রায়ই একে অপরের সঙ্গে মিশে যায়। দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও পূর্ব এশিয়ার মিলনস্থলে অবস্থিত এই অঞ্চল। অঞ্চলটি জাতিগতভাবে বৈচিত্র্যময়, পরিবেশ ও ভূপ্রকৃতিগতভাবে সংবেদনশীল। রাজনৈতিকভাবেও জটিল। ফলে এখানে নিরাপত্তা, কৌশলগত ও মানবিক সমস্যা সব ঘনীভূত।
ভারতের পশ্চিম সীমান্তে মূল উদ্বেগ পাকিস্তান ও পাকিস্তান-সমর্থিত সন্ত্রাসবাদ। উত্তর-পূর্ব সীমান্তে খেলোয়াড় অনেক। তাদের স্বার্থও পরস্পরবিরোধী। বহু জাতিগোষ্ঠী ও রাষ্ট্রের স্বার্থ-সংঘাতে এই অঞ্চল প্রায় স্থায়ীভাবে উত্তেজনাপূর্ণ। ভারতে সম্ভবত আর কোনো অঞ্চলেই অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য এতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।
সীমান্তবর্তী জাতিগোষ্ঠীর উপস্থিতি, তাদের জাতিগত আকাঙ্ক্ষা ও জাতীয় স্বার্থের মিশ্রণ এখানে জটিল আন্তঃসীমান্ত গতিশীলতা তৈরি করেছে। এই অঞ্চল সংঘাতপ্রবণ হয়ে উঠেছে, যার প্রভাব পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ভূরাজনৈতিক দিক থেকে এখানে একটিও ভুল সিদ্ধান্ত বড় ক্ষতি ডেকে আনতে পারে।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থান হয়। পরে দমন-পীড়নের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এই অনিশ্চয়তার নতুন অধ্যায়। গণতন্ত্রপন্থিরা ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি) গঠন করে। এর সশস্ত্র শাখা পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ)। এটি জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। দেশটি জড়িয়ে পড়ে গৃহযুদ্ধে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী ধীরে ধীরে ভারতের সীমান্তবর্তী অনেক অংশের নিয়ন্ত্রণ হারায়। মণিপুর ও মিজোরামের সীমানায় অবস্থিত চিন রাজ্যে সিএনএ, সিডিএফ ও কেএনএর মতো জো জনগোষ্ঠীর সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর ঘাঁটি লক্ষ্য করে বিমান হামলা শুরু করে জান্তা বাহিনী। এসব গোষ্ঠী পিডিএফের মিত্র হিসেবে নিজেদের জো জনগণের প্রতিনিধি বলে দাবি করে থাকে।
চিন রাজ্যে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার পর এর প্রভাব পড়ে ভারতে। মিজোরাম ও মণিপুরে শরণার্থী প্রবাহ শুরু হয়। মিজোরামে, যেখানে জো-জনগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাদের উষ্ণভাবে গ্রহণ করা হয়। কিন্তু মণিপুরে জো ও নাগা দুটি সংখ্যালঘু গোষ্ঠী। সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই জনগোষ্ঠী উদ্বেগ প্রকাশ করে বলে, শরণার্থী আগমনের ফলে রাজ্য জনসংখ্যার ভারসাম্য হারাচ্ছে। মেইতেই সম্প্রদায় অনুপ্রবেশকারী বহিষ্কারের দাবি তোলায় জো জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের উত্তেজনা বাড়ে।
২০২৩ সালের মে মাসে মেইতেই ও জো সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ভয়াবহ জাতিগত সংঘাত শুরু হয়। পরবর্তী দুই বছরে প্রায় ৩০০ জনের প্রাণহানি ঘটে। এতে মেইতেই বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর পুনরুত্থানের আশঙ্কা তৈরি হয়। এই গোষ্ঠীকে এক সময় ভারত দমন করেছিল।
ভারতের মিয়ানমার সীমান্তে নেওয়া পদক্ষেপগুলোর বহুমুখী প্রভাব রয়েছে। অনুপ্রবেশ, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর চলাচল ঠেকাতে ভারত ‘ফ্রি মুভমেন্ট রেজিম’-এর পরিসর সীমিত করেছে। ‘প্রটেকটেড এরিয়া রেজিম’ পুনর্বহাল করেছে। সীমান্তে কাঁটাতার নির্মাণ শুরু করেছে। তবে এই পদক্ষেপগুলো জো ও নাগা জনগণের ঐতিহ্যবাহী আন্তঃসীমান্ত সম্পর্ক ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি করেছে। 
ইম্ফলভিত্তিক এক সাংবাদিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এসব সিদ্ধান্তে মেইতেইদের মধ্যে সীমান্ত নিরাপত্তা ও জনসংখ্যাগত পরিবর্তন ঠেকানো নিয়ে আশ্বাস তৈরি হলেও, জো ও নাগা জনগণের অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে। তা ছাড়া সীমান্ত অঞ্চলের বহু মানুষ অনানুষ্ঠানিক সীমান্ত বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল।
বিদ্রোহীদের মোকাবিলা
২০২৫ সালের মে মাস নাগাদ পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। নাগা বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কাউন্সিল অব নাগালিমের (এনএসসিএন-আইএম) অন্যতম নেতা ইকাটো চিশি সিউ মিয়ানমারে চলে যান। যেখানে তিনি এইচ এস রামসান ও অ্যাবসালম রামান নেতৃত্বাধীন কট্টরপন্থি একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীতে যোগ দেন বলে জানা যায়। এই পদক্ষেপ নাগা শান্তি আলোচনাকে বিপদের মুখে ফেলে। একই সঙ্গে নাগা সশস্ত্র সংগ্রামের পুনরুত্থান নিয়েও উদ্বেগ তৈরি হয়।
এনএসসিএন-আইএম ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অন্যতম শক্তিশালী বিদ্রোহী গোষ্ঠী– যা নাগাল্যান্ডকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এরা ঐতিহাসিকভাবে মিয়ানমারের নাগাল্যান্ড সীমান্তবর্তী এলাকায় সক্রিয়। ভারত থেকে স্বাধীনতার দাবিতে গঠিত হলেও, তারা ১৯৯৭ সাল থেকে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে রয়েছে। বর্তমানে তারা বৃহত্তর নাগাল্যান্ড দাবি করছে, যেখানে আসাম, মণিপুর ও অরুণাচল প্রদেশের কিছু অংশ অন্তর্ভুক্ত। তবে ওই তিন রাজ্যই এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে আসছে।


২০২৪ সালে ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ) এক আদালতে দাবি করে, এনএসসিএন-আইএমের মিয়ানমারভিত্তিক চীন-মিয়ানমার মডিউল নিষিদ্ধ মেইতেই বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কাংলেই ইয়াউল কানবা লুপ (কেওয়াইকেএল) এবং পিপলস লিবারেশন আর্মিকে (পিএলএ) সহায়তা করে ভারতে অনুপ্রবেশ করাতে। যেন তারা জো জনগণের ওপর সন্ত্রাসী হামলা চালাতে পারে। কেওয়াইকেএল এবং পিএলএ মণিপুরের ইম্ফল উপত্যকাভিত্তিক সাতটি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম। গোষ্ঠীগুলো ভারত থেকে আলাদা হতে চায়। মিয়ানমার ও বাংলাদেশে তাদের ঘাঁটি রয়েছে। 
এনআইএর এই অভিযোগে নাগা ও মেইতেই উভয় গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়। এনএসসিএন-আইএমের দাবি, ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী কুকিদের পক্ষ নিচ্ছে। এরপর ভারত সরকারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কিছুটা উন্নত হয়। তবে সিউর পদক্ষেপ আবারও অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। অন্যদিকে যুদ্ধবিরতির বিরোধিতাকারী এনএসসিএন-কে (ইয়ুং অং) এখনও মিয়ানমারের নাগা স্বশাসিত অঞ্চলে সক্রিয় রয়েছে। এই অঞ্চল ভারতের নাগাল্যান্ড ও চীনের ইউনান প্রদেশের সীমান্তঘেঁষা।
মিয়ানমারের সাগাইং, চিন ও রাখাইন রাজ্যে ভারতের একাধিক বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সশস্ত্র গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে, যারা প্রায়ই মিয়ানমারের জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে কাজ করে। জো জনগোষ্ঠীর মধ্যে কুকি ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) চিন ও সাগাইংয়ে সক্রিয়। এরা জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে কাচিন ইন্ডিপেনডেন্স আর্মিকে (কেআইএ) সহযোগিতা করে। কেআইএর সঙ্গে এনএসসিএনের ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। কেএনএ ও কেআইএ উভয়েরই রাখাইনভিত্তিক আরাকান আর্মির (এএ) সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে।
জোমি রেভলিউশনারি আর্মি (জেডআরএ) চিন ও সাগাইং অঞ্চল থেকে পরিচালিত হয় এবং মিয়ানমারের চিন ন্যাশনাল আর্মির (সিএনএ) সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। সিএনএর সঙ্গে ভারতের মিজোরাম রাজ্যের মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের (এমএনএফ) ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। ২০২৩ সালে লালদুহোমার জোরাম পিপলস মুভমেন্টের (জেডপিএম) কাছে ক্ষমতা হারায় এমএনএফ। এমএনএফেরও আরাকান আর্মির সঙ্গে পুরোনো সম্পর্ক রয়েছে।
অন্যদিকে জোমি রেভলিউশনারি অর্গানাইজেশন (জেডআরও), যা চিন রাজ্যে সক্রিয়, তারা মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে সহযোগিতা করে। মণিপুরি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন পিএলএ সাগাইংয়ে সক্রিয় এবং জান্তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী উলফা-ইন্ডিপেন্ডেন্টেরও (উলফা-আই) মিয়ানমারে ঘাঁটি রয়েছে। তারা বিদ্রোহবিরোধী কর্মকাণ্ডে জান্তা সরকারকে সহযোগিতা করে বলে জানা যায়।
ইম্ফলভিত্তিক সাংবাদিক প্রদীপ ফানজৌবমের মতে, মিয়ানমারে চলমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ভারতীয় বিদ্রোহী সংগঠনগুলোর পুনর্গঠনের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে। অথচ সরকারের অবস্থান এখনও দ্বিধাগ্রস্ত। ‘আমরা নতুন নতুন সমীকরণ ও পুনর্গঠনের খবর পাচ্ছি,’ বলেন তিনি। ‘সরকার কী অনুমোদন করবে আর কী করবে না– তা এখনই ঠিক করতে হবে। অথচ এখনও আমরা সেই পুরোনো কৌশলই দেখছি। এক গোষ্ঠীকে ব্যবহার করে আরেক গোষ্ঠীকে দমন করার খেলা।’
একসময় ভারত ও মিয়ানমার যৌথ সামরিক অভিযান চালিয়ে এনএসসিএন-কে, উলফা-আই, পিএলএ, জেডআরএ এবং কেএনএর ঘাঁটি ধ্বংস করেছিল। বর্তমানে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ হ্রাস পাওয়ায় এ ধরনের যৌথ অভিযানের সুযোগ কম। পাশাপাশি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের শীতলতাও সীমান্তবর্তী বিদ্রোহীদের দমন করতে বাংলাদেশের সহযোগিতার সম্ভাবনাকে ক্ষীণ করে তুলেছে।
চীনা চ্যালেঞ্জ
ভারত-চীন কূটনৈতিক সম্পর্কে কিছুটা উষ্ণতা এলেও সীমান্ত পরিস্থিতি এখনও উত্তেজনাপূর্ণ। উভয় দেশই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার (এলএসি) পাশে সামরিক ও নাগরিক অবকাঠামো নির্মাণ করছে। চীন সম্প্রতি অরুণাচল প্রদেশের সীমান্তসংলগ্ন অঞ্চলে ইয়ারলুং সাংপো নদীর ওপর ‘বিশ্বের বৃহত্তম বাঁধ’ নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে। ভারত আশঙ্কা করছে, এই বাঁধ ব্রহ্মপুত্র নদের পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হতে পারে।
মিয়ানমার ও বাংলাদেশে কৌশলগত প্রভাব বিস্তারে চীনের পদক্ষেপগুলোও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। চীন বাংলাদেশে তিস্তা নদীর পানি ব্যবহারসহ নানা কৌশলগত অবকাঠামো প্রকল্পে জড়িত হতে চাইছে। সেই সঙ্গে বঙ্গোপসাগর হয়ে ভারত মহাসাগরে প্রবেশাধিকার চাইছে। মিয়ানমারে চীনের উপস্থিতি এতটাই বেড়েছে যে গণতন্ত্রপন্থিরা জান্তা সরকারকে ‘চীনা ক্রীড়নক’ বলেও আখ্যায়িত করছে। কিছুটা পশ্চিমা সমর্থনও পাচ্ছে তারা।
চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) অংশ হিসেবে চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর (সিএমইসি) এখনও একটি মূল অগ্রাধিকার। কিয়াওকফিউ গভীর সমুদ্রবন্দরসহ অবকাঠামো প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে চীনের ভারত মহাসাগরে প্রবেশাধিকার আরও সহজ হচ্ছে। 
মিয়ানমার সরকার একটি আইন পাস করেছে– পাবলিক সিকিউরিটি সার্ভিসেস ল। এর মাধ্যমে মিয়ানমারে চীনা ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষায় চীনের নিরাপত্তা বাহিনী সক্রিয় হতে পারবে। এমনকি দেশটি চীনা নববর্ষকে জাতীয় ছুটি হিসেবেও স্বীকৃতি দিয়েছে।
সম্ভবত এরই প্রতিদানস্বরূপ চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ৯ মে রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে মিয়ানমারের জান্তা নেতা সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এই সাক্ষাৎ বোঝায়, চীন ও রাশিয়া তাদের পাশে রয়েছে। ভারতের এক গোয়েন্দা কর্মকর্তার মতে, এই সাক্ষাৎ রাশিয়ারও চীনের সঙ্গে মিয়ানমার ইস্যুতে অবস্থান সাযুজ্যের ইঙ্গিত দেয়। চীন ও রাশিয়া দুটোই মিয়ানমার জান্তার অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ।
এর আগে চীন মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেসি অ্যালায়েন্স আর্মিকে (এমএনসিএএ) শান রাজ্যের উত্তরাঞ্চলের লাশিও শহরটি জান্তার কাছে হস্তান্তরের জন্য রাজি করায়। এই শহর চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। চীন বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর কাছে অনুরোধ করেছে, তারা যেন সিএমইসির রুটের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো থেকে দূরে থাকে। তবে জান্তা সরকারের প্রতি চীনের স্পষ্ট সমর্থন বিদ্রোহী ও গণতন্ত্রপন্থি গোষ্ঠীগুলোর কাছে চীনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে পারে। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন, মিয়ানমারের কিছু অংশে চীনবিরোধী মনোভাব বাড়ছে ক্রমশ। v

সৌজন্যে: আউটলুক ম্যাগাজিন, ১ জুন ইস্যু

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে জনগণের হিস্যা কোথায়
  • লন্ডন বৈঠকে অবিশ্বাস দূর, সরকারের সম্মানজনক প্রস্থানের পথ সুগম হবে: সাইফুল হক
  • বাজেটের ত্রুটি সংশোধনের আহ্বান
  • ড. ইউনূসকে দেশের কাজে যুক্ত রাখতে চায় বিএনপি
  • লন্ডন বৈঠকে বিচার ও সংস্কারের বিষয়টি নির্বাচনের মতো গুরুত্ব না পাওয়া অত্যন্ত হতাশাজনক: এনসিপি
  • জনগণের উদ্দেশে ভাষণ দেবেন ইরানের প্রেসিডেন্ট
  • সহসাই রাজনীতির কালো মেঘ কেটে যাবে: ডা. জাহিদ  
  • চীনের উত্থান ও ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের বাস্তবতা
  • ‘সংস্কার ছাড়া নির্বাচন মানবে না জনগণ’
  • ডিসেম্বরে নির্বাচন করে সংস্কার ও বিচার কার্যক্রম দৃশ্যমান করা সম্ভব: রুহিন হোসেন