ফলন হবে না ভেবে ফেলে রাখা নোনা জমিতে কোটি কোটি টাকার মিষ্টি তরমুজ
Published: 7th, April 2025 GMT
মাঠের পর মাঠ, যত দূর চোখ যায়, কেবল তরমুজের গাছ। সবুজ লতার ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে ডোরাকাটা আলপনা আঁকা নানা আকারের তরমুজ। কোথাও কোথাও মাঠের মধ্যে তরমুজ স্তূপ করে রাখা। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকারেরা এসে এসব তরমুজ কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। শনিবার খুলনার উপকূলীয় কয়রা উপজেলার বিভিন্ন তরমুজখেত ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
কয়েকজন তরমুজচাষি বলেন, পাঁচ বছর আগেও জমিগুলো আমন ধান চাষের পর অনাবাদি পড়ে থাকত। শুষ্ক মৌসুমে মাটিতে অতিরিক্ত লবণাক্ততা ছড়িয়ে পড়ায় বৃথা পরিশ্রম ভেবে কেউ চাষাবাদের চেষ্টা করতেন না। এখন সেই পতিত জমিগুলোই স্বপ্ন দেখাচ্ছে কয়রার চাষিদের। অল্প সময়ে বিনিয়োগের দ্বিগুণ থেকে তিন গুণ লাভ করায় দিন দিন এখানকার কৃষকের আশার আলো হয়ে উঠছে লবণসহিষ্ণু সুস্বাদু তরমুজের আবাদ। গত কয়েক বছরের ব্যবধানে চাষের পরিধি বেড়েছে কয়েক গুণ।
কয়রা উপজেলা কৃষি দপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালে উপজেলায় মাত্র ৬৫ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ হয়েছিল। এরপর ২০২১ সালে তরমুজ চাষ হয় ৬৫০ হেক্টর জমিতে। ২০২২ সালে উপজেলায় তরমুজ আবাদের জমির পরিমাণ দাঁড়ায় ৮৯৫ হেক্টরে। ২০২৩ সালে উপজেলায় ১ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে তরমুজ আবাদ হয়। আর ২০২৪ সালে তরমুজ আবাদের জমির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৯৩০ হেক্টরে। অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে এ বছর ৪ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ করেন কৃষকেরা।
কয়রা উপজেলার আমাদী, মহারাজপুর, মহেশ্বরীপুর, চণ্ডীপুর, খিরোল, হরিকাঠি, কিনুকাঠি, ফতেকাটিসহ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, তরমুজখেতে চাষিদের কেউ কেউ সেচ দিচ্ছেন, কেউ আবার খেত থেকে তরমুজ তুলছেন। তরমুজের মাঠে ঘুরছেন ফড়িয়া ও আড়তদারেরা। বিভিন্ন এলাকা থেকে ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও ট্রলার নিয়ে তরমুজ কিনতে এসেছেন তাঁরা।
তরমুজের ব্যাপারী যশোরের রেজাউল করিমের সঙ্গে কথা হয় কয়রার হরিকাঠিতে। তিনি বলেন, কয়রার তরমুজ খুব মিষ্টি, বাজারে চাহিদাও অনেক। তরমুজের এবার ভালো হয়েছে। তিনি বিঘাপ্রতি ৮০ হাজার টাকা দরে তরমুজ কিনেছেন।
ব্যাপারীদের সঙ্গে কাজ করেন একদল মৌসুমি শ্রমিক। খেত থেকে তরমুজ কেটে ট্রাকে তুলে দেওয়াই তাঁদের কাজ। এমন এক শ্রমিক আবুল কালাম সরদার বলেন, তাঁদের দলে ২০ জন কাজ করেন। প্রতিদিন তাঁদের গড়ে এক হাজার টাকার মতো আয় হয়।
কয়রার কিনুকাঠি গ্রামের খেত থেকে তরমুজ তুলে মাঠের মধ্যে সেগুলো জড়ো করে স্তূপ করছিলেন কৃষক তারক মণ্ডল। তিনি জানান, এবার তিনি ২২ বিঘা জমিতে তরমুজ লাগিয়েছিলেন। ইতিমধ্যে ৯ বিঘা জমির তরমুজ পাঁচ লাখ টাকায় বেচেছেন। এবার আবহাওয়া ভালো ছিল, তবে বৃষ্টি বেশি হলে তরমুজ আরও বড়ো হতো।
কয়রার মহারাজপুর এলাকার বিলে বছরে শুধু একবার আমন চাষ হতো। এ বছর প্রথমবারের মতো ১২০ একর জমিতে তরমুজের আবাদ হয়েছে।
সেখানে তরমুজখেতের পরিচর্যার ফাঁকে কৃষক মোশারফ হোসেন বলেন, তাঁর বাড়ি আমাদী এলাকায়। কিন্তু সেখানে কোথাও কোনো জমি ফাঁকা না থাকায় এবার মহারাজপুর এলাকায় এসেছেন। এখানে আমন ধান ওঠার পর বিল পড়ে থাকত। তিনি চার বছর ধরে তরমুজ চাষ করে সংসারের অভাব কাটিয়ে এক বিঘা জমিও কিনেছেন।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের খুলনা কার্যালয়ের বৈজ্ঞানিক সহকারী জাহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কয়রার অধিকাংশ জমিতে লবণাক্ততার মাত্রা বেশি হওয়ায় আমন ধান ছাড়া কোনো ফসল হতো না। ২০১৫ সালের দিকে প্রথমবারের মতো কয়রার লবণাক্ত পতিত জমিতে শুষ্ক মৌসুমে ফসল উৎপাদনের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। সেটা যে কত সফল, তা তরমুজের ফলন থেকেই বোঝা যায়।
কয়রা উপজেলা উপকৃষি কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান বলেন, তরমুজ চাষে রবি শস্য থেকে তিন গুণ বেশি লাভ হয়। এ কারণে চলতি মৌসুমে তরমুজের আবাদ বেড়েছে। এবার কয়রায় উৎপাদিত তরমুজের বাজারমূল্য প্রায় ২৫২ কোটি টাকা।
এই পরিমাণ বাজারমূল্যের হিসাব প্রসঙ্গে এই কৃষি কর্মকর্তা বলেন, এক হেক্টর সমান প্রায় সাড়ে সাত বিঘা। সে হিসাবে ৪ হাজার ২০০ হেক্টরে ৩১ হাজার ৫০০ বিঘা হয়। কৃষি বিভাগ এক বিঘা জমিতে হওয়া তরমুজের বিক্রয়মূল্য ধরে ৮০ হাজার টাকা। সে হিসাবে কৃষি বিভাগ এবার কয়রায় উৎপাদিত তরমুজের বাজারমূল্য ধরেছে প্রায় ২৫২ কোটি টাকা।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: তরম জ চ ষ তরম জ র ব তরম জ ক য় কয়র উপজ ল কয়র র
এছাড়াও পড়ুন:
খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলে রেকর্ড বৃষ্টিতে ব্যাপক ক্ষতি
বরেন্দ্র অঞ্চলে বছরে বৃষ্টি হয় প্রায় ১,২০০ থেকে ১,৫০০ মিলিমিটার পর্যন্ত। বৃষ্টি কম হওয়ায় ভূ-গর্ভস্থ পানিও ক্রমাগত নিচে নামছে। ফলে দিনকে দিন অঞ্চলটি খরাপ্রবণ হয়ে উঠছে। তবে, গত শুক্রবার (৩১ অক্টোবর) রাতের স্মরণকালের ভারী বর্ষণে বরেন্দ্র অঞ্চলের অনেক এলাকা প্লাবিত হয়েছে। মাটির বাড়ি ধসে পড়ার পাশাপাশি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে এবং মাঠের ধান শুয়ে পড়েছে।
রবিবার (২ নভেম্বর) সকালে রাজশাহীর কাঁকনহাট পৌরসভার দরগাপাড়া গ্রামে কৃষক জহিরুল ইসলাম নিজের জমির পাশে দাঁড়িয়ে বলেন, “মাঠের ৮০ ভাগ ধান শুয়ে পড়েছে। এই ধান তুইলতে লোকও পাওয়া যাবে না। সবাইকে একসঙ্গে ধান তুইলতে হবে। আমরা এবারের খুব ক্ষতির শিকার।”
আরো পড়ুন:
চাঁপাইনবাবগঞ্জে ভারী বর্ষণে ৪০০ পুকুর ভেসে গেছে
পদ্মা-মেঘনায় ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ছে পাঙ্গাস
সরেজমিনে রাজশাহীর গোদাগাড়ী ও তানোরের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে কৃষকের কথার সত্যতা পাওয়া গেছে।
বরেন্দ্র অঞ্চলের ফসলি মাঠ উঁচুনিচু সিঁড়ির মতো। দুই পাশ উঁচু হলেও মাঝের অংশ তুলনামূলক নিচু থাকে, যা স্থানীয়রা ‘কান্দর’ বলেন। এবার এই কান্দরগুলো তলিয়ে গিয়ে বিলের মতো হয়েছে। এসব জমিতে আমন ধান চাষ হয়েছে। কখনো কখনো বিলের ধান পানিতে ডুবলেও কান্দর কখনো ডুবে না। শুক্রবার রাতের বৃষ্টিতে সবই তলিয়েছে।
রাজশাহী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রহিদুল ইসলাম বলেন, “গ্রামের দিকে খুব বৃষ্টি হয়েছে। তবে, শহরে আমরা মাত্র ১৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছি।”
এদিকে, বিলের পুকুরের মাছ ভেসে যাওয়ায় মানুষ দলবেঁধে মাছ ধরতে নেমেছেন। শনিবার (১ নভেম্বর) থেকেই মাছ ধরার মহোৎসব চলছে। পবা উপজেলার শুলিতলা ভিমারডাইং এলাকায় জোয়াখালি নদীতে অর্ধশতাধিক মানুষ মাছ ধরছিলেন।
ক্ষেত থেকে শুয়ে পড়া ধান কাটছেন এক কৃষক
আলোকছত্র গ্রামের কৃষক মো. মনিরুজ্জামান (৬৫) বলেন, “জাল ফেললেই বড় বড় মাছ পাওয়া যাচ্ছে। আমি আমার জীবনে এবার দ্বিতীয়বার উত্তরা পেলি দেখছি। সাধারণত নদীর স্রোত উত্তর দিকে যায়, কিন্তু এবার উত্তরেই এত বেশি বৃষ্টি হয়েছে যে পানি দক্ষিণে যাচ্ছে।”
বিলের মধ্যে খনন করা পুকুরগুলো পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় মাছচাষিরা বড় ক্ষতির মুখে পড়েছেন। গোদাগাড়ীর কালোসাঁকো বিলে চারটি পুকুরে মাছচাষ করতেন মারিফুল ইসলাম। তিনি জানান, প্রায় ৪ লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে। অন্তত ১৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
রিশিকুল ইউনিয়নের খড়িয়াকান্দি এলাকায় দুটি স্থানে পাকা রাস্তা প্লাবিত হয়ে একপাশ থেকে অন্যপাশে পানি যাচ্ছে। স্থানীয়রা সেখানে জাল দিয়ে মাছ ধরছেন। রাস্তার দুই পাশে শত শত বিঘা জমির ধান তলিয়ে গেছে। খড়িয়াকান্দি খালের পাশে ১০–১২টি বাড়ির মাটির দেয়াল ভেঙে পড়েছে।
মান্ডইল নলপুকুর গ্রামের বিশ্বনাথ সরেন জানান, তার বাড়ির দুটি ঘর ধসে পড়েছে।
জালে বড় মাছ উঠায় খুশি স্থানীয় এক বাসিন্দা
রিশিকুল এলাকার বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম বলেন, “আমাদের এলাকায় এমন বন্যা হয়েছিল ১৯৮৬ সালে। তারপর এত বৃষ্টি ও বন্যা হয়নি। এবার প্রথম।”
এলাকাবাসী জানান, পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় রান্নাবান্না সম্ভব হচ্ছে না। স্বেচ্ছাসেবীরা খিচুড়ি রান্না করে বাড়ি বাড়ি বিতরণ করছেন। গোদাগাড়ীর কাঁকনহাট, আলোকছত্র হয়ে তানোরের সরনজাই ও কালীগঞ্জ এলাকায় মাঠের পর মাঠের ধান শুয়ে পড়েছে।
কালীগঞ্জের কৃষক সাবিয়ার রহমান বলেন, “আমার ১২ বিঘা জমির ধান শেষ। আধাপাকা ধান ঘরে তুলতেও লোক পাওয়া যাবে না।”
এবার মাঠ তলিয়ে যাওয়ায় আলু ও শীতকালীন সবজি চাষে বিলম্ব হবে। পার্শ্ববর্তী মোহনপুর ও বাগমারায় ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পানি ঢুকে যাওয়ায় পানবরজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
দুই পাশের জমি প্লাবিত করে বৃষ্টির পানি সড়কে উঠেছে
শনিবার বাগমারার বাসুপাড়ায় নুর মোহম্মাদ নামের এক পানচাষির মৃত্যু হয়েছে। স্থানীয়দের ধারণা, বরজে পানি ঢুকে যাওয়ায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা গিয়ে থাকতে পারেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন দাবি করেছেন, “ক্ষয়ক্ষতি তেমন হয়নি।” তিনি বলেন, “৫০০ হেক্টর ধানের ক্ষতির প্রতিবেদন আমরা দিচ্ছি। ধান শুয়ে পড়লেই কিন্তু ক্ষতি হবে না। মাঠে যাচ্ছি, দেখছি।”
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “কিছু উপজেলা থেকে পুকুর ভেসে যাওয়ার খবর পেয়েছি। মাছ বেরিয়ে গেছে। এটি অপরিকল্পিত পুকুর খননের কারণে হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানার জন্য উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছি।”
ঢাকা/কেয়া/মাসুদ