বৈশাখে শতবর্ষীয় বাঁশির সুর বাজে যে গ্রামে
Published: 13th, April 2025 GMT
কুমিল্লার হোমনা উপজেলার শ্রীমদ্দী গ্রামে বৈশাখের আগমনে এক অনন্য উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। শতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী বাঁশি তৈরির প্রাচীন শিল্প এখানে এখনো জীবন্ত, যা গ্রামবাসীর মুখে হাসি ও শহরের মেলায় সুরের ছোঁয়া নিয়ে হাজির হচ্ছে।
শ্রীমদ্দী গ্রামে প্রায় ১২০টি পরিবার বাঁশি তৈরির কাজে জড়িত। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কারিগররা বাঁশ সংগ্রহ, ছিদ্র করা এবং রঙিন সাজসজ্জার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।
স্থানীয় কারিগরদের মতে, এই প্রাচীন শিল্প কেবল একটি বাদ্যযন্ত্র তৈরির প্রক্রিয়া নয় বরং এটি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক শিকড়ের এবং আত্মার গভীর প্রতিফলন।
গ্রামের সবচেয়ে প্রবীণ বাঁশিশিল্পী আমির হোসেন (৬৫) তিনি বলেন, “আমাদের পূর্বপুরুষেরা যখন বাঁশি তৈরি করতেন, তখন এতে কেবল কারিগরি দক্ষতা নয়, আত্মার এক গভীর প্রেরণা ছিল। বৈশাখের আগমন ঘটতেই চাহিদা বেড়ে যায়। এক মাস ধরে চলা এই কার্যক্রমের মধ্যে দেশে নানা প্রান্ত থেকে মানুষ এসে বাঁশি সংগ্রহ করে।”
এদিকে পরম্পরাগতভাবে পুরুষদের শিল্প মনে হলেও, শ্রীমদ্দীতে নারীরাও সমানভাবে অংশ নেয়।
গ্রামের গৃহবধূ রাহেলা খাতুন বলেন, “ঘরের কাজ শেষে আমরা মেয়েরা বসে বাঁশিকে সাজাই। প্রত্যেকটি বাঁশি যেন আলাদা এক গল্প বলে। আমাদের তৈরি বাঁশি এখন শহরের বড় মেলায় পৌঁছে যায়।”
নারী ও পুরুষের সমন্বয়ে গ্রামটি বৈশাখের আগমনে নতুন সুরে মাখিয়ে ওঠে। তবে সাম্প্রতিক বৈশাখ আসলে শ্রীমদ্দীর বাঁশির চাহিদা বহুগুণে বেড়ে যায়। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন মেলায় এই বাঁশি জনপ্রিয় হস্তশিল্প হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে বাজারে প্রায় ৩০ টাকা থেকে ১৭০ টাকা মূল্যের বাঁশি বিক্রি করা হয়।
এই সাথে বর্তমান তরুণরা ঐতিহ্য সংরক্ষণের পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে তা বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরেছেন। ইউটিউব, ফেসবুক ও অনলাইন মার্কেটপ্লেসের মাধ্যমে শ্রীমদ্দীর বাঁশির ইতিহাস এবং কারিগরি প্রচার হচ্ছে।
গ্রামাঞ্চলের কলেজ ছাত্র ফামিদুল বলেন, “আমরা এখন বাঁশি বানিয়ে অনলাইনে বিক্রি করছি; বিদেশ থেকেও অর্ডার আসছে। ডিজিটাল মাধ্যমের মাধ্যমে আমাদের ঐতিহ্যকে বহির্বিশ্বে উপস্থাপন করার সুযোগ তৈরি হয়েছে।”
হোমনা উপজেলার সংস্কৃতিকর্মী লুৎফর রহমান বলে, বাঁশির শিল্প শুধুমাত্র অর্থ উপার্জনের মাধ্যম নয়, এটি আমাদের শিকড়ের- আমাদের আত্মার প্রতীক। প্রতিটি বাঁশি যেন দেশের ঐতিহ্য বহন করে।”
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সুমি আক্তার, গ্রামটিতে বাঁশির সুর একসময়, শহর থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে ছড়িয়ে পড়বে, তখন আমাদের মনে গেঁথে যায় শতবর্ষের ঐতিহ্য ও শিকড়ের প্রকৃত সুর।
এই প্রাচীন শিল্প কেবল একটি বাদ্যযন্ত্র নয়, বরং বাঙালির আত্মার, সাংস্কৃতিক গর্বের এবং জাতীয় পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
হোমনা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) ক্ষেলালিকা চাকমা বলেন, “শ্রীমদ্দি একটি এতিহ্যবাহী গ্রামে। তারা দীর্ঘদিন ধরে এই শিল্পটাকে টিকিয়ে রেখেছে। অনেক পরিবার এই শিল্পের ওপর জীবিকা নির্বাহ করছে।”
তিনি আরও বলেন, “তাদের সাথে আমাদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ থাকে। বিভিন্ন অনুষ্ঠান যেমন পয়লা বৈশাখসহ অন্যান্য যে দিবস আছে আমরা তাদের আমন্ত্রণ করি। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের সহায়তা করে আসছে।”
ঢাকা/এস
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর শ র মদ দ আম দ র উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
তুলশীগঙ্গার তীরে সন্ন্যাসতলীর শতবর্ষী ঘুড়ির মেলা
জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার মামুদপুর ইউনিয়নের মহব্বতপুর গ্রাম ঘেঁষে তুলশীগঙ্গা নদীর অদূরে সন্ন্যাসতলীর বটতলা। জায়গাটিতে প্রায় একশ বছর আগে থেকে বাংলা জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ শুক্রবার আয়োজন হয় ঘুড়ির মেলা। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। অন্তত ৫০ গ্রামের হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে শুক্রবার সন্ন্যাসতলী ঘুড়ি উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে।
মেলার দিনক্ষণ মনে রেখে সময়মতো দোকানিদের পাশাপাশি দর্শনার্থীরা ভিড় জমান নিভৃত পল্লীতে। আগে মেলার দিন বৃষ্টি হওয়া যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটেছে। প্রচণ্ড গরম ও তাপপ্রবাহের মধ্যেই চলে এ আয়োজন। বৈরী পরিবেশের কারণে উৎসবের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্থানীয় প্রবীণ বাসিন্দারা বলছেন, সন্ন্যাসতলীর এ ঘুড়ি উৎসব শুরুর দিন বিকেলে বটতলায় স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায় সন্ন্যাস পূজা পালন করেন। তাদের এ পূজা-অর্চনা ঘিরেই মূলত এ মেলার উৎপত্তি। তবে শুরুর কথা কেউ বলতে পারেননি। প্রবীণরা শুধু জানেন, একশ বছরের বেশি সময় ধরে তারা এ মেলার আয়োজন দেখে আসছেন।
মেলার নিজস্ব জায়গা না থাকলেও এর ব্যাপ্তি প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে। প্রচণ্ড গরমের মধ্যেই এক দিনের এ মেলা ঘিরেই জেলার জামালগঞ্জ চারমাথা থেকে ঐতিহাসিক আছরাঙ্গাদীঘি পর্যন্ত রকমারি পণ্যের দোকান বসে। এখান থেকে সংসারের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন আসবাব থেকে শুরু করে ছোট মাছ ধরার বাঁশের তৈরি পণ্য খলসানি, টোপা, ডালা, চালুন কিনে নেন অনেকে।
সুতার তৈরি তৌরা জাল, গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত দ্রব্যাদি, বিভিন্ন ধরনের খেলনা, মিষ্টান্ন, প্রসাধনী, মাটির তৈজসপত্রসহ বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রি হয়। শিশুদের বিনোদনের জন্য ছিল নাগরদোলার ব্যবস্থাও। আর মেলার বড় আকর্ষণ ঘুড়ি ওড়ানো ও বিক্রি। পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা এসেছিলেন ঘুড়ি বিক্রি করতে।
প্রচণ্ড গরমের পাশাপাশি তেমন হাওয়া-বাতাস না থাকায় এবার ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা সেভাবে জমে ওঠেনি। তবে ঘুড়ি বেচাকেনা ও শিশু-কিশোরদের উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো। এ উপলক্ষে আসা হাজার হাজার দর্শনার্থীর নিরাপত্তার জন্য মেলায় সার্বক্ষণিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের টহল ছিল।
আদমদীঘির শিববাটি গ্রামের ঘুড়ি ব্যবসায়ী সালাম হোসেনের ভাষ্য, সন্ন্যাসতলীর মেলা বড় হওয়ায় তিনি এসেছেন ঘুড়ি বিক্রির জন্য। মেলায় প্রত্যাশা অনুযায়ী ঘুড়ি বিক্রি করতে পেরে তিনি খুশি। জয়পুরহাটের পার্বতীপুর এলাকার ঘুড়ি ব্যবসায়ী মফিজ উদ্দিন ও মজনু সরদার বলেন, পূর্বপুরুষের আমল থেকে এ মেলার কথা শুনে আসছেন তারা।
মেলা উদযাপন ও পূজা কমিটির সদস্য মহব্বতপুর গ্রামের মন্টু মণ্ডল বলেন, মেলাটি হিন্দু সম্প্রদায়ের হলেও এটি আসলে সব ধর্মালম্বীর মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে।
মামুদপুর ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান মিলন হোসেনের ভাষ্য, এক দিনের আয়োজনে যে এত লোকের সমাগম হতে পারে, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। মেলায় যেন অনৈতিক কর্মকাণ্ড না হয়, সে ব্যাপারে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
ক্ষেতলাল থানার ওসি মোহাম্মদ ফরিদ হোসেন বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এবং মেলায় আসা দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ প্রশাসন সতর্ক আছে। মেলায় অনৈতিক আচরণ লক্ষ্য করা গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।