সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আজ থেকে ধারাবাহিক বৈঠক শুরু করছে বিএনপি। গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে বিকেল ৩টায় ১২ দলীয় জোটের বৈঠকের মধ্য দিয়ে এ আলোচনা শুরু হবে। সন্ধ্যায় লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপির সঙ্গে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য দলের সঙ্গেও বসবে বিএনপি।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ বৈঠক করবে দলটি। বৈঠক শেষে সবার মতামত ও পরামর্শের ভিত্তিতে দলের পক্ষে পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে। 

বিএনপির দলীয় সূত্র বলছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখা হবে। দলটি মনে করছে, নির্বাচন নিয়ে সরকার ততটা আন্তরিক নয়। তারা নির্বাচনকে তুলনামূলক কম গুরুত্ব দিচ্ছে। সরকারের ওপর চাপ তৈরির অংশ হিসেবে সমমনাসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করবে বিএনপি। দুই সপ্তাহের মধ্যে বৈঠকগুলো শেষ করতে চায় তারা। তারপর সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন বিষয়ে আবার নিজেদের অবস্থান জানান দেবে দলটি। বৃহস্পতিবার রাতে অনুষ্ঠিত বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে। বিএনপি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায়। 

বিএনপির সাত সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল গত বুধবার নির্বাচনের সময় ও পথনকশা জানতে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করে। সরকারের দিক থেকে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময় না পেয়ে প্রকাশ্যেই অসন্তোষ প্রকাশ করে বিএনপি। পরদিন বৃহস্পতিবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বসে বিএনপি। সে বৈঠকের যে প্রতিক্রিয়া দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তাতেও আছে অসন্তোষের ছাপ। এর পর রাতেই স্থায়ী কমিটির বৈঠক ডেকে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আলোচনায় বসে দলটি। সেখানে শুরুতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনার ফলাফল তুলে ধরেন। এর পর নির্বাচন বিষয়ে সরকারের যে দৃষ্টিভঙ্গি বিএনপির কাছে প্রতীয়মান, জমিরউদ্দিন সরকার তা তুলে ধরেন। 

বৈঠক সূত্র জানায়, বিএনপি নেতাদের কাছে মনে হয়েছে, সরকার আগামী ডিসেম্বর থেকে পরবর্তী জুনের কথা বললেও নির্বাচন নিয়ে আসলে তারা অনেকটা উদাসীন। উপদেষ্টাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজে বিএনপি নেতাদের কারও কারও মনে হয়েছে, নির্বাচন ২০২৬ সালের জুন পেরিয়ে ডিসেম্বরে চলে গেলেও সরকারের কোনো সমস্যা নেই। নির্বাচনকে সরকার এখনও কার্যত আমলে নিচ্ছে না। দলীয় সূত্র জানায়, বৈঠকে অন্য দলগুলোর অবস্থানও পর্যালোচনা করেন বিএনপি নেতারা। তারা মনে করছেন, জাতীয় নির্বাচন বিষয়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের মিত্র এবং আগে নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলোর অবস্থান আস্তে আস্তে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। তাদের অনেকেই কাছাকাছি অবস্থানে আসছে। আলোচনার মাধ্যমে এদের সবাইকে এক জায়গায় আনার প্রচেষ্টাকে জোরালো করতে হবে। 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আগামী রোজার আগে জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচন দাবির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দলটির শীর্ষ নেতারা জামায়াতের এই অবস্থানকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন। বৈঠকে বিএনপি নেতারা বলেন, এই সরকার গণঅভ্যুত্থানের ফসল। তাই সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপি সরাসরি কোনো কর্মসূচি কিংবা বড় আন্দোলনে যেতে চাচ্ছে না। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারকে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করবে তারা। বিএনপি চায় না এই সরকার ব্যর্থ হোক। বৈঠকের সূত্র বলছে, নির্বাচন ইস্যুতে সরকার সুনির্দিষ্ট কী পদক্ষেপ নেয়, তা পর্যবেক্ষণ করবে বিএনপি। দলটির শঙ্কা, রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত ও চাওয়া উপেক্ষা করে সরকার নির্বাচনের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ না নিলে দেশের চলমান পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে ও অস্থিতিশীল হয়ে যেতে পারে। তাই চাপ তৈরি করে সরকারকে দ্রুত নির্বাচনের গুরুত্ব বোঝাতে চায় বিএনপি। 

ড.

মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বিএনপি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পথনকশা ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছিল। শুরুতে প্রধান উপদেষ্টা চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের কথা বলেন। পরে সেখান থেকে সরে গিয়ে ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলেন। বিএনপি মনে করছে, নির্বাচন বিলম্বিত করতে নানা পক্ষ কাজ করছে। নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের দু-একজন উপদেষ্টা এবং দু-একটি দলের নানা রকম বক্তব্যে নির্বাচন প্রলম্বিত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয় বিএনপির মধ্যে। 

বিএনপি মনে করে, নির্বাচনমুখী প্রয়োজনীয় সংস্কার কার্যক্রম শেষে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। এর বেশি হলে তা হবে সময়ক্ষেপণ। দলটি মনে করছে, গুম, খুন ও গণহত্যায় জড়িতদের বিচার এবং সংস্কার কার্যক্রমও সেভাবে এগোচ্ছে না। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য যে ধরনের সংস্কার দরকার, সেগুলো গুছিয়ে আনছে না সরকার। বৈঠকে সরকারের সংস্কার কার্যক্রম নিয়ে একাধিক নেতা বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে গতিতে বিভিন্ন দলের সঙ্গে বৈঠক করছে, তাতে আরও কয়েক মাস লাগতে পারে। এর পর সব দলের মতামতের ভিত্তিতে সংস্কার বাস্তবায়ন করতে আরও সময় লাগবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, তারা যে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপের দাবি করছেন এবং এটি দেওয়া যে জরুরি, সে বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন বলে বৈঠকে তাদের মনে হয়নি। তাদের মনে হচ্ছে, সরকারের ভেতরের কোনো একটি পক্ষ নির্বাচন বিলম্বিত করতে চায়। তাই বিএনপি যদি সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত না রাখে তাহলে নির্বাচন জুন নয়, আগামী বছরের ডিসেম্বরেও চলে যেতে পারে।

দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু সমকালকে বলেন, ‘ফ্যাসিবাদের পতন ঘটলেও মানুষের অধিকার এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আমরা সেই অধিকার ফিরিয়ে আনতে নির্বাচনের কথা বলছি। দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচন না হলে দেশ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নানা সংকটে পড়তে পারে বলে আমাদের আশঙ্কার কথাও তুলে ধরেছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকার নির্বাচনের কোনো রোডম্যাপ ঘোষণা করতে পারেনি। এ অবস্থায় আমরা সমমনাসহ সব দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে সামনের এগোতে চাই।’

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব এনপ এলড প ব এনপ র স র জন ত ক ড স ম বর অবস থ ন দলগ ল র সরক র র কম ট র দল র স বছর র

এছাড়াও পড়ুন:

এই সরকারও আমলাতন্ত্রের চাপে!

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান নতুন যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে, সেখানে নিশ্চিত করেই জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রশ্নটি নাগরিকদের কেন্দ্রীয় একটি চাহিদা। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই পদ ছাড়া পদোন্নতি দিচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, আগের সরকার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল যে কয়টা স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে, তার অন্যতম আমলাতন্ত্র।

জনপ্রশাসনকে রাজনীতিকরণের বৃত্ত ভেঙে জনবান্ধব করার একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছিল অভ্যুত্থান। কিন্তু শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর অতিনির্ভরশীল হয়ে ওঠায় সেই সুযোগ অনেকটাই হাতছাড়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরোধিতার কারণে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বড় কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। অন্যদিকে বেতন বাড়াতে গঠন করা হয়েছে বেতন কমিশন। কিছু মুখকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া জনপ্রশাসনে সেই পুরোনো চর্চা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে পদ ছাড়া পদায়নের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনে যেভাবে আগের সরকারের চর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে, সেটা যারপরনাই দুঃখজনক।

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, উপসচিব স্তরে যেখানে আগে থেকেই পদের চেয়ে ৬০০ কর্মকর্তা বেশি রয়েছেন, সেখানে আগস্ট মাসে নতুন করে ২৬৮ জনকে এই পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদেও পদোন্নতির আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের আমলে জনপ্রশাসনে হরেদরে পদোন্নতি দেওয়ার অনেক নজির আছে। এর কারণ একটাই, আমলাতন্ত্রকে তুষ্ট রাখা। অন্তর্বর্তী সরকার এই চর্চায় ছেদ ঘটাতে পারবে, সেটাই সবাই প্রত্যাশা করেছিল।

পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ার পর বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে আগের জায়গাতেই রেখে দেওয়া হয়। এর মানে হচ্ছে তাঁরা আগের দায়িত্বই পালন করেন, কিন্তু মাঝখান থেকে বেতন-ভাতা বাড়ে। উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা তিন বছর চাকরি পাওয়ার পর বিনা সুদে গাড়ি কেনার জন্য ঋণসুবিধা পান। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের যেভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তার দৃষ্টান্তও খুব বেশি নেই। অবসরে যাওয়া প্রশাসন ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ও অন্য ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৮ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে।

জনপ্রশাসনের মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে পরের ধাপে যাবেন, সেটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু পদ না থাকার পরও কেন পদায়ন করা হবে? এ ক্ষেত্রে সরকারকে পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন, জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদ বাড়ানো যায় কি না। আবার যেখানে এমনিতেই পদের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি, সেখানে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া কতটা যৌক্তিক?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জনপ্রশাসনবিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেছেন, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়া যায় না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে মেধাবীদের পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এরপরও কেন এমন পদোন্নতি—সেই ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, সরকার সম্ভবত আমলাতন্ত্রের চাপে রয়েছে। এই ধারণা শুধু তাঁর একার নয়, নাগরিক পরিসরের
বিস্তৃত একটি ধারণাও। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা হাজির করা উচিত।

মাথাভারী আমলাতন্ত্র সরকারি সেবা নাগরিকের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা। অন্যদিকে সরকারকে এখানে বিশাল ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হয়। ফলে মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও গতিশীল জনপ্রশাসনই সবাই প্রত্যাশা করে। জনপ্রশাসনের সব স্তরে পদোন্নতি রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, মেধার ভিত্তিতেই হতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ