নানা চড়াই-উতরাই, পরিবর্তন আর বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে পথ চলছে আমাদের এ নীল গ্রহ। মানুষের আগমনের আগেও ছিল এ পৃথিবী, ছিল প্রাণের বিকাশ। ২২ এপ্রিল বিশ্ব ধরিত্রী দিবস। পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখার জন্য ১৯৭০ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে এ দিবস। অথচ একদিকে যুদ্ধ, দখলদারিত্ব, দাবানল, ভোগবাদী আগ্রাসন, অন্যদিকে এর প্রতিফল জলবায়ু পরিবর্তনের কঠিন বাস্তবতা। প্রকৃতি আজ ক্ষতবিক্ষত। জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে, গলে যাচ্ছে হিমবাহ, ডুবে যাচ্ছে উপকূল। পৃথিবীর ছোট একটি দেশ বাংলাদেশ, যার অস্তিত্ব জড়িয়ে আছে প্রকৃতির সঙ্গে। এখানেও আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি– নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড়, লবণাক্ততা, খরার প্রকোপ দিন দিন বেড়ে চলেছে।
কিছুদিন আগে উত্তরবঙ্গজুড়ে দেখা দেয় আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতি। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেতে না পেতে উপকূল ও পাহাড়জুড়ে ব্যাপক পানি সংকট দেখা দেয়। পানির জন্য পাড়ি দিতে হচ্ছে সাত থেকে আট কিলোমিটার। প্রাকৃতিক, মানবসৃষ্ট ও ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের নদীগুলোর ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। এক সময়ের প্রাণবন্ত নদীগুলো আজ দখল, নাব্য হারানো এবং বিভিন্ন বাঁধ নির্মাণের ফলে মৃতপ্রায়। এসব কারণে বর্ষা মৌসুমে অতিবৃষ্টিতে দেখা দিচ্ছে ভয়াবহ বন্যা; কারণ পানি নিষ্কাশনের পথ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আবার শুষ্ক মৌসুমে কম বৃষ্টিপাত ও নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ায় সৃষ্টি হচ্ছে ভয়াবহ খরা। এ জলবায়ু ও নদী সংকটের ফলে দেশের খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কৃষিতে পানি সংকট দেখা দিচ্ছে; যা অর্থনীতির ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে। নদীভিত্তিক জীবিকায় নির্ভরশীল মানুষজন হারাচ্ছে তাদের আয়ের উৎস।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চমাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত ও দুর্বল বেড়িবাঁধগুলো এখন নতুন করে দুর্যোগের আশঙ্কা তৈরি করেছে। সামান্য জলোচ্ছ্বাস বা ভারী বৃষ্টিপাতে ভেঙে পড়ছে এসব বাঁধ। যার ফলে প্লাবিত হচ্ছে বিস্তীর্ণ জনপদ ও ফসলি জমি। ঈদুল ফিতরের আগের দিন পূর্ণিমার কারণে জোয়ারের পানি সামান্য বাড়ার কারণে দুর্বল হয়ে পড়ে বেড়িবাঁধ। ঈদের দিন যখন মানুষ নামাজের প্রস্তুতি নিচ্ছে কিংবা মসজিদে প্রার্থনায় মগ্ন, ঠিক সেই সময় স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি উচ্চতার জোয়ারে ভেঙে পড়ে সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার বিছট এলাকার বেড়িবাঁধটি। খবর পেয়ে স্থানীয় জনগণ দ্রুত বাঁধ রক্ষার চেষ্টা চালান, তারা তৈরি করতে চেয়েছিলেন অস্থায়ী প্রতিরক্ষা। সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। কিছু সময়ের ব্যবধানে আশাশুনির অন্তত ১০টি গ্রাম পানিতে তলিয়ে যায়। লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়ে গ্রামাঞ্চলে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রায় ১৫ হাজার পরিবার। ঈদের আনন্দ পরিণত হয় কান্না, আতঙ্ক ও অসহায়ত্বে। জোয়ারের পানিতে শুধু একটি বাঁধ ভেঙে পড়েনি; তা ভেঙে দিয়েছিল হাজারো মানুষের স্বপ্ন, নিরাপত্তা ও ভবিষ্যতের ভরসা। যেসব পরিবার ঈদের দিন আনন্দে মেতে ওঠার কথা, তারা সেদিন তলিয়ে গিয়েছিল কান্না, আতঙ্ক ও বেদনার গভীরে। আব্দুল রশিদ সরদারের বাড়ি আশাশুনির বল্লপুরে। তিনি বলেন, ‘যখন বাঁধ বাঁধতে পারিনি, তখন বাড়ির দিকে ছুটতে লাগলাম। ফিরতে ফিরতে বাড়ি ভেঙে পড়েছে। আমার হাঁড়ি-পাতিলের ব্যবসা। এসে দেখি হাঁড়ি-পাতিল সব ভেসে গেছে। আমি এখন নিঃস্ব।’
মোহাম্মদ কাজল মোড়ল বলেন, ‘আমার ৬০টির মতো হাঁস-মুরগি ভেসে গেছে। দুটি ছাগল নোনাপানি খেয়ে মারা গেছে। ঘর ভেঙে গেছে। আমি একা কিছুই রক্ষা করতে পারিনি।’ এভাবে জহুরা খাতুনের পাঁচটি ছাগল আর ১০টি মুরগি মারা গেছে। ৮৪ বছরের নিলু রানীর তিনটি গরু যেন ভেসে চলে না যায়, তাই জানের মায়া না করে ওই পানির স্রোতকে উপেক্ষা করে ঠাই দাঁড়িয়ে ছিলেন গোয়াল ঘরে। আয়শা খাতুন আর তাঁর স্বামী কোনো জিনিস রক্ষা করতে পারেননি। তারা সাত মাস ও দুই বছর বয়সী দুই শিশুসন্তানকে রক্ষা করেন। রোমেলা খাতুন ঘর ভাঙার পর অন্যের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। এখন ভাড়া বাড়িতে উঠেছেন। অনেকের ভাঙা ঘরগুলো আর নিরাপদ নেই। খোকন সরদার মাছ চাষ শুরু করেছিলেন। দেড় লাখ টাকা খরচের পর আয় করতে পেরেছেন মাত্র ১১ হাজার টাকা। এখন তিনি পুরো নিঃস্ব। আগের ঋণ শোধ করতে না করতেই আবারও ঋণগ্রস্ত হলেন। এ মানুষগুলোর জীবনে এখন শুধু ক্ষয়, বেদনা আর অনিশ্চয়তা। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষত শুধু বসতভিটা নয়, কেড়ে নিয়েছে জীবনের স্বপ্নগুলো। তারা কেউই আজ নিরাপদ নন– না খাদ্যে, না আশ্রয়ে, না ভবিষ্যতের নিশ্চয়তায়।
লবণপানির সঙ্গে যুদ্ধ করছেন শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনীর শেফালী বিবি। খোসপাঁচড়া-চুলকানি প্রতিদিন লেগে আছে। গত এক বছর আগে ফেলে দিতে হয়েছে জরায়ু। এখনও ইউরিন ইনফেকশন সারছে না তাঁর। সময়মতো বৃষ্টি না হওয়ায় এবার চাষ করতে পারেননি শাহিনুর ইসলাম। পদ্মপুকুরের লাইলিসহ দশ ঘর অন্য এলাকা থেকে মাইগ্রেশন হয়ে ওয়াপদার চরে বসবাস করছে। আইলা থেকে শুরু করে রিমাল পর্যন্ত প্রতিটি ঘূর্ণিঝড় তাদের গৃহহীন করেছে।
এই বিশ্ব ধরিত্রী দিবসে আমরা যখন পৃথিবীকে ভালো রাখার অঙ্গীকার করব, তখন আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বাস্তবতা; যেখানে মানুষ প্রকৃতির বিরূপতার বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করছে।
এ দুর্যোগের পেছনে শুধু প্রকৃতির রুদ্ররূপ নয়। আছে অবহেলা, প্রস্তুতির অভাব এবং বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের নির্মম বাস্তবতা। বাংলাদেশের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশগুলোর মানুষ বারবার ঘর বাঁধে, আবার হারায়– তাদের স্বপ্নগুলো ভেসে যায় লবণাক্ত জোয়ারে, ভেঙে পড়ে দুর্বল বেড়িবাঁধে।
আজ আমাদের শুধু সহানুভূতিশীল হওয়াই যথেষ্ট নয়। দরকার দায়িত্বশীলতা, টেকসই পরিকল্পনা, জলবায়ু ন্যায়বিচার এবং মানুষের প্রতি অঙ্গীকার। দরকার প্রাকৃতিক সম্পদের সুরক্ষা ও দুর্যোগ মোকাবিলায় কার্যকর প্রস্তুতি। যারা প্রান্তিক, যারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত তাদের কণ্ঠকে কেন্দ্রে রেখে গড়ে তুলতে হবে ভবিষ্যতের পথরেখা। কারণ পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখতে হলে আমাদের সবারই পরিবর্তিত হতে হবে। নয়তো এ নীল গ্রহে মানবসভ্যতা টিকে থাকা হয়ে পড়বে অনিশ্চিত।
লেখক: উন্নয়নকর্মী
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: গ রস ত আম দ র রস ত ত উপক ল
এছাড়াও পড়ুন:
কাজের আনন্দই জীবনের সার্থকতা
জন্মদিনের অনুষ্ঠান নয়, তবে অনানুষ্ঠানিক আয়োজনটি ছিল সে উপলক্ষেই। আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষাবিদ ও সুবক্তা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের জন্মদিন ছিল গত ২৫ জুলাই। তাঁর অগণিত অনুরাগীরা চেয়েছিলেন তাঁকে নিয়ে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে মিলিত হতে। উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের যে হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে গেছে, তারপর আর জন্মদিনের অনুষ্ঠান করতে কিছুতেই সম্মত হননি তিনি।
শুক্রবার সন্ধ্যায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ষষ্ঠতলায় কেন্দ্রের প্রাক্তনী ও তাঁর কিছু ঘনিষ্ঠজন আলাপচারিতার এক ঘরোয়া আয়োজন করেছিলেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে নিয়ে। সেখানে তিনি বললেন, কাজের মধ্য দিয়ে জীবনে যে আনন্দ পেয়েছেন, সেটিই জীবনের সার্থকতা। এই আনন্দই তাঁকে অনুপ্রাণিত করে, শক্তি জোগায়।
এ আয়োজনে অংশগ্রহণকারীরা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে বিভিন্ন প্রশ্ন করেছেন। তিনি তাঁর চিরপরিচিত সরস অথচ বুদ্ধিদীপ্ত গভীর তাৎপর্যময় কথায় উত্তর দিয়েছেন। কবিতা, সাহিত্য, শিল্প থেকে শিক্ষা, ইতিহাস, দর্শন, ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংগঠন, প্রেম–ভালোবাসা—সবকিছু উঠে আসে প্রশ্নোত্তরভিত্তিক কথোপকথনে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল থেকে শুরু করে বিশ্বসাহিত্যের বহু কালজয়ী লেখকের রচনা থেকে প্রচুর উদ্ধৃতি দিয়েছেন তিনি। এক অন্তরঙ্গ প্রাণবন্ত আবহ বিরাজমান ছিল সন্ধ্যা থেকে অনেকটা রাত অবধি এই আয়োজনে।
আবৃত্তিশিল্পী জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় শুরুতেই আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের একটি কবিতা আবৃত্তি করে জানতে চান, তিনি কবিতার চর্চা করেননি কেন? জবাবে তিনি বলেন, কবি শামসুর রাহমান একবার তাঁকে বলেছিলেন, তাঁর মধ্যে কবিত্বের ঘাটতি আছে। তাঁর নিজেরও সে রকম মনে হয়েছে। তারপর সাহিত্য পত্রিকা কণ্ঠস্বর প্রকাশ ও অনেক রকম কাজ করতে গিয়ে আর কবিতা লেখা হয়ে ওঠেনি।
অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য প্রশ্ন করেন, এখন একটা কঠিন সময় যাচ্ছে। তরুণ প্রজন্মকে কীভাবে দেখেন, কী আশা করেন তাদের কাছে?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, ‘তরুণেরা কী হবে, তা তরুণদের ওপরে নির্ভর করে না। সেটা নির্ভর করে আমরা তাদের কী বানাতে চাই, তার ওপর। দেখতে হবে তরুণদের গড়ার মতো আমাদের ক্ষমতা কতটা আছে। অর্থাৎ শিক্ষক কেমন হবে, তার ওপরে নির্ভর করে তাঁর ছাত্র কেমন হবে। সক্রেটিস শিক্ষক ছিলেন বলে ছাত্র প্লেটো হয়েছেন। প্লেটোর শিক্ষা পেয়ে ছাত্র অ্যারিস্টটল হতে পেরেছেন। বড়দের যদি বড়ত্ব না থাকে, তবে ছোটরা বড় হতে পারে না। দুর্ভাগ্য যে আমরা বড়রা তাদের সামনে আদর্শ দাঁড় করাতে পারিনি। ফলে এখন বড়দেরই ছোটদের পেছনে দাঁড়াতে হচ্ছে।’
ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম জানতে চান, তিনি এত বিচিত্র ধরনের এত বিপুল কাজ করেছেন। এই প্রাণশক্তি পান কেমন করে?
উত্তর দিতে গিয়ে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, ‘শক্তি আসে আনন্দ থেকে। কাজ করতে পারাটাই আনন্দের। আর সব সময় আশাবাদী থাকি। আশা কখনো শেষ হয় না। আশা শেষ মানে আমি শেষ।’
আলাপচারিতায় আরও অংশ নেন দুদক চেয়ারম্যান এম এ মোমেন, ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ, চিকিৎসক আমজাদ হোসেন, অভিনয়শিল্পী খায়রুল আলম সবুজ, কথাশিল্পী আনিসুল হক, ছড়াকার আমিরুল ইসলাম, উপস্থাপক আবদুন নূর তুষার, অভিনয়শিল্পী আফসানা মিমি, মশিউর রহমান, আলী নকী প্রমুখ। সঞ্চালনা করেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রাক্তনী খাদিজা রহমান।