Samakal:
2025-09-18@04:57:42 GMT

কেড়ে নিচ্ছে জীবনের স্বপ্ন

Published: 19th, April 2025 GMT

কেড়ে নিচ্ছে জীবনের স্বপ্ন

নানা চড়াই-উতরাই, পরিবর্তন আর বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে পথ চলছে আমাদের এ নীল গ্রহ। মানুষের আগমনের আগেও ছিল এ পৃথিবী, ছিল প্রাণের বিকাশ। ২২ এপ্রিল বিশ্ব ধরিত্রী দিবস। পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখার জন্য ১৯৭০ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে এ দিবস। অথচ একদিকে যুদ্ধ, দখলদারিত্ব, দাবানল, ভোগবাদী আগ্রাসন, অন্যদিকে এর প্রতিফল জলবায়ু পরিবর্তনের কঠিন বাস্তবতা। প্রকৃতি আজ ক্ষতবিক্ষত। জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে, গলে যাচ্ছে হিমবাহ, ডুবে যাচ্ছে উপকূল। পৃথিবীর ছোট একটি দেশ বাংলাদেশ, যার অস্তিত্ব জড়িয়ে আছে প্রকৃতির সঙ্গে। এখানেও আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি– নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড়, লবণাক্ততা, খরার প্রকোপ দিন দিন বেড়ে চলেছে।
কিছুদিন আগে উত্তরবঙ্গজুড়ে দেখা দেয় আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতি। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেতে না পেতে উপকূল ও পাহাড়জুড়ে ব্যাপক পানি সংকট দেখা দেয়। পানির জন্য পাড়ি দিতে হচ্ছে সাত থেকে আট কিলোমিটার। প্রাকৃতিক, মানবসৃষ্ট ও ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের নদীগুলোর ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। এক সময়ের প্রাণবন্ত নদীগুলো আজ দখল, নাব্য হারানো এবং বিভিন্ন বাঁধ নির্মাণের ফলে মৃতপ্রায়। এসব কারণে বর্ষা মৌসুমে অতিবৃষ্টিতে দেখা দিচ্ছে ভয়াবহ বন্যা; কারণ পানি নিষ্কাশনের পথ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আবার শুষ্ক মৌসুমে কম বৃষ্টিপাত ও নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ায় সৃষ্টি হচ্ছে ভয়াবহ খরা। এ জলবায়ু ও নদী সংকটের ফলে দেশের খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কৃষিতে পানি সংকট দেখা দিচ্ছে; যা অর্থনীতির ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে। নদীভিত্তিক জীবিকায় নির্ভরশীল মানুষজন হারাচ্ছে তাদের আয়ের উৎস।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চমাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত ও দুর্বল বেড়িবাঁধগুলো এখন নতুন করে দুর্যোগের আশঙ্কা তৈরি করেছে। সামান্য জলোচ্ছ্বাস বা ভারী বৃষ্টিপাতে ভেঙে পড়ছে এসব বাঁধ। যার ফলে প্লাবিত হচ্ছে বিস্তীর্ণ জনপদ ও ফসলি জমি। ঈদুল ফিতরের আগের দিন পূর্ণিমার কারণে জোয়ারের পানি সামান্য বাড়ার কারণে দুর্বল হয়ে পড়ে বেড়িবাঁধ। ঈদের দিন যখন মানুষ নামাজের প্রস্তুতি নিচ্ছে কিংবা মসজিদে প্রার্থনায় মগ্ন, ঠিক সেই সময় স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি উচ্চতার জোয়ারে ভেঙে পড়ে সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার বিছট এলাকার বেড়িবাঁধটি। খবর পেয়ে স্থানীয় জনগণ দ্রুত বাঁধ রক্ষার চেষ্টা চালান, তারা তৈরি করতে চেয়েছিলেন অস্থায়ী প্রতিরক্ষা। সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। কিছু সময়ের ব্যবধানে আশাশুনির অন্তত ১০টি গ্রাম পানিতে তলিয়ে যায়। লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়ে গ্রামাঞ্চলে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রায় ১৫ হাজার পরিবার। ঈদের আনন্দ পরিণত হয় কান্না, আতঙ্ক ও অসহায়ত্বে। জোয়ারের পানিতে শুধু একটি বাঁধ ভেঙে পড়েনি; তা ভেঙে দিয়েছিল হাজারো মানুষের স্বপ্ন, নিরাপত্তা ও ভবিষ্যতের ভরসা। যেসব পরিবার ঈদের দিন আনন্দে মেতে ওঠার কথা, তারা সেদিন তলিয়ে গিয়েছিল কান্না, আতঙ্ক ও বেদনার গভীরে। আব্দুল রশিদ সরদারের বাড়ি আশাশুনির বল্লপুরে। তিনি বলেন, ‘যখন বাঁধ বাঁধতে পারিনি, তখন বাড়ির দিকে ছুটতে লাগলাম। ফিরতে ফিরতে বাড়ি ভেঙে পড়েছে। আমার হাঁড়ি-পাতিলের ব্যবসা। এসে দেখি হাঁড়ি-পাতিল সব ভেসে গেছে। আমি এখন নিঃস্ব।’
মোহাম্মদ কাজল মোড়ল বলেন, ‘আমার ৬০টির মতো হাঁস-মুরগি ভেসে গেছে। দুটি ছাগল নোনাপানি খেয়ে মারা গেছে। ঘর ভেঙে গেছে। আমি একা কিছুই রক্ষা করতে পারিনি।’ এভাবে জহুরা খাতুনের পাঁচটি ছাগল আর ১০টি মুরগি মারা গেছে। ৮৪ বছরের নিলু রানীর তিনটি গরু যেন ভেসে চলে না যায়, তাই জানের মায়া না করে ওই পানির স্রোতকে উপেক্ষা করে ঠাই দাঁড়িয়ে ছিলেন গোয়াল ঘরে। আয়শা খাতুন আর তাঁর স্বামী কোনো জিনিস রক্ষা করতে পারেননি। তারা সাত মাস ও দুই বছর বয়সী দুই শিশুসন্তানকে রক্ষা করেন। রোমেলা খাতুন ঘর ভাঙার পর অন্যের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। এখন ভাড়া বাড়িতে উঠেছেন। অনেকের ভাঙা ঘরগুলো আর নিরাপদ নেই। খোকন সরদার মাছ চাষ শুরু করেছিলেন। দেড় লাখ টাকা খরচের পর আয় করতে পেরেছেন মাত্র ১১ হাজার টাকা। এখন তিনি পুরো নিঃস্ব। আগের ঋণ শোধ করতে না করতেই আবারও ঋণগ্রস্ত হলেন। এ মানুষগুলোর জীবনে এখন শুধু ক্ষয়, বেদনা আর অনিশ্চয়তা। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষত শুধু বসতভিটা নয়, কেড়ে নিয়েছে জীবনের স্বপ্নগুলো। তারা কেউই আজ নিরাপদ নন– না খাদ্যে, না আশ্রয়ে, না ভবিষ্যতের নিশ্চয়তায়।
লবণপানির সঙ্গে যুদ্ধ করছেন শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনীর শেফালী বিবি। খোসপাঁচড়া-চুলকানি প্রতিদিন লেগে আছে। গত এক বছর আগে ফেলে দিতে হয়েছে জরায়ু। এখনও ইউরিন ইনফেকশন সারছে না তাঁর। সময়মতো বৃষ্টি না হওয়ায় এবার চাষ করতে পারেননি শাহিনুর ইসলাম। পদ্মপুকুরের লাইলিসহ দশ ঘর অন্য এলাকা থেকে মাইগ্রেশন হয়ে ওয়াপদার চরে বসবাস করছে। আইলা থেকে শুরু করে রিমাল পর্যন্ত প্রতিটি ঘূর্ণিঝড় তাদের গৃহহীন করেছে।
এই বিশ্ব ধরিত্রী দিবসে আমরা যখন পৃথিবীকে ভালো রাখার অঙ্গীকার করব, তখন আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বাস্তবতা; যেখানে মানুষ প্রকৃতির বিরূপতার বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করছে।
এ দুর্যোগের পেছনে শুধু প্রকৃতির রুদ্ররূপ নয়। আছে অবহেলা, প্রস্তুতির অভাব এবং বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের নির্মম বাস্তবতা। বাংলাদেশের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশগুলোর মানুষ বারবার ঘর বাঁধে, আবার হারায়– তাদের স্বপ্নগুলো ভেসে যায় লবণাক্ত জোয়ারে, ভেঙে পড়ে দুর্বল বেড়িবাঁধে।
আজ আমাদের শুধু সহানুভূতিশীল হওয়াই যথেষ্ট নয়। দরকার দায়িত্বশীলতা, টেকসই পরিকল্পনা, জলবায়ু ন্যায়বিচার এবং মানুষের প্রতি অঙ্গীকার। দরকার প্রাকৃতিক সম্পদের সুরক্ষা ও দুর্যোগ মোকাবিলায় কার্যকর প্রস্তুতি। যারা প্রান্তিক, যারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত তাদের কণ্ঠকে কেন্দ্রে রেখে গড়ে তুলতে হবে ভবিষ্যতের পথরেখা। কারণ পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখতে হলে আমাদের সবারই পরিবর্তিত হতে হবে। নয়তো এ নীল গ্রহে মানবসভ্যতা টিকে থাকা হয়ে পড়বে অনিশ্চিত। 
লেখক: উন্নয়নকর্মী

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: গ রস ত আম দ র রস ত ত উপক ল

এছাড়াও পড়ুন:

অমর একুশে বইমেলা ফেব্রুয়ারিকে স্পর্শ করুক

অমর একুশে বইমেলা বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের মেলা। মূলত প্রকাশকদের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধ উত্তর বাংলাদেশে এই বইমেলার সূত্রপাত। সম্প্রতি এই বইমেলা নানা কারণে-অকারণে ডিসেম্বরে করার কথা শোনা যাচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে সুস্পষ্টভাবে বলতেই হচ্ছে -ডিসেম্বরে কিছুতেই মেলা করা যাবে না। কারণ সেসময় সারাদেশে শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষা চলবে।

বইমেলার প্রধান পাঠক আমাদের শিক্ষার্থী। তারা ডিসেম্বরে কিছুতেই মেলায় আসতে পারবে না। প্রধান পাঠকই যদি মেলায় আসতে না পারে তাহলে মেলা প্রাণহীন হয়ে পড়বে। বইমেলায় অংশগ্রহণকারি প্রকাশকরাও ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়বে। তাছাড়া একুশের চেতনাকে ধারণ করে যে অমর একুশে বইমেলা, সেটা ফেব্রুয়ারিকে স্পর্শ করুক। ভাষা শহীদদরর প্রতি বইমেলার মাধ্যমে আমাদের যে শ্রদ্ধাঞ্জলি, তা অক্ষুন্ন থাকুক। 

আরো পড়ুন:

রাজশাহীতে বইপড়ায় কৃতিত্বের পুরস্কার পেল ২৩০৩ শিক্ষার্থী

‘গল্পকারের পছন্দের ৫০ গল্প’ গ্রন্থ প্রকাশিত

সর্বোপরি ৫ জানুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, এই সময়ে বইমেলা হতে কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। অথবা তারিখ দুই একদিন এদিক-সেদিক করে নেয়া যেতে পারে। এ সময়ে রোজা নেই, নির্বাচনও নেই। নির্বাচনী ক্যাম্পেইন চলবে। এই মাঠে বইমেলা চলাকালীন সর্বদলীয় সিদ্ধান্তে কেউ সভা-সমাবেশ না করার সিদ্ধান্ত নিলে অনায়াসে এই সময়টাতে বইমেলা করা যেতে পারে। আমার বিশ্বাস- সব দলই অমর একুশে বইমেলার জন্য এই ছাড়টুকু দেবেন।

প্রায় পঞ্চাশ বছরের অধিক সময়ের  প্রচেষ্টায় অমর একুশে বইমেলা মহিরুহ হয়ে আমাদের কাছে আবির্ভূত, হঠকারি কোন সিদ্ধান্তে তা যেনো ধ্বংস হওয়ার উপক্রম না হয়। জেনে শুনে বাঙালির এতো বড় একটি সাংস্কৃতিক উৎসবকে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্থ না করে বরং তা যে কোন মূল্যে আমাদের রক্ষা করা উচিত।

জানুয়ারিতে বাণিজ্যমেলায়ও হয়ে থাকে। এতে অমর একুশে বইমেলার ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে আমি তা মনে করি না। বইমেলার প্রধান পাঠক শিক্ষার্থী। তারা বইমেলায় আসার জন্য মুখিয়ে থাকে। বাণিজ্য মেলায় যাওয়ার লোকজন বেশির ভাগই আলাদা। তবে অনেকেই বইমেলা এবং বাণিজ্যমেলা দুটোতেই যান। এটা তারা ম্যানেজ করে নিতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস।

আমি বলেছি শুধুমাত্র মেলার মাঠ প্রাঙ্গনে সভা-সমাবেশ না করার মাধ্যমে যদি সর্বদলীয় একটা সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তাহলে জানুয়ারি- ফেব্রুয়ারি মিলিয়ে  বইমেলা করা সম্ভব।আমার মনে হয়, বইমেলা চলাকালীন এই মাঠ কোন দলকে সভা-সমাবেশের জন্য সরকার বরাদ্দ না দিলে, অথবা বইমেলা চলাকালীন দলগুলো নিজের থেকেই এই মাঠের বরাদ্দ না চাইলে সমস্যা আর থাকে না।

লেখক: প্রকাশক পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিমিটেড

ঢাকা/লিপি

সম্পর্কিত নিবন্ধ