মৃত সন্তান প্রসব, সন্তানের মৃত্যু ও দ্বিতীয় বিয়েসহ বিশেষ ক্ষেত্র বিবেচনায় প্রসূতিকালীন ছুটি চারবার পর্যন্ত মঞ্জুর করার সুপারিশ করেছে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন। বাংলাদেশ সরকারি চাকরি বিধিমালা (পার্ট ১) অনুসারে, একজন কর্মজীবী নারী দুটি সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষেত্রে পূর্ণকালীন বেতনসহ ছুটি পান। গতকাল শনিবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে কমিশন। প্রতিবেদনে দত্তক সন্তানের জন্যও ছুটির বিধান রাখা এবং সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানের জন্য ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটির পাশাপাশি দুই সপ্তাহের পিতৃত্বকালীন ছুটি রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।

মোট ৪৩৩টি সুপারিশের মধ্যে কর্মজীবী নারীদের জন্য এসব সুপারিশ ছিল। সুপারিশ তৈরি করা হয়েছে তিন ধাপে— অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদে করণীয়, পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের মেয়াদে করণীয় এবং দীর্ঘ নারী আন্দোলনের আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের ভিত্তিতে।

‘সর্বক্ষেত্রে সর্বস্তরে নারীর প্রতি বৈষম্য বিলুপ্তি এবং নারী–পুরুষের সমতা অর্জনের পথে পদক্ষেপ চিহ্নিতকরণ’ শিরোনামের প্রতিবেদনে ‘পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের মেয়াদে করণীয়’ হিসেবে বলা হয়েছে, সরকারি, বেসরকারি ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে বিশেষ ক্ষেত্রে যেমন মৃত সন্তান প্রসব, সন্তানের মৃত্যু বা দ্বিতীয় বিয়েতে সন্তানের ক্ষেত্রে নারীদের জন্য প্রসূতিকালীন ছুটি চারবার পর্যন্ত শিথিল করা এবং দত্তক সন্তানের জন্যও ছুটির বিধান রাখতে হবে। পিতৃত্বকালীন ছুটির জন্য পূর্ণকালীন বেতনসহ দুই সপ্তাহের ছুটি ব্যবস্থা রেখে আইন প্রণয়ন করার সুপারিশ করা হয়েছে।

গত বছরের ১৮ নভেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ১০ সদস্যের নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন গঠন–সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে। নারীপক্ষ–এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শিরীন পারভিন হককে প্রধান করে গঠিত কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের জ্যেষ্ঠ ফেলো মাহীন সুলতান, সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ফৌজিয়া করিম ফিরোজ, বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি কল্পনা আক্তার, নারী স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ হালিদা হানুম আখতার, বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরুপা দেওয়ান, নারীপক্ষের পরিচালক কামরুন নাহার, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ সামাজিক উন্নয়ন উপদেষ্টা ফেরদৌসী সুলতানা ও শিক্ষার্থী প্রতিনিধি নিশিতা জামান নিহা।

প্রসূতিকালীন ছুটি চারবার পর্যন্ত শিথিল করার সুপারিশ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম প্রথম আলোকে বলেন, যেসব কারণ উল্লেখ করে চারবার পর্যন্ত ছুটি শিথিল করার সুপারিশ করা হয়েছে, তা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা যেতে পারে। ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ও দুই সপ্তাহের পিতৃত্বকালীন ছুটি অবশ্যই বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন।

বাংলাদেশ সরকারি চাকরি বিধিমালায় সংশোধনী এনে ২০১১ সালের ৯ জানুয়ারি মাতৃত্বকালীন ছুটি চার মাস থেকে বাড়িয়ে ছয় মাস করা হয়। বিধি অনুসারে, একজন নারী দুবারের বেশি প্রসূতিকালীন ছুটি পাবেন না। তবে মাতৃত্বকালীন ছয় মাস ছুটি শুধু সরকারি নারী কর্মকর্তা–কর্মচারীরা পেয়ে থাকেন। কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পূর্ণ বেতনসহ ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি দিলেও বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান চার মাসের বেশি ছুটি দেয় না। আবার পোশাকশিল্প কারখানায় মাতৃত্বকালীন ছুটি ১২০ দিন।

বিদ্যমান শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী নারী শ্রমিকদের প্রসূতিকালীন ছুটি ১১২ দিন। শ্রম ও নারী অধিকারকর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে এই ছুটি ছয় মাস করার দাবি জানিয়ে আসছেন। এ দাবিতে কখনো রাজি হননি মালিকপক্ষ। এর মধ্যে এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে শ্রমিক সংগঠন ও মালিকপক্ষের সঙ্গে আলোচনার পর সরকার ছুটি ১২০ দিন করার প্রস্তাব করে। তবে শ্রম সংস্কার কমিশনের এক সদস্য জানিয়েছেন, তাঁরা মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। মালিকপক্ষ চার মাসের জন্য পূর্ণ বেতনে ছুটি দিতে সম্মত হয়েছে। বাকি দুই মাস বিনা বেতনে ছুটি দিতে রাজি হয়েছে। তবে তাঁরা প্রস্তাব করতে যাচ্ছেন, ওই দুই মাস ছুটির বেতন যেন সরকার ও শ্রমিক কল্যাণসংক্রান্ত কোনো তহবিল থেকে বহন করা হয়। আগামীকাল সোমবার শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেওয়ার কথা রয়েছে। কমিশনের ওই সদস্য জানিয়েছেন, সময় উল্লেখ না করে তাঁরাও পিতৃত্বকালীন ছুটি দেওয়ার সুপারিশ করেছেন। তবে প্রসূতিকালীন ছুটি চারবার পর্যন্ত শিথিল করার কোনো সুপারিশ তাঁদের নেই।

এদিকে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন ‘অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের মেয়াদে করণীয়’ হিসেবে দত্তক সন্তানের আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করতেও সুপারিশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন ১৮৯০ সংস্কার করে দত্তক বিষয়ে একটি স্বতন্ত্র আইন তৈরি করতে হবে, যা শিশুটিকে দত্তক পরিবারের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে সুবিধা দেবে। শিশুটিকে পূর্ণ উত্তরাধিকার দেবে এবং শিশুটিকে গর্ভজাত সন্তানের মতো একই আইনি সুবিধা দেবে। দত্তক গ্রহণ যেন এমনভাবে স্বীকৃত হয় যে শিশুর কল্যাণ নিশ্চিত করে এবং উত্তরাধিকার, অভিভাবকত্ব ও পিতা–মাতার অধিকার সম্পর্কে স্পষ্টতা প্রদান করে।

আরও পড়ুননারীর জন্য ৩০০ সংরক্ষিত আসন, বিয়ে-তালাক, উত্তরাধিকারে সমান অধিকার দেওয়ার সুপারিশ ১৯ ঘণ্টা আগে

এ ছাড়া শ্রম আইনে দত্তক নেওয়ার সুবিধা অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে, যাতে সন্তান দত্তক নেওয়া বাবা–মায়েরা মাতৃত্ব ও পিতৃত্বকালীন ছুটি ও সুবিধা ভোগ করতে পারেন। এ বিষয়ে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, শ্রম আইন ২০০৬ ও সংশোধিত শ্রম আইন ২০১৩ সংশোধন করে সব খাতে ছয় মাসের বাধ্যতামূলক পূর্ণ বেতনে প্রসূতি, প্রসব ও দত্তকজনিত ছুটি নিশ্চিত করতে হবে। শ্রম আইনে ‘প্রসূতি কল্যাণ’ পরিবর্তন করে ‘প্রসূতি অধিকার’ লিখতে হবে। প্রসূতিকালে ও প্রসূতিজনিত ছুটির সময় চাকরিচ্যুতি নিষিদ্ধ করাসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সুযোগ–সুবিধা অর্ন্তভুক্ত করতে হবে। পিতৃত্বকালীন ছুটি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। গর্ভধারণ থেকে প্রসবোত্তর ছুটি থাকাকালীন চাকরিচ্যুতি নিষিদ্ধ করাসহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য সুযোগ–সুবিধা অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে।

সুপারিশ প্রসঙ্গে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্য ও বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি কল্পনা আক্তার বলেন, নারীর স্বাস্থ্য ও নবজাতকের সুস্থতার কথা চিন্তা করে সব প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ করা হয়েছে। আর এখন একক ও ক্ষুদ্র পরিবারের সংখ্যা বেশি। বাবা ছুটি পেলে প্রসূতি মায়ের যত্ন হবে। এতে করে মাকে স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়তে হবে না। সন্তান দত্তক নিলে ওই ছোট শিশুটির দেখাশোনার জন্যও মা ও বাবার ছুটি একইভাবে জরুরি। প্রসূতিকালীন ছুটি শিথিলের সুপারিশ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একজন মায়ের মৃত সন্তান হলে, সন্তান মারা গেলে তাঁর ছুটি নির্ধারিত মাতৃত্বকালীন ছুটি থেকে কাটা হয়, একইভাবে সন্তান রয়েছে এমন কোনো নারী দ্বিতীয় বিয়ে করলে তাঁকেও মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে জটিলতায় পড়তে হবে। এসব বিবেচনা করেই প্রসূতিকালীন ছুটি বিশেষ ক্ষেত্রে চারবার পর্যন্ত শিথিল করার সুপারিশ করা হয়েছে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ম ত ত বক ল ন ছ ট প রস ত ক ল ন ছ ট প ত ত বক ল ন ছ ট কর র স প র শ কর সরক র র ম য় দ শ থ ল কর র ভ ক ত কর ন র জন য প রসব ত করত সদস য করণ য়

এছাড়াও পড়ুন:

বেঙ্গালুরুতে ভারতের, কলম্বোতে পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলবে বাংলাদেশ

বাছাই পর্ব পেরিয়ে নারী ওয়ানডে বিশ্বকাপে জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশ। আট দলের এই প্রতিযোগিতা হচ্ছে হাইব্রিড মডেলে। ভারতের চারটি ভেনু‌্যতে হবে সাত দলের সব ম‌্যাচ। পাকিস্তান নিজেদের ম‌্যাচগুলো খেলবে কলম্বোতে। 

৩০ সেপ্টেম্বর ভারত ও শ্রীলঙ্কার ম‌্যাচ দিয়ে শুরু হবে নারীদের ওয়ানডে বিশ্বকাপ। ম‌্যাচটি হবে বেঙ্গালুরুর চিন্নাসোয়ামি স্টেডিয়ামে। একই ভেনু্যতে বাংলাদেশ ও ভারত খেলবে। ২৬ অক্টোবর ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া বাংলাদেশ পাকিস্তানের বিপক্ষে কলম্বোতে খেলবে ২ অক্টোবর। 

রাউন্ড রবিন লিগ পদ্ধতিতে আট দলের টুর্নামেন্টে প্রথম পর্বে ম্যাচ হবে মোট ২৮টি। ভারতসহ ২০২২-২৫ আইসিসি নারী চ্যাম্পিয়নশিপের পয়েন্ট তালিকার শীর্ষ ছয় দল সরাসরি জায়গা করে নিয়েছে বিশ্বকাপে। অন্য পাঁচ দল হলো- অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, নিউ জিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কা। বাছাই পর্ব পেরিয়ে মূল পর্বের টিকেট পেয়েছে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান।

আইসিসি এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে সূচি প্রকাশ করেনি।

পাকিস্তান পরের ধাপে কোয়ালিফাই করার ওপর নির্ভর করবে নক আউটের ভেনু্য। পাকিস্তান নক আউট পর্বে উঠলে শ্রীলঙ্কায় ম্যাচ হবে। নয়তো নক আউট পর্বের সব ম্যাচই হবে ভারতে। সাম্ভাব্য সূচিও চূড়ান্ত হয়েছে। ২৯ অক্টোবর গৌহাটি কিংবা কলম্বোয় প্রথম সেমিফাইনাল। পরদিন ৩০ অক্টোবর দ্বিতীয় সেমিফাইনাল বেঙ্গালুরুতে। ২ নভেম্বর বেঙ্গালুরু বা কলম্বোয় হবে ফাইনাল। 

প্রসঙ্গত, সবশেষ আইসিসির ইভেন্ট চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ম্যাচও হয়েছিল হাইব্রিড মডেলে। পাকিস্তানে বসেছিল সব ম্যাচ। ভারত সফর না করায় তাদের ম্যাচ হয়েছিল দুবাইয়ে।
 

ঢাকা/ইয়াসিন

সম্পর্কিত নিবন্ধ