মানব জাতিকে সঠিক পথের দিশা দিতে যুগে যুগে যেসব নবী ও রাসুল আগমন করেছেন, তাদের মধ্যে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ হলেন হজরত মুহাম্মদ (সা.)। আমানতদারি ও বিশ্বস্ততার জন্য তিনি বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছিলেন। এ কারণে কাফির, মুশরিকরাও তাঁকে ‘আল আমিন’ বা ‘বিশ্বাসী’ বলে ডাকত। আমানতদার ব্যক্তি সব সমাজেই প্রশংসিত।
‘আমানত’ আরবি শব্দ। এর অর্থ গচ্ছিত রাখা, নিরাপদ রাখা। কারও কাছে কোনো অর্থসম্পদ, বস্তু গচ্ছিত রাখাকে আমানত বলা হয়। যিনি গচ্ছিত বস্তুকে বিশ্বস্ততার সঙ্গে সংরক্ষণ ও যথাযথভাবে হেফাজত করেন এবং মালিক চাওয়ামাত্র কোনো টালবাহানা ছাড়া ফেরত দেন, তাঁকে আল আমিন তথা বিশ্বস্ত আমানতদার বলা হয়।
আমানতদারিকে আল্লাহতায়ালা মুমিনের অন্যতম গুণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। পবিত্র কোরআনের সুরা আল মু’মিনুনের ৮ আয়াতে এরশাদ হয়েছে: ‘এরা সেই লোক, যারা আমানতের প্রতি লক্ষ্য রাখে এবং স্বীয় অঙ্গীকার হেফাজত করে।’
অন্যত্র সুরা আন নিসার ৫৮ আয়াতে আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের আদেশ দিচ্ছেন যে তোমরা যেন আমানত তার মালিককে যথাযথভাবে ফিরিয়ে দাও।’
সুরা বনি ইসরাইলের ৩৪ আয়াতে এরশাদ করেন, ‘তোমরা অঙ্গীকার পূর্ণ করো। নিশ্চয়ই অঙ্গীকার সম্পর্কে কেয়ামতের দিন তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে।’
প্রিয় নবী (সা.
সততা, ন্যায়পরায়ণতা, বিশ্বস্ততা ও আমানতদারি রক্ষা না করা, অঙ্গীকার ভঙ্গ করা, কথায় কথায় মিথ্যাচার ইত্যাদি গর্হিত আচরণকে মুনাফিকের নিদর্শনরূপে সাব্যস্ত করা হয়েছে। হাদিস শরিফে বর্ণিত, হজরত রাসুলে কারিম (সা.) এরশাদ করেন, ‘মুনাফিকের নিদর্শন তিনটি: ১. কথা বললে মিথ্যা বলে, ২. ওয়াদা করলে ভঙ্গ করে। ৩. যখন তার কাছে কোনো বস্তু আমানত রাখা হয়, তার খেয়ানত করে।’ (সহিহ বুখারি)
এক প্রকার আমানত হাক্কুল্লাহ বা আল্লাহর হক-সম্পর্কিত। বান্দার প্রতি মহান আল্লাহ প্রদত্ত যাবতীয় ফরজ ও ওয়াজিব এবং যাবতীয় হারাম বর্জনের আদেশ হলো আল্লাহর হক-সম্পর্কিত আমানত। হাক্কুল ইবাদ বা বান্দার হক-সম্পর্কিত আমানতের মধ্যে আর্থিক আমানত অন্যতম। কেউ কারও কাছে কোনো সম্পদ বা টাকা-পয়সা গচ্ছিত রাখলে এটি আর্থিক আমানত। এটি রক্ষা ও প্রত্যর্পণ করাও ফরজ। অনুরূপ কারও গোপন কথা শরিয়তসম্মত ওজর ছাড়া ফাঁস করে দেওয়া হারাম। তদ্রূপ মজুর ও কর্মচারীর ওপর নির্ধারিত দায়িত্বও আমানত। অতএব কাজ চুরি বা সময় চুরিও এক প্রকার আমানতের খেয়ানত।
হজরত রাসুলে কারিম (সা.) বিদায় হজের ভাষণের শেষ দিকে এসে লাখ লাখ সাহাবির উদ্দেশে বলেন, ‘কেয়ামতের ময়দানে তোমাদের ব্যাপারে আমাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, তখন তোমরা কী বলবে? তারা সমস্বরে বলেন, আমরা বলব আপনি আপনার রিসালাত পৌঁছে দিয়েছেন, আপনার আমানত পূর্ণ করেছেন এবং আপনার উম্মতকে আপনি নসিহত করেছেন।’ (সহিহ বুখারি)
মহান আল্লাহতায়ালা মানুষকে যে হাত-পা, চোখ, কান, নাক ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দান করেছেন, তা সবই তাঁর পক্ষ থেকে আমানত। এ আমানতগুলো যদি সত্য-সুন্দর ও মানবতার কল্যাণ তথা ইসলামের পথে ব্যবহার করা হয়, তাহলে আমানত রক্ষা হবে এবং পরকালে এর জন্য তিনি পুরস্কৃত হবেন।
ড. মো. শাহজাহান কবীর: বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: কর ছ ন আল ল হ খ য় নত
এছাড়াও পড়ুন:
দোয়ার ফজিলত ও আদব
দোয়া শব্দের আভিধানিক অর্থ আহ্বান করা বা প্রার্থনা করা। পরিভাষায় দোয়া হলো কল্যাণ ও উপকার লাভের উদ্দেশ্যে এবং ক্ষতি ও অপকার রোধে মহান আল্লাহকে ডাকা এবং তাঁর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা।
প্রিয় নবীজি (সা.) বলেন, ‘দোয়াই ইবাদত।’ (বুখারি ও মুসলিম) ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে কিছু চায় না, আল্লাহ তাআলা তার প্রতি অসন্তুষ্ট হন।’ (তিরমিজি: ৩৩৭৩)
আল–কোরআনের বর্ণনা, ‘আর তোমাদের রব বলেন, “তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের জন্য সাড়া দেব। নিশ্চয় যারা অহংকারবশত আমার ইবাদত থেকে বিমুখ থাকে, তারা অচিরেই লাঞ্ছিত অবস্থায় জাহান্নামে প্রবেশ করবে।”’ (সুরা-৪০ মুমিন, আয়াত: ৬০)
মুমিনের পরিচয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তাদের পার্শ্বদেশ শয্যা থেকে আলাদা থাকে। তারা তাদের পালনকর্তাকে ডাকে ভয়ে ও আশায় এবং আমি তাদের যে রিজিক দিয়েছি, তা থেকে ব্যয় করে। কেউ জানে না তার কৃতকর্মের জন্য তাদের কী কী চোখজুড়ানো প্রতিদান লুকায়িত আছে।’ (সুরা-৩২ সাজদা, আয়াত: ১৬-১৭)
‘আর আমার বান্দাগণ যখন আমার সম্পর্কে আপনাকে জিজ্ঞাসা করে, (তখন বলে দিন যে) নিশ্চয় আমি অতি নিকটে। আহ্বানকারী যখন আমাকে আহ্বান করে, আমি তার আহ্বানে সাড়া দেই। কাজেই তারাও আমার ডাকে সাড়া দিক এবং আমার প্রতি ইমান আনুক, যাতে তারা সঠিক পথে চলতে পারে।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৮৬)
দোয়া কবুলের অন্যতম শর্ত হলো হালাল উপার্জন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে রাসুলগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু থেকে আহার করো এবং সৎকাজ করো; তোমরা যা করো, সে সম্বন্ধে আমি সবিশেষ অবহিত।’ (সুরা-২৩ মুমিনুন, আয়াত: ৫১)দোয়া ও আমল কবুল হওয়ার মূল শর্ত হলো ইখলাস। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তিনি চিরঞ্জীব, তিনি ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই। অতএব, তাঁকে ডাকো খাঁটি ইবাদতের মাধ্যমে।’ (সুরা-৪০ মুমিন, আয়াত: ৬৬)
দোয়া কবুলের অন্যতম শর্ত হলো হালাল উপার্জন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে রাসুলগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু থেকে আহার করো এবং সৎ কাজ করো; তোমরা যা করো, সে সম্বন্ধে আমি সবিশেষ অবহিত।’ (সুরা-২৩ মুমিনুন, আয়াত: ৫১) ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা পাক পবিত্র বস্তুসামগ্রী আহার করো, যেগুলো আমি তোমাদের রিজিক হিসেবে দান করেছি।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৭৩)
নবীজি (সা.) বলেন, ‘উষ্কখুষ্ক ধুলায় ধূসরিত অবস্থায় দীর্ঘ সফরকারী একজন যে স্বীয় দুই হাত আকাশের দিকে প্রসারিত করে বলে, “হে প্রভু! হে প্রভু!” অথচ তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, পোশাক হারাম এবং সে হারাম দ্বারা লালিত, তার দোয়া কীভাবে কবুল হবে?’ (মুসলিম: ১৬৮৬)
নির্জনে নীরবে বিনয়ের সঙ্গে দোয়া করা উত্তম। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা স্বীয় প্রতিপালককে ডাকো কাকুতি মিনতি করে এবং সংগোপনে। তিনি সীমা অতিক্রমকারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা-৭ আরাফ, আয়াত: ৫৫)। ‘পৃথিবীকে কুসংস্কারমুক্ত ও ঠিক করার পর তাতে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করো না। তাকে আহ্বান করো ভয় ও আশাসহকারে। নিশ্চয় আল্লাহর করুণা সৎকর্মশীলদের নিকটবর্তী।’ (সুরা-৭ আরাফ, আয়াত: ৫৫-৫৬)
দোয়ার আদব হলো দৃঢ়সংকল্প ও আকুতির সঙ্গে দোয়া করা, দোয়া কবুলে প্রবল আশাবাদী হওয়া।
হজরত জাকারিয়া (আ.) তাঁর দোয়ায় বলেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! আপনার কাছে দোয়া করে আমি কখনো ব্যর্থ হইনি।’ (সুরা-১৯ মারিয়াম, আয়াত: ৪) হজরত ইব্রাহিম (আ.) বলেন, ‘আশা করি, আমার প্রতিপালকের নিকট দোয়া করে আমি বিফল হব না।’ (সুরা-১৯ মারিয়াম, আয়াত: ৪৮)
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম
[email protected]