Prothomalo:
2025-08-01@02:06:08 GMT

সংস্কার নিয়ে সবক ও শঙ্কা

Published: 25th, April 2025 GMT

অন্তর্বর্তী রাজনীতি এখন দ্রুত একটা অবয়ব নিতে যাচ্ছে। সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপ চলছে। বিএনপির নেতারা কয়েক দফায় ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন। সংবাদমাধ্যমে জানতে পারলাম, কিছু বিষয়ে তাঁদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। একটি প্রস্তাব ছিল, কেউ টানা দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। আরেকটি প্রস্তাব হলো একই ব্যক্তি দলের শীর্ষ নেতা, সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। বিএনপির এতে ঘোর আপত্তি।

প্রথমে বলা দরকার, এই প্রস্তাব কেন এল। এটা তো আসমান থেকে টুপ করে পড়েনি। তার একটা পরিপ্রেক্ষিত আছে। আমরা নিকট অতীতে দেখেছি, কেউ একবার ক্ষমতা হাতে পেলে আর ছাড়তে চান না। ছলে–বলে–কৌশলে সেটি ধরে রাখতে চান। ফলে আমরা দেখেছি, একের পর এক তামাশার নির্বাচন, প্রধান বিরোধী দলের নির্বাচন বর্জন এবং মানুষকে জিম্মি করে ভয়াবহ সন্ত্রাস। এর তো একটা শেষ হতে হবে।

দুনিয়ায় আমরা তো একমাত্র রাষ্ট্র নই। আরও দেশ আছে। সেসব দেশেও আমরা দীর্ঘকাল ‘নির্বাচিত’ স্বৈরশাসন দেখেছি। উদাহরণ হিসেবে আমরা ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, দক্ষিণ কোরিয়া, মিসর, জিম্বাবুয়ের নাম বলতে পারি। এসব দেশে নামকাওয়াস্তে নির্বাচন হতো। ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট প্রতিবারই বিপুল ভোটে ‘নির্বাচিত’ হতেন। এসবের প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ভীষণ। সেসব দেশে গণ-অভ্যুত্থানে কিংবা সেনা-অভ্যুত্থানে সরকারের পরিবর্তন হয়েছে। সেখান থেকে মানুষ শিক্ষা নিয়েছে। ফিলিপাইন আর দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষ সংবিধানে এমন একটি ধারা ঢুকিয়েছে যে কেউ এক মেয়াদের বেশি প্রেসিডেন্ট থাকতে পারবেন না। ফলে ওই সব দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বেগবান হয়েছে।

বিএনপি নেতারা দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না থাকার প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছেন। কেন দিয়েছেন তা তাঁরা জানেন, আমরাও বুঝি। কিন্তু মুখে তাঁরা এটি বলবেন না। সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রীর গলায় প্রায়ই শুনতাম, রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা না থাকলে দেশে নাকি স্থিতিশীলতা আসে না, উন্নয়ন হয় না। এর অর্থ হলো, তিনিই ক্ষমতায় থাকবেন ধারাবাহিকভাবে। তাঁর অনুচর আর চাটুকারেরা বলাবলি করত, দেশে যত উন্নয়ন হচ্ছে, এসবই তাঁর অবদান।

উন্নয়ন যে সরকারের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে, ব্যক্তির মর্জির ওপর নয়; উন্নয়নের খরচ আসে জনসাধারণের ট্যাক্সের টাকায়, নেতার পকেট থেকে আসে না—এটা তাদের কে বোঝাবে। আসলে এটা হচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার। এক জমিদার একটা পুকুর কাটালেন, স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেন বা রাস্তা বানালেন। প্রজারা খুশিতে ডুগডুগি বাজাল, আমাদের জমিদার কত মহানুভব। কিন্তু তিনি নায়েব, গোমস্তা, লাঠিয়াল দিয়ে কী পরিমাণ খাজনা আদায় করলেন, কতজনকে ভিটাছাড়া করলেন, সেটি নজরে পড়ে না।

বিএনপি এক ব্যক্তিকে সামনে রেখেই এসব প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে বলে মনে হয়। দলনেতা, সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী যদি তিনজন আলাদা ব্যক্তি হন, তাহলে বিএনপির সমস্যা কী? অসুবিধা একটা আছে। হয় দলের সর্বময় কর্তৃত্বের মালিকের এই ইচ্ছা, অথবা এটি এমন একটি দল, যেখানে ন্যূনতম তিনজন নেতা নেই, যাঁরা এই তিনটি দায়িত্বে থাকতে পারেন। কেন একই ব্যক্তিকে দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে হবে? দেশে আর যোগ্য লোক নেই? হ্যাঁ, বলতে পারেন, অন্যান্য সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশে তো প্রধানমন্ত্রিত্বের মেয়াদ নির্দিষ্ট করে দেওয়া নেই। অকাট্য যুক্তি।

কিন্তু আমাদের দেশটা কি ওই সব দেশের মতো? আমরা তো অনন্য! অন্যান্য দেশে আমাদের দেশের মতো জীবিত নেতার পূজা, মৃত নেতার কবরপূজা, নেতার পরিবারের পূজা হয় কি?

আমাদের অতীতের অভিজ্ঞতা ভালো নয়। বাহাত্তরের সংবিধান লেখা হয়েছিল এক ব্যক্তির মুখের দিকে চেয়ে। ফলে তিনি হয়ে যান সর্বময় কর্তা। মন্ত্রিসভা জাতীয় সংসদের কাছে নয়, প্রধানমন্ত্রীর কাছে দায়বদ্ধ করা হয়। এটা ছিল সংসদীয় ব্যবস্থার আঁতুড়ঘর যুক্তরাজ্যের ওয়েস্টমিনস্টার পদ্ধতির সরকারব্যবস্থার একটা বিকৃত রূপ। সেটিকে জায়েজ করার জন্য উঁচু গলায় বলা হতো, ‘আমরা বিদেশি ইজমে বিশ্বাস করি না; আমাদের আছে দেশের আলো-বাতাসে তৈরি নিজস্ব সিস্টেম!’

এক-এগারো মানুষের মধ্যে জিজ্ঞাসা তৈরি করেছিল। যেদিন চুনোপুঁটি ছাড়াও রাঘববোয়ালেরা গ্রেপ্তার হচ্ছিল, দুর্বৃত্তরা দামি দামি গাড়ি ফেলে ভেগে যাচ্ছিল, তখন মানুষ খুশিতে বাহবা দিয়েছিল। মানুষ ভাবতে শুরু করেছিল, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। কিন্তু ওই সময়ের সেনানেতৃত্ব এক্সিট প্ল্যানের নাম করে এমন একটা ব্যবস্থা দিয়ে সরে পড়েছিল, যার মাশুল দিতে হয়েছে সমগ্র জাতিকে। আমরা চাই না এর পুনরাবৃত্তি হোক।

বিএনপি ধরেই নিয়েছে, নির্বাচন হলে তারা জিতবে। তাদের নেতা প্রধানমন্ত্রী হবেন। সেখানে অন্তর্বর্তী সরকার বাগড়া দিচ্ছে কেন? এটা হচ্ছে পুরোপুরি একটা দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি।

সমস্যা হলো, স্বাধীন চিন্তা করার মতো ব্যক্তি কি এই দলে নেই? হয়তো আছেন। কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারেন না। তাঁদের সামনে আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার উদাহরণ আছে। তিনিও একই রকম সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। এ নিয়ে দলের মধ্যে কোনো আলোচনাই হয়নি। আলোচনার সুযোগও ছিল না। এটি এমন একটি দল, যেখানে চেয়ারপারসনের ইচ্ছা-অনিচ্ছাই চূড়ান্ত। দলটি এভাবেই তৈরি করেছিলেন জিয়াউর রহমান। কে দলে থাকবেন, কে থাকবেন না, তিনিই এ সিদ্ধান্ত নেন। দলে বাকি সবাই হ্যান্ডপিকড। কেউ নির্বাচিত নন। নেতার সুরে সুর মেলাতে না পারলে দলে কেউ থাকতে পারবেন না। সুতরাং হয় নেতার কথায় সায় দিন, ঝাঁপিয়ে পড়ুন, নইলে রাস্তা মাপুন।

আমাদের দেশের রাজনীতিতে অনেক মুখরোচক শব্দ আছে। অর্থ না বুঝেই আমরা অহরহ এসব আওড়াই। এ রকম একটি স্বাদু শব্দ হলো ‘গণতন্ত্র’। আমি ততটুকু গণতন্ত্র দেব, যতটুকু দিলে আমার নেতৃত্ব ঝুঁকিতে পড়বে না।

রাজনৈতিক দল হয় অনেক লোককে নিয়ে। সেখানে পারস্পরিক আলোচনা ও বিতর্কের মধ্য দিয়ে সিদ্ধান্ত হয়। সবাই সব ব্যাপারে একমত হবেন, এটা সচরাচর ঘটে না। সে ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে সিদ্ধান্ত হয়। এটা হলো ক্ল্যাসিক্যাল গণতন্ত্রের কেতাবি কথা। বাস্তবে এর চর্চা নেই আমাদের দেশে।

দেশে মাঝেমধ্যে দুর্যোগ আসে। এক-এগারো ছিল একটা বড় রাজনৈতিক সুনামি। তার ধাক্কায় রাজনৈতিক দলগুলো এলোমেলো হয়ে পড়েছিল। পরে তারা এটি সামলে নেয়। কিন্তু তারা এ থেকে কোনো শিক্ষা নেয়নি। গণতন্ত্রের চর্চা ধারাবাহিকভাবে ব্যাহত হওয়ার কারণেই ২০২৪ সালে গণ-বিদ্রোহ সংঘটিত হলো। এখনো যদি আমরা নিজেদের না বদলাই, পুরোনো ধারাকেই আঁকড়ে থাকি, তাহলে সামনে আরও বড় ঝড় অপেক্ষা করছে।

রাজনৈতিক দলগুলোকে মানুষের মন পড়তে হবে। মানুষ তাঁদের সারমন বা ওয়াজ শুনতে আর রাজি নন। চব্বিশের জুলাই গণ–অভ্যুত্থান শুরু হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও চাকরিপ্রত্যাশীদের একটি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। যখন সমাজের সব স্তরের মানুষ তাঁদের সমর্থনে বেরিয়ে এল, তখনই এটি সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নিল।

এই আন্দোলনে জয় হয়েছে জনতার। পরাজিত হয়েছে রাজনৈতিক অলিগার্ক ও পারিবারিক সিন্ডিকেট। এর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এই আন্দোলনে অন্যান্য সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ থাকলেও এটি কোনো দলের ব্যানারে হয়নি। এর আগে দলের ব্যানারে যত আন্দোলন হয়েছে, কোনোটিই সফল হয়নি। এটি বুঝতে হবে। পরাজিতরা এর মধ্যে যতই ষড়যন্ত্রতত্ত্ব খুঁজে বেড়াক না কেন, এটি ছিল গণবিস্ফোরণের একটি অনন্য উদাহরণ। ইতিহাসের চাকা পেছন দিকে আর ফেরানো যাবে না। এই উপলব্ধি আসতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে।

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বা তাঁর উপদেষ্টারা কী চান, সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো তাঁরা যা বলছেন, তাতে সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন আছে কি না। দেশটা অন্তর্বর্তী সরকার বা সংস্কার কমিশনের নয়। দেশ ১৭ কোটি মানুষের। এক-এগারো মানুষের মধ্যে জিজ্ঞাসা তৈরি করেছিল। যেদিন চুনোপুঁটি ছাড়াও রাঘববোয়ালেরা গ্রেপ্তার হচ্ছিল, দুর্বৃত্তরা দামি দামি গাড়ি ফেলে ভেগে যাচ্ছিল, তখন মানুষ খুশিতে বাহবা দিয়েছিল। মানুষ ভাবতে শুরু করেছিল, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। কিন্তু ওই সময়ের সেনানেতৃত্ব এক্সিট প্ল্যানের নাম করে এমন একটা ব্যবস্থা দিয়ে সরে পড়েছিল, যার মাশুল দিতে হয়েছে সমগ্র জাতিকে। আমরা চাই না এর পুনরাবৃত্তি হোক।

বিএনপির সামনে একটা বড় সুযোগ এসেছে নিজেকে বদলানোর, দেশকে বদলে দেওয়ার। আশা করি, দলটি এ সুযোগ হাতছাড়া করবে না।

মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আম দ র দ শ গণতন ত র এমন একট প রব ন ন ন ত ক দল প রস ত ব ব এনপ র ব যবস থ মন একট সব দ শ কর ছ ল হয় ছ ল মন ত র সরক র র একট

এছাড়াও পড়ুন:

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেভাবে সুষ্ঠু ভোটে বাধা হতে পারে

বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিয়ে ইতিমধ্যে প্রশ্ন ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সেখানে এআইয়ের (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) ব্যবহার এক নতুন ধরনের হুমকি নিয়ে এসেছে। এটি শুধু প্রচলিত কারচুপির পদ্ধতিগুলোকেই আরও সফিসটিকেটেড বা কৌশলী করে তুলবে না; বরং আমাদের গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি যে জনগণের বিশ্বাস, সেটিই নষ্ট করে দিতে পারে।

নির্বাচনে এআইয়ের প্রভাব কোনো কাল্পনিক গল্প নয়, এটি একটি বাস্তব ঝুঁকি। এআই-চালিত টুলগুলো ব্যবহার করে রাজনৈতিক নেতা বা কর্মকর্তাদের অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য ‘ডিপফেক’ (ভুয়া অডিও, ভিডিও এবং ছবি) তৈরি করা সম্ভব।

এই ডিপফেকগুলো সহজেই মিথ্যা কেলেঙ্কারি ছড়াতে পারে, যা ভোটারদের বিভ্রান্ত করে তাঁদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এআই-চালিত বটগুলো সেকেন্ডের মধ্যে এমন সব মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দিতে পারে, যা একটি রাজনৈতিক দলের জন্য ব্যাপক জনসমর্থনে বা বিরোধিতায় ভূমিকা রাখতে পারে।

যখন জনগণ দেখতে পাবে, তারা যা দেখছে বা শুনছে, তার মধ্যে কোনটা আসল আর কোনটা নকল, তা বোঝা কঠিন, তখন স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্যে সংবাদমাধ্যম, নির্বাচন কর্তৃপক্ষ এবং পুরো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিষয়ে সন্দেহ ঢুকে যাবে। এটি একটি দেশের স্থিতিশীলতার জন্য দীর্ঘমেয়াদি হুমকি।

এআই অ্যালগরিদমগুলো বিশাল পরিমাণ ডেটা বিশ্লেষণ করে নির্দিষ্ট ভোটারদের লক্ষ করে তাদের ব্যক্তিগত আগ্রহ ও দুর্বলতা অনুযায়ী রাজনৈতিক বার্তা পাঠাতে পারে। এই ‘মাইক্রো টার্গেটিং’-এর মাধ্যমে ভোটারদের মনোভাবকে প্রভাবিত করা বা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে ভোটদানের সময় বা স্থান সম্পর্কে ভুল তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে তাদের ভোটদান থেকে বিরত রাখাও সম্ভব।

আমাদের গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখতে হলে এই নতুন প্রযুক্তির ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে

এআই শুধু মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, এটি নির্বাচনী পরিকাঠামোর ওপর সাইবার হামলাও জোরদার করতে পারে। এআই-চালিত টুলগুলো আরও সফিসটিকেটেড ফিশিং আক্রমণ তৈরি করে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের অ্যাকাউন্ট হ্যাক করতে বা এমন ম্যালওয়্যার তৈরি করতে পারে, যা প্রচলিত নিরাপত্তাব্যবস্থা এড়িয়ে যেতে সক্ষম। এ ধরনের আক্রমণ ভোটার ডেটাবেজ বা ভোটিং মেশিনকে লক্ষ্য করে করা যেতে পারে। সেটি নির্বাচনের ফলাফল পরিবর্তন বা পুরো প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করতে পারে।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিপত্তির সমাধান কী? এ প্রশ্নের জবাব হিসেবে প্রথমেই মনে রাখা দরকার, এই গুরুতর চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় একটি সমন্বিত ও কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন। এখানে এক্সপ্লেইনেবল এআই (এক্সএআই) একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এআই মডেলের সিদ্ধান্তগুলো মানুষের কাছে বোধগম্য করে তোলে এক্সএআই। এটি এআইয়ের স্বচ্ছতা বাড়ায়।

ডিপফেক শনাক্তকরণ: এক্সএআই ব্যবহার করে এমন টুল তৈরি করা সম্ভব, যা কেবল ডিপফেক শনাক্ত করে না; বরং কেন একটি বিষয়বস্তু জাল বলে চিহ্নিত হয়েছে, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যাও দেয়। এর ফলে মানব ফ্যাক্ট-চেকাররা বিশ্লেষণ যাচাই করতে পারেন এবং জনগণের আস্থা তৈরি হয়।

প্রচারণার নিরীক্ষা: এক্সএআই রাজনৈতিক প্রচারণায় এআই ব্যবহারের নিরীক্ষা করতে পারে। এটি বিশ্লেষণ করে দেখাতে পারে, কীভাবে একটি অ্যালগরিদম তার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা পক্ষপাতদুষ্ট বা কারসাজিমূলক টার্গেটিং কৌশলগুলো প্রকাশ করতে সাহায্য করে।       

নিরাপত্তা বৃদ্ধি: সাইবার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এক্সএআই হুমকির শনাক্তকরণ সিস্টেমকে উন্নত করতে পারে। এটি ব্যাখ্যা করতে পারে, কেন একটি নির্দিষ্ট কার্যকলাপকে ক্ষতিকর বলে মনে করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়া নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের দ্রুত এবং কার্যকরভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে সাহায্য করে।

অংশগ্রহণকারীদের করণীয়: এআইয়ের হুমকি মোকাবিলায় সব গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণকারীকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। প্রথমত, রাজনৈতিক দলগুলো এবং নেতাদের প্রকাশ্যে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে, তাঁরা প্রতারণামূলক এআই জেনারেটেড কনটেন্ট বা ভুল তথ্য ছড়ানোর প্রচারে জড়িত হবেন না। তাঁদের উচিত এআইয়ের যেকোনো বৈধ ব্যবহার সম্পর্কে স্বচ্ছ থাকা এবং এআই জেনারেটেড কনটেন্টে সুস্পষ্ট লেবেল ব্যবহার করা। দ্বিতীয়ত, নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক প্রচারে এআই ব্যবহারের বিষয়ে সুস্পষ্ট নিয়ম ও প্রবিধান তৈরি এবং প্রয়োগ করতে হবে। তাদের উচিত এআই-চালিত টুলগুলোতে বিনিয়োগ করা এবং ভোটারদের সচেতন করার জন্য বড় আকারের প্রচার চালানো।

এ ছাড়া একটি যৌথ গবেষণা ও উন্নয়ন দল গঠন করা প্রয়োজন, যারা নির্বাচনের আগপর্যন্ত কমিশনকে এআই এবং সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে নিরবচ্ছিন্ন সহায়তা দেবে। তৃতীয়ত, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সংবাদমাধ্যম এবং সুশীল সমাজকে এআইয়ের হুমকি সম্পর্কে তথ্য আদান-প্রদান করতে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে পড়লে তা দ্রুত মোকাবিলা করার জন্য একটি সুস্পষ্ট প্রটোকল স্থাপন করা জরুরি। সংবাদমাধ্যম এবং সুশীল সমাজের উচিত ফ্যাক্ট-চেকিং এবং জনগণের মধ্যে মিডিয়া লিটারেসি বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা।

আমাদের গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখতে হলে এই নতুন প্রযুক্তির ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে। এআইয়ের ক্ষমতা যেমন বিশাল, তেমনি এর অপব্যবহারের বিপদও কম নয়।

জনগণের বিশ্বাস এবং একটি ন্যায্য নির্বাচনের অধিকার নিশ্চিত করতে এখনই আমাদের সবাইকে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো, বাংলাদেশ সরকারের একটি সম্মিলিত গবেষণা ও উন্নয়ন (আরএনডি) দল গঠন করা। এই বিশেষজ্ঞ দল এআই-সম্পর্কিত ঝুঁকিগুলো ক্রমাগত বিশ্লেষণ ও অনুমান করবে এবং দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করবে।

অধ্যাপক ড. আলমগীর হোসেন এআইয়ের সাবেক অধ্যাপক, যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজে অবস্থিত এআরআইটিআইয়ের সাবেক পরিচালক

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • এক-এগারোর মতো ঘটনা ঘটা এখানে অস্বাভাবিক কিছু নয়
  • কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেভাবে সুষ্ঠু ভোটে বাধা হতে পারে
  • মিয়ানমারে ডিসেম্বরে নির্বাচনের ঘোষণা জান্তা সরকারের, জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার
  • বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী সরাসরি ছাত্র সংসদ নির্বাচনের পক্ষে
  • ট্রাম্পের বিরুদ্ধে লুলার প্রতিবাদে অন্যরাও শামিল হোক
  • এমন কিছু করবেন না যাতে গণতন্ত্র ব্যাহত হয়: মির্জা ফখরুল
  • সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ৭ দিনের রিমান্ডে
  • বিতর্কমুক্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব‍্যবস্থা না হলে গণতন্ত্র আবার হুমকিতে পড়বে: এবি পার্টি
  • মানুষ ঠিকমতো ইভিএম বোঝে না, পিআর বুঝবে কী করে: মির্জা ফখরুল