বাগেরহাটে ঈদের দিনে সংঘর্ষ জড়াল দুটি গোষ্ঠী, প্রাণ গেল দুজনের, রক্তাক্ত আরও ৩০
Published: 8th, June 2025 GMT
বাগেরহাটের মোল্লাহাটে ঈদের দিনে দুই পক্ষের সংঘর্ষে দুজন নিহত হয়েছেন। এ সময় নারীসহ উভয় পক্ষের অন্তত ৩০ জন আহত হন। হতাহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে মোল্লাহাট, গোপালগঞ্জ ও খুলনার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
স্থানীয় পর্যায়ে আধিপত্য বিস্তার ও পূর্ববিরোধের জেরে গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় মোল্লাহাট উপজেলার চুনখোলা ইউনিয়নের সিংগাঁতি গ্রামের উত্তরপাড়ায় ওই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
নিহত ব্যক্তিরা হলেন সিংগাঁতি গ্রামের উত্তরপাড়ার মোশারেফ চৌধুরীর ছেলে আজিজুল চৌধুরী (৪০) ও একই এলাকার এরশাদ চৌধুরী ছেলে মুরসালিন চৌধুরী (৩০)। তাঁরা পরস্পরের চাচাতো ভাই।
পুলিশ ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিংগাঁতি গ্রামের উত্তরপাড়ার মাসুম চৌধুরী ও এরশাদ চৌধুরীর মধ্যে গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব বহু পুরোনো। জমি ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এর আগেও উভয় পক্ষ ছোটখাটো বিভিন্ন বিষয়ে একাধিকবার সংঘর্ষে জড়ায়। গতকাল দুপুরে কোরবানির মাংস বিতরণের পর দুই পক্ষের দুজনের মধ্যে কথা-কাটাকাটি ও ধাক্কা দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এর জেরে সন্ধ্যার দিকে এরশাদ চৌধুরীর লোকজনের বাড়িতে ঢাল–সড়কি, রামদাসহ দেশী অস্ত্র নিয়ে হামলা করে প্রতিপক্ষ। পরে উভয় পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।
এ সময় দেশীয় অস্ত্রের আঘাতে উভয় পক্ষের অন্তত ৩০ জন রক্তাক্ত হন। তাঁদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকেরা আজিজুল চৌধুরীকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাতে গোপালগঞ্জ হাসপাতালে মারা যান মোরসালিন চৌধুরী। নিহত দুজনই এরশাদ চৌধুরী পক্ষের।
তবে সংঘর্ষের বিষয়ে দুই পক্ষের কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ঘটনার পর থেকে গা ঢাকা দিয়েছেন জড়িত ব্যক্তিরা।
মোল্লাহাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শফিকুল ইসলাম বলেন, পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে। নতুন করে যাতে আর সংঘর্ষ হতে না পারে, সে জন্য ঘটনাস্থলে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। ৫০ বছর ধরে ওই দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ চলে আসছে। গতকালের ওই ঘটনায় দুজন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। এ বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: এরশ দ চ ধ র স ঘর ষ
এছাড়াও পড়ুন:
শিশুদের হয়ে বড়দের কাছে আবেদন
জাতি হিসেবে আমরা অনেক বিষয়েই উদাসীন। এর মধ্যে শিশুদের প্রতি আমাদের জাতিগত ঔদাসীন্য ও অবহেলা খুবই উদ্বেগজনক। তারাই যে দেশের ভবিষ্যৎ, সে কথা সবাই জানি এবং অহরহ বলে আসছি। কিন্তু সমাজের বয়স্কদের দিকে তাকালে আমরা কি বলতে পারব, তাঁদের শৈশবের বিকাশপর্ব ঠিকভাবে অতিবাহিত হয়েছিল?
আমরা দেখি, সত্য গোপন শুধু নয়, সামান্য সুবিধার জন্যও অবলীলায় মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া মোটেও ব্যতিক্রমী ঘটনা নয় এ সমাজে। সহজেই মানুষ ছোট-বড় দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে, স্বজনের উপকারে পক্ষপাতদুষ্ট কাজে সোৎসাহে সক্রিয় হতে দেখা যায়। ক্ষমতার দাপটে এখানে অহরহ নিয়ম ভেঙে পড়ে, আইন থমকে যায়।
মানুষের মধ্যে স্বার্থপরতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। যেন আদিকালের শিকারিজীবনের চাপা পড়া হনন–প্রবৃত্তির নিয়ন্ত্রণ টুটে গিয়ে বহু মানুষ এখন হিংসায় উন্মত্ত এবং একমাত্র জিঘাংসাতেই সংঘাতের মীমাংসা খুঁজছে। মানুষের ভোগবাসনার দাপট দেখে বোঝা যায়, শৈশবে তাদের সুকুমারবৃত্তি ও সংবেদনশীলতার জমিন ঠিকভাবে কর্ষিত হয়নি।
অভিভাবকেরা সন্তানদের শৈশবকে ফলাফলের ইঁদুরদৌড়ে এতটাই ব্যস্ত রেখেছিলেন যে বড় হয়ে তারা নিজেদের সুপ্ত ক্ষমতা ও প্রতিভার উন্মেষ ঘটাতে পারেনি। ফলে শিশুর সুষ্ঠু বিকাশে যত্নের যে অভাব ঘটছে, সেই বাস্তবতা কেবল বঞ্চনা নয়, শিশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা।
পুরুষশাসিত এ সমাজে পুরুষের মানবিক অক্ষমতার করুণ বাস্তবতা প্রায়ই ঘটে থাকে নারী ও শিশুর প্রতি কদর্য নিষ্ঠুরতায়। শিশুর পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যার মতো নির্মমতা ভাবা যায়! এমন সমাজে শিশু ও নারী উভয়েই নানা অনাচার-অবিচারের ভুক্তভোগী। বুঝতে হবে যে কেবল কঠোর আইন আর কঠিন শাস্তিতে এই সামাজিক ব্যাধির সমাধান হবে না।
২.
একসময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগে খণ্ডকালীন পড়াতে যেতাম। বিভিন্ন ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের জিজ্ঞাসা করতাম, তাদের মধ্যে কতজনের মাঠে গিয়ে খেলার অভিজ্ঞতা আছে। দেখা যেত, কি ছেলে কি মেয়ে—সিংহভাগ শিক্ষার্থীই জীবনে কখনো মাঠে গিয়ে খেলেনি। অধিকাংশ শিক্ষার্থী স্কুলজীবনে পিকনিকে যাওয়ার সুযোগ পায়নি, বার্ষিকী প্রকাশ হতে দেখেনি, নাটকে অংশ নেয়নি, পাঠাগার থেকে বই পড়েনি (অনেক স্কুলে পাঠাগার ছিলই না)।
এভাবে নানা ‘না’–এর সমাহার অর্থাৎ বহুতর বঞ্চনার (এবং অবহেলার) তালিকা আরও দীর্ঘ করা যাবে। এসব বঞ্চনার ভেতর দিয়ে বড় হওয়া তরুণেরা ছেলে-ছেলে বা মেয়ে-ছেলে কিংবা মেয়ে-মেয়ে পরস্পর কেজো বা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলার স্বাভাবিক ক্ষমতার অভাব বেশ প্রকট। আবেগের বশবর্তী এমন সম্পর্ক যেমন দ্রুত গড়ে ওঠে, তেমনি ভাঙেও তাড়াতাড়ি। সবচেয়ে বড় কথা, তাদের তারুণ্যের (অর্থাৎ যৌবনের) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্ব কেটে যায় জীবনের বৈচিত্র্যপূর্ণ বিভিন্ন অঙ্গের পাঠ, রস গ্রহণ ছাড়া গতানুগতিক চক্রের আবর্তে। এতে তাদের রাজনীতি, আড্ডা বা বেশির ভাগ কাজের পরিণতি খুব উচ্চ মানবিক প্রাপ্তি দিতে পারে না। অপ্রাপ্তি, অতৃপ্তি নিয়ে সহজে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়িয়ে যায়।
একালে শিক্ষার্থীদের, বস্তুত অধিকাংশ মানুষের একটা বড় অংশের জীবনে ভোজনই প্রধান বিনোদন। তাই তো শহরে শহরে নতুন নতুন রেস্তোরাঁর কমতি নেই। বাহারি পোশাকের আকর্ষণও কম নয়। এ দুইয়ের ডিজিটাল আকর্ষণেরও শেষ নেই। সব মিলে ডিজিটাল ডিভাইসের আসক্তি সংক্রামক রোগের মতো ছড়াচ্ছে। একালে শিশুসহ সাধারণভাবে মানুষমাত্রই অন্দরের (ইনডোর) প্রাণীতে পরিণত হচ্ছে, প্রকৃতির সঙ্গে স্বাভাবিক নৈমিত্তিক সম্পর্ক হয় না বললেই চলে।
পরীক্ষা ও মুখস্থনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা এবং সামাজিক নানা কারণে গৃহবন্দিজীবনে শিশুর সহজাত কৌতূহল, জিজ্ঞাসা, কল্পনাপ্রবণতা, বিস্ময়বোধ ইত্যাদি জীবনপ্রভাতেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অল্প কিছু দারুণ মেধাবী, অদম্য মনোবলের অধিকারী কিংবা যথার্থ পারিবারিক সহায়তাপ্রাপ্ত শিশু-কিশোর-তরুণের সাফল্যকে দৃষ্টান্ত ধরা যাবে না, সেটা ব্যতিক্রম। আমাদের সামাজিক তলরেখা অস্বাভাবিক নিচে চলে গেছে। অবস্থা নিরাময়ের বাইরে চলে যাওয়ার আগে এ নিয়ে ভাবা জরুরি।
দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের যাত্রাপথ বরাবর নানামুখী উত্থান–পতন, দূরত্ব-বিভাজন, দ্বন্দ্ব-সংঘাতের চাপে বন্ধুর ও ভঙ্গুর। এর সহগামী অস্থিরতা, বিদ্বেষ, হিংসায় সমাজজীবন জর্জরিত। এ পরিবেশে দিন দিন জোরদার হচ্ছে সংঘাত-প্রতিহিংসার ভাষা, ক্রোধের অশালীন বহিঃপ্রকাশসহ বাস্তবে তার নানামুখী প্রকাশ ঘটেই চলেছে। এরপরও পারস্পরিক প্রতিযোগিতার মধ্যে ছাপা কিংবা অনলাইন গণমাধ্যমও অবিরাম একই রকম ক্রোধ-বিদ্বেষ-ঘৃণার খবর প্রচার করে চলেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও হিংসারই জয়জয়কার চলছে। মানুষে–মানুষে সন্দেহ, অবিশ্বাস, শত্রুতা-বিদ্বেষ, প্রতিশোধ-প্রতিহিংসার চর্চা থামছে না; সেই সঙ্গে বাঙালির নিজস্ব ‘কৃষ্টি’ পরশ্রীকাতরতা ও পরচর্চার ভরা জোয়ার চলছে। সমাজে আজ মানবিক কণ্ঠস্বর ক্ষীণ হয়ে আসছে, সুকুমারবৃত্তি চর্চার পরিসর ছোট হতে হতে গুরুত্ব হারাচ্ছে। শিল্প-সাহিত্য, সংগীত-নাটকের দুর্দিন চলছে।
শৈশবে সাহিত্য–শিল্পের রসাস্বাদন না ঘটলে এবং প্রকৃতির বিশালত্ব ও বৈচিত্র্যের সন্ধান না পেলে মানুষের পক্ষে জীবনের মহিমা এবং জীবনকে প্রগাঢ়ভাবে অনুভবের সামর্থ্য অর্জন কখনো সম্ভব নয়। পড়াশোনা কেবল পরীক্ষার প্রশ্নের উত্তর শেখায় কিংবা বড়জোর পাঠ্যবইয়ের পড়ায় আবদ্ধ থাকলে সেই শিক্ষার্থীর পক্ষে জীবনের ঘটনাপুঞ্জকে শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতায় রূপ দেওয়াও অসম্ভব। আদতে মানুষের জন্য আজীবন ‘মানুষ’ থাকা একটি মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ। তার সেই যাত্রাপথে বারবার যেসব বাধা আসবে, সেসব চ্যালেঞ্জ জয়ের রসদ-পুষ্টির সন্ধান শৈশবেই তাদের দিতে হবে। তা এড়িয়ে শিশুদের মধ্যে অনেক ঘাটতি রেখে দিয়ে সুস্থ সমাজ গঠন অসম্ভব।
এভাবে চলতে চলতে মানুষ একসময় ভুলে যায় সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে তার মূল গন্তব্য বড় ধনী, বড় কর্মকর্তা বা ক্ষমতাবান নেতা হওয়া নয়, ছিল প্রকৃত মানুষ হওয়া, যার চেষ্টা থাকে মহত্ত্বের চূড়া স্পর্শ করা। তাই তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিক্ষাকে তুলনা করেছেন কমলহীরার টুকরার সঙ্গে—বিদ্যা ও জ্ঞানের থাকে ওজন, আর তেমন ওজনদার হীরার টুকরা থেকেই বেরোয় আলোর ছটা, যাকে তিনি বলেছেন সংস্কৃতি। আমরা কি পথ হারিয়ে ফেলছি না? এটাকে কি সুস্থ সমাজ বলা যাবে?
৩.
সমাজে দ্বন্দ্ব–বিভেদ, বিদ্বেষ-হিংসার চর্চার শুরু আদিকাল থেকেই। কিন্তু এই রিপুগুলোকেই শেষ কথা বলে মানুষ মেনে নেয়নি, আর নেয়নি বলেই সে একসময় অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই খুঁজে পেয়েছে মানুষ হওয়ার মস্ত অবলম্বন—নৈতিকতা ও মূল্যবোধ। তা–ও কি সহজে মিলেছে? এ ক্ষেত্রে তার সহজাত কৌতূহল ও জিজ্ঞাসা, বিস্ময়বোধ ও আনন্দিত হওয়ার ক্ষমতা তাকে প্রেরণা দিয়েছে। নিরন্তর চর্চা ও অনুশীলনের মাধ্যমে এভাবেই সৃজনশীলতার ভেতর দিয়ে যেতে যেতে অভিজ্ঞতার ঝুলিতে বহু কিছু জমেছে। তারই মধ্যে থেকে জেনেছে, সব বিষয়েরই নিজস্ব নিয়ম, বিধান, সংস্কৃতি আছে। এসবকে ধারণ করেই সুন্দর ও সার্থক হয় জীবন। তাই মানুষ হওয়ার দায় হলো কোনোভাবেই তার মানবিক বোধ, সৃষ্টিশীলতা, ভেতরের মনুষ্যত্বের শক্তিকে নেতিশক্তির রিপুগুলো যেন ছাপিয়ে না ওঠে।
গোড়ার কথায় ফিরে আসি। শিশুকে মানুষ হয়ে ওঠার রসদ ও পরিবেশ দিতে হবে। বহুদিন ধরে বিদ্বেষ-বিভাজনের বয়ান শুনতে শুনতে তার বিচিত্র প্রকাশ হিসেবে জিঘাংসা-প্রতিহিংসার প্রকোপ দেখতে দেখতে এবং একালের প্রযুক্তির অযাচিত অকল্যাণকর ব্যবহারের অংশীজন-ভুক্তভোগী হতে হতে শিশুরাও তো পথ হারাচ্ছে। একটু থেমে বড়দের, বিশেষত নীতিনির্ধারকদের ভাবতে হবে, সামাজিক পরিবেশকে আমরা আর কত বিষিয়ে তুলব, আর কত রকম দূষণে অসুস্থ করে ফেলব।
● আবুল মোমেন লেখক ও সাংবাদিক
* মতামত লেখকের নিজস্ব